১৮+ সতর্কতা
চিঠি দিও
১৫
________________
মানুষ ছাড়াও হিংস্র প্রজাতির জীবের অভাব নেই পৃথিবীতে। সেসবের তালিকা করতে বসলে নিশ্চিত খাতা ভরিয়ে ফেলা সম্ভব। সব হিংস্র প্রাণীর আবার হিংস্রতা এক নয়;এক নয় তাদের শিকারী কায়দা। নামের মতোই সকলের মধ্যে আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য রয়েছে।শি’কারী প্রাণীর হিংস্রতার পাশাপাশি চৌকস হওয়া একটা বড় গুণ।
হায়েনাকে বলা হয় পৃথিবীর অন্যতম ধূর্ত প্রাণী। সব নয়, কিছু প্রজাতির হায়েনা শিকারী। শিকারকে সামনে পেলেই লাফিয়ে পড়ার প্রবণতা তাদের মধ্যে প্রবল। বাছবিচারে তারা সময় ব্যয় করতে পছন্দ করে না।
অতনুর হায়েনা পছন্দ নয়। শিকার পেলেই লাফিয়ে পড়ার মত এতখানি অধৈর্যতাকে সে ধূর্ততা বলতে পছন্দ করে না।
অতনুর পছন্দ লেপার্ড;শিকারী লেপার্ড। শিকারকে বাগে আনা যার বাঁয়ে হাতের খেল। তার পক্ষে দুঃসাধ্য কিছুই নয়। সে হলো ভরা বাজারে মূর্তিমান আতঙ্কের মতো। যেমন ধূর্ত তেমনই নৃশংস। কাউকে রেয়াত করে না। রক্তের স্বাদ তার সব থেকে প্রিয়। মাঝেমধ্যে নিজেকে লেপার্ড বলে অভিমান করতে পছন্দ করে অতনু৷ সেও এই শহরে একটা মূর্তিমান আতঙ্ক। এবং তারও.. রক্তের স্বাদ ভীষণ পছন্দ। বক্র হেসে সুসজ্জিত সোফার টেবিলের ওপর থেকে মাঝারি আকারের ব্র্যান্ডির বোতলখানা হাতে তুলে নিলো অতনু। জানালার ধার থেকে গুণগুণ করে গান ভেসে আসছে,
“এ মণিহার আমায় নাহি সাজে”
ছিপি খুলে বোতল সমেত ঘুরে বসল অতনু। জানালার গরাদ বেয়ে নেমে আসছে একাদশীর বাঁকা চাঁদের স্নিগ্ধ আলো। ঝলমলে মায়াকাড়া সে আলোর ভেলায় গা ভাসাবে বলে দুহাত পেতে দাঁড়িয়ে আছে এক মনমোহিনী, হৃদয় হরণী। পরনে তার সাদা সিল্কের নাইট গাউন। গাউনটা বোধহয় অতনুই উপহার দিয়েছিল তাকে। এক ঝলক দেখামাত্র মনে হয়েছিল এ জিনিস এই কামদেবীর জন্যই তৈরি। অনুমান ভুল হয়নি। মাখনের মতো পেলব ত্বকে কি সুন্দর মিশে গেছে রঙটা। আঁটোসাটো চেপে বসেছে বলে পেছন থেকে দেহের বাঁক সমস্ত স্পষ্ট। মেঘরাশির মতন চুলগুলোকে অবিন্যস্তভাবে পিঠের ওপর ছেড়ে রাখায় কি চমৎকার লাগছে! দু-চোখ থেকে কামনা ঠিকরে বেরচ্ছে অতনুর। কিছু সময় পূর্বে ওই মেঘরাশিতে মুখ ডুবিয়ে অন্য এক জগতে হারিয়ে গিয়েছিল অতনু। এখন দ্বিতীয়বার হারানোর ইচ্ছে প্রবল হচ্ছে ধীরে ধীরে। ছিপি খুলে কিছুটা ব্র্যান্ডি গলায় ঢেলে ডেকে উঠল অতনু,
— এই যে রম্ভা। নিরীহ মানুষটাকে ক্ষুধার্ত রেখে পুরো রাত এমনি এমনি জানালার ধারে কাটিয়ে দেবে বলে ডেকে পাঠিয়েছিলে বুঝি!
অতনুর কথায় গান থামিয়ে ফিরে তাকাল উর্বশী। চোখ সরু করে কপট রাগ দেখিয়ে বলল,
— বলেছি না রম্ভা ডাকবে না? রম্ভা আমার মায়ের নাম।
চোখ প্রসারিত করে কণ্ঠমণিতে হাত রাখল অতনু। দাঁতে জিভ কেটে মাথা নেড়ে বলল,
— মাফ চাই সিস্টার। জাস্ট ফরগট। জানোই তো তোমার সামনে এলে তুমি ছাড়া বাকিসব মাথা থেকে বেরিয়ে যায়।
এমন উত্তরের বিপরীতে খিলখিল হেসে উঠল উর্বশী। অবিন্যস্ত চুলগুলোকে দু’হাতের মুঠোয় চেপে খোঁপায় আটকে ধীরপায়ে এগিয়ে এলো অতনুর কাছে। লেশমাত্র সংকোচ না করে সোজা ওর কোলের ওপর উঠে বসে দু’হাতে গলা জড়িয়ে দুষ্টু হেসে শুধল,
— ঘটনা কি বলো তো? আজ মধু ঝরছে এই কণ্ঠ বেয়ে?
দুষ্টুমির মাত্রা বাড়িয়ে কণ্ঠমণির ওপর টুপ করে চুমুও খেয়ে নিলো উর্বশী। ক্ষণিকের জন্য চোখ বুঁজে অতনুও হাসলো। মেয়েটা বুদ্ধিমান আছে। ব্র্যান্ডির বোতলখানা নামিয়ে রেখে একহাতে জাপ্টে ধরল উর্বশীর কৃশকায় কোমর। অপরহাতে পীনোন্নত বুকে হাত গলিয়ে বক্ষ বিভাজিকায় মুখ ডুবিয়ে অস্পষ্ট স্বরে জবাব দিলো,
— একটা জায়গায় যেতে হবে তোমাকে সিস্টার।
স্বার্থহীন মিষ্টি কথা যে পাওনা নয় এ তো জানা ছিল উর্বশীর। তথাপি প্রিয় মানুষ বলে যাকে বিবেচনা করে, তার মুখে সরাসরি স্বার্থের কথা শুনলে হৃদয়ে চিঁড় ধরে বৈকি! তবুও গহীনের ব্যথা গহীনেই লুকিয়ে রাখা সমীচীন মনে করল। ব্যথার ওপর বাড়তি প্রলেপ লাগাতে মেকি কামনা কণ্ঠে ফুটিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করল,
— কোথায়?
— নিজাম চৌধুরীর বাড়িতে।
অবাক হওয়ার ভাণ করে উর্বশী। অতনুর ঝাঁকড়া চুলের মাঝে হাত ডুবিয়ে মুঠ পাকিয়ে ধরে কিছু চুল। এরপর টেনে সরায় ওকে নিজের বুক থেকে। চোখে চোখ রেখে বিস্ময়ের সাথে বলে,
— তুম আমাকে অন্যের বিস্তারপে পওছাতে চাও?
সূক্ষ্মদৃষ্টি নিবদ্ধ করলে উর্বশীর চোখজোড়ায় ব্যথার আভাস স্পষ্ট টের পায় অতনু। তৎক্ষনাৎ শুধরে নেয় নিজেকে। কণ্ঠে দ্বিগুণ কোমলতা ফুটিয়ে কোমরে মৃদু চাপ দিয়ে বলে,
— ভুল বুঝো না আমাকে। অল্প সময়ের জন্য কাজটা করতে হবে।
— একবার কেউ নারী মাংসের সোয়াদ পেয়ে গেলে অল্পে ছেড়ে দেয়?
— ও ধরে রাখতে চাইলেই কি আমি দেব? ওকে নাকাল করার জন্যই তো তোমায় পাঠানো।
— আমি বুঝতে পারছি না তোমার কথা।
হতবুদ্ধিভাব জাগে উর্বশীর মধ্যে। দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিলিয়ে শক্ত গলায় অতনু বলে
— ওর পদটা আমার চাই উর্বশী। আজ যে ক্ষমতা ওর হস্তগত। ওই ক্ষমতাটা আমার চাই। এই আসনের সাংসদ হতে চাই আমি; চাই মন্ত্রীত্ব৷
লক্ষ্য থেকে বেশি দূরে নই। অল্প কিছুটা হাঁটলেই লক্ষ্যে পৌঁছনো সম্ভব। আর আমায় এই লক্ষ্যে নিয়ে যেতে পারো একমাত্র তুমি; তুমিই পূরণ করতে পারো আমার সব চাওয়া-পাওয়া।
— আমি! কীভাবে? শরীর বিলিয়ে?
ফের শুধরে দেয় অতনু,
— শুধু শরীর বিলিয়ে দেওয়ার জন্য তো তোমায় পাঠাচ্ছি না। আমার উদ্দেশ্য অন্য। কাজ শুরু হলে সবটা জানতে পারবে ।
— কিন্তু বাঙ্গালী বাবু বহুত পাওয়ার তো হ্যায় তুমহারে হাত ম্যে। এই শহরের অন্যতম পরিচিত মুখ আছো তুমি। তবে আর কেন..
কথা সম্পূর্ণ করে না উর্বশী।
— শুধু পরিচিত হয়ে থাকার জন্য তো আমি আসিনি এ পথে। গোটা সাম্রাজ্যের আধিপত্য চাই আমার।
— এক সিংহাসনে দুই রাজা তো থাকতে পারে না।
— এজন্যই অযোগ্য রাজাকে সরিয়ে দিতে হবে। আর ওকে সরাতে সাহায্য করবে তুমি আমার। বলো করবে না?
— কিন্তু..
— ভালোবাস না তুমি আমায়?
উর্বশীকে দুর্বল করার মোক্ষম অস্ত্র প্রয়োগ করে ফেলল অতনু। ওর মুখে ভালোবাসার কথা শুনে চমকে উঠল উর্বশী। ক্ষণিক নীরব থেকে বলল,
— ঠিক আছে মাদাত করব আমি তোমার।
কাঙ্ক্ষিত জবাব পেয়ে ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠল অতনুর। চঞ্চল হাতজোড়া কোমর থেকে সরে এসে গাউনের নট খোলায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল । মুখে সে বলল,
— জানতাম তুমি আমার কথা ফেলতে পারবে না। তুমি আমার ভরসার জায়গা জানো তো?
— জানি।
ফিঁকে হেসে উত্তর করল উর্বশী। অতনুর নজর সেদিকে নেই। কামনায় ঠাঁসা তার দৃষ্টিজোড়া সমস্তটা বস্ত্রশূন্য উর্বশীর দেহ পরিমাপে ব্যস্ত। যে উদ্দেশ্য নিয়ে এই কুটিরে পা রেখেছিল তা তো পূরণ হলো। উপরি পাওনা জুটে গেলে তাকে পায়ে ঠেলবে কেন?
রইল বাকি রাজনৈতিক আলাপ! সুক্ষ্মচালে দাবার গুটি চেলে দিয়েছে ও। জয়ের পাল্লা ওর দিকেই ভারী। দেখা যাক সামনে কি হয়। মাত্র কয়েক মুহুর্তের অপেক্ষা।
নিজাম চৌধুরীকে কিন্তু একসময় আইডলই মনে করত অতনু। লোকটার মধ্যে একটা অন্যরকম ব্যাপার ছিল। ধারালো ছিল ব্যক্তিত্ব। কিন্তু বয়সের সাথে সাথে কেন যে লোকটা এত বিরক্তিকর আর একঘেয়ে হয়ে যাচ্ছে! নারীর মোহে সমস্ত ব্যক্তিত্ব খোয়াতে বসেছে। আজ ব্যক্তিত্ব খোয়াচ্ছে, কাল অর্জিত সম্পদ,ক্ষমতা সব খোয়াবে। সেরকম ব্যবস্থাই করেছে অতনু।
অতনুকে নিজের ডান হাত মনে করে লোকটা। বিশ্বস্ত মনে করে। বিশ্বস্ততা! এই পথে আবার বিশ্বস্ততা কিসের? এখানে যে যতটা সুযোগসন্ধানী তার পথ ততটা বিস্তৃত।
নারীর নেশা পেয়ে বসেছে না ওকে! এই নেশা কতদূর অবধি নিয়ে যায় তাই দেখবে অতনু। উর্বশীর মৌতাতকে বানাবে ওর কাল।
তবে এক লাফে নিজাম অবধি পৌঁছনো সমীচীন হবে না। নিজামের আগে পথের কাঁটা আছে দুটো। এক. আনিস শেখ আর দুই.রওনক।
এই দুটোর একটা ব্যবস্থা করা দরকার।
________________
মাঝখানে কেটে গেছে অনেকটা দিন। রওনকের সাথে কোনোরকম যোগাযোগ হয়নি উপমার। মানুষটা কোথায় আছে, কেমন আছে কিচ্ছু জানা নেই উপমার। আগামীকাল থেকে ক্লাস শুরু করবে। উপমা ভেবে রেখেছে আগামীকাল কলেজ যাওয়ার পথে ক্লাবে গিয়ে খোঁজ নেবে রওনকের। সাঙ্গপাঙ্গগুলো নিশ্চয়ই জানবে ওর খোঁজ!
— পড়া হয়নি এখনও ননদীনির?
দোর এঁটে মুচকি হেসে উপমার পাশে এসে দাঁড়াল আসমা। অ্যাক্সিডেন্টের পর থেকে রাত্রিবেলা করে ও শোয় উপমার কাছে। সুস্থ হওয়ার পর উপমা বারণ করেছিল বটে। কিন্তু কে শোনে কার কথা! বই-খাতা গুটিয়ে রাখতে রাখতে উপমা জবাব দিলো,
— হয়েছে ভাবী। তুমি আজও এই ঘরে। সেজো ভাই ফেরেনি?
— উঁহু। তবে কথা হয়েছে কাল সকালের বাসে রওয়ানা দেবে।
— হুট করে ঢাকায় গেল কেন?
— কেন যে গেল! আমায় খুলে বলে নাকি কিছু?
লম্বা শ্বাস ফেলে বিছানার ওপর গিয়ে বসল আসমা। কলেজ ব্যাগ গোছাতে গোছাতেই উপমা হুট করে প্রশ্ন করল,
— তোমার বাড়ির কথা মনে পড়ে ভাবী?
— পড়ে।
— সবসময় নাকি মাঝেমধ্যে?
— প্রত্যেকদিন সময়ে-অসময়ে, কাজের ফাঁকে, অবসরে মনে পড়ে। এটাকে সবসময় বলে নাকি মাঝেমধ্যে?
অল্প হেসে বলল আসমা। বিনিময়ে উপমাও হাসলো।
— কাকে সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে?
— উমম। আমার মাকে। জানো আনন্দি, আমার মা হলো খুব নিরীহ একজন মহিলা। স্বামী, সন্তান আর সংসারের বাইরে অন্য কোনো জগৎ হয় এ তার জানা নেই। তার ভেতর-বাহির সমস্ত জগতই ছিলো আমাদের ঘিরে। আব্বা তো খুব রাগী একজন মানুষ। আমরা ভাইবোনেরা সাহস করে কখনো আব্বার কাছে কিছু চাইতে পারিনি। আমাদের সমস্ত চাওয়া-পাওয়া ছিল আম্মার কাছে। আম্মার নেওটা ছিলাম আমরা একেকজন।
— এভাবে সেজো ভাইয়ের সাথে বেরিয়ে আসায় মাউইমা খুব কষ্ট পেয়েছেন তাই না?
— খুব। অভিমানও করেছেন। এখানে আসার পর একদিন লুকিয়ে ফোন করেছিলাম বাড়িতে। ফোনটা মা ধরেছিলেন। আমার কণ্ঠ শোনামাত্র কেটে দিলেন। দ্বিতীয়বার ফোন দিলে কড়াশব্দে বললেন আসমা নামের কাউকে তাঁরা চেনেন না৷ আসমা মরে গেছে তাঁদের জন্য।
শোনার পর আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না ঐ কথাটা আমার মায়ের।
— এমনও তো হতে পারে কণ্ঠ মাউইমার কিন্তু কথাটা শিখিয়ে দিয়েছেন তোমার আব্বা?
— হতে পারে৷ কিন্তু এ কথাও তো সত্যি আমি তাঁদের অনেক কষ্ট দিয়েছি।
— সেজো ভাই চেষ্টা করে না কেন সব মিটমাট করার?
— এতটা সহজ নয়। আমার বাপ-চাচারা এত সহজ মানুষ নয়৷ শেষে দাঙ্গা বাঁধিয়ে ফেলবে তোমার ভাইয়ের সাথে।
বলতে বলতে হেসে ফেলল আসমা। ঠোঁটে হাসি লেগে থাকলেও চোখজোড়া যে জলে টইটুম্বুর নজর এড়ালো না উপমার। উঠে গিয়ে আসমার পাশে বসে ওর কাঁধে হাত রেখে বলল,
— তুমি চাইলে বড়মামার সাথে কথা বলব ভাবী। মামা সব সমাধান করে দেবেন দেখবে।
— ওনারা চেষ্টা করছেন আনন্দি। আব্বারাই সাড়া দিচ্ছেন না। আমি চাই না ঝা”মেলা বাড়ুক। আব্বাকে তো চিনি। আপাতত আমাদের হাতে আসলে কিছুই নেই। সময়ের জালে বন্দী আমরা।
— তোমার জন্য আমার খুব কষ্ট হয় ভাবী।
মলিন কণ্ঠে কথাটি বলে আসমার কাঁধে মাথা রাখল উপমা। সস্নেহে উপমার মাথায় হাত বুলিয়ে আসমা বলল,
— বোকা মেয়ে। আমি কি নালিশ করেছি কখনও? বলেছি আমি সুখে নেই? তবে কি ভেবে কষ্ট পাও তুমি।
— কে জানে! আচ্ছা ভাবী সেজো ভাই তোমায় ভালোবাসে?
এ প্রশ্নে একটু লজ্জা পেয়ে গেল আসমা। ক্ষীণস্বরে বলল,
— বাসে। সবসময় থাকতে পারে না কাছে কিন্তু তার ভালোবাসাটা আমি অনুভব করতে পারি। খুব যত্ন করে মানুষটা আমার। তাকে যতটুকু কাছে পাই, যতখানি পাশে পাই ওতেই সন্তুষ্ট আমি আনন্দি। ওতেই সুখী।
— সত্যি তো?
— সত্যি, সত্যি। তিন সত্যি।
— তুমি সুখে থাকলেই আমরা সুখী।
উপমার কথা শুনে পুনরায় ছলছল করে উঠল আসমার চোখজোড়া। ওর কাঁধে হাত রেখে আসমা বলল,
— তুমি চলে গেলে আমি একদম একা হয়ে যাব আনন্দি।
— আমি কোথায় যাচ্ছি?
উপমা অবাক হলো।
— কেন তোমার চাচা-চাচির সাথে? বিদেশে।
— উঁহ। আমি যাচ্ছি না ওখানে। তোমাদের ছেড়ে যেতে আমার বয়েই গেছে।
বিরক্তি নিয়ে বলল উপমা। আসমা যেন খুশিই হলো। তবুও বলল,
— ওখানে গেলে পড়াশোনা ঠিক মতো হবে। জীবন সামলে যাবে তোমার।
— কেন এখানে কি আমার পড়াশোনা হচ্ছে না? আমি বুঝি খারাপ ছাত্রী!
— সে কখন বললাম।
— শোনো ভাবী। তোমাদের ছেড়ে গেলে কখনোই আমার জীবন সামলে যাবে না। উল্টো ঘেঁটে যাবে। তাছাড়াও চাচা-চাচির অন্য একটা সংসার। কয়েকদিন পর সংসার বড় হবে। আমি আউটসাইডার উড়ে গিয়ে জুড়ে বসলে ওদের সমস্যা নয়? তাই আমি যাচ্ছি না।
— এটা কি তোমার অভিমানের কথা?
— উঁহু। কেউ ছেড়ে গেলে আমার আর অভিমান হয় না ভাবী। মানিয়ে নিতে শিখেছি আমি। কেউ ছেড়ে যাবে, নতুন কেউ যোগ হবে এটাই তো প্রকৃতির নিয়ম তাই না?
আচ্ছা ছাড়ো এসব কথা। কাল তো কলেজ। মাথায় একটু তেল দিয়ে দাও না?
— এই রাতের বেলা তেল দেবে? চুল ধোয়ার ঝক্কি পোহাতে হবে কাল।
— হোক না। তবুও দিয়ে দাও। মাথার তালুতে একটু চেপে চেপে বসিয়ে দাও। মাথাটায় কি ব্যথা!
— আচ্ছা এসো দিয়ে দিই।
বিছানার ওপর পা গুটিয়ে বসল আসমা। উপমা গিয়ে তেলের বোতল নিয়ে এলো।
তেল দিতে দিতে দু একটা কথা হলো তাদের। উপমার বিশেষ আগ্রহ রইল না সেসব গল্পে। রাত গাঢ় হলে রওনকের ভাবনা ওকে চেপে ধরতে চায়। মানুষটা দূরে গিয়ে একদণ্ড শান্তি ওকে দিচ্ছে কি? আসুক না একবার। কড়ায়-গণ্ডায় এসব ফেরত যদি না দিয়েছে! স্রেফ আসুক।
— সেদিন রাতে এসেছিল। ছেলেটা কে আনন্দি?
অপ্রত্যাশিত আসমার প্রশ্নখানা শুনে ঝট করে চোখ মেলে চাইল উপমা। কোন রাতের কথা বলছে আসমা? ভয় পেলেও তা লুকিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করল,
— কোন ছেলে ভাবী।
— সেই ছেলেটাই যে অ্যাক্সিডেন্টের দিন ছুটোছুটি করে তোমায় হাসপাতালে নিলো। সেদিন রাতে বাড়ির পেছন গেটে এলো।
উপমা বুঝল ও ধরা পড়ে গেছে। আমতাআমতা করে বলল,
— তুমি দেখে ফেলেছ?
— তুমি অনেক বড় দুঃসাহসের কাজ করে ফেলেছিলে। আমার জায়গায় অন্যকেউ হলে কুরুক্ষেত্র বেঁধে যেত।
— প্লিজ ভাবী কাউকে বোলো না। আর কখনও করব না এরকম। প্লিজ ভাবি।
অনুনয় করে আসমার হাত চেপে ধরল উপমা।
— বলব না। তবে তার পরিচয় জানা আমার দরকার। সে কে? তোমার সাথে তার কি সম্পর্ক?
— সম্পর্ক এখনও তৈরি হয়নি ভাবী। তবে আমি… আমি তাকে ভালোবাসি।
— আর সে?
— হয়তো সেও৷
— হয়তো! বলেনি তোমায়?
— স্বীকার করেনি। তবে আমি বুঝতে পারি সেও আমাকে পছন্দ করে।
— বুঝেশুনে এগো আনন্দি । পাছে ভুল না হয়ে যায়৷
— মানুষটা ভীষণ ভালো ভাবী। ভীষণ ভালো। তাকে চিনতে ভুল আমার হবে না।
— তবুও সতর্ক থাকতে হবে । তোমার পরিচয় কেবল উপমাতেই সীমাবদ্ধ নয়। তুমি কোন পরিবারের মেয়ে, কার বোন এটাও একটা বড় ব্যাপার।
— সে তো আমার এই পরিচয় জানেই না। আমি তাকে জানাইনি এসব।
— তুমি জানাওনি বলে যে সে জানবে না এমন কোনো কথা নেই। ভুল বুঝো না আমাকে। তোমার ভালো চাই তাই বলছি। সতর্ক থাকবে। খারাপ কিছু দেখলে সরে আসবে। বুঝেছ?
ওপর নীচে মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানালো উপমা। এরপর আর কথা হলো না দু’জনের মধ্যে। উপমাকে চুল আঁচড়ে, বেনি করে দিয়ে ঘুমুতে গেল দু’জন।
মাঝরাতে উপমার ঘুম ভাঙলো ভয়ানক এক দুঃস্বপ্নে । স্বপ্নে সে দেখলো একটা নির্জন মাঠে সে আর রওনক দাঁড়িয়ে। রওনক তার থেকে বেশ কিছুটা সামনে। পেছন ফিরে রয়েছে বলে তখনও ওকে দেখেনি। নাম ধরে বার কয়েক ডাকল উপমা নিজের উপস্থিতি জানান দেয়ার জন্য। কিন্তু রওনকের মন যে কোথায়! উপমার কথা সে শুনতেই পাচ্ছে না। এত ডাকছে উপমা!
তন্মধ্যে হুট করে আগমন ঘটল এক অস্ত্রধারী আততায়ীর। রওনককে সতর্ক করবেই উপমা এর পূর্বে আততায়ী বিষাক্ত গুলি ছুঁড়ে ছাতি চিরে দিলো রওনকের। উপমার চোখের সামনে
আহত রওনক লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। উপমা নাম ধরে চিৎকার করল রওনকের। ছুটে যেতে চাইল ওর কাছে। কিন্তু পারল না। পেছন থেকে কেউ শক্ত করে চে’পে ধরে রইল উপমাকে। কে ধরে রাখল স্পষ্ট নয় উপমার কাছে। ওর খেয়াল তো কেবল রক্তে ভেসে যাওয়া রওনকের দিকে নিবন্ধ।
ঘুম ভাঙলেও স্বপ্নের রেষ কাটল না উপমার। বরং একরাশ ভয় বেশ করে জেঁকে ধরল ওকে। ভয়ের কথা কাউকে না বলতে পেরে অসহায় উপমা করতলে মুখ লুকিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। এবং হৃদয়ের গহীন থেকে বারংবার একটা বাক্যই প্রতিধ্বনিত হতে শোনা গেল,
“রওনক সাহেব,
আমি আপনাকে ভীষণ মিস করছি”
চলবে,
Sinin Tasnim Sara