১৮+ সতর্কতা চিঠি দিও ৩০

১৮+ সতর্কতা
চিঠি দিও
৩০
_________________

“কি ব্যাপার শ্যালিকা বাড়িতে কেউ নেই নাকি?”
— কেন আমি আছি তো। আমাকে দিয়ে হয় না!
টি টেবিলের ওপর নাশতার ট্রে টা নামিয়ে রাখতে রাখতে মুচকি হেসে জবাব দিলো আসমার ছোটোবোন সেঁজুতি।
আশেপাশে চোখ বুলিয়ে অতনুও ঠোঁট টেনে হাসলো। তারপর বলা নেই কওয়া নেই চকিতে সেঁজুতির গলায় ঝুলতে থাকা ওড়নাটা টান দিয়ে হাতের মুঠোয় নিয়ে নিলো। ঈষৎ ঝুঁকে ছিল সেঁজুতি, ওড়নায় টান পড়ায় সটান দাঁড়িয়ে মৃদু চিৎকারযোগে উচ্চারণ করল,
“দুলাভাই! এটা কোন ধরনের অসভ্যতা”
— ঐ পাহাড়ের চূড়াগুলোর খাঁজ দেখিয়ে ওড়নার প্রহসন আবার কোন সভ্যতায় পড়ে শ্যালিকা!
অতনুর বাঁকা হাসির বিপরীতে আমতাআমতা করতে শুরু করল সেঁজুতি। হাত বাড়িয়ে কণ্ঠে রোষ ফোটাবার চেষ্টা করে বলল,
— দিন আমার ওড়না ফেরত দিন।
— এসে নিয়ে যাও।
সোফায় দু-হাত মেলে দিয়ে আরও আরাম করে বসে বলল অতনু। তা দেখে সরু চোখে কতক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থেকে পায়ে ধপধপ শব্দ করে অপরপ্রান্তে সোফার কাছে গিয়ে দাঁড়াল সেঁজুতি। কাছাকাছি চলে যেতেই এক ঝটকায় কোমর চেপে ধরে ওকে নিজের কোলে বসিয়ে নিলো অতনু। কামিজটা হাত দিয়ে টেনে নামিয়ে বক্ষবিভাজিকায় নাক ঘষে বড় শ্বাস টানল। যা চাওয়ার ছিল পেয়ে যেতেই অহমের হাসি ফুটে উঠল সেঁজুতির ঠোঁটে। কোথায় তার প্রতিবাদ কোথায় কি! বরং অতনুর মাথাটা আশ্লেষে স্তনসংকটে চেপে ধরে কামনার শীৎকারযোগে চোখ বুঁজে নিলো। অতনু হাসলো। কম নারীর সঙ্গে তো মেলামেশা নেই তার। কার চোখের ভাষায় কিসের ইঙ্গিত বুঝতে অসুবিধে হয় না এখন। বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িতে পা রেখেছে কম কিন্তু যেদিনই রেখেছে একটা মানুষ বেশ করে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেছে, সে হলো তার মেজো শ্যালিকা সেঁজুতি। অতনুর মনে হয়েছে নানাসময় নানাভাবে মেয়েটা তাকে দৈহিক সম্পর্কে আমন্ত্রণ জানানোর চেষ্টা করেছে৷ কখনো সাড়া দেয়নি। আজও দেবে না। তবে পরীক্ষা করে দেখতে চাইছিল তার ধারণা কতটুকু সঠিক!
না চাইতেও সস্তা পণ্যের মতো বিনা মূল্যে নারীদেহ পেয়ে যাওয়ার পর এসবের ওপর থেকে মন উঠে যেতে শুরু করেছে অতনুর। দৈহিক সম্পর্কে সে ততটা আগ্রহী নেই যতটা শুরুতে ছিল। তার অন্তর এবং দেহের পরিপূর্ণ অধিকারীণি এখন একজন নারী, আসমা;তার প্রেয়সী তার অর্ধাঙ্গী। মেয়ে তো নয় পুরোটাই স্নিগ্ধ লজ্জাবতী লতা। ছুঁলেই যে লজ্জায় গুটিয়ে যায়। সংস্পর্শে এলে যাকে প্রত্যেকবার আনকোরা লাগে, নূতন লাগে। ওর নূতনত্বে বাকি সবকিছু ফিঁকে। মেয়েটার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবার অবকাশ নেই। পৃথিবীর সমস্ত রূপ-মাধুর্যে পরিপূর্ণ যেন সে।

একজনের দেহে মগ্ন হবার অভিনয় চালিয়ে একইসাথে মস্তিষ্কে অন্যকাউকে কল্পনা করলে সেই ব্যক্তিকে অসুস্থ মস্তিষ্কের ব্যক্তি আখ্যায়িত করা যেতে পারে। সুস্থ স্বাভাবিক চলেফিরে বেড়ানো অতনু ভেতরে ভেতরে যে মানসিক ব্যধিগ্রস্ত বলার অপেক্ষা রাখে না। শুধু সে নয় তারই গোত্রের এমন অনেক মানুষ প্রতিনিয়ত আমাদের চোখের সামনে দিয়ে হেঁটেচলে বেড়ায় যাদের প্রত্যেকে এমন নোংরা ব্যধিতে আক্রান্ত। যাদের কাছে পরকীয়ার মতো পাপকর্ম খুব স্বাভাবিক কোনো বিষয়। ভালোবাসা অন্যায় নয়। তবে অনৈতিক চাহিদার ভালোবাসা কেবল অন্যায়ই নয়, চরম অপরাধও বটে।
এই মুহুর্তে একই অপরাধে অপরাধী আসমার বোন সেঁজুতি। যে নিজের বোনের স্বামীর সাথে অনৈতিক সম্পর্কে জড়ানোর চেষ্টায় মত্ত বহুদিন থেকে। তার এসব পরিকল্পনা কিন্তু আজকের নয়। অনেক অনেকদিন আগে থেকে অলীক খেয়ালে অতনুর পাশে আসমাকে নয় বধূ বেশে সে নিজেকে কল্পনা করে এসেছে। সেই কৈশোর বয়স থেকে এই মানুষটার ঘরনি হয়ে থাকতে চেয়েছে। আড়ালে-আবডালে ভালোবেসেছে পাগলের মতো। কিন্তু অদৃষ্টের বিচিত্র নিয়ম! দুঃখজনকভাবে ভালোবাসার মানুষটা হয়ে যায় তারই বড়বোনের স্বামী। এ অনর্থ কোনোভাবেই মেনে নিতে পারে না সেঁজুতি। সেই ছোটোবেলা থেকে বড়পাকে সে কম পছন্দ করে। রূপে, গুণে কিংবা বিচার-বিবেচনায় বড়পা তার থেকে কয়েকধাপ এগিয়ে। পরিবারের সকলের থেকেও পেয়েছে অসীম স্নেহ এবং ভালোবাসা। বাবা-মা তো বটে দাদা-দাদি এবং বড়বাবা-বড়মাও ওকে প্রচুর ভালোবাসা দিয়েছে। পরিবারের প্রথম সন্তান নাকি ও। ওর তুলনায় পরের ভাইবোনরা কমই পেয়েছে স্নেহ-ভালোবাসা। নাকি অন্যরা পেয়েছে, সেঁজুতির ভাগেই কম এসেছিল কে জানে! বড়পার প্রতি চাপা ক্ষোভ দীর্ঘদিন যাবৎ পুষছে সে ভেতরে ভেতরে। কখনো বাইরে প্রকাশ করেনি কারণ প্রয়োজন পড়েনি। আদর-স্নেহের ওপর ভাগ বসাতে বসাতে আপা যখন তার স্বপ্ন পুরুষের ওপরও ভাগ বসিয়ে ফেলল, ক্ষো”ভটাকে আর চেপে রাখতে পারল না সেঁজুতি।
ও জানতো অতনুর চারিত্রিক ত্রুটি রয়েছে। পুরুষ মানুষের ওসব থাকা দোষের নয়। তবুও শুরুতে যখন শুনেছিল একটু কষ্ট লেগেছিল বৈকি! তবে বড়পার সাথে বিয়ে হওয়ার পর এই ত্রুটিটাকে উপজীব্য করে স্বপ্ন পুরুষের জীবনে অনুপ্রবেশ করবে বলে ভেবেছিল সেঁজুতি। ভাবনা যে এত দ্রুত সত্যি হয়ে যাবে কল্পনা করেনি। বক্র হেসে অতনুর চুলে আঙুল ডুবিয়ে চুলগুলো মুঠোয় চেপে মাথাটা সরিয়ে নিলো বুক থেকে। চাপা হাসিযোগে ভ্রু নাচিয়ে বলল,
— চা ঠান্ডা হয়ে যাবে না?
— গরম চায়ের থেকে গরম তুমি বেশি লোভনীয় মনে হচ্ছে।
অশুষ্ক জিভ দ্বারা শুকনো ঠোঁটজোড়াকে সিক্ত করে নিলো অতনু। লজ্জার ভঙ্গিমায় ওর বুকের ওপর মৃদু কিল বসালো সেঁজুতি।
— যাহ্ কি বলেন না বলেন।
এরপর কি মনে পড়ায় অতনুর কলারের কাছটা চেপে ধরল একহাতে। কণ্ঠে গুঢ়তা ফুটিয়ে বলল,
— শ্যালিকাকে কোলে বসিয়ে কামকেলি খেলার চেষ্টা করছেন বউ জানে?
— বউ জেনে গেলে তো রেহাই নেই। তোমারও নেই, আমারও।

জোর করে ওর হাতটা টেনে সরিয়ে দিলো অতনু। এতে বোধহয় নাখোশ হলো সেঁজুতি। কোল থেকে নেমে গিয়ে সোফায় বসল। ওড়না জড়াতে জড়াতে বলল,
— বাড়ি ফাঁকা আপনি জানতেন তাই না?
— আমি কি করে জানব, তুমি কি রিসিভারে খবর পাঠিয়েছিলে!
স্বাভাবিকভাবেই বলল অতনু। তবে সেঁজুতির তা বিশ্বাসযোগ্য মনে হলো না। ভেংচি কেটে বলল,
— মিথ্যুক। নাটক তো ভালই করেন।
— আরেহ না সত্যি। আমি তো কাজে এসেছিলাম একটা।
— আপনার কাজ যে কি জানা আছে৷

অল্পক্ষণ পূর্বের বিষয়টাকে ইঙ্গিত করে বলল।
বিপরীতে অতনু হেসে উঠল।
— আমি সত্যিই কাজে এসেছিলাম সেঁজুতি।
— সেকি! সত্যি তবে। কি কাজ?

অবাক দৃষ্টিতে চোখ বড় বড় করে তাকাল সেঁজুতি। অতনুর মনে হলো আসমার অসুস্থতার কথা এই মেয়ের থেকে জানতে চাইলে পুরো সত্য জানা যাবে না, উপরি কিছু মিথ্যে বানিয়ে বলতে পারে। তবুও রাখঢাক রেখে যদৃচ্ছভাবে শুধল,
— তোমাদের পরিবারে উল্লেখযোগ্য কোনো দূর্ঘটনার স্বীকার হয়েছিল কেউ? এখন কিংবা অতীতে।
অতীত শব্দটা ক্ষীণ করে বলল অতনু। জবাবে ভ্রু জোড়া কুঁচকে দু’দিকে মাথা নাড়ল সেঁজুতি। খানিক বিস্ময় নিয়ে বলল,
— দূর্ঘটনা! না তো। কে হবে?
— নাহ্ তেমন কিছু না।
— আমি কিচ্ছু বুঝতে পারছি না দুলাভাই।

ঠোঁট প্রসারিত করে উঠে দাঁড়াল অতনু। বলল,
— বুঝবে আস্তেধীরে সব বুঝবে।
— আপনি চলে যাচ্ছেন নাকি?
সেঁজুতির কণ্ঠে উৎকণ্ঠা। চুলে ব্যাকব্রাশ করতে করতে অতনু জবাব দিলো,
— যাচ্ছি। কিন্তু আবার আসব। আজ নয় অন্যদিন। আজ একটু তাড়া আছে।
— চা..
— চা টা বরং তুমি খেয়ে নাও। ঠান্ডা চা খেলে সব রকমের উষ্ণতা প্রশমিত হয়ে যাবে।

এরপর আর বাক্যবিনিময়ের অবকাশ না দিয়ে বেরিয়ে গেল অতনু। বজ্রাহ”তের মতো সোফায় বসে হতাশা এবং রাগে চিড়বিড় করে উঠল সেঁজুতি। মানুষটা তাকে আরও একবার প্রত্যাখ্যান করল। কাছে টেনে নির্মমভাবে ছুঁড়ে ফেলে দিলো;যেন সে আস্তাকুঁড়ের কোনো আবর্জনা। দুঃখে-যন্ত্রণায় কান্না পেয়ে গেল সেঁজুতির। অপমানে ঝাঁঝরা হয়ে করতলে মুখ লুকিয়ে ফুঁপিয়ে উঠল সে। পৃথিবীর সমস্ত অসমতা কেবল তার ভাগ্যে পড়েছে;কেবল তার ভাগ্যে।

যান্ত্রিক কতগুলো শব্দে ঘুম হালকা হলো আসমার। চেতনাশক্তি ফিরে পেলে সর্বপ্রথম নাকে এসে ধাক্কা খেল ফিনাইলের কড়া গন্ধ। তৎক্ষনাৎ ভেতরটা উল্টে আসতে চাইল আসমার। কপাল কুঁচকে মুখভঙ্গিতে বিরক্তি ফুটিয়ে ধীরে ধীরে চোখ মেলে চাইল সে। দৃষ্টিজোড়া নিবদ্ধ হলো হাসপাতালের চুন করা সাদা সিলিংয়ে৷ পাশে থেকে ভেসে এলো ভীষণ পরিচিত একটি ডাক,
— ভাবী?
একডাকে মুখ ফিরিয়ে বাঁয়ে চাইল আসমা। নজরে এলো চিন্তাগ্রস্ত উপমার তটস্থ মুখখানি। ঈষৎ ঝুঁকে আসমার কপালে হাত রাখল সে। কম্পিত কণ্ঠে শুধল,
— এখন কেমন লাগছে ভাবী? ঠিক আছো তো তুমি?
— ঠিক আছি। দুশ্চিন্তা করো না।
মৃদুস্বরে জবাব দিলো আসমা। উপমার দুশ্চিন্তা একবিন্দু কম হলো না। ব্যান্ডেজ করা আসমার পা জোড়ার দিকে চোখ বুলিয়ে পুনরায় প্রশ্ন করল,
— এতসব হুট করে কীভাবে হলো বলো তো? আমি বাড়িতে নেই আর…
— দুশ্চিন্তা করো না পাগল মেয়ে। বলছি তো আমি ঠিক আছি। ভুলবশত হাত ফসকে..
ডাক্তার ব্যান্ডেজ করে দিয়েছে তো। ঠিকমতো ঔষধ খেলে দেখো সুস্থ হয়ে যাব।
— আমার খুব খারাপ লাগছে ভাবী। যখন খবরটা শুনেছি আত্মা উড়ে গিয়েছিল পুরো। কেন জানি না বারবার শুধু বড় মামির কথা মনে পড়ছিল। আল্লাহ না করুক তোমার কিছু হয়ে গেলে…
খুব ব্যথা পেয়েছ তাই না?
— আরেহ এত প্যানিক করছো কেন ঠিক আছি তো আমি।
উপমার একটা হাত নিজের দু’হাতের মুঠোয় চেপে ধরে হাসবার চেষ্টা করল আসমা। উপমা এতেও শান্ত হলো না। ভাবীর হাতের পিঠে কপাল ঠেকিয়ে মৃদু কাঁপতে লাগল । কাউকে বোঝাতে পারবে না বাড়ি ফিরে লিখনের কাছে আসমার খবরটা শোনার পর কতখানি আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল সে। কাপড়ও ছাড়েনি ওভাবেই বেরিয়ে এসেছে লিখনের সাথে। পুরো রাস্তা রীতিমতো দম আটকে বসে ছিল। বারবার শুধু বড় মামির মৃত্যুর দিনটা স্মরণে আসছিল। সত্যিকার অনলে দ”গ্ধ হয়ে মামি তাকে একা করে চলে গিয়েছিল। এখনও মনে পড়ে ব্যান্ডেজ করা মামির লাশটা দিয়ে কেমন উৎকট গন্ধ ছড়াচ্ছিল। মানুষ পো”ড়া গন্ধ। সামনে নিয়ে গেলে ভয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল উপমা একাধিকবার। মামি চলে যাওয়ার পর তাঁর মতো করে কেউ ভালোবাসেনি। এত বছর পর একজন প্রতিরূপ এলো। সেও নাকি..
নাহ্ আর ভাবতে পারছিল না উপমা৷ হাসপাতালে এসে ঘুমন্ত আসমাকে দেখে খানিক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পেরেছিল। ভাগ্যিস ক্ষতি বেশি হয়নি। মামা বুঝতে পেরেছিলেন ওর অস্থিরতা। মাথায় হাত রেখে সময় নিয়ে সান্ত্বনা দিয়েছেন। অল্পক্ষণ হয় নামাজের জন্য বেরলেন। তখন থেকে উপমা আসমার পাশে বসা।
— কখন ফিরেছ তুমি বাড়িতে?
ভাবীর ডাকে ধ্যানভঙ্গ হলো উপমার। সোজা হয়ে বসে জবাব দিলো,
— বিকেলের দিকে। এসেই লিখন নামক ছেলেটার কাছে তোমার সম্পর্কে জানতে পারলাম।
— ওহ ওর সাথেই এসেছ তবে?
— হ্যাঁ।
মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানাল উপমা৷ মৃদু হাসি ফিরিয়ে দিয়ে ক্ষণ কতক নিশ্চুপ রইল আসমা।
তন্মধ্যে কেবিনের দরজা খুলে অতনু প্রবেশ করল ভেতরে। আসমা এবং উপমা একসাথে তাকাল দরজার দিকে। উপমাকে দেখে একটু অবাক হয়েছে অতনু। তৎক্ষনাৎ প্রশ্ন ছুঁড়ল,
— কিরে তুই কখন এলি?
— এইতো অল্প আগে।
উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে জবাব দিলো উপমা।
হাতের ইশারা করে অতনু বলল,
— উঠছিস কেন? বসে থাক।
— না না তুমি বোসো। আমি একটু ওয়াশরুমে যাব।

ত্রস্তে একপ্রকার পালিয়ে কেবিনের বাইরে বেরিয়ে এলো উপমা। যেদিন থেকে জানতে পেরেছে তার ভাই আর রওনক একই দলের হয়ে কাজ করে এবং সুপরিচিত সেদিন থেকে সবসময় একটা আতঙ্কের মধ্যে থাকে উপমা। মনে হয় এই যেন ধরে ফেলল সেজো ভাই ওকে রওনকের সাথে। এরপর…
এরপর আর কি হয় ভাবতে ইচ্ছে করে না উপমার। ভাবনারা যেন মাথার মধ্যে জট পাকিয়ে ফেলে। কল্পনাতেই এমন ভয়ানক অবস্থা, সত্যি সত্যি যেদিন সামনাসামনি হয়ে যাবে না জানে সেদিন কোন ঝড় বয়ে যাবে ওদের ওপর দিয়ে!

_______
বহুদিন পর আজ রওনক বাড়িতে ফিরেছে। প্রতিবার রওনকের বাড়িতে ফেরা একটা উপলক্ষ বানিয়ে উদযাপন করা হয়। চমৎকার সব খাবারের ঘ্রাণে ম ম করে পুরো বাড়ি। রওনকের লজ্জা লাগে ভীষণ। ভাবীটা যে কি করে না! সবকিছুতেই তার বাড়াবাড়ি।
রওনকের ধারণা তার ভাবীর সবচেয়ে প্রিয় কাজ রান্না করা। পারলে সমস্তটা দিন সে রান্নাঘরে ব্যয় করে। কথাটা অবশ্য মিথ্যে নয়। হাসনা আসলেই রাঁধতে পছন্দ করে। নিত্য নতুন খাদ্যের পদ রান্না করে বাড়ির সদস্যদের খাওয়ানো তার শখের মতো। শখটাকে প্রাধান্য দেয় সকলে। একবার খেলেই প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে যায়। হাসনার রান্নাকে না বলার অবকাশ নেই। খাদ্যরসিক পরিবারের মেয়ে। রান্নার এত ভ্যারাইটি শিখেছে সে নিজের মায়ের কাছে। মায়ের হাত পেয়েছে মেয়ে।

বাড়ি ফিরে আজ দীর্ঘ কয়েকমাস পর রওনক সামনাসামনি হয়েছে তার বাবা-র সাথে। এতদিন তো বাবা গ্রামে ছিলেন। ফিরেছেন বেশিদিন হয়নি। সাধারণ সম্পাদক হওয়ার খবরটা তাঁর কানেও গেছে। খুশি হয়েছেন নাকি অখুশি বোঝা যাচ্ছে না তবে সাবধানে চলাফেরা করতে সতর্ক করে দিয়েছেন। সতর্কতা বাক্য হোক এতেও রওনক খুশি। রাজনীতিতে আসার পর বাবা-র সাথে তার অদৃশ্য একটা দূরত্বের সৃষ্টি হয়েছে। দিনকে দিন এই দূরত্ব বাড়ছে বৈ কমছে না। শাহজাহান সাহেব বিচক্ষণ মানুষ। পলিটিক্সের ক্ষেত্রটাতে পুত্রের ইমেজ কতখানি নীট অ্যান্ড ক্লিন তা তাঁর অজানা নয়। তাঁর মতো সহজ-সাধারণ মানুষের ঘরে অ”স্ত্র”ধারী ছেলের বাস এ বিষয়টা তিনি মানতে পারেন না। ছেলেদের এমন জীবন তিনি মোটেই চাননি। বড় ছেলেটাও তো এরকম সৃষ্টিছাড়া ছিল না। রওনক তবে কার মতো হয়েছে? তার ছোটো চাচার মতো! শাহজাহান সাহেবের ছোটো ভাই ছিল এমন, রওনকের মতো সৃষ্টিছাড়া। রাজনীতির নেশায় ডুবে একসময় ঘরবাড়ি ছেড়েছিল ঐ ছেলে। পড়াশোনাও বন্ধ করে দিয়েছিল। শেষের দিকে এমন শোচনীয় অবস্থা হয়েছিল! এরপর তো রোগে শোকে মরল ছেলেটা। রক্ত কথা বলে।
ছোটো পুত্রকে নিয়েও এই ভয়টাই কাজ করে শাহজাহান সাহেবের মধ্যে। বাপ হয়ে রেগে-ধমকে ফেরানোর চেষ্টা করেছিলেন একদা। সফল হননি। তখন থেকেই ছেলের সাথে বাপের দূরত্ব। এই দূরত্ব কভু কমবে কি না বলা যায় না তবে দু’জনেই চায় দূরত্ব কমুক। কোনো জাদুবলে কমুক।

রাতের খাওয়াদাওয়া শেষে বেশ কিছুটা সময় আশিকের সাথে হাসি-তামাশায় মত্ত রইল রওনক। সবসময় চাচাকে কাছে পায় না বাচ্চাটা। আজ পেয়েছে, ঘুমুতেই চাইছিল না একদম। কিন্তু সারাদিন খেলাধুলো করে ক্লান্ত হয়ে গেছে। ছোট্ট শরীরে কতটুকু কুলোয়! চাচার বুকে শুয়ে গল্প শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে গেছে। হাসনা অবশ্য নিয়ে যেতে চাইছিল। রওনক দেয়নি।
আশিক ঘুমানোর পর বাড়িটাতে ঝুঁপ করে নিস্তব্ধতা নেমে এলো। প্রতিদিন এমনটাই হয়। হাসনারা অভ্যস্ত। তবে রওনকের এতখানি নিস্তব্ধতায় অদ্ভুত লাগছিল। রাতের পর রাত ঘুমায় না সে। ঘুমহীন রাত্রির নিগূঢ় নৈশব্দতা এতদিনে অভ্যেস হয়ে যাওয়ার কথা। কেন যে হয় না! বিছানায় অলস শুয়ে এসব আজগুবি ভাবনায় ডুবে যাচ্ছিল রওনক। এলেবেলে ভাবনার মাঝে সিগারেট খেতে পারলে ভালো লাগত বোধহয়। কিন্তু আশিক আছে পাশে। ছোটো বাচ্চাদের আশেপাশে সিগারেট ধরানো অশোভন লাগে। সিগারেট শব্দটা মাথায় এলে অদ্ভুতভাবে তৃষ্ণা কয়েকগুণ বেড়ে গেল রওনকের। নাহ্ সিগারেটের দিক থেকে মাইন্ড ডাইভার্ট করা অবশ্যম্ভাবী। নইলে কখন কন্ট্রোললেস হয়ে পড়বে!
মুখে চ-জাতীয় শব্দ করে উঠে বসল রওনক। কি করবে কি করবে ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মনে হলো উপমার জন্য একটা চিঠি লিখলে কেমন হয়? সেই কবে থেকে একটা চিঠির জন্য তার প্রিয়তমা তড়পাচ্ছে। হুট করে চিঠি হাতে গুঁজে দিয়ে তাকে চমকে দিলে কেমন হবে বিষয়টা? দারুণ হবে নিশ্চয়ই।
নিজ মনে হেসে টেবিল ল্যাম্প জ্বেলে নিঃশব্দে চেয়ার টেনে বসল রওনক। চিঠির বাহানায় বহুদিন বাদে ধুলোপড়া বই-খাতাগুলো হাত দিয়ে ছোঁয়া হলো। রানিং স্টুডেন্ট তবুও বই খাতায় ধুলোর স্তর পড়ে গেছে। আসলে নামেমাত্র ছাত্র সে। ক্লাস নেই, পড়াশোনা নেই। কেবল পরীক্ষাগুলো দিয়ে আসে। তখন যা পড়া হলে হয় । নইলে বই ছোঁয় কবে? ক্যারিয়ার নিয়ে বোধহয় কোনো ভাবনা নেই রওনকের। নাকি আছে! কে জানে। অজানা কারণে রওনকের বুক চিরে বেরিয়ে এলো প্রলম্বিত দীর্ঘশ্বাস। সময় নষ্ট না করে বইখাতার নীচ থেকে চিরুনি অভিযান চালিয়ে বের করে আনলো এক রঙিন কাগজের ডায়েরি। বহুদিন পর অস্ত্র ছেড়ে কলম ধরল রওনক। বিজ্ঞরা বলেন অস্ত্র দিয়ে শুধু একজন মানুষকে ঘায়েল করা সম্ভব, আর কলম দিয়ে লাখ।
তবে আজ কলমের জোরে শুধু একজনকেই ও ঘায়েল করতে চায়। ওর প্রিয়তমাকে।
মার্জিনে সুসজ্জিত ডায়েরির একটা পাতা বের করে মৃদু হেসে টিপ কলম দিয়ে লিখতে শুরু করল,

প্রিয়তমা,
কি লিখব তোমায়৷ চিঠি লেখার অভ্যেস যে আমার একদম নেই। প্রেমিক হয়েও আমি শতভাগ প্রেমিক নই। প্রেমের ভাষা জানি না। কীভাবে প্রেমিকাকে আদর করে সম্বোধন করতে হয়, কীভাবে খাঁটি প্রেমিকের মতন আচরণ করতে হয় কিচ্ছু জানি না। শুধু জানি আমার মরুভূমির মতো জরাজীর্ণ জীবনে এক পশলা সুখ বৃষ্টি হয়ে এসেছ তুমি। দীর্ঘদিনের নিষ্প্রাণ দেহটা তোমার প্রেম সঞ্জীবনী দ্বারা জীবন্ত হয়ে উঠেছে। আমার অষ্টাদশী প্রিয়তমা, আমার চঞ্চল জলফড়িং তুমি কি জানো তোমার উচ্ছলতা সারাবেলা আমায় কেমন আচ্ছন্ন করে রাখে। আন্দোলিত করে বুকের ভেতরের আমার অদৃশ্য মাংসপিণ্ডটাকে। শুদ্ধ ভাষায় যাকে বলে হৃদয়।
আমি হয়তো জানি না চিঠির বিপরীতে একটা চিঠি কি করে লিখতে হয়, গুছিয়ে কি করে বলতে হয় ভালোবাসার কথা। শুধু এতটুকু জানি চঞ্চল ফড়িংটার মধ্যে আমি নতুন করে বাঁচার উদ্দীপনা পাই, নতুন এক আমিত্বকে পাই।
আমার পাগলীনি প্রিয়তমা, দেরি করে চিঠি লিখছি বলে মান কোরো না। জেনে রেখো তুমি আমার সমস্ত সুখের কেন্দ্রবিন্দু। তুমিহীনা আমি রিক্ত, নিঃস্ব।
একজীবনে আকণ্ঠ ভালোবাসার তৃষ্ণায় ডুবে থাকা আমার তৃষ্ণা মেটে তোমার কণ্ঠে “ভালোবাসি” শব্দটা শুনে।
করুণা করে হলেও চিঠি দিও প্রিয়তমা। বোলো ভালোবাসি।
ইতি
তোমার মাস্তান প্রেমিক

চলবে,
Sinin Tasnim Sara

★আজ এলোমেলো লাগতে পারে। ফ্রেশ মাইন্ড নিয়ে লিখতে বসেছিলাম তখুনি পাড়ার পোলাপান গান বাজাতে শুরু করে দিছে সাউন্ড বক্সে। কিসের যেন পিকনিক তাদের। মাঝখান থেকে আমার মাথা গেল আউলায়ে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here