১৮+ সতর্কতা চিঠি দিও ২৭

১৮+ সতর্কতা
চিঠি দিও
২৭
__________

একজন ব্যক্তি যখন অপহৃত হয় কিংবা পথভুলে হারিয়ে যায় তখন তাকে খুঁজে পাওয়ার ক্ষীণ হলেও সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু যে ব্যক্তি নিজেই নিজেকে আড়াল করে রাখে, আত্মগোপনে চলে যায় তাকে খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব পর্যায়ের। বকুলের বাবা লোকটা তেমনই আত্মগোপনে গেছে বলে ধারণা রওনকের। এতদিন যাবৎ এত উপায়ে খুঁজল লোকটাকে, এমনকি আইনেরও শরণাপন্ন হয়েছে; তারাও যথাসম্ভব চেষ্টা করলেন অথচ কেউই তার টিকিটা অবধি ধরতে পারল না। না জলজ্যান্ত মানুষ, না লাশেদের ভীড়ে সে আছে।
বিষয়টাকে এতদিন মোটেই সিরিয়াসলি নেয়নি রওনক। নিতে ইচ্ছে করেনি। যতটুকু যা করেছে কেবল দায়িত্ববোধ থেকে। এখনও যে ঘটনাটা তেমন গুরুত্ববহ মনে হচ্ছে তা নয়; তবে থেকে থেকে সন্দেহের উৎপত্তি হচ্ছে।
এ পর্যায়ে নিজের ভাবনাচিন্তার ওপর ভারী বিরক্ত হলো রওনক। নাকমুখ কুঁচকে চ’জাতীয় শব্দ করল একটা। কাউনিয়া যাচ্ছে ও হোন্ডায় করে। সাঁঝ পড়ে গেছে অনেকক্ষণ। যে কাজের জন্য যাচ্ছে সে চিন্তা বাদ দিয়ে এই অকাজের চিন্তা কেন মাথায় আসছে বুঝতে পারছে না। এদিকে একটানা হোন্ডা চালাতে চালাতে মেরুদণ্ডে ব্যথা শুরু হয়ে গেছে;হাতগুলোও আর চলছে না। গতি কমিয়ে ইতি-উতি কোনো চায়ের দোকান খোঁজার চেষ্টা করল রওনক। সামনেই বড় বাজার। ভরসন্ধ্যা বাজার পুরো রমরমা৷ দোকানপাটের কোনো অভাব নেই, না আছে মানুষের অভাব। বেছে বেছে ক্ষিপ্র আলোর দোকানগুলো ছাড়িয়ে ভেতরের দিকের একটা চালতোলা চায়ের দোকানের সামনে এসে দাঁড়াল রওনক। বিরাট দুটো মাটির চুলোয় গনগনে আগুনের তাপে ভাজাপোড়া তৈরি হচ্ছে। হোন্ডা থেকে নামতেই কচুরির সুতীব্র ঘ্রাণ নাকে ভেসে এলো রওনকের। লোভনীয় খাবারের ঘ্রাণে পেট ডেকে উঠল সাথেসাথে;যেন পেটটাও খবর পেয়ে গেছে খাবার আছে সামনে। মাথা চুলকে ঈষৎ হাসল রওনক। মনে পড়ল আজ সকাল থেকে ভারি কিছু পেটে পড়েনি তার। এত ব্যস্তময় একটা দিন কেটেছে! সমাবেশে গেছে, মিটিং করেছে, কলেজে যেতে হয়েছে এরপর তো সোজা কাউনিয়ার উদ্দেশ্যে। সভা-সমাবেশের উছিলায় যদিও চা-বিস্কুট জাতীয় কিছু পেটে পড়েছে তবে সেসবে কি আর খিদে মেটে?
এই মুহুর্তে যাবতীয় সব চিন্তা বাদ দিয়ে পেট ঠান্ডা করার নিমিত্তে কচুরির ঘ্রাণ ধরে হোটেলের ভেতরে গিয়ে বসার সিদ্ধান্ত নিলো রওনক।
টেবিলে বসার পর মনে হলো কচুরি বোধহয় এই হোটেলটার স্পেশাল আইটেম। যতগুলি কাস্টমার সবার সামনেই স্টিলের পিরিচে তিন চারটে করে কচুরি দেখা যাচ্ছে। চারিদিকে নজর বুলিয়ে হাতের ইশারায় বেয়ারাকে ডেকে উঠল রওনক। কমবয়সী একটা ছেলে গলায় গামছা ঝুলিয়ে ছুটোছুটি করে কাস্টমার সামলাচ্ছে। রওনক দৃষ্টি আকর্ষণ করলে দূর থেকে সে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ল,
— কচুরি আর চা তো? কয়টা খাবেন খালি পরিমাণটা বলেন ছার।
ওর কথা শুনে রওনক হেসে ফেলল। ছেলে তো রীতিমতো মন পড়তে পারে৷ যেন জেনেই বসে আছে যত কাস্টমার আসবে সব কচুরি খেতেই আসবে। সময় নষ্ট না করে আঙুলের ইশারায় ২ দেখালো রওনক। সাথে বলল,
— চায়ে চিনি বেশি দিবি না৷
ক্ষীণ স্বরে “আচ্ছা” বলে কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল ছেলেটা৷
মানতে হবে ছেলেটার হাত ভীষণ চালু। অর্ডার প্লেস করতে বেশি সময়ই নিলো না।
হাসিমুখে ছোট্ট পিরিচটাতে চোখ বুলিয়ে ধীরেসুস্থে খাবার মুখে পুরলো রওনক। তৎক্ষনাৎ অবর্ণনীয় স্বাদে চোখজোড়া বন্ধ হয়ে এলো ওর। কিছুটা সময় চোখ বুঁজেই খাবারের স্বাদ আস্বাদনে মেতে থাকতে চাইল ও। যদিও পারল না। অচীরে খাওয়াদাওয়ায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে স্টিলের একটা গ্লাস পানি সমেত হুট করে কেউ ছুঁড়ে মারল ওর গা বরাবর৷ হাতে লেগে কিছুটা পানি গায়ে পড়ে গ্লাসটা মাটিতে গড়াগড়ি খেতে লাগল। কিছুটা বিস্ময়, কিছুটা বিরক্তি এবং কিছুটা রাগ মিশ্রিত দৃষ্টিতে ও সামনে চাইলে দেখতে পেলো ওর ঠিক বিপরীত টেবিলের কাছটায় ছোটোখাটো একটা গোলযোগের মতো লেগে গেছে। মাঝবয়েসী দু’জন লোক একে অপরকে অশ্লীল গালিগালাজ করতে করতে রীতিমতো হাতাহাতি শুরু করে দিয়েছে। উপস্থিত অন্যান্য কাস্টমাররা ছুটে এসেছে ওদের থামাতে। থামছে তো না-ই বরং বাকি লোকদেরও পারলে গালাগালি করছে দু’জনের একজন।
রওনকের বুঝতে সমস্যা হলো না ওদের মধ্যেই কেউ একজন রাগে গ্লাস ছুঁড়ে মেরেছে এদিকে। নিমেষে মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল। কি সুন্দর ভালোমনে খেতে বসেছিল। নাহ্ সব মাটি করে দিলো লোকদুটো।
আধখাওয়া কচুরি রেখে সরোষে টেবিলে বাড়ি মেরে উঠে দাঁড়াল ও। সালিশ করতে আসা দু একজন যদিও ঘুরে তাকাল শব্দ শুনে, তবে বাকিদের কোনো হেলদোল নেই। রওনক আর স্থির থাকতে পারল না। গা ঝাড়া দিয়ে বেরিয়ে বিপরীতমুখী টেবিলটার কাছে এগিয়ে গেল। এবং ওখানে গিয়েও সজোরে টেবিলে চাপড় দিয়ে বলল,
— এক্ষুনি থেমে যাও দু’জন বলছি। না থামলে কিন্তু ঝামেলা হয়ে যাবে।
বলার অপেক্ষা রাখে না হাতাহাতি পর্যায়ের গোলযোগে ওর ফাঁকা হুমকি কারোর গায়েই লাগল না। পারলে বলা নেই কওয়া নেই হুট করে এসে অন্যের ঝগড়ায় নাক গলানোর কারণে সামনের দু’জন তেড়ে এসে ওকে মারতে চায়। মেজাজের পারদ চড়চড় করে ওপরে ওঠা ছাড়া নীচে নামল না। ধৈর্যচ্যুতি ঘটে গেল রওনকের এবং অন্য কোনো অপশনে না গিয়ে সোজা কোমরে গুঁজে রাখা পিস্তলটা বের করে টেবিলের ওপর রেখে ঠান্ডা দৃষ্টিতে সামনে তাকাল ও। বন্দুক দেখে সরগরম পরিবেশে নীরবতা নেমে আসতে সময় লাগল না। ঝগড়ারত দুজন তো থামলই, সাথে আশেপাশে যারা জটলা পাকিয়েছিল তারাও চোখ বড় বড় করে একবার রওনকের দিকে, একবার অস্ত্রের দিকে চোখ বুলিয়ে সুরসুর করে নিজের জায়গায় ফিরে গেল। হতবাক হয়ে কেবল দাঁড়িয়ে রইল বেয়ারা ছেলেটা এবং হোটেলের মালিক। চোখ ঘুরিয়ে রওনক ওদের দিকে তাকালে দু’জনই বোকার মতো হাসল। বেয়ারা তো গায়ের গামছা নিয়ে পারলে ছুটে এসে রওনকের ভেজা কাপড়চোপড় মুছে দেয়। হাতের ইশারায় ওকে থামিয়ে টেবিল থেকে পিস্তলটা তুলে নিলো রওনক। বজ্রাহত মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকা লোকদুটোকে উদ্দেশ্য করে বলল,
— এক্ষুনি বের হয়ে যাবেন এইখান থেকে। টু শব্দ যদি শুনছি তাইলে শব্দ করার জবানটা আর থাকবে না। বুঝা গেছে?
শুকনো ঢোক গিলে দু’জনেই একসাথে মাথা নেড়ে সম্মতি দিলে পুরো হোটেলটায় দ্বিতীয়বার চোখ বোলালো রওনক। ওর ভয়ে তটস্থ পুরো তল্লাট। হোটেলজুড়ে পিনপতন নীরবতা। কেউ চোখ তুলে তাকানোর সাহস পাচ্ছে না; এমনকি খাবারটাও এত সতর্কতার সাথে খাচ্ছে! শব্দের অবকাশ নেই।
নিয়ন্ত্রিত পরিবেশ দেখে ছোট্ট করে শ্বাস ফেলে নিজের টেবিলে ফিরে যেতে যেতে রওনক হোটেলের মালিককে উদ্দেশ্য করে বলল,
— যান আপনারা কাজে যান। আর কেউ ডিস্টার্ব করবে না।
— জ্বী জ্বী ভাইজান। এই ছোটু তুই ভাইজানের সাতসাত থাক। কি লাগে না লাগে সব দেখ।
ভাইজান আপনার কিছু লাগবে আর?

বিনীত ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করল রওনককে। ছোট্ট করে রওনক জবাব দিলো, “নাহ”
তবুও যেন মানতে চাইল না লোকটা। ছোটুকে রওনকের কাছে থাকার ইশারা করে চুলোর কাছে ফিরে গেল। মধ্যবয়েসী লোকদুটোও আর সময় নষ্ট করল না। কোনোরকমে বিল মিটিয়ে জান নিয়ে ছুটে পালালো।
গ্রাম এলাকার হোটেলগুলোতে খাবার খেয়ে কে কবে বিল মিটিয়েছে দোকানির মনে পড়ে না। তবে অস্ত্রের মুখে অস্থির হয়ে সবাই আজ বিলগুলো যে মিটিয়ে যাবে শতভাগ নিশ্চিত হলো দোকানি। আনন্দে খলবল করে উঠল তার মন। কচুরি বানানোর অবকাশে মুচকি মুচকি হেসে খাওয়ায় ব্যস্ত রওনকের দিকে বার কয়েক তাকাল সে। আহা এই ছেলেকে যদি প্রতিদিন নিয়ে আসা যেত, একটা কাস্টমারও বদমাইশি করার সুযোগ পেতো না।

“ছার তোমরা কি আনিস ছারের লোক?”
গলা যথাসম্ভব খাদে নামিয়ে বেশ ভদ্রচিতভাবে প্রশ্নটা করল বেয়ারা ছেলেটা। খাওয়া এতক্ষণে শেষ রওনকের। ঠান্ডা চায়ে চুমুক বসিয়ে ও সরাসরি তাকাল ছেলেটার দিকে। ভ্রু কুঁচকে বলল,
— তোর কি মনে হয়?
— মনে তো হয় আপনি তারই লোক। ঠাটবাট তাই কয়। আবার সাথে বন্দুকও।
মাথা চুলকে বোকা হেসে বলল ছেলেটা। বিনিময়ে রওনকও অল্প করে হাসলো। বলল,
— হ্যাঁ আমি ওনারই লোক। বলতে পারিস ছোটোভাইয়ের মতো।
— দেখছেন আমি ঠিকে ধরছিলাম।
চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল ছেলেটার। এরপর কি ভেবে আমতাআমতা করে বলল,
— কিন্তু ছার আপনাকে আগে তো কখনও…
— এখন দেখবি। নিয়মিত দেখবি। যাওয়া-আসা লেগে থাকবে আমার।
— ওহ আচ্ছা আচ্ছা।
হেসে মাথা দুলিয়ে এবার জলদি হাতে পিরিচ-গ্লাস গোটাতে শুরু করল ছেলেটা৷ এঁটো প্লেট-গ্লাস রেখে আসতে আসতে রওনকের চা শেষ। কাপ রেখে পকেট থেকে পঞ্চাশ টাকার একটা নোট বের করে ছেলেটার হাতে গুঁজে দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল রওনক।
— বিল কত হলো?
— ভাইজান আপনার বিল দেওয়া লাগবানায়৷ ভালো লাগলে আসি খায়ে যাবেন অতে হবে।
কচুরি বানানো ছেড়ে হাতজোড় করে ছুটে এলো দোকানি। মেকি বিনয়। কথাটা ঠিক পছন্দ হলো না রওনকের। মুখে কিছু না বলে পকেট থেকে আরও একশো টাকার নোট বের করে দোকানির দিকে বাড়িয়ে ধরে সে বলল,
— আমি ফ্রীর খাবার খাই না। যাকগে আশেপাশে কোথাও পান-সিগারেটের দোকান আছে?
— আছে আছে। ঐ তো পাশেরটাই।
টাকা নিয়ে হাতের ইশারায় দেখিয়ে দিলো রওনককে।
— ঠিকাছে আসি। খাবার মজার ছিল।ভেজাল-টেজাল মেশাবানা তাইলে ব্যবসা ভালো চলবে।

বলে একহাত পকেটে পুরে বেরিয়ে গেল রওনক। দোকানি মুখে কিছু না বললেও মাথা নাড়ল। মনে মনে কামনা করল বন্দুকধারী ছেলেটা যেন আরও কয়েকবার তার হোটেলে খেতে আসে।

পান-সিগারেটের দোকানটায় কোনো বৈদ্যুতিক সংযোগ নেই। যদিও তাতে বিশেষ কোনো সমস্যা হচ্ছে না। আশেপাশের অন্য দোকানগুলো থেকে ভেসে আসা আলোতে সব দৃশ্যমান। দোকান থেকে চটপট একটা সিগারেট কিনে লাইটার হাতে সাইডে চলে গেল রওনক। এই দোকানটার পাশ ঘেঁষে সরু গলির মতো কিছু একটা দেখা যায়। আড়াল বুঝে ওখানেই দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিলো রওনক।
দেয়ালে হেলান দিয়ে বার দুয়েক সুখটান দেয়ার পর মনে হলো গলির ভেতর থেকে জনকতক পুরুষ মানুষের গলার স্বর ভেসে আসছে। কৌতূহলে মাথা বাড়ালে নজরবন্দি হলো অদূরে ভাঙাচোরা হাফ ওয়ালের ঘরে কয়েকজন গোল হয়ে বসে নেশা করছে আর তাস পেটাচ্ছে। শুরুতে তেমন গুরুত্ব না দিলেও ষাট ওয়াটের ফ্যাকাসে হলুদ বাল্বের আলোয় একটা চেহারা ওর কপালে ভাঁজ ফেলে দিলো। সিগারেট হাতে ধীরপায়ে ও এগিয়ে গেল ভাঙা ঘরটার দিকে। লম্বাচওড়া ছেলে রওনক। দেউড়ি সদৃশ জায়গায়টায় দাঁড়ালে তাসের আড্ডায় ওর ছায়া পড়ল। নেশায় ঢুলুঢুলু কেউ একজন খেঁকিয়ে উঠল,
— কে বে খেলবি নাকি? খেললে আয় নাইলে সার অট থেকি। আন্দার লাগে সব।
— অন্ধকার তো তোর পুরো জগৎ করে দিব আমি।
দাঁতে দাঁত চেপে কথাটা বলে সিগারেট ফেলে ঝড়ের গতিতে গিয়ে লোকটার কলার চেপে ধরল রওনক। ছেঁচড়ে টেনে তুললে নেশাক্ত ঝাপসা চোখ মেলে লোকটা দেখার চেষ্টা করল ওকে৷ জড়ানো গলায় নোংরা খিস্তি দিয়ে বলল,
— বান্দির পো কে রে তুই৷ হাকাউ লাগতে আসছিস আমার সাথে।
— ভাল্লো মতো চোখ তুলে দেখেন আমার আরেকজন বাপ। আপনার একমাত্র সৎ পুত্র এসে উপস্থিত হইছে আপনার সামনে।
ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে কলার ধরে জোরে ঝাঁকুনি দিলো রওনক লোকটাকে। বলা বাহুল্য লোকটা অন্য কেউ নয়, বকুলের বাবা। যাকে খুঁজতে পুরো শহর তোলপাড়, সে এই খুপরিতে এসে ঘাপটি মেরে বসে আছে।
ঝাঁকুনিতে ওর সৎবিৎ ফিরল বোধহয়। থেমে থেমে অস্পষ্ট স্বরে উচ্চারণ করল,
— র..রওনক।
— চিনতে পারছিস তাহলে।
বাঁকা হাসল রওনক। তা দেখে আৎকে উঠে কলার ছাড়ানোর জন্য ছোটাছুটি করতে লাগল লোকটা। হাতে জোর বাড়িয়ে কলার ধরে টানতে টানতে ওকে বাইরে বের করে নিয়ে এলো রওনক। এতকিছু যে হয়ে যাচ্ছে ওর সঙ্গীসাথীগুলোর কিন্তু কোনো খেয়াল নেই সেদিকে। ওরা মুখ তুলে একবার তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হেসে বিড়বিড় করে কি যেন বলে চুপ করে রইল।
এদিকে বাইরে এনে সরোষে রওনক জেরা করতে শুরু করল লোকটাকে।
— কতবড় জুয়ারি হইছিস তুই,সারা দুনিয়া জুয়া খেলে বেড়াইতেছিস। জবাব দে আমাক।
কি চাইতেছিসটা কি? তোর যে একটা পরিবার আছে ঐটা তো ভুলে খাইছিস বছরবয়াত আগে। এই বয়সে আসিয়া শান্তি দিচ্ছিস না ওদেক।
— কিরে ধরা খায়া গেছিস নাকি আগের পক্ষের কাছে!
ভেতর থেকে একজন হাসতে হাসতে কথাটি বললে সন্দিগ্ধ চোখে তাকাল রওনক। শুধল,
— আগের পক্ষ মানে! আবারও বিয়ে করছিস তুই?

রওনকের এ প্রশ্নে ফাঁদে পড়া ইঁদুরের মতো কাচুমাচু করতে শুরু করল বকুলের বাবা। মুখ ঘুরিয়ে সঙ্গীদের কতক নোংরা গালি ছুঁড়লেও ঠিক বুঝতে পারল রওনকের হাত থেকে ওর নিস্তার নেই।
রাগের চরম পর্যায়ে পৌঁছে কয়েক ঘা বসানোর পরও রওনক বুঝে উঠতে পারল না কি করা উচিৎ ওর লোকটাকে। লোক জড়ো করে গণপিটুনি খাওয়ানো উচিৎ নাকি এক কথায় স্যুট করে দেয়া উচিৎ। ওদিকে মার খেয়ে নিচে কতক গড়াগড়ি করল লোকটা। নাটক;নাটক করে বাঁচার চেষ্টা। মুখ কুঁচকে বিরক্ত চোখে লোকটার নাটক দেখে গেল রওনক। লোকটা ভাবল রওনকের মনযোগ বোধহয় সরানো গেছে। অন্যমনস্কতার সুযোগ নিয়ে এবার সে পালাতে পারবে। মাটিতে গড়াগড়ি করতে করতেই এক পর্যায়ে ঝট করে উঠে দাঁড়ালো। এরপর কোনোদিকে না তাকিয়ে সোজা পলায়ন। বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ওর পলায়ন দেখল রওনক। বলা চলে নিজ ইচ্ছায় লোকটাকে পালাতে দিলো। এই মুহুর্তে ওর সাথে আর কাজ নেই। বরং ওর দ্বিতীয় পরিবারটার খোঁজ লাগাতে হবে। বকুলকে বললে বিশ্বাস নাও করতে পারে। সচক্ষে দেখাতে হবে ওর বাবার এই রূপটা। কষ্ট পাবে মেয়েটা, ভীষণ কষ্ট পাবে।
বকুল এবং বিহনের কথা ভেবে ভীষণ খারাপ লাগল রওনকের। এরকম পরিস্থিতির শিকার তো ও নিজেও হয়েছিল। কষ্টটা ওর শতভাগ জানা৷ বুকচিরে বেদনাদায়ক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। বাবা-মায়ের পাপের ফল অনেকক্ষেত্রে সন্তানদের ভোগ করতে হয়। বিষয়টা দুঃখজনক।
অথচ এই চরিত্রহীন নোংরা লোকটার হাত ধরে তার মা পালিয়েছিল একদিন। কি পেয়েছিল লোকটার মধ্যে! ভালোবাসা পেয়েছিল কি? পেয়েছিল সম্মান, বিশ্বাস? কিছুই না। ভালোবাসা থাকলে লোকটা কখনও তার মাকে ছাড়তে পারত না।
রওনক জানে লোকটা তার মাকে ভালো না বাসলেও বোকা মা’টা এই লোককে অসম্ভব ভালোবেসেছিল। মায়ের কৈশোরের ভালোবাসা ছিল এই লোকটা। যার কাছে হেরে গিয়েছিল চৌদ্দ বছরের পবিত্র বন্ধন।
একটা ভুল ভালোবাসা। কি পেলো বিনিময়ে? জীবনভরের অশান্তি ছাড়া কিচ্ছু না; কিচ্ছু না।
_____________

৮.২৫ শতক জমির ওপর অত্যাধুনিক বিলাসবহুলভাবে বানানো বাড়িটা বছরের অধিকাংশ সময় বন্ধই পড়ে থাকে। দুই ঈদ, বৈশাখ কিংবা পারিবারিক কোনো অনুষ্ঠান ছাড়া মালিকদের পদচারণা তেমন নেই বাড়িটায়। বাড়িটা আনিস শেখের। একসময় এই বাড়ির অন্য একটা রূপ ছিল। এলাকার অন্যান্য বাড়িগুলোর মতো পাঁচ রুমের টিনশেড বাড়ি ছিল এটা। পিতার রেখে যাওয়া শেষ চিহ্ন। পৈতৃকভাবে এই একটা সম্পত্তিই পেয়েছিল আনিস শেখ। পিতা-মাতার স্মৃতি বহনকারী বাড়িটাকে নবরূপে সজ্জিত করার পরিকল্পনা যদিও তার ছিল না তবে স্ত্রীর নির্দেশ! মাঝেমধ্যে মনে হয়ে অযথাই বাড়িটাকে সংস্কার করা হলো বোধহয়। পরিবারসমেত তো সে এখন ঢাকারই স্থায়ী বাসিন্দা। পরিবারের লোকগুলো তেমন আসতেও চায় না এখানে। আসলে আনিস একাই আসে। কখনো ঘুরতে, কখনো কাজের সূত্রে নিজাম সাহেবের পিছু পিছু। পৈতৃক ভিটেকে সে যতখানি পছন্দ করে, অতখানি অপছন্দ করে তার পরিবারের লোকগুলো। কারণ জানা নেই আনিস শেখের।
অথচ শহরে এলে তার একবার না একবার বাড়িটা থেকে ঘুরে যেতেই হয়। বাড়িটা যে তার বড্ড পছন্দের।
আজ রওনককেও ডেকে পাঠানো হয়েছে এখানে। পছন্দের মানুষ ছাড়া যাকেতাকে বাড়িতে ডেকে পাঠায় না আনিস শেখ। অনেক নিকটাত্মীয়ও এখন পর্যন্ত এই বাড়িতে পা রাখতে পারেনি। সে হিসেবে ধরলে রওনক তার অত্যন্ত পছন্দের একজন মানুষ।

গ্রামাঞ্চলের ভেতর অত্যধুনিক বিলাসবহুল বাড়ি দেখে এক সেকেন্ডের জন্য থমকে গেল রওনক। গ্যারাজে হোন্ডা রেখে মুগ্ধ চোখে চারিদিক ঘুরেফিরে দেখতে দেখতে একজন ভৃত্যের সাথে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল। রওনককে বসার ঘরে বসিয়ে ভৃত্যটা কোথায় যেন মিলিয়ে গেল। সেদিকে বিশেষ নজর দিলো না রওনক। ঘুরেফিরে এখনও বাড়িটাই দেখতে লাগল।
এমন সময় ভেতরের ঘর থেকে মৃদু গোঙানির শব্দ ভেসে আসতে শোনা গেল। চোখ ঘুরিয়ে পর্দার আড়ালের ঘরটায় একবার তাকাল রওনক। বুঝতে সমস্যা হলো না কি হচ্ছে ভেতরে। ভীষণ বিব্রত হয়ে পড়ল ও। বিব্রতভাবে নাক চুলকে নড়েচড়ে বসল।

এরপরই ঘটল এক অদ্ভুত কাণ্ড। রওনক তো ভেবেছিল নিষিদ্ধ পল্লি থেকে কাউকে ধরে এনে এসব করা হচ্ছে বোধহয়। কিন্তু নাহ্, ওর ধারণাকে কৌতুহলে পাল্টে দিয়ে ভেতর থেকে হুট করে নারী স্বরের ক্রন্দন ও চিৎকার ভেসে এলো, সাথে ধুপধাপ মারের শব্দ। নগরবধূ জাতীয় কেউ হলে বিরোধ করার কথা নয়। তারমানে ভেতরে অন্যকেউ আছে। যার এখানে থাকার কথা ছিল না। প্রশ্নবোধক চাহনি নিয়ে পলকহীন তাকিয়ে রইল রওনক ঘরটার দিকে।

খানিক পরে এলোমেলো বসনে লুঙ্গিটা সামলাতে সামলাতে আনিস শেখ বের হলে বসার ঘরে রওনককে দেখে একটু বোধহয় চমকে গেল। অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে শব্দ করে হেসে বলল,
— অপেক্ষা করাইলাম বেশি?
বিনিময়ে জোরপূর্বক হেসে না বোধক মাথা নাড়ল রওনক।
— আচ্ছা তুই আরেকটু বস আমি ফ্রেশ হয়া আসতেছি।
কথাটা বলে পুনরায় পর্দা টানানো ঘরটায় ফিরে গেল আনিস শেখ। এরপর চাপা স্বরে খিস্তি শোনা গেল,
“শালী বে**-মা** একটা চিৎকার দিছিস তো জবান ছাঁটি ফেলাব। পাঙ্খা গজাইছে না তোর? পাঙ্খা গজাইছে। তোর এই পাঙ্খা যদি না ছাঁটছি তালে আমি শেখের ব্যাটাই না।”
পটাপট মেয়েটাকে কয়েকটা লাত্থি বসিয়ে সশব্দে ঘরের দরজা টেনে দিয়ে কিছু হয়নি এমনভাবে রওনকের সামনে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল আনিস শেখ।

ওদিকে ভেতরের ঘরে ক্রন্দনরতা নারীটি হাত পা ছুঁড়ে নিজের চুল খামচে ধরে গলা ফাটানো চিৎকারের সঙ্গে কান্নার বেগ বাড়িয়ে দিলো। রওনক জানে না কেন বিষয়টা ওর এত নোংরা এবং জঘন্য মনে হলো!
কড়া লাগানো হয়নি বিধায় চৌকাঠে বাড়ি খেয়ে দরজা অর্ধেক খোলাই রয়েছে। বসার ঘরের জানালা দিয়ে হুড়মুড় করে বাতাস ঢুকছে। শীতল বাতাসের ধাক্কায় পর্দাগুলো ইতিউতি দোল খেতে খেতে ঘরের ভেতরের একাংশ দৃশ্যমান করে দিলো। কৌতূহল দমাতে না পেরে দুলতে থাকা পর্দার ফাঁক দিয়ে একবার ঘরের ভেতর চাইল রওনক। সাথেসাথে তড়িতাহতের মতো উঠে দাঁড়াতে হলো ওকে।
এলোমেলো বসনার আহত মুখখানা ওর শরীরে বিদ্যুৎ প্রবাহিত করল যেন। এ তো কোনো নগরবধূ নয়। বরং কম বয়সী একটি মেয়ে। সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার হলো মেয়েটিকে রওনক চেনে। মেয়েটি আর অন্য কেউ নয়, সদ্য প্রয়াত সভাপতি মিন্টুর একমাত্র ছোটো বোন।
কিন্তু ও এখানে এলো কি করে? ওর তো এই মুহুর্তে নিজের চাচার বাড়িতে থাকার কথা। মিন্টুকে কবরস্থ করার পর এমনকিছুই শুনেছিল রওনক।
পরিবারটাতে ওরা দুই ভাই-বোন ছাড়া আর কেউ ছিল না। যা মিন্টুর খুনের পর জানতে পেরেছিল। ওদের মা মরে যায় ছোটোবেলায়, বাবা কয়েকদিন সংসারে ছিল। মিন্টু যখন রাজনীতির ক্ষেত্রটাতে চলে এলো তখন বাবাও অভিমান করে গৃহত্যাগী হলো। একটা বিয়ে করেছিল সেটাও ভেঙেছে রাজনীতির কারণে। শেষ পর্যন্ত তো নিজেও অপঘাতে মারা পড়ল। স্কুলপড়ুয়া এই ছোটোবোনটাকে নিয়ে সবার মাথাব্যথা ছিল। নানার পক্ষ বলে তারা ওকে রাখবে, চাচার পক্ষ বলে তারা রাখবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সার্বিক চিন্তা করে মেয়েটাকে চাচারা নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। তবে ও আজ এখানে এই অবস্থায় কেন?
দ্বিতীয়বার ক্রন্দনরত মেয়েটার দিকে তাকালে রওনকের বুকের ভেতরটা হু হু করে উঠল। জানে না কেন এক সেকেন্ডের জন্য মেঝের ওপর কুঁকড়ে শুয়ে থাকা মেয়েটার জায়গায় ও বকুলকে কল্পনা করে ফেলল।
চোখের সামনে বকুলের অমন অবয়ব দেখে মৃগী রোগীর মতো সারা শরীর থরথর করে কেঁপে উঠল রওনকের। চিপ বেয়ে গড়িয়ে পড়তে শুরু করল ঘামের সুক্ষ্ম ধারা। হাতের তালুতে তা মুছে শুকনো ঢোক গিলল রওনক। এই প্রথম একটা খু'”নের সাথে নিজের সম্পৃক্ততা ওকে নিজের কাছে ভীষণ অপরাধী এবং লজ্জিত করে তুলল। তবে এই অপরাধবোধ কি ওর আগে হয়নি?
এর পূর্বে আরও কয়েকটা খু”নের সাথে প্রতক্ষ এবং পরোক্ষভাবে ও জড়িত থেকেছে। মানুষগুলো যদি পৃথিবীর নিকৃষ্টতম কেউ হয়ে থাকে সেক্ষেত্রেও স্রষ্টার বিপরীতে গিয়ে তাদের ওপর অস্ত্র ধরার অধিকার ওকে কে দিয়েছে? একটাবারের জন্যও ওর রুহ কাঁপেনি? কেঁপেছে, অবশ্যই কেঁপেছে। অশান্তিতে নির্ঘুম কতগুলি রাত কাটিয়েছে ও। তবে আজকের মতো কাঠগড়ায় দাঁড়ানো অপরাধী এর পূর্বে মনে হয়নি নিজেকে।
ভেতরে সদ্য জাগ্রত হওয়া অপরাধবোধটা আজ চিৎকার করে জানান দিচ্ছে,
“মেয়েটার এই দুর্ভাগ্যের পেছনে একমাত্র দায়ী রওনক। কেবল আজ নয়, স্বার্থে অন্ধ হয়ে সে এমনিকরে আগেও অনেকগুলি জীবন নষ্ট করেছে। এতগুলি জীবন নষ্ট করার বিপরীতে যথাযোগ্য শাস্তি তার আজ অবধি হয়নি। হয়তো হবে কোনো একদিন। তখন সেও বুঝতে পারবে রাজনীতির এই পথটা মিন্টুর মতো তাকেও কিচ্ছু দিতে পারল না। জীবনভরের অশান্তি আর কিছু মানুষের অভিশাপ ছাড়া।”

চলবে,
Sinin Tasnim Sara

বিঃদ্রঃ এই পর্বের প্রেক্ষিতে একটা কথা বলতে চাই। সমাজে সব মানুষ পশু নয়। হলে সমাজটা আর সমাজ থাকতো না। মুদ্রার যেমন এপিঠ থেকে ওপিঠটি আলাদা। তেমনই রাজনৈতিক ক্ষেত্রটা আলাদা। এখানে ভালো নেতা-নেত্রী যেমন আছেন তেমন খারাপও আছেন। সবাই তো ভালোদের নিয়ে লেখেন আমি একাংশ খারাপটা তুলে ধরছি। প্লিজ কেউ এর থেকে নেগেটিভ শিক্ষা নেবেন না কিংবা এই ক্ষেত্রটাকে এত নোংরাও ভাববেন না। এসব ঘটনা লেখার কারণ একসময় দেশে রাজনীতির অবস্থা খারাপ ছিল। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জনের কাছে শোনা গল্পের সাথে নিজস্ব ভাষা যোগ করে আমি লিখছি। নিরেট সত্যিও নয় কল্পনাও নয়। মাঝামাঝি। এবং অপরাধের পরিণতি যা হয় আমার সাধ্যমতো দেখানোর চেষ্টা করব। অনেকসময় হয় না সেটাও দেখাব।
এবং লেখার খাতিরে স্ল্যাংগুলো এড়াতে পারছি না। যথাসম্ভব এড়াচ্ছি। বিষয়টা কন্সিডার করবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here