চিঠি দিও
২৩
“এখনও আমার বাবার খোঁজ পাননি আপনারা? দেখতে দেখতে চারটে দিন পার হয়ে গেল। আর কত অপেক্ষা করব!”
কান্নায় রোধ হয়ে আসা কন্ঠস্বরকে সামলে নিতে বড় করে শ্বাস টানল বকুল। অবদমিত মস্তক সোজা করার পূর্বে এক ফাঁকে ওড়নার কোনটা অশ্রুতে টইটম্বুর চোখের কোলে চেপে ধরল সতর্ক হাতে৷
আহত চাহনিতে দৃশ্যটা অবলোকন করে হাতের আঙুলগুলো দিয়ে কপালের দু ধার চেপে ধরল মিজান। নিজেকে এত অসহায় কভু লাগেনি তার। ছোট্ট পরিধির জীবনটাতে কত ঝড়ঝাপটা বয়ে গেছে, কত কঠিন কঠিন সময়ে সে থেকেছে অবিচল। পাথরের মূর্তির মতো ভাবহীন,অনুভূতিহীন। যেন রক্ত মাংসের মানুষ নয়, বরং নিশ্চল জড় পদার্থ। তবে আজ সেই কঠিন ভাবমূর্তিটার কি হলো? অনতিদূরে বসা ভীষণ পরিচিত মেয়েটার এভাবে আপ্রাণ অশ্রু লুকোনোর চেষ্টা তাকে হঠাৎ এমন দুর্বল করে দিচ্ছে কেন! অজ্ঞাতে পাথুরে মূর্তি যেন ভেঙে গুড়িয়ে মাটিতে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। সহসা উঠে দাঁড়িয়ে বার দুয়েক পায়চারী করে নিজের অস্থিরতা কমানোর চেষ্টা করল মিজান। বারংবার বকুলের দিকে ভরসার হাত বাড়াতে গিয়ে নিজেকে গুটিয়ে নিলো। ঠোঁটজোড়া কিঞ্চিৎ নড়ে উঠল কিছু একটা বলবার অভিপ্রায়ে। সম্ভব হলো না। নিজের ওপর রাগ হলো মিজানের। ছোট্ট ক্লাবঘরটায় উপস্থিত সঙ্গী-সাথী ছেলেগুলো প্রিয় বড় ভাইটির অস্থিরতা দেখে অবাক হলো বৈকি! চোখ বড় বড় করে একে অপরের দিকে তাকিয়ে ইশারায় অস্থিরতার কারণ অনুধাবনের চেষ্টা করল। কতটুকু পারল কে জানে!
“আমার ভাই কোথায়? ডাকুন তাকে। সে তো আমাকে ওয়াদা করেছিল সব বিপদাপদে ছায়ার মতো পাশে থাকবে। তবে আজ কেন তাকে পাশে পাচ্ছি না। কেন সে আমার বাবার খোঁজ এনে দিতে পারছে না? জিজ্ঞেস করতে চাই আমি তাকে”
মিজানের পায়চারী থামল বকুলের দ্বিতীয় কথাটা শুনে। অশুষ্ক জিভ দ্বারা শুকনো ঠোঁট ভিজিয়ে বলল,
— দেখ বকুল তোমার আব্বাকে খুঁজার পসিবল সব চেষ্টাই আমরা করতেছি। যতটা আয়ত্তে সব জায়গায় লোক পঠানো হয়া গেছে। আশা রাখতেছি এই সপ্তাহের মাঝে উনার খোঁজ পায়ে যাব। একটু খালি অপেক্ষা..
কথা শেষ করতে পারল না মিজান, তার পূর্বে ফুঁসে উঠল বকুল,
— আর কত অপেক্ষা! আর কত? সমস্ত ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে আমার মিজান ভাই।
বাড়িতে অসুস্থ মা,ছোটো ভাইটা;কারোর মুখের দিকে তাকাতে পারি না। সকাল বিকেল তাদের একটাই প্রশ্ন বাবা কখন ফিরবে! কি জবাব দেব আমি তাদের বলতে পারেন?
— শোনো বকুল..
অস্থিরতায় কথা গুছিয়ে উঠতে পারল না মিজান। ঘড়ঘড় শব্দে চেয়ার টেনে বকুলের মুখোমুখি বসল। হাঁটুতে কনুই ঠেকিয়ে বলল,
— আমি নিজে গেছিলাম তোমার দাদাবাড়ী। একরাত থেকে পুরা এলাকা আঁতিপাঁতি করে খুঁজছি। পাওয়া যায়নাই ওনাকে। যাদের সাথে ঘুরতো তাদের সবাইকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ শেষ। আমরা তো আমাদের মতো খোঁজ চালাইতেছি, পাশাপাশি রওনক পুলিশের সাথে যোগাযোগ করছে। এতগুলা মানুষ আমরা ওনার পেছনে, কেউ না কেউ তো হদিস পাবই।
রক্ত-মাংসের একটা মানুষ হাওয়ায় তো আর মিলায় যাইতে পারে না। তুমি একটু ধৈর্য ধরো।
— আমি পারছি না যে।
অসহায়ভাবে কথাটা বলে দু’হাতে মুখ ঢেকে ফেলল বকুল।
তা দেখে ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে একজনকে ইশারা করল মিজান,পানি নিয়ে আসার জন্য।
হুকুম পাওয়ামাত্র ছেলেটা ছুটল পানির খোঁজে।
মিজানের খুব ইচ্ছে করল ক্রন্দনরত বকুলের মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দেয়। গুছিয়ে দুটো ভরসার কথা বলে। কিন্তু কিসের একটা জড়তা তাকে দুর্বোধ্য জালের মধ্যে আটকে ফেলল। ইচ্ছে অপূর্ণ রয়ে গেল।
পানির বোতল হাতে ছেলেটা ফিরল দ্রুত। লেবেল খুলে ছিপি আলগা করে বোতলটা বকুলের দিকে বাড়িয়ে দিলো মিজান। চোখ মুছে, নাক টেনে কান্নাটা গিলে নিয়ে পানির বোতল হাতে নিলো বকুল। দুই কি তিন চুমুক দিয়েছে তখনই নৈশব্দিক প্রকৃতির নিস্তব্ধতা ভেঙে হোন্ডা পিটিয়ে ক্লাবের বাইরে উপস্থিত হলো রওনক। পরিচিত হোন্ডার শব্দে সকলে একটু নড়েচড়ে বসল। মিজান এবং বকুল দু’জনেই উৎসুক দৃষ্টিতে তাকাল দরজার দিকে।
ক্লাবে বকুলের আগমন চমৎকৃত করল না রওনককে। হোন্ডার চাবিটা পকেটে পুরে ঠান্ডা দৃষ্টিতে পুরো ঘরে একবার চোখ বোলালো। ছেলেপেলেরা তো সালামের তুবড়ি ছুটিয়েছে। শান্তভাবে সালামের জবাব দিয়ে হাত নেড়ে সকলকে প্রস্থানের ইঙ্গিত করল রওনক। থাকল শুধু সে, বকুল আর মিজান। রওনক এলে চেয়ারটা ছেড়ে দাঁড়ালো মিজান। ওর দেখাদেখি বকুলও। রওনক বকুলকে পুনরায় বসতে ইশারা করে চেয়ার টেনে নিলো নিজের কাছে।
বসতে বসতে নরম গলায় বলল,
— তোমাকে তো বলেছি যে করেই হোক তোমার আব্বাকে খুঁজে এনে দেব। ভাইয়ের ওপর বিশ্বাস নেই?
— বিষয়টা সেরকম নয় ভাইয়া।
ইতস্ততভাবে কান্নামাখা গলায় বলল বকুল। রওনক একদৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে। কি মনে করে এগিয়ে গিয়ে মাথায় হাত রাখল। ভরসার হাত পেয়ে ভাইয়ের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল বকুল। এবার আর কান্না পেলো না। উথলে উঠতে চাওয়া কান্নার বেগটা হুট করে প্রশমিত হয়ে গেল। কেবল অস্পষ্ট স্বরে সে বলল,
— আমার এত ভয় লাগছে কেন ভাইয়া? কেন মনে হচ্ছে কিছু একটা ঠিক নেই। খারাপ কিছুর আভাস পাচ্ছি।
রওনক ওর কথায় তাল মেলালো না। স্পষ্ট সুরে ভরসা দিয়ে বলল,
— আজেবাজে কথা একদম চিন্তা করবে না। তোমার ভাই বেঁচে থাকাবস্থায় খারাপ কিছুই তোমাদের স্পর্শ করতে পারবে না। দুইটা দিন আর সময় দাও আমাকে। বিশ্বাস রাখো ভাইয়ের ওপর। সব আগের মতো করে দিব৷
এবারে খানিক নরম হলো বকুল। সোজা হয়ে বসে মাথা নাড়লো। তা দেখে রওনক কিঞ্চিৎ ঠোঁট প্রসারিত করল। ওরা কেউ দেখল না পেছনে আরেকজনও নির্ভার হয়ে খানিক হাসতে পেরেছে।
বকুলের সাথে আরও কিছুটাক্ষণ গল্প করে মিজানের সাথে ওকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিলো রওনক। সাথে দিলো হোন্ডার চাবি। মিজানের মনের ভেতর এমনকিছুই ঘুরছিল। বন্ধুর থেকে হুকুম পাওয়ায় খুশিই হলো সে। প্রসন্নতায় তার হাসি গাঢ় হলো। সহাস্যে চাবি হাতে নিয়ে এগিয়ে গেল হোন্ডার দিকে। ভাইয়ের থেকে বিদায় নিয়ে বকুলও ধীরপায়ে এগলো বাইরে। ইদানিং তার ভীষণ ইচ্ছে করে ভাইদের সাথে গিয়ে থাকবে। একসাথে, এক বাড়িতে বড় ভাই, ছোটো ভাই সবার সাথে মিলেমিশে। ভাইয়েরা তাকে অসম্ভব ভালোবাসে ও স্নেহ করে তা বকুল জানে। বুঝ হওয়ার পর থেকে বাবা-মায়ের ভালোবাসার পাশাপাশি ভাই-বোনের ভালোবাসার ভীষণ অভাববোধ করেছে বকুল। একসময় এত আফসোস করেছে বাবা-মায়ের বড় সন্তান বলে! পরবর্তীতে যখন মায়ের জীবনের নোংরা সত্যগুলো বাইরে বেরিয়ে এলো, প্রথমে মানতে পারেনি। একসময় ভাইদের সাথে দেখা হলো, ভাইদের সান্নিধ্য পেলো তখন মনের বরফটা কীভাবে যেন গলতে শুরু করল। এখন ভাইদের জন্য ওর এত মায়া হয়! মনে হয় কেন তাদের বাবা আলাদা হলো। বাবাও যদি এক হতো, অভিন্ন একটা পরিবার পেতো সে আর বিহন। তিন ভাইয়ের আদরের বোন হতো । কিন্তু এসব শুধু স্বপ্ন। চাপা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে পিছু ফিরে ছোটো ভাইয়াকে আরেকবার দেখে নিলো বকুল। স্মিত হাসি ঠোঁটে ফুটিয়ে হাত নেড়ে বিদায় জানালো রওনক।
ওদিকে হোন্ডায় উঠে নিজের মধ্যে একটা ভাব এসে গেছে মিজানের। ঠোঁটের কোণের হাসিটা সরছেই না। একফাঁকে ভিউ মিররটা হাত দিয়ে নেড়েচেড়ে ঠিক করে নিলো মিজান। ছোট্ট আয়নায় চট করে প্রতিফলিত হলো রওনকের ছোট্ট অবয়ব। অজান্তে রওনক দেখে ফেলল ওর হাসি। এই হাসির অর্থ একটু ভিন্ন। ভ্রু জোড়ায় কুঞ্চন লাগল রওনকের। তা দেখে তৎক্ষনাৎ মিজান হাসি বন্ধ করল। একটুখানি কেশে বকুলকে ইশারা করল। বকুল আর সময় নিলো না। হোন্ডায় উঠে বসলে সাঁ করে বেরিয়ে গেল মিজান।
ওদের যাওয়ার পরও দুহাত পকেটে পুরে কিছুটা সময় রওনক চৌকাঠে দাঁড়িয়ে রইল। মস্তিষ্কে একসাথে অনেকগুলো চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। বকুলের বাবার অকস্মাৎ অন্তর্ধান, মিজানের পরিবর্তন, অতনুর বিষয়টা। সব জটলা পাকিয়ে এক হয়ে যেতে চাইছে। নাহ্ এক তো তাদের হতে দেয়া যাবে না।
একটি রেললাইন দিয়ে একসাথে অনেক রেলগাড়ী কখনোই চলতে পারে না। এতে নিশ্চিত দুর্ঘটনা। আলাদা আলাদা রেলগাড়ীর জন্য যেমন আলাদা আলাদা রেলপথ, তেমন আলাদা আলাদা চিন্তা ধারারও ভিন্ন ভিন্ন পথ করে দেয়া উচিৎ। সাজানো-গোছানো পথ। চিন্তারা সহজে বিকশিত হতে পারবে এতে।
কাঁধ উঁচু করে বাইরেটায় শীতল দৃষ্টি বুলিয়ে ভেতরে ফিরে গেল রওনক। তিনসিট সোফাটায় গা এলিয়ে দিয়ে শার্টের ওপরের দুটো বোতাম খুলে দিলো। উদম বুকে হাওয়া লাগিয়ে জট পাকানো ওর মস্তিষ্ককে শান্ত করার চেষ্টা। অদ্ভুত! শরীর আর মস্তিষ্কের চিন্তাধারার মিল কোথায়? হয়তো আছে, হয়তো নেই।
পায়ের ওপর পা তুলে একটা পা নাড়াতে নাড়াতে চোখজোড়া বুঁজে নিলো রওনক। বন্ধ চোখে চিন্তার গভীরতা বেশি টের পাওয়া যায়।
চিন্তাধারায় বেশি সময় ব্যয় অবশ্য সম্ভব হলো না ওর পক্ষে। সজাগ ঘ্রাণেন্দ্রিয়ে অচীরেই প্রেয়সীর দেহের সুবাস রন্ধ্রে রন্ধ্রে চঞ্চলতার তন্তু ঢুকিয়ে দিলো। চট করে চোখ মেলে চাইতেই নজরে এলো একগুচ্ছ লিলুয়া বাতাসে ভর করে প্রেমময় আমেজ নিয়ে তার প্রিয়তমা চৌকাঠে পা রেখেছে। তড়াক করে উঠে বসল রওনক।
ওদিকে ভর দুপুরের তপ্ত রোদে ঘামে ধুয়ে ওঠা শরীর আর অবর্ণনীয় ক্লান্তি নিয়ে কোনোরকমে পা টেনে রওনকের পাশে গিয়ে বসল উপমা৷ ব্যাগের সাইড পকেট থেকে নরম রঙের চারভাঁজ রুমাল বের করে আলতো হাতে সমস্ত মুখমণ্ডলের ঘাম মুছতে মুছতে রওনকের উদ্দেশ্যে বলে উঠল,
— একটু পানি দিন তো। উফফ এত গরম! আজকালের আবহাওয়া মোটেই বুঝে উঠতে পারি না। এই রোদ তো এই বৃষ্টি। বৃষ্টি হলে কঠিন বৃষ্টি, রোদ হলে ঝলসে দেয়া রোদ।
রওনকের বিস্ময় এখনও কাটেনি। তবে বিস্ময়টাকে আড়াল করতে ও ঠিক জানে। সময়ক্ষেপণ না করে টেবিলের ওপর থেকে কিছুক্ষণ পূর্বের আনা বোতলটা উপমার হাতে ধরিয়ে দিতেই এক চুমুকে সবটা পানি শেষ করে ফেলল উপমা। শেষ করে ক্লান্ত চোখে রওনকের পানে চেয়ে মিষ্টি করে হাসলো। বিনিময়ে রওনক ওর পাশে এসে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
— হুট করে আগাম বার্তা না দিয়ে এলে। জানলে কীভাবে আমি এখানে?
— আপনাকে গলিতে ঢুকতে দেখেছি তো। একটু আগে যখন হোন্ডা করে আসছিলেন তখন বন্ধুরাসহ জয় বাংলার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম।
হেলে গিয়ে রওনকের বুকে জায়গা করে নিলো উপমা। একহাতে ওকে আগলে নিয়ে কোমল স্বরে রওনক বলল,
— বড্ড দুঃসাহসিক কাজকারবার করো তুমি আজকাল। ধরা পড়ে যাওয়ার ভয় করে না?
— উমম করে না বললে ভুল হবে। কিন্তু যখনই ভয় করে তখন ভাবি আমার প্রেমিকও কি কম যায়! এদিকসেদিক হলে ঠিক কোমরে গোঁজা ঐ পিস্তলটা নিয়ে বাঁচাতে আসবে আমাকে।
উপমার কথায় হেসে ফেলল রওনক। চিবুক হাত রেখে মুখটা তুলে চোখে চোখ রেখে বলল,
— তোমার সেজো ভাই তো আমার চাইতেও কঠিন চিজ। ওর নজরে এসে গেলে আস্ত রাখবে আমাদের?
— সেজো ভাইয়ের বিষয়টা চিন্তা করিনি। ওঁর কথা ভাবতে গেলে মাথা জট পাকিয়ে যায় আমার। একবার ভাবি প্রেম করছি আবার সাহসী হব না? জানেন তো ভালোবাসতে হলে অসীম সাহসের প্রয়োজন হয়।
— তাই নাকি!
ঠাট্টার সাথেই বলল রওনক। তবে উপমা ওর ঠাট্টাটা বুঝতে পারল কি না কে জানে! উদাস কন্ঠে বলল,
— আমি ভবিষ্যৎ ভাবা মেয়ে। সবকিছুর উর্ধ্বে ভবিষ্যৎটা কি হবে সেই চিন্তা আগে আসে। কিন্তু আমাদের বিষয়টা নিয়ে কেন যেন ভবিষ্যতের ভাবনা ভাবতে ইচ্ছে করে না। সব ধূসর ধূসর লাগে। পথ খুঁজে পাই না।
উপমার দুশ্চিন্তা পুরোটাই বুঝতে পারে রওনক। ঠাট্টা করতে আর ইচ্ছে করে না। বরং আঙুল সরিয়ে চিবুকের ওপর সিগারেট পোড়া ঠোঁটজোড়ার আলতো স্পর্শ এঁকে দিয়ে বলে,
— ভবিষ্যৎ নিয়ে বেশি মাথা ঘামাতে যাবে না মেয়ে। ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। ও শুধু দুশ্চিন্তা আর হতাশা বাড়াতে জানে। নিশ্চিত তো তোমার বর্তমান। প্রত্যেকটা মুহুর্তকে এমনভাবে বাঁচো যেন কোনো আক্ষেপ না থাকে। ভবিষ্যতের পরিকল্পনায় সময় নষ্ট করে লাভ আছে? রেলগাড়ীর বগির মতো একের পর এক পরিকল্পনা সাজাতেই থাকবে। কোনো কারণে তা বাঞ্ছাল হয়ে গেলে সেই হারটা মেনে নিতে পারবে না। কি হবে যা অদূর তাকে নিয়ে ভেবে? যা তোমার হাতের নাগালে তাকেই আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে রাখো না।
— রাখব?
রওনকের পানে চেয়ে দুষ্টুমি ভঙ্গিমায় বলে উঠল উপমা। রওনক ধরতে পারল ওর দুষ্টুমি। নিজেও মজা পেলো। একপাশে মাথা হেলিয়ে বলল,
— অবশ্যই। একদম আষ্টেপৃষ্টে কিন্তু।
রওনকের ইশারা বুঝতে দেরি হলো না উপমার। প্রশস্ত হাসি হেসে দু’হাতে ঠেলে দিলো ওকে। পাশে থেকে একটা শপিং ব্যাগ তুলে রওনকের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
— খুলে দেখুন তো পছন্দ হয় কি না। বান্ধবী আমার হাতের কাজ শিখছে। ওকে দায়িত্ব দিয়েছিলাম পাঞ্জাবি কিনে সুতোর কাজ করে দিতে। আজ এতদিনে কমপ্লিট করল কাজটা।
রওনক অবাক হয়ে ব্যাগ হাতে নিলো। বলল,
— হঠাৎ পাঞ্জাবি কেন?
— আমার আরেক বান্ধবী মিতালির বিয়ে আগামী সপ্তাহে। এই পাঞ্জাবি পরে আপনি আমার সাথে যাবেন।
পাঞ্জাবিটা বের করে রওনক দেখল সফেদ জমিনের পাঞ্জাবি। পুরোটা জুড়ে কোনো কাজ নেই। কেবল বাঁ দিকে লম্বা করে লাল এবং পেস্ট কালার সুতো দিয়ে লতানো ফুল টাইপ কিছু আঁকানো হয়েছে। নুয়ে পড়া কচি ডালগুলোকে এক পলক দেখলে মনে হবে চেইন সিস্টেমে তিনটে প্রশ্নবোধক চিহ্ন লম্বা করে বুঝি জুড়ে দেয়া এবং ওদের মাথায় সাত পাপড়ির লাল গুটি গুটি ফুল। নাহ্ ডিজাইনটা মন্দ নয়। সাধারণের মধ্যে অসাধারণ। পাঞ্জাবিটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে দেখতে রওনক শুধল,
— আমার মাপ পেলে কি করে তুমি? দেখে তো মনে হচ্ছে একদম গায়ের মাপেরই হবে।
এ প্রশ্নের উত্তরে সরোষে উপমা বলল,
— মাপ আমাকে দিতে হবে? হোন্ডা পিটিয়ে নায়ক সেজে ঘুরে বেড়ান। একেকটা তো চোখ দিয়ে ইঞ্চি ইঞ্চি মাপে আপনাকে। নিজে নিজেই বানিয়ে দিয়েছে।
— সেকি! আমি বুঝি এত ফেমাস তোমার বন্ধু মহলে?
অবাক হওয়ার ভান করলেও উপমা জানে রওনকের এসব অভিনয়। ঈর্ষান্বিত উপমাকে দেখে ওর নিশ্চয়ই আনন্দ হচ্ছে। অবচেতনে একা একাই বিড়বিড় করল উপমা,
— মাপবে না আবার। পাঞ্জাবি পরলে চোখ ফেরানো যায় কি! কথার ফাঁকে যখন হাতা গোটাতে শুরু করে দৃশ্যটা একদম কলিজায় গিয়ে লাগে।
রওনকের কানে ওর কথাগুলো গেল না। ও এখনও জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে উপমার মুখপানে। ভাবনা বন্ধ করে উপমা ওর হাত থেকে পাঞ্জাবিটা নিলো। মুখ ফুলিয়ে বলল,
— না জানার ভান করবেন না। সব জানেন আপনি, সব।
পরিস্থিতি গম্ভীর হয়ে যাচ্ছে দেখে কথা ঘোরানোর চেষ্টা করল রওনক। শুধল,
— আমাদের সম্পর্কের বিষয়টা জানিয়ে দিয়েছ তোমার বন্ধুদের?
— উঁহু। কীভাবে যেন একা একাই জেনে গেছে ওরা। শুরু থেকেই সন্দেহ করতো। মাঝখানে যে পাগলামি শুরু করেছিলেন। কলেজ যাওয়ার আগে প্রতিদিন নাকি গান শুনিয়ে যেতে হবে। নিজেই সন্দেহের বীজ বপন করে দিয়েছেন ওদের মধ্যে।
— আমাদের সম্পর্কটা বোধহয় ওপেন সিক্রেট হয়ে গেছে। জানে অনেকেই, মুখ খোলে না।
— আমারও তাই মনে হয়।
— এতে করে তোমার ভাইয়ের কানে যেতে বেশি সময় লাগবে না। নাহ্ বিষয়টা বাড়াবাড়ি হওয়ার আগে ফুলস্টপ লাগিয়ে দিতে হবে।
— মানে?
— দেখি আমি চিন্তাভাবনা করে। আপাতত আমাদের ঘনঘন দেখাসাক্ষাৎ না হওয়াই ভালো উপমা। শুধু ফোনে কথা হবে। কেমন?
রওনকের কথায় অবাক হয়ে ওর দিকে তাকাল উপমা। মুখভঙ্গিতে মনে হচ্ছে রওনক সিরিয়াস। একটু থেমে পুনরায় রওনক বলল,
— সম্পর্কের ভেতর রাজনৈতিক জটিলতা ঢুকলে সমস্যা। এখনও পরিস্থিতি অস্থিতিশীল। অনেককিছু আমার হাতের মুঠোয় থেকেও নেই। তোমাকে গুটি বানিয়ে কেউ চাল দেয়ার চেষ্টা করুক এটা আমার মোটেই ভালো লাগবে না।
বলা বাহুল্য উপমার এসব গণতন্ত্র-রাজতন্ত্রে কখনোই কোনো আগ্রহ জন্মায়নি। হয়তো জন্মাবেও না। তবে ওর জীবনের পরতে পরতে যে রাজনীতির মারপ্যাঁচ জড়ানো এ সত্যিকে অস্বীকৃতিও জানাতে পারবে না। ওর জীবনের মূল ভূমিকার দুই পুরুষই তো এই লাইনে অবস্থান করছে। একজন ওর পরিবার, ওর আপন ভাই;দ্বিতীয়জন ওর ভবিতব্য। চাইলেও ক্ষেত্রটাকে ও এড়িয়ে যেতে পারবে না জানে। এতদিনে প্রথমবার তাই একটুখানি আগ্রহ থেকে ও জিজ্ঞেস করল,
— আচ্ছা সেজো ভাইয়ের সাথে আপনার সম্পর্ক কেমন? সেদিন যে ওঁ ডেকে পাঠালো। জরুরি কোনো কাজে?
রওনক জানতো এই প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। বিচলিত হলো না। বরং মাথায় হাত বুলিয়ে বেশ স্বাভাবিক গলায় বলল,
— সম্পর্ক খারাপ নয়। ডেকেছিল তো কাজেই। তবে তোমার ওসবে মনোযোগ দেয়ার প্রয়োজন নেই। তুমি বরং বান্ধবীর বিয়ের ব্যাপারে ভাব। কার সাথে যেন বিয়েটা হচ্ছে ওর?
— আমাদেরই আরেকটা বন্ধু সাজু। কয়েকদিনের বন্ধুত্বে প্রেম হয়ে গেল দুটির। এত সাহস! সরাসরি বাসায় জানিয়ে দিলো। কীভাবে কীভাবে যেন মেনেও গেল ওদের বাবা-মা। কি ভাগ্য তাই না?
— ভাগ্য তো বটে। আমি ভাবছি তোমার বয়সী দুটো ছেলে-মেয়ের কি সুন্দর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। তুমি কবে বিয়ের বাজারে নামতে চাইছ?
রওনকের কথায় লজ্জা পেয়ে গেল উপমা। মেদুর গাল দুখানা হয়ে উঠল রাঙা। ওর হাতে মৃদু চাপড় দিয়ে বলল,
— ইশশ কি যে বলেন না!
প্রিয়তমার লাজরাঙা মুখখানা দেখে সশব্দে হেসে উঠল রওনক। চিবুক ধরে মোহাচ্ছন্ন হয়ে বলল,
— আমার প্রিয়তমা কি জানে লজ্জা পেলে তাকে কতখানি মিষ্টি লাগে?
রওনকের এই একটা কথায় উপমার লজ্জার পারদ অন্তরীক্ষ ছুঁয়ে ফেলল। লজ্জার হাত থেকে বাঁচতে হাত সরিয়ে উঠে জানালার কাছে চলে গেল সে।
প্রেমিক পুরুষটা তার হার মানার মানুষ নয়। পথ অনুসরণে সেও গেল পিছুপিছু। গরাদে রাখা প্রিয়তমার কোমল হাতের ওপর হাত রেখে আচমকা বলে উঠল,
— আমাকে বিয়ে করবে উপমা?
হতবিস্ময়ে চোখ বড় বড় করে তার দিকে ফিরে চাইল উপমা। শুরুতে কথা জোগাল না মুখে। একটুখানি ধাতস্থ হয়ে ক্ষীণস্বরে বলল,
— পরিবারের অমতে নয়।
এমন উত্তরই আশা করেছিল রওনক। ধারণা মিলে যেতে বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো ওর। প্রিয়তমা কি জানে ওদের এক হওয়ার পথটা কি ভীষণ কঠিন! পুরোটাই প্রাণঘাতি বিষ কাঁটায় সুসজ্জিত। বিষকাঁটাগুলো মাড়িয়ে ওদের এক হওয়া কেবল অদৃষ্টের হাতে।
ভবিষ্যতের আশংকায় বুকে কাঁপন ধরলে তা প্রশমিত করতে চট করে উপমাকে বুকে টেনে নিলো রওনক। পালকস্পর্শের মতো মাথার তালুতে চুমু খেয়ে বলল,
“আমার কাছে কেবল তোমার মতামতই শিরোধার্য”
_____________________
সময়টা পড়ন্ত বিকেল। কুসুমরঙের সূর্যটার বিস্তৃতি আকাশজুড়ে অবিচল থাকলেও ফিঁকে হয়ে আসা রৌদ্রের তাপ তেমন গায়ে লাগছে না। বাড়ির সামনে লনে সিমেন্ট দিয়ে ছোট্ট ছাউনির মতো বানানো। সুসজ্জিত ছোট্ট গোল টি টেবিল আর দুদিকে দুটো বেতের সোফা বসিয়ে সকাল-বিকেলের চা-আড্ডার ব্যবস্থা করা হয়েছে এখানে। শখের জায়গাটায় মুখোমুখি বসে চায়ের কাপে অল্প অল্প চুমুকের সাথে বাপ-ছেলে রাজ্যের গল্পের ঝুড়ি নিয়ে বসেছে, পিতৃ সত্ত্বার অনুভূতি হওয়ার পর থেকে এমন দৃশ্য মানসপটে হাজার বার অঙ্কিত করেছেন নিজাম সাহেব। বাস্তবে প্রতিফলন যদিও দেরিতে হচ্ছে তবে শেষ পর্যন্ত অপূর্ণ স্বপ্নটা পূরণ হতে দেখে তার যে কি আনন্দ হচ্ছে বলে বোঝানো সম্ভব নয়।
হাতের পেপারটা টি টেবিলের ওপর রেখে বাড়ির ভেতর থেকে আগত ছেলের দিকে দৃষ্টি রাখলেন নিজাম সাহেব। উচ্চতায় ছেলেটা তাকেও ছাড়িয়ে যায়। বেশ মেইনটেইন করা শরীর। তরতরে নাক, চওড়া কপালের ক্লিনশেভ উজ্জ্বল মুখে সৌম্যভাব বিদ্যমান। চোখের চশমার কারণে যদিও গম্ভীর গম্ভীর লাগে। তবে চশমা খুললে গাম্ভীর্য বোঝা যায় না। ছেলে সুদর্শন হওয়ার পেছনে মায়ের জিনের প্রভাব রয়েছে। মানতে হবে শওকতের মা ভীষণ ভীষণ সুদর্শনা একজন মহিলা ছিলেন। ছিলেন শিক্ষিতা, রুচিশীল। ছেলে পুরো মায়ের পথেই হেঁটেছে। এই এতখানি সুপুরুষ একটা ছেলে যে তার আছে মাঝেমধ্যে বিশ্বাসই হতে চায় না নিজাম সাহেবের।
ভাবনার মধ্যে চায়ের ট্রে হাতে ছাউনির নীচে উপস্থিত হয়ে গেল শওকত চৌধুরী। ট্রেটা টেবিলের ওপর রাখতে রাখতে বলল,
— আপনার রিপোর্ট চলে এসেছে। মাত্র চেইক করে এলাম। সুগার তো ভয়ানক মাত্রায় বেড়ে গেছে। তার মানে আমার বানিয়ে দেয়া ডায়েট চার্ট একদমই ফলো করছেন না আপনি।
ছেলের কাছে ধরা খেয়ে মুখ কাচুমাচু করে ফেললেন নিজাম সাহেব। আমতাআমতা করে বললেন,
— ও-ই আরকি কয়েকদিন পার্টি মিটিংয়ের কারণে..
— এসব অনিয়ম একদমই বরদাস্ত করব না আমি বাবা। আজ থেকে আপনার সুইটস খাওয়া একদমই বন্ধ। ইভেন ডায়েট চার্টটাই আমি পাল্টে দেব ভাবছি। নতুন ফুড চার্ট ফলো করে খাবেন। শুধু খাবার নয় নিয়ম করে ঔষধ, এক্সারসাইজ সব করতে হবে। এমনিতেই চেহারাটা দিনকে দিন খারাপ হয়ে যাচ্ছে আপনার।
চিন্তাগ্রস্ত ছেলের শাসনে আপ্লুত নিজাম চৌধুরীর চোখজোড়া যেন ভিজে আসতে চাইল। আজ এতদিন পর উপলব্ধি হচ্ছে সন্তানগুলোকে অতদূরে না পাঠালেই ভালো হতো। নষ্ট জীবনটায় যত্ন-ভালোবাসা সব বেলাশেষে পেতে হচ্ছে। হোক না, তবুও তো পাচ্ছে। এর আগে এমন কিছু আশাও করেনি কখনো।
আরও কয়েকটা নিয়ম-অনিয়মের কথা বলতে বলতে কেটলি থেকে কাপে গরম পানি ঢেলে চা বানানোয় মনোযোগী হলো শওকত। লিকার দিয়ে হাতের মুঠোয় ধরে রাখা ছোট্ট কাঁচের শিশির লেবেল খুলে বাবার অলক্ষ্যে ভায়াল উপুড় করে ভেতরের তরলটা সম্পূর্ণ মিশিয়ে দিলো চায়ের কাপে। ছেলের ভালোবাসার চাদরে ঢেকে যাওয়া নিজাম চৌধুরীর অভিজ্ঞ চৌকস দৃষ্টিজোড়া ধারণাও করতে পারল না নামহীন কোনো তরল অজান্তে তার জন্য গরলে রূপান্তরিত হতে পারে।
চা বানানো শেষে বাবার হাতে চায়ের কাপটা তুলে দিতে দিতে শুওকত বলল,
— আগামীকাল থেকে আমার ডিউটি শুরু। আমার অলক্ষ্যে একদম অনিয়ম করবেন না। মনে থাকবে?
— থাকবে বাবা, থাকবে। কত শাসন করছিস বুড়ো বাপটাকে।
সহাস্যে চায়ের কাপ টেনে নিয়ে ওতে চুমুক বসালেন নিজাম সাহেব। বাবার প্রসন্ন মুখমণ্ডলে দৃষ্টি বুলিয়ে রহস্যমাখা গলায় শওকত বলল,
— শাসন তো ভালোবাসারই আরেক বহিঃপ্রকাশ বাবা। এতদিন আপনার সাথে অনেক অন্যায় করেছি। তার জন্য আমি অনুতপ্ত। জানি না ক্ষমা করতে পারবেন কি না। তবে এখন সব মিটিয়ে নেব বলেই এসেছি।
— অন্যায় তো আমিও তোদের সাথে কম করিনি। ক্ষণস্থায়ী জীবনে ওসব মনে রেখে কি লাভ। তারচেয়ে যতদিন বেঁচে আছি বাপ-ছেলে এক হয়ে আনন্দেই কাটাই।
সহাস্যে শওকত মাথা নাড়ল। নাকের ডগা থেকে চশমাটা ঠেলে উপরে উঠিয়ে বলল,
— ডোন্ট ওয়ারি বাবা। আই’ল বি দেয়ার; আই’ল বি দেয়ার টিল দ্য এন্ড অফ ইওর লাইফ। ইটস মাই প্রমিস।
“ইওর” শব্দটা বলার সময় গলার স্বর ক্ষীণ শোনালো শওকতের। সবটা হয়তো শুনতে পারলেন না নিজাম চৌধুরী। সরল হাসলেন। শওকতের প্রসারিত হাসিটা কিন্তু সরল মনে হলো না। চশমার আড়ালে তার শীতল দৃষ্টির ভাষাও ভিন্ন।
কে জানে গল্পের কোন মোড় ঘোরাতে তার এই অকস্মাৎ আগমন!
চলবে,
Sinin Tasnim Sara





