চিঠি দিও
২১
নশ্বর পৃথিবীতে চিরজীবন কেউ এক অবস্থানে অধিষ্ঠিত থাকতে পারে না৷ নিয়মমতো সবাইকে একদিন স্থান ছেড়ে দিতে হয়। কখনো তার থেকে অধিক যোগ্য কেউ এসে স্থানটা ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে। কখনোবা প্রকৃতিগতভাবে স্থানত্যাগের ছাড়পত্র হাতে আসে। প্রকৃতি থেকে ছাড়পত্র এলে তা অগ্রাহ্য করার কোনো উপায় মানুষের হাতে থাকে না। তখন বিকল্প হিসেবে ভরসাযোগ্য কারোর হাতে সমস্তটা অর্পণ করে যেতে ইচ্ছে করে। এই বাসনায় বংশগতি এগিয়ে নিয়ে যায়।
নিজাম চৌধুরীর সন্তানসন্ততি সংখ্যা বেশি নয়। মাত্র দুই। এক ছেলে, এক মেয়ে। স্ত্রীর সাথে মনঃসংযোগ বহু আগেই কেটে গেছে। দ্বিতীয় সন্তানটা হওয়ার পর তো শারিরীক এবং আত্মিক কোনো সম্পর্কই অবশিষ্ট রইল না। সমাজের সামনে নামে স্বামী-স্ত্রী হয়ে বহুদিন অভিনয় করেছে দু’জন। দিন যত বেড়েছে সম্পর্কের জটিলতা বেড়েছে বৈ কমেনি।
একসময় ঘরের ভেতরের জটিলতাটুকু খুব লাগামছাড়া হয়ে পড়ছিল। না চাইতেও সন্তানদের সামনে এসে যাচ্ছিল সবটা। ছেলেটার বয়স তখন বাড়ন্ত। জ্ঞান-বুদ্ধি হতে শুরু করেছে। বাবা-মায়ের মধ্যে যে কিছু একটা ঠিক নেই বেশ বুঝতে পারছিল সে। মিসেস চৌধুরী বিচক্ষণ একজন মানুষ ছিলেন। ছেলের থেকে যে কিছু লুকোতে পারছেন না বুঝতে পারছিলেন তিনি। বাবা-মায়ের দূরত্ব সন্তানদের জন্য সুখকর কোনো বিষয় নয়। এর প্রভাব কতখানি ভয়ানক হতে পারে ধারণা করেই সিদ্ধান্ত নিলেন সমস্যাটাকে আর বাড়তে দেয়া ঠিক হবে না। হয় সমস্যাকে গোড়া থেকে উপড়ে ফেলে দিতে হবে, নয়তো সমস্যা রেখে পালাতে হবে। একজন সাদামাটা গৃহিণীর জন্য গোড়া থেকে সমস্যা উপড়ে ফেলা সহজ নয়। তাই সন্তানদের কথা চিন্তা করে একপ্রকার বাধ্য হয়ে পলায়নের পথ ধরতে হলো তাকে।
নিজাম সাহেবের অবশ্য সমস্যা ছিল না এসবে। বরং সুখবরটা শুনে সানন্দে নিজ গরজে দূরদেশে তিনজনের বিলাসবহুলভাবে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন তিনি।
তবে ভালো স্বামী না হতে পারলেও ভালো বাবা হওয়ার চেষ্টাটা করেছেন বরাবর৷ এতে কোনো অভিনয় ছিল না। খাঁটি অনুভূতিই ছিল। তার ঔরসজাত সন্তান। অদ্ভুত জাদুকরী এক বিষয়। তারই দুটো অংশ। কি সুন্দর হেসে-খেলে জীবনযাপন করছে।
সারা পৃথিবীর সামনে যেমনই হোক না কেন! ছেলেমেয়ের সামনে নিজের অন্য একটা ভাবমূর্তি ধরে রেখেছেন সবসময়। কতটা সফল হয়েছেন আন্দাজ করা যায় না। শতভাগ হননি বোধহয়। তাই তো মেয়েটাকে অনুগত রাখতে পারলেও ছেলেটাকে পারেনি। বয়সের সাথে সাথে একটু একটু করে আলাদা হয়ে গেছে ছেলেটা। হয়েছে সৃষ্টিছাড়া, একরোখা। নিজে যা ভালো বুঝেছে করেছে। দেখা গেছে মাসের পর মাস কেটে যাচ্ছে ছেলে বাপকে ডাকছে না, কথা বলছে না, দেখা করছে না। খারাপ লেগেছে নিজাম সাহেবের। কিন্তু পরক্ষণে আবার মেনে নিতে হয়েছে। একসময় নিজেও তো সমস্ত বাঁধন কেটে বেরিয়ে এসেছিলেন। বেঁচেছেন নিজেকে নিয়ে নিজের মতো করে। এ তাদের বংশগত। কখনো কারোর বশ্যতা স্বীকার করে না।
তবে আজ এতদিন বাদে কীভাবে যেন একটা ম্যাজিক হয়ে গেছে। গেল বছর মা হারিয়ে বাবার সাথে সম্পর্ক পুনঃস্থাপন করেছে ছেলেটা। নিজে থেকে যোগাযোগ করেছে। জানিয়েছে সে এবার দেশে ফিরতে চায়, ফিরতে চায় আপন নীড়ে তার বাবার কাছে। আর থাকতে পারছে না একাকী।
শুরুতে অবাক হয়েছিলেন নিজাম সাহেব। এত বছর পর! জীবনধারা যেখানে আমূল পাল্টে আছে। কীভাবে ছেলেটাকে সেই এলোমেলো জীবনে ফিরতে আমন্ত্রণ জানাবেন? কিন্তু পিতৃ হৃদয় ওসবের তোয়াক্কা করেনি। প্রয়োজন হলে নাহয় বাকিসব ছেড়ে দেবেন। এখন তো ছেড়ে দেয়ারই বয়স এসেছে। তাছাড়াও পার্টিতে যে ওনার কদর কমে গেছে বুঝতে সমস্যা হয়নি। পিঠ পেছনে ছুরি মারার জন্য অনেকে প্রস্তুত হয়ে আছে। উপর্যুক্ত সুযোগ হাতে এলেই বিলম্ব করবে না। কিন্তু নাহ্, আততায়ীদের সে সুযোগ দেয়া যাবে না। যত দ্রুত সম্ভব ছড়িয়ে পড়া সবকিছু পুনরায় হাতের মুঠোয় নিয়ে আসতে হবে। আর এতে সাহায্য করবে তার ছেলে শওকত চৌধুরী। ছেলে যেহেতু একবার ঘরমুখো হয়েছে, তাকে এবার রাজনীতিমুখোও করতে হবে। ছেলে তার বিচক্ষণ, সম্মানিত একটা পেশায় আছে। মানুষও তাকে সহজে গ্রহণ করবে৷
তাই নিজের রাজনীতির হাতেখড়ি যে এলাকা থেকে সেখানেই ছেলেকে নিয়ে এসেছেন। এখানে সরকারি হাসপাতালে নিয়মিত বসবে শওকত। রাজনীতিতে আসতে হলে আগে খেটে খাওয়া মানুষগুলোর মন জয় করা চাই। ওদের ওপর ভর দিয়ে চলছে সমস্ত সংসার। ওরা সিংহভাগ৷ একবার ওদের মন জয় করতে পারলে বাকি কাজটা ওরাই এগিয়ে দেবে। শওকতকে অবশ্য পরিকল্পনার ব্যাপারে বলেননি নিজাম। সময় হোক সব খুলে বলবেন।
সময়টা ভর দুপুর। এই মুহুর্তে ক্লাবে রওনক ব্যতীত দ্বিতীয় কেউ নেই। দুপুরের সময়টাতে আসলে ছেলেপেলেরা কেউ থাকে না। যে যার কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে। বেলা ডুবলে নীড়ে ফেরা পাখির মতো সব ঝাঁকে ঝাঁকে ক্লাবে ফেরে।
ক্লাবঘরে নিজের কিং সাইজের চেয়ারটায় চুপচাপ বসে আছে রওনক। দৃষ্টি ভাবুক। কিছু একটা নিয়ে ভীষণ দুশ্চিন্তায় আছে ও। দুশ্চিন্তার ভার এতখানি, আঙুলের ফাঁকে ধরে রাখা সিগারেট একা একাই পুড়ে পুড়ে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে সেদিকে খেয়াল নেই।
মিজান গেছে পীরগাছা। রওনকই অবশ্য পাঠিয়েছে ওকে। গতকাল সন্ধ্যে থেকে বকুলের বাবাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। লোকটাকে খোঁজার জন্য পাঠিয়েছে। শেষবার নাকি দেখা গিয়েছিল তেঁতুলতলায় এক জুয়ার আড্ডায়। এরপর নেই; গায়েব। রওনক জানতো পীরগাছায় ঐ লোকের গ্রামের বাড়ি। প্রাথমিক খোঁজখবর তাই ওখান থেকেই নেয়া শুরু হয়েছে।
ওর দুশ্চিন্তা এসব নিয়ে নয়। ও ভাবছে অন্য কথা। শুনেছে নিজাম চৌধুরী শহরে আসছে আজ ছেলেসমেত। এতে কোনো সমস্যা নেই। ছেলে-মেয়ে প্রয়োজনে বাবার কাছে আসতেই পারে। সেখানে অন্য কারোর কি সমস্যা? তবে প্রশ্নটা তো অন্য জায়গায়।
নিজাম চৌধুরী কখনো ফ্যামিলিম্যান টাইপ লোক ছিল না। ওর যে একটা সাজানো গোছানো পরিবার আছে এই অমোঘ সত্যিখানা কোন স্বার্থে বহুদিন সিক্রেট রাখার চেষ্টা করেছে সে । রাখতে পারেনি কারণ এটা সিক্রেট রাখার মতো কোনো বিষয় নয়৷ তবে ওর পরিবারের মানুষগুলোকে ভালোই বলা চলে। কখনো কোনো দাবী নিয়ে ফিরে আসেনি। যেমনভাবে রেখেছে বিনা বাক্য ব্যয়ে তেমনভাবেই থেকেছে। তাই এতদিন সব চুপচাপ ছিল। শত্রুপক্ষ-মিত্রপক্ষও সর্বদা কেবল নিজাম চৌধুরীকে নিয়েই ভেবেছে। পরিবার পর্যন্ত পৌঁছনোর প্রয়োজনবোধ করেনি কেউ। তবে এখন বোধহয় করবে। করার মতো কারণ ইতোমধ্যে তৈরি হয়ে গেছে এবং ব্যাপকভাবে তা ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। রওনকের কাছেও ভাসা ভাসা কিছু খবর এসেছে। ও শুনতে পেয়েছে এতদিন বাদে তল্পিতল্পা গুটিয়েই দূরদেশ থেকে ফিরে এসেছে নিজাম সাহেবের ছেলেটা। শুধু তাই নয় সে নাকি অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য এই রংপুরের বাসিন্দা হয়ে যাবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পেশায় সে ডাক্তার। বসবে সরকারি হাসপাতালে। কর্তৃপক্ষ থেকে কাগজপত্র নেয়া শেষ। কাগুজে ভাষায়ও পোস্টিং তার এই জেলাতে দেয়া হয়েছে। ওর জন্য হাসপাতালে বেশ তোড়জোড় চলছে। সচক্ষে দেখে এসেছে রওনক। এরপর থেকে বিষয়টা বেশ ভাবাচ্ছে ওকে।
ছেলেটা বিদেশি ডিগ্রিধারী ডাক্তার। ঢাকায় একটা এলিট এলাকায় ওদের বিশাল রাজকীয় বাড়ি। এছাড়াও ঢাকার হাসপাতালগুলোতে এখানকার চাইতে দ্বিগুণ-তিনগুণ বেশি সুযোগ সুবিধা;ইনকামও বেশি। সেটেল হলে ঢাকায় হবে। এখানে কেন? এখানে তো কিছুই নেই। সদ্য নির্মিত হাসপাতাল। তেমন উন্নতও নয়। আবার জীবন-মরণ সমস্যা ছাড়া মানুষ আসতেও চায় না। এলেও যারা আসে তাদের আর্থিক স্বচ্ছলতা তেমন নয়। এখানে চাকরি করলেও তেমন ইনকাম করতে পারবে না এই ডাক্তার। পরিবেশও ভালো পাবে না। সুবিধার চাইতে অসুবিধার সংখ্যা যেখানে বেশি, সেখানে দীর্ঘসময়ের জন্য আগমন কেন? তবে কি এ আগমনের পেছনে অন্য কোনো কারণ জড়িয়ে আছে?
ধারণা থেকে সিদ্ধান্তে আসা অপছন্দ রওনকের। তবুও ওর চৌকস মস্তিষ্ক বলে দিচ্ছে ঘটনার গভীরতা অনেক। যা সরল চোখে ঠিক দেখা যাচ্ছে না।
_________________
চকচকে কমলা রঙের নরম কাপড়ের ফতুয়া পরনে রুষ্টপুষ্ট বছর এক-দেড়ের একটি ছেলেবাচ্চা অতনুর কোলে বসে খেলছে। সদ্য বুলি ফোটা কোমল কণ্ঠে অস্পষ্ট সুরে গানের মতো শোনাচ্ছে, “বাব্বা, বাব্বা” ডাকটি। একইসাথে আনন্দ এবং বিস্ময়ভরা দৃষ্টি নিয়ে বাচ্চাটিকে অবলোকন করছে অতনু। মিষ্টি গোলগাল মুখখানা পুরোটা যেন তার আদলে সৃষ্টি। এই বড় বড় চোখ, চৌকো নাক, ছোট্ট লাল ঠোঁটজোড়া। অ্যালবামে নিজের ছোটো বেলাকার সাদাকালো ছবি যেমন দেখেছিল, বাচ্চাটা একদম তেমন৷
গায়ের রঙটা অবশ্য ওর মতো নয়। মায়ের কাছে শুনেছিল ছোটোবেলায় ওর গায়ের রঙ ছিল তামাটে। বড় হওয়ার সাথে সাথে রঙ আর পাল্টায়নি। কিন্তু বাচ্চাটার গায়ের রঙ ভীষণ ফর্সা। যেন একফালি শ্বেতশুভ্র মেঘ।
বাচ্চাটা ভীষণ চঞ্চল। কোলের মধ্যে একদম স্থির নেই। আনন্দে-আহ্লাদে ডগমগ করছে। বাব্বা, বাব্বা ডাকছে আর ছোটো ছোটো হাত দুখানা দিয়ে পাঞ্জা বসাচ্ছে অতনুর গালে৷ কখনো খামচি দিয়ে ধরার চেষ্টা করছে ওর চুল, কখনোবা দুই কান চেপে ধরে টানছে। একবার তো নাকের ওপর সদ্য গজানো মিহি দাঁত দিয়ে কুট করে কামড়েও দিলো। মিহি দাঁতে জোর আছে বৈকি! অতনুর তামাটে বর্ণের নাকটাও কেমন লাল হয়ে উঠল নিমেষে। অতনু হেসে ফেলল। ভীষণ স্নেহে জাপটে ধরতে চাইল বাচ্চাটিকে। তখনই বাঁধল বিপত্তি। বাচ্চার গায়ে হাত রাখামাত্র অদ্ভুতভাবে বাচ্চাটা গলতে শুরু করল। জমাটবাধা মোম যেমন আগুনের তাপ পেলে তরল হয়ে গলতে শুরু করে ঠিক তেমনভাবে বাচ্চাটাও গলে গলে পড়তে লাগল। প্রথমে গলে গেল ওর দু-হাত। আস্তে-আস্তে পা, মুখ-চোখ, সমস্ত শরীর। বাচ্চাটা তার স্বরে কাঁদতে কাঁদতে চোখের পলকে তরল হয়ে ছড়িয়ে পড়ল অতনুর কোলের ওপর। ভীতসন্ত্রস্ত অতনু বুঝে উঠতে পারল না মাত্র কি ঘটতে দেখল সে চোখের সামনে। ভয়ে, আতঙ্কে থরথর কাঁপতে শুরু করল।
যে হাতজোড়া দিয়ে বাচ্চাটিকে ছুঁতে গিয়েছিল কম্পমান সেই হাতজোড়া চোখের সামনে মেলে ধরতেই আত্মা উড়ে গেল ওর। গাঢ় লাল রক্তে যে ধুয়ে উঠেছে হাতটা। ভীত দৃষ্টিটা আর নীচে নামানোর সাহস হলো না।
বাইরে কালবৈশাখি ঝড়ের উথালপাথাল হাওয়া উঠেছে। হাওয়ার সাথে পুরো ঘরময় ছড়িয়ে পড়তে লাগল রক্তের উৎকট গন্ধ। গন্ধটা একদম সহ্য করতে পারল না অতনু। তড়িঘড়ি করে নাকে হাত চাপা দিলো। হাতটা তো ভরে ছিল রক্তে। মুখে ছোঁয়ানোর সাথে সাথে সমস্ত মুখমণ্ডলে রক্তের দাগ লেগে গেল। পুনঃ আতঙ্কে বরফের ন্যায় জমে গেল অতনু। রক্তমাখা ওর মুখখানা এত ভয়ানক দেখাতে লাগল! যেন রক্তখেকো কোনো পিশাচ বসে আছে। মাথা ফাঁকা হয়ে আসতে লাগল অতনুর। কি করবে, কি বলবে কিচ্ছু ভেবে পেলো না ও।
তখুনি কোথা থেকে ভেসে আসতে শোনা গেল সুপরিচিত এক কণ্ঠস্বর,
“এ্যাই শুনছ?”
চেনা ডাকে ধড়ফড় করে উঠে বসল অতনু। ঘুমখোলা ঝাপসা চোখে খুব কাছে থেকে দেখতে পেলো আসমার সরল মুখখানা। ঘনঘন কয়েকটা শ্বাস ফেলে চকিতে দৃষ্টি সরিয়ে নিজের হাতের দিকে তাকাল;এরপর পাগলের মতো আশেপাশে চোখ বুলতে লাগল। যেন কিছু খুঁজছে।
সদ্য ঘুমভাঙা অতনুকে এমন অদ্ভুত আচরণ করতে দেখে আসমার ভ্রু জোড়া সংকুচিত হয়ে এলো। কাঁধে হাত রেখে মৃদু ঝাঁকি দিয়ে প্রশ্ন করল,
— কি হয়েছে তোমার? এমন অদ্ভুত আচরণ করছ কেন?
— হু..
ঘোরের মধ্যে অতনু জবাব দিলো। প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে চাইল আসমার পানে। আসমা পুনরায় শুধল,
— বলছি কি হয়েছে?
— ক কিছু নাহ্। ক’টা বাজে? অসময়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম আমি।
— হ্যাঁ তাই তো অবাক হয়েছি। দুপুরে কখনো ঘুমোও না তুমি। শরীর খারাপ নাকি?
চিন্তাগ্রস্তভাবে ও হাত রাখল অতনুর কপালে, গলায়।
অতনু কিছু বলল না। চুলগুলো ব্যাকব্রাশ করে দেয়ালঘড়িতে চোখ বুলিয়ে নিলো।
— লিখন আছে বাইরে?
— আছে তো বোধহয়। গাড়ি মুছতে দেখেছিলাম একটু আগে। কেন ডাকব?
— উঁহু দরকার নেই। আমি নিজে দেখা করে আসছি।
বিছানা ছেড়ে নেমে দাঁড়াল অতনু। আসমা প্রশ্ন করল,
— বাইরে বেরোবে এখন?
— উহ্.. না। তুমি বরং আমার গোসলের পানিটা প্রস্তুত করে দাও আমি আসছি।
সংক্ষেপে জবাব দিয়ে ত্রস্তে বেরিয়ে গেল অতনু। ওর গমন পথে তাকিয়ে চিন্তাযুক্ত শ্বাস ছাড়ল আসমা। মানুষটাকে এত অন্যমনস্ক লাগছে কেন, কি হয়েছে তার? খারাপ কিছু!
এদিকে এলোমেলো গতিতে হেঁটে বাইরে বেরিয়ে এসেছে অতনু। ঘুমের ঘোরটা এখনও কাটছে না তার; কাটছে না দুঃস্বপ্নের স্মৃতি। এ কেমন অদ্ভুত আর বাজে স্বপ্ন দেখল সে। জীবনে তো কখনও দেখেনি। আজ তবে কেন দেখল? স্বপ্নটা এমন অদ্ভুতই কেন? মানেটা কি এর?
“আসসালামু আলাইকুম ভাই”
আঙিনা থেকে বড় করে সালাম ঠুকলে ভাবনা বন্ধ করে লিখনের দিকে তাকাল অতনু। সালাম নিয়ে হাতের ইশারায় ডেকে পাঠাল। লিখন এগিয়ে এলে প্যান্টের পকেট থেকে জিপের চাবিটা বের করে ওর হাতে দিতে দিতে বলল,
— রওনককে চিনিস তো?
— চিনি।
হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল লিখন।
— এক্ষণ ওর কাছে যাবি। গিয়ে বলবি আমি ডেকে পাঠাইছি আর্জেন্ট। এক মিনিট যেন দেরি না করে।
আদেশ করল অতনু।
চাবি হাতে নিতে নিতে কথাটা শুনে বেশ চমৎকৃত হলো লিখন। অতনু আর রওনকের সাপেনেউলে সম্পর্ক অজানা নয় কারোর। সেই অতনুই আজ নিজে থেকে রওনককে ডেকে পাঠাচ্ছে ঘটনা কি! মনে উত্থিত প্রশ্ন যদিও বাইরে আসতে দিলো না।
অতনুই আবার বলল,
— শোন যাকেতাকে গিয়ে আবার জিজ্ঞেস করবি না ওর সম্পর্কে। ঝামেলা হতে পারে। ক্লাবটা চিনিস তো? লালবাগ মোড়ে। আগে ওখানে গিয়া খোঁজ নিবি। না পাইলে ওর সাথে যেসব পোলায় ঘুরে ওদেরকে জিজ্ঞেস করবি। যে করেই হোক ফিরবি ওকে নিয়েই।
— জ্বী আচ্ছা।
পুনরায় মাথা নেড়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল লিখন। রওনককে ওর ভালোই লাগে। বেশ সাহসী একটা ছেলে। অতনুর এখানে কাজ না পেলে অবশ্যই ও রওনকের সাথে কাজ করতো। ভালোই হতো বিষয়টা।
গাড়ি নিয়ে লিখন বেরিয়ে যাওয়ার পরও ওখানে অনেকটা সময় দাঁড়িয়ে রইল অতনু। আজ প্রথম নিজের কোনো কাজে রওনককে ডেকে পাঠিয়েছে। কে জানে আসবে কি না! আসবে বোধহয়। চৌকস ছেলে রওনক। বুঝতে সমস্যা হওয়ার কথা নয় কেন ডাকছে।উদ্দেশ্যটা আসলেই বিরাট।
রাজনীতিতে আসার পর বিগত কয়েক বছর যাবৎ একটাই স্বপ্ন দেখে এসেছে অতনু, তা হলো এই আসনের সাংসদ হওয়া। মন্ত্রীত্ব লাভ করা। দিন গেছে স্বপ্নের পথে হাঁটার জন্য নিত্য নতুন কাজে নিজেকে যুক্ত করেছে যা আদতে তার করার কথা ছিল না৷ কত-শত পরিশ্রম করেছে, ত্যাগ স্বীকার করেছে। একেকসময় হয়ে থেকেছে নিজাম চৌধুরীর হাতের পুতুল।তবেই না লোকটার শতভাগ বিশ্বস্ততা অর্জন করতে পেরেছে।
কিন্তু আজ এতদিন পর, নিজের স্বপ্নের এতখানি কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়ার পর হঠাৎ করে তাকে শুনতে হচ্ছে, একটু একটু করে যে স্বপ্নে প্রতিনিয়ত সে বেঁচেছে সেই স্বপ্নটা দেখা নাকি বন্ধ করে দিতে। যে ক্ষমতা লাভের আশায় এতটাদিন তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষা করেছে সে ক্ষমতা চোখের সামনে অন্য কারোর হাতে স্থানান্তরিত হয়ে যাবে। কারণ? কারণ সে মন্ত্রীর বংশধর!
নাহ্, এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল না। এই অঘটন কিছুতেই ঘটতে দিতে পারে না অতনু। চোখের সামনে নিজের স্বপ্নকে ভেঙে যেতে দেখতে পারে না। লক্ষের এতটা কাছে পৌঁছে লক্ষ্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারে না।
যা হয় হোক। যে সফলতার পেছনে এতটাদিন যাবৎ শ্রম লাগিয়েছে, চড়াই-উতরাই ভেঙে একটু একটু করে হেঁটে এসেছে তাকে নিজের নাম না দেয়া অবধি শান্তি নেই।
আর এ কাজটা তার একার পক্ষে করা সম্ভব নয়। এতটুকু দূরত্ব আর একা মেটানো সম্ভব নয়। শেষ পর্যায়ে এসে তার রওনকের সাহায্য খুব করে প্রয়োজন। রওনকের মধ্যে নিজের আরেকটা ছায়া দেখতে পায় অতনু। ও জানে এই ছায়াটার দ্বারা কোনো কিছুই অসম্ভব নয়। কোনো কিছু না।
চলবে,
Sinin Tasnim Sara