১৮+ সতর্কতা চিঠি দিও ৯

১৮+ সতর্কতা
চিঠি দিও

______________

“সুনাহে আপনে শাদি কারলিয়ে বাঙ্গালী বাবু। উমহুম নট ফেয়ার হাঁ!”
রিনরিনে মেয়েলি গলার স্বর কানে ভেসে আসতেই চোখ তুলে তাকাল অতনু। চৌকাঠে দাঁড়ানো উদ্ভিন্নযৌবনা এক তরুণী। বয়স তার বাইশ থেকে পঁচিশের মধ্যে হওয়ার কথা। চোখে পড়ার মতো রূপ-লাবণ্য এবং দেহগড়নে অনন্যা। পরনে তার আসমানী রঙের জর্জেট শাড়ি। সুন্দর ভাঁজ করে কাঁধে তুলে রাখা বলে শাড়ির ফাঁক গলিয়ে তুষারশুভ্র মসৃণ সর্পিল কোমরখানা দৃশ্যমান। নাম তার উর্বশী। পেশায় সে..
থাক পেশার দিকটায় না যাওয়াই ভালো। বরং অতনুর সাথে তার পরিচয়ের গল্পটা ছোট করে উল্লেখ করা যাক।
কম বয়সে বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে প্রথম নষ্ট গলির সন্ধ্যান পেয়েছিল অতনু। সেবার বেনারস থেকে রাজধানীতে কিছু মেয়ে ধরে আনা হলো। কম সময়ে তল্লাটে যাদের ডিমান্ড প্রচুর পরিমাণে বেড়ে গেল। মাথা নষ্ট করা রূপ-লাবণ্যে ঠাঁসা সেসব মেয়েরা সব্বার কামনার বস্তু। পাহাড় পর্বত ভেঙে হলেও তাদের সান্নিধ্য চাই। বলা বাহুল্য সেই মেয়েদের মধ্যে একজন উর্বশী ছিল। বছর চৌদ্দ-পনেরোর কিশোরী। চড়া সাজ, দেহের বাঁক এবং বাকপটুতা অবশ্য তার বয়সটা জোরালোভাবে আড়ালের চেষ্টায় মত্ত ছিল। কমনীয় নারীর অভিজ্ঞ স্পর্শে এক ধনীর দুলালকে রীতিমতো পাগল করে দিয়েছিল সে। এতটাই ঘোরগ্রস্ত হয়ে গিয়েছিল ছেলে! চড়া মূল্য গুনে হলেও জোর চেষ্টায় একান্ত নিজের করে রাখার জন্য এই শহরে নিয়ে এসেছিল তাকে। যদিও শেষ পর্যন্ত রাখতে পারেনি। কারণটা অতনু। সেই দুলালের সাথে পরিচয় ছিল অতনুর। ও বাড়িতে পা দিয়ে একঝলক যখন সে উর্বশীকে দেখেছিল তখনই ভেবে রেখেছিল এই অপ্সরাকে তার চাই৷ যেকোন উপায়ে চাই। দ্বন্দ্ব বেঁধে গিয়েছিল তার নিজের বন্ধুর সাথে। অতনু কখনো হারতে শেখেনি। তার যেটা চাই, সর্ব উপায়ে চাই। আপোষে না পেলে ছিনিয়ে আনে। তবুও নিজের করে ছাড়ে। তেমনই ছিনিয়ে এনেছিল সে উর্বশীকে। তারপর থেকে উর্বশী তার কাছে। নাহ্ উর্বশীর সাথে আত্মিক বা মানসিক কোনো সম্পর্ক নেই তার। উর্বশী কেবল তার কাছে একটা ট্রফির মতো।

অতনুর ভাবনা সকল সাঙ্গ হলো কানে ধরে রাখা টেলিফোনের ওপাশ থেকে ভেসে আসা শব্দে। ফোনের অপর পাশে নিজাম সাহেব৷ গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় ব্যস্ত থাকলেও চৌকাঠে দাঁড়ানো অতি পরিচিত রমনীকে দেখার পর থেকে কথায় তালগোল পাকিয়ে যেতে লাগল অতনুর। চেষ্টা করল নিজেকে শুধরাবার, কিন্তু প্রতিবারের মতো এবারেও ব্যর্থ হতে হলো। শেষে হাল ছেড়ে দিয়ে বিনীত ভঙ্গিতে নিজাম সাহেবের থেকে বিদায় নিয়ে ফোন রেখে দিতে হলো অতনুকে। অমন শক্ত সামর্থ্য মানুষটাকে সহজে নাকাল হতে দেখে চৌকাঠে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে খিলখিল করে হেসে উঠল উর্বশী। তার হাসির শব্দ প্রতিধ্বনিত হতে লাগল ঘরময়। চেয়ার ঠেলে এবার উঠে দাঁড়াল অতনু। টেবিলে দু-হাত রেখে ঈষৎ ঝুঁকে সরাসরি চোখ রাখল উর্বশীর মুখ পানে। হাসিতে যেন মুক্ত ঝরছে মেয়েটার। ঠোঁট কামড়ে ঝংকার তোলা সেই হাসি অবলোকন করতে করতে ভ্রু নাচিয়ে অতনু শুধল,
— ভেতরে আসবে না?
— জিন্দেগীসে নিকালকে আব ভেতরে যেতে বলছো। অনধিকার চর্চা হয়ে যাবে না?
হাসি থামিয়ে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ল লাস্যময়ী ললনা৷
— যে অধিকার আমি নিজে দিয়ে রেখেছি সেখানে অতিরিক্ত “ন” টা যোগ করার সাহস তোমার কীভাবে হয়?
চোখ সরু করে দম্ভের সাথে বলল অতনু।
এ কথা শুনে আরেক পশলা হেসে উঠল উর্বশী। ডান হাতে ধরে রাখা শাড়ির আঁচল ছেড়ে দিয়ে অদ্ভুত এক ছন্দ তুলে সে ভেতরে প্রবেশ করল। বিপরীতে ঠিক অতনুর মতোই টেবিলে ভর দিয়ে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে যথাসম্ভব নীচু গলায় শুধল,
— বিবির নাম কি তোমার?
অতনু ওর কথায় যোগ দিল না। সতর্কিত ওর চোখজোড়া এ মুহুর্তে সামনে দাঁড়ানো উদ্ভিন্নযৌবনা তরুণীর শরীরে এঁটে থাকা ধবধবে সাদা ব্লাউজের মধ্যিখান থেকে উঁকি দিতে চাওয়া উন্নত বক্ষ বিভাজিকা পরিমাপে ব্যস্ত । তরুণী বুঝতে পারল ওর মনোযোগী দৃষ্টির অবস্থান। একটুখানি তড়পাতে ঝট করে সোজা হয়ে দাঁড়াল সে। সফলই হলো বলা যায়। অতনুরও মনযোগ ভেঙে গেল সাথেসাথে। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে চোখ রাখল সে তরুণীর চোখে। মৃদু স্বরে বলল,
— বলিনি ইলেকশনের সময় আমায় না জানিয়ে বেরুবে না। তুমি যে এই শহরেই আছো কেউ কিন্তু জানে না। জানলেই..
— কি হবে জানলে? মেরে ফেলবে উও লোগ আমাকে?
— উর্বশী!
ধমকে উঠল অতনু।
পুনরায় হাসার চেষ্টা করল উর্বশী৷ সফল কতটুকু হলো কে জানে! ছলছল করে উঠল ওর চোখজোড়া। অতনু বিয়ে করেছে খবরটা শোনার পর থেকে বেতমিজ চোখজোড়া সময় অসময়ে ছলছল করে ওঠে। উফফ! নিজের ওপর বিরক্ত হয় উর্বশী। এতটা বেসামাল লাগে কেন আজকাল? প্রশ্নের সপক্ষে নিজেই আবার উত্তর সাজায়, অতনুর তার প্রতি আত্মিক-মানসিক কোনো টান না থাকতেই পারে, তাই বলে কি তার টানটা তৈরি হয়নি? টানের চাইতে বেশি কিছু হয়েছে। এই বেশি কিছুটাই বেসামাল লাগার একমাত্র কারণ৷ কিন্তু সে যে নোংরা গলি থেকে উঠে আসা মেয়ে। পুরুষ মানুষের সাথে তার সম্পর্ক কেবল শরীরি। অতনুর সাথেও এই। এর বাইরে কিচ্ছু নয়। কিচ্ছু না।
ধীরপায়ে হেঁটে এসে ও মুখোমুখি হলো অতনুর। গালে হাত রেখে মৃদু স্বরে বলল,
— কতদিন পর দেখা হচ্ছে বলো তো? হিসেব আছে?
উর্বশীর কথায় লম্বা শ্বাস টেনে অতনু বলল,
— তুমি জানো তো আমার ব্যস্ততা।
— এতই ব্যস্ত ছিলে একটা কল দেয়ারও সময় পাওনি?
উর্বশীর গলায় তীব্র অভিমান। অতনু অবশ্য ওদিকে বিশেষ নজর দিলো না। উর্বশীকে দুহাতে আগলে নেওয়ার চেষ্টা করে বলল,
— পুষিয়ে দেব সব।
এ কথা শুনে চট করে মেয়েটা গা থেকে ওর হাত সরিয়ে দিলো। মুখ ফিরিয়ে ক্ষীণ গলায় বলল,
— বাড়িতে বিবি রেখে..
কথা সম্পূর্ণ করল না সে নিজের।
অতনু ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে উঠল। কনুইয়ের কাছটা চেপে ধরে এক ঝটকায় টেনে নিলো উর্বশীকে নিজের কাছে। উন্মুক্ত কণ্ঠদেশে হাত বুলতে বুলতে বলল,
— বউয়ের সাথে এসবের কোনো সম্পর্ক নেই। শরীর আর সংসার দুটো বিপরীত শব্দ। ওদের বিপরীতই থাকতে দাও। মেলাতে যেও না।
— কিন্তু..
আসন্ন কথামালাকে শুরুতেই থামিয়ে রাখতে চট করে উর্বশীর অধরজোড়ায় তর্জনী চেপে ধরল অতনু। কপালে কপাল ঠেকিয়ে ধীর অথচ দৃঢ় গলায় বলল,
— তর্ক করবে না উর্বশী। তর্ক করা মেয়ে মানুষ আমার পছন্দ না। বলিনি, যে অধিকার স্বয়ং তোমায় দিয়ে রেখেছি তার ওপর একটা প্রশ্ন উঠবে না। প্রশ্ন তোলার সাহস কারোর নেই। কারোর না। তাই চুপচাপ যেজন্য এসেছ তাকে সফল হতে দাও।
কানের নরম কামড়ে ধরে দৃঢ় স্পর্শে বাহুবদ্ধ করে ফেলল অতনু উর্বশীর কটিদেশ। সময় ব্যয় না করে শূন্যে তুলে টেবিলের ওপর বসিয়ে দিলো চোখের পলকে। পড়ে যাওয়ার আশংকায় উর্বশীও খামচে ধরল অতনুর কাঁধ। ওর নখের স্পর্শে কামনার আভাস। ঈষৎ হেসে শাড়ির ফাঁকে হাত গলিয়ে দিলো অতনু। নাভিমূলে হাত বুলতে বুলতে কাঁধের দিকটায় জীভ ছোঁয়াতে শুরু করল। আবেশে চোখ বুঁজে স্বগতোক্তিতে উর্বশী বলে উঠল,
“সমাজ স্বীকৃতিতে তুমি আমার না হলেও, আমার স্বীকৃতিতে তুমি আমারই বাঙ্গালী বাবু। আমার আজন্ম অধিকারে। এই অধিকারে ভাগ বসানোর অনুমতি আমি কাউকে দেব না৷ কক্ষনও না। আজ শরীর দিয়ে তুমি আমার; একদিন মন দিয়েও হবে। হতেই হবে”

______________________

“এ্যাই মেয়ে গান পারো তুমি?”
চিরায়ত গমগমে গলার স্বরখানা কর্ণকুহরে ধাক্কা দিতেই ঈষৎ কেঁপে উঠল উপমা। দাঁতে দাঁত পিষে মনে মনে আওড়াল, জন্মের সময় মুখে মধুও দেয়নি মাস্তানটার। কথায় কথায় বজ্রধমক দেয়। উফফ!
প্রশ্নের তৎক্ষণাৎ জবাব না পেয়ে ভ্রু কুঁচকে গেল রওনকের। পূর্বের চাইতেও জোরালো ধমকে সে প্রশ্ন রিপিট করল,
— কি বলছি শুনতে পাও না?
দ্বিতীয় ধমকে থতমত খেয়ে গেল উপমা। ডানে বাঁয়ে মাথা নেড়ে আমতাআমতা করে বলল,
— পারি আবার পারি না।
— এইটা কেমন উত্তর?
বিস্ময়াভূত হলো রওনক। নিজের বোকা বোকা উত্তরে বিভ্রান্ত হলো উপমাও। মাথা চুলকে পুনরায় আমতাআমতা করতে করতে বলল,
— মনে হয় পারি। আবার বোধহয় পারি না। মনে পড়ছে না।

এমন দায়সারা উত্তরে রওনক বেশ বিরক্ত। চ-কারান্ত একটা শব্দ করে সে বলল,
— আচ্ছা শোনাও দেখি। গান শোনাও একটা।
— গান!
কাচুমাচু ভাবে উচ্চারণ করল উপমা।
— গান শব্দটা প্রথম শুনলা নাকি?
বিরক্তমাখা গলায় বলল রওনক। আঁড়চোখে ওর দিকে তাকিয়ে চোখমুখ কুঁচকে ফেলল উপমা। স্বগতোক্তি করল, “শোনাচ্ছি তোকে গান”
এরপর মুখে বলল,
— না ভাইয়া আগেও শুনেছি। পারি তো আমি গান। এখনই শোনাব?
— আরে সেটাই তো বলছি। শোনাও।
জোর গলায় টেনে টেনে বলল রওনক। উপমাও স্মিত হাসার চেষ্টা করে গদগদ হয়ে বলল,
— আচ্ছা আচ্ছা শোনাচ্ছি।
এরপর বিকট শব্দ করে গলা খাঁকারি দিয়ে সে রীতিমতো চিল্লানোর মতো করে গাইতে লাগল জাতীয় সংগীত, “আমার সোনার বাংলায়াআআ। আমি তোমাআআয়.. ”
এ পর্যায়ে তড়িঘড়ি করে হাত তুলে ধমকে উঠল রওনক,
— এ্যাই থামো থামো। এটা গান নাকি কানের পর্দা ফাটানোর অস্ত্র। মাবুদ! এ্যাই মেয়ে,গলা তো তোমার ফাটা বাঁশের মতো।

রওনকের নাকানিচুবানি অবস্থা দেখে খুব জোর হাসি পেলো উপমার। তথাপি নিজেকে শান্ত রেখে মাথা নীচু করে করুণ সুরে সে বলল,
— আমি তো এভাবেই গাই ভাইয়া। কেন ভালো হয়নি?
— ভালো! তোমার গানে তো আমি ধন্য সিস্টার। এত মধুর গলা ভুল করেও কাউরে শোনাইও না।বাপরে বাপ।
— আপনি ভুল বুঝছেন ভাইয়া। আরেকটু শুনেই..
— না না থাক। দরকার নেই সিস্টার। গান শোনার ইচ্ছা আমার কয়েক শতাব্দীর জন্য মরে গেছে।
হাত তুলে হড়বড় করে বলে উঠল রওনক। উপমা তখনও দুঃখী দুঃখী ভাব চেহারায় ফুটিয়ে রেখেছে।
— আপনাকে পুরোটা গান শোনাতে পারলাম না। কষ্ট লাগছে ভাইয়া। এত কষ্ট করে ক্লাস বাদ দিয়ে ডেকে পাঠালেন! শোনেন না আরেকটু?
— না না। দরকার নেই। আরে হ্যাঁ ক..ক্লাস। ক্লাস আছে তো তোমার। যাও যাও তুমি বরং ক্লাসে যাও। আমার তো মাথাতেই ছিল না।
— এখন গিয়ে কি আর লাভ আছে? তারচেয়ে বরং..
উপমার কথা সম্পূর্ণ করার পূর্বেই রওনক বলে উঠল,
— নেই মানে! অবশ্যই আছে। পৃথিবীর আর সমস্ত কাজে লোকসানের গননা থাকলেও ক্লাসের ক্ষেত্রে এই গননা নেই। ক্লাসে লাভ ছাড়া লস নেই। আমি তো ভুলই করছি তোমাকে ডেকে।
— আচ্ছা তাহলে যাই। নাকি?
— অবশ্যই। যাও। আমার বন্ধু ছেড়ে আসবে নাকি তোমাকে?
— না না তার দরকার পড়বে না ভাইয়া।
ব্যাগ কাঁধে তুলে টুক টুক করে ক্লাবঘর থেকে বেরিয়ে এলো উপমা। বেশ জব্দ করা গেছে মাস্তানটাকে। খুব শখ না গান শোনার? নে এখন গান খা। গানের সাথে কান দুটো খুলে ভর্তা করে খা। হুহ্।

হাত ঘড়িতে উপমা দেখল প্রথম ক্লাসের সময় পেরিয়ে গেছে। এখন ফিজিক্স ক্লাস। ফিজিক্স ম্যাম ভীষণ ভীষণ রাগী। ওনার যা পাংচুয়ালিটি! পড়া না হোক কিন্তু ক্লাসে দেরিতে ঢোকা! উঁহু ওনার ক্লাসে চলবে না। সময়ানুবর্তিতার দিকে যে শিক্ষার্থীর খেয়াল নেই সে ওনার দু চোখের বিষ। একমিনিট দেরি তো পুরো ক্লাসে দরজায় দাঁড়িয়ে পার করতে হবে। এই মুহুর্তে অমন ভয়ানক রাগী ব্যক্তির মুখোমুখি হওয়ার আগ্রহ অবশিষ্ট নেই উপমার মধ্যে। ব্যাগ কাঁধে তাই সে পথ পাল্টে বিপরীত দিকে হাঁটা শুরু করল। এই রোডটা সোজা বাংলা ডিপার্টমেন্টের দিকে চলে গেছে। নতুন হওয়া রাস্তা আর দু’পাশে সারি সারি গাছ। রোডটা ভীষণ পছন্দ হয়েছে উপমার। ব্যাগ কাঁধে ঘুরে ঘুরে দেখতে দেখতে সে এগোচ্ছে। সামনে বাংলা মঞ্চ বলে একটা জায়গা পড়ে। ওখান থেকে ছেলেমেয়েদের হাসি-ঠাট্টা আর কিছুক্ষণ পর পর গান-বাজনার আওয়াজ ভেসে আসছে। উৎসুক উপমা আর কোথাও না গিয়ে সোজা বাংলা মঞ্চের দিকে পা বাড়াল। নাচ-গান যারা করছে তারা নিশ্চয়ই ওর সিনিয়র? অনার্সের ছেলেমেয়েরা। ওদের মনে তো আনন্দ লেগে থাকে সবসময়। প্রায় প্রায় বাংলা মঞ্চে তারা নানামুখী অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। ছুটির পর বেশ কয়েকদিন উপমা দলবলসমেত এসে অনুষ্ঠান দেখে গেছে। প্রতিদিন ওরা অডিয়েন্স থেকে কাউকে ডাকে যেকোনো পারফরম্যান্সের জন্য। বন্ধুরা তো জেঁকে ধরত উপমাকে গান গাওয়ার জন্য। এত ভালো গান জেনেও মানুষের সামনে পারফর্ম করেনি উপমা। লজ্জা করে তার।
তবে আজ একটা সুপ্ত ইচ্ছে মাথা চাড়া দেয়ার চেষ্টা করছে কেন যেন। মনে হচ্ছে এত সুন্দর গান করে,মানুষকে শোনানো উচিৎ। প্রশংসনীয় কোনো কাজ করলে প্রশংসা পাওয়ার ইচ্ছে জাগবে এটাই স্বাভাবিক। আজ যদি কেউ অডিয়েন্স থেকে ডাকে তাহলে উপমা যাবে বলে ঠিক করল। বাড়ির সবাই তো বলে উপমার গানের গলা ভালো। পরীক্ষা করে দেখা যাক সত্যি সত্যি ভালো কি না! এখানে তো আরও অনেক গাইয়ে আছে। তাদের সাথে পাল্লা দেয়ার সক্ষমতা উপমার তৈরি হয়েছে কি না দেখা যাক!

উপমাকে ফেরত পাঠানোর পর রওনকও আর বসে রইল না। আজ কলেজে আবারও মারামারি হয়েছে। নতুন একটা দল ডাল-পালা মেলে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। একে শুরুতে হালকাভাবে নিলেও ইদানিংয়ের কিছু কাজকারবার দেখে মনে হচ্ছে অবস্থান এর বেশ শক্তপোক্ত। তাদের রাজত্ব চলা অবস্থায় তৃতীয় পক্ষের আগমন ঘটানোর দুঃসাহস কে করল তা দেখার আগ্রহ রওনকের। দলের একটা ছেলেকে নিয়ে তাই সে রওয়ানা হলো বাংলা ডিপার্টমেন্টের দিকে। ওটাই তো মূল চত্বর।

মঞ্চের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে তন্ময় হয়ে একটা নাচ দেখছিল উপমা। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এক আপু দারুণ নাচে। দু একদিন ওঁর নাচ দেখে ফ্যান হয়ে গেছে উপমা। এই আপুর নাচ এলে কখনো মিস করে না সে। সব্বাই পছন্দ করে আপুটাকে। উপমাও।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মেয়েটার নাচ শেষে উপস্থাপনায় থাকা ছেলে-মেয়েরা হুট করে অডিয়েন্স কল করা শুরু করল। অডিয়েন্সের মধ্যে আর কে নাচ অথবা গান করতে চায়।
উপমা তো ভেবে এসেছিল ডাকলেই সে যাবে। কিন্তু এখানে দাঁড়িয়ে বেশ দ্বিধায় পড়ে গেল। যাবে কি যাবে না। যদি গান ভালো না হয়? সবাই কি ওকে নিয়ে হাসাহাসি করবে? নাহ্ হাসাহাসি করবে কেন! আর গান ভালোই বা হবে না কেন। কত যত্ন করে ও শিখেছে। প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে মনের সমস্ত দ্বিধা ঝেড়ে ফেলল উপমা। এরপর চট করে হাত তুলে জোর গলায় বলল,
— আমি গান করব।
ওর সামনে আরও কয়েকজন দাঁড়ানো ছিল। তারা চট করে ফিরে তাকাল এবং সরেও গেল। উপমা ওদের দিকে একবার তাকিয়ে আত্ম বিশ্বাসের সাথে এগিয়ে গেল মঞ্চের দিকে। উপস্থাপনায় থাকা দু’জনের মধ্যে একজন সহাস্যে ওকে মঞ্চে উঠে যেতে বলল।
সাথে ওর নাম এবং পরিচয়ও শুনে নিলো। মাইক হাতে দেওয়ার আগে ওর নাম-পরিচয় সকলের উদ্দেশ্যে শোনানো হলো। তখনও দর্শকমহলে গোলযোগ চলছে হালকা। উপস্থিত সকলের দিকে নিবিড়ভাবে একবার চোখ বুলিয়ে মাইক শক্ত করে চেপে ধরল উপমা। মনে মনে মামিকে স্মরণ করল একবার। এরপর আলতো করে চোখ বুঁজে তার মামির একটা প্রিয় গানে সুর তুলল,
“শুধু গান গেয়ে পরিচয়”
প্রথম লাইনটা যখন গাওয়া হয়েছে সেই মুহুর্তে রওনকেরও হোন্ডা উপস্থিত হয়েছে বাংলা মঞ্চের কাছে। এবং মাইকে পরিচিত গলার স্বর তার কর্ণদ্বয়েও ধাক্কা মেরেছে। চট করে হোন্ডা থামিয়ে দিয়েছে সে। হঠাৎ থেমে যাওয়ায় পেছনে বসা ছেলেটা প্রশ্ন করে উঠল,
— ভাই দাঁড়াইলেন যে?
— গান গায় কে নুরু?
উৎসুক চোখে মঞ্চের দিকে তাকাতে তাকাতে শুধল রওনক। নুরু নামক ছেলেটা ওর চাইতে বেশ খাটো । বিধায় উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে সে বলল,
— থামেন ভাই দেখি।
কিন্তু সময়ক্ষেপণে রওনক মোটেও আগ্রহী নয়। নুরুকে নামতে বলে হোন্ডা সঁপে সে চপল গতিতে এগোতেই বেশি আগ্রহী।
নুরু তখনও বোকার মতো বোঝার চেষ্টা করছে কি হচ্ছে! রওনকের হঠাৎ চঞ্চলতার কারণ।
তবে এ জটিল জিনিস বোঝার সাধ্য ওর নেই।
ওদিকে রওনক চপল গতিতে এগোতে এগোতে মঞ্চের অনেকটা কাছে চলে গিয়েছে। মঞ্চের সামনে দাঁড়ানো সব ছেলেমেয়ে অপরিচিতার সুরের মূর্ছনায় ভাসছে। ভাসতে চাইছে রওনকও। কিন্তু তার পূর্বে যে অপরিচিতা শর্বরীর চেহারা দেখা চাই ।
জোর হাতে ভীড় ঠেলে রওনকের পৌঁছতে পৌঁছতে উপমার গান অর্ধেক হয়ে গেছে। সে পুনরাবৃত্তিতে গাইছে,
“চলার পথে ক্ষণিক দেখা
এ কি শুধু অভিনয়
শুধু গান গেয়ে পরিচয়”

এতটুকু গাওয়ার মধ্যে রওনক ঠিক তার মুখোমুখি মঞ্চের সামনে উপস্থিত হয়ে গেল। উপমাও বোঁজা চোখজোড়া ঝট করে খুলে ফেলল। আরেকবার হলো দুজনের দৃষ্টি বিনিময়। অদ্ভুত একটা সময়ে। মাইক হাতে যেমন উপমা অবাক তাকিয়ে রইল রওনকের দিকে, উপমার চাইতে শতগুণ বিস্ময় নিয়ে রওনকও তাকিয়ে রইল মাইক হাতে দাঁড়ানো উপমার দিকে। সত্যিই গান দিয়েই তো ওদের পরিচয়। রওনকের রহস্যময়ী সেই ছায়ামানবীর পরিচয় শেষ পর্যন্ত তবে উন্মোচিত হলো রওনকের সামনে। ছায়ামানবীর পরিচয় এমনও হতে পারে সে কভু কল্পনা করেছিল?

চলবে,
Sinin Tasnim Sara

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here