মানলাম তুমি ভালোবাসোনি
কলমে- মম সাহা
[২]
“সময় ও স্রোত কারো জন্য থেমে থাকে না”- এই প্রবাদ বাক্যটা আমি ভীষণ বিশ্বাস করি। কেবল বিশ্বাস করতে পারি নি নিজের অধঃপতন। রাস্তায় লুটিয়ে পড়ার ঠিক তিনদিন পর আমার জ্ঞান ফিরে। যখন নিভু নিভু চোখ গুলো টেনে খুললাম, নাকে ভেসে এলো ফিনাইলের গন্ধ। আমি নাক-মুখ কুঁচকে ফেললাম। ছোটোবেলা থেকেই আমার এক প্রকার হসপিটাল ভীতি ছিলো। হসপিটালের নাম শুনলেই কেমন মানুষ হারানোর ভয় হতো। তবে আজকাল যে এই হসপিটালই আমার নতুন আরেকটা বসবাসের জায়গা হবে কে জানতো?
টানা তিনদিন পর জ্ঞান ফিরতেই মাথার উপর খটখট করে চলতে থাকা ফ্যান প্রথম চোখে পড়লো। তারপর ধীরে ধীরে সাদা জানালার পর্দা, স্যালাইন স্ট্যান্ড চোখে পড়লো। আমি চোখ বন্ধ করলাম। বন্ধ করতেই ভেসে উঠলো সেই দিনের ঘটনা। সেই মানুষটার পুরো মুখটা এতদিনে একদম স্বচ্ছ হলো আমার চোখের পাতায়। কী সুন্দর মুখশ্রী! মনে হয় যুগ যুগ কাটানো যাবে সেই মুখের দিকে তাকিয়ে। কী শান্ত চোখ জোড়া! কী চঞ্চল হাসি! আমি আপন মনেই হেসে উঠলাম। কিন্তু আমার হাসি বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। তার আগেই চোখে ভেসে উঠলো তুলি আপুর মুখটা। তুলি আপুর সেই ম্যাজিক বাক্য, যা শুনে আমি লুটিয়ে পড়ে ছিলাম সেই ভেজা রাস্তায়। আমি মাথা চেপে ধরলাম। মাথায় প্রচন্ড ব্যাথা অনুভব হচ্ছিলো। কি অসহ্য! কি ভয়ংকর সে ব্যাথা। আমার দুনিয়া আঁধার হয়ে আসছিলো। আমি চিৎকার করলাম। চিৎকার করে বার কয়েক ডাকলাম,
” মা, মা, বাবা কই তোমারা?”
আমার চিৎকার দেওয়ার সেকেন্ড কয়েক পেরুতেই বাবা-মা দু’জন ছুটে এলো আমার কাছে, সাথে এলো নার্স ডাক্তারও। মা আমাকে জাপটে ধরলেন, বাবা মাথা হাত বুলিয়ে গেলেন অনবরত আর বারংবার বলছিলেন,
“কী হয়েছে, মা? তোমার কোথায় সমস্যা হচ্ছে?”
আমি বাবাকে বলতে চাইলাম, আমার বুকে প্রচন্ড ব্যাথা করছে বাবা, আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। আমি এ কেমন প্রেমে পড়লাম বাবা, আমার যে চোখ মেললেই কেবল চারপাশে মৃত্যুপুরী মনে হচ্ছে। কিন্তু আমি কথা গুলো বলতে পারলাম না। তীব্র ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসলো। বুঝলাম, আমাকে ঘুমের ইনজেকশন পুশ করা হয়েছে।
এরপর কেটে গেলো সাতটা দিন। তার মাঝে একটা দিনও আমি তার দেখা পাই নি। তবে তুলি আপু এসেছিল, অনেকক্ষণ আদরযত্ন করেছিল। বার বার বলেছিল সুস্থ হয়ে উঠতে। আমি বলতে পারি নি তখন, আমার সুস্থ হওয়ার ওষুধ যে তার কাছে।আমার প্রাণ ভোমরা যে তার কাছে বাঁধা। সে চাইলেই আমাকে বাঁচাতে পারে। তবে, তুলি আপুর সাথে আমি আগের মতন কথা বলা বন্ধ করে দিলাম। কেমন যেন বিরক্ত লাগা শুরু করলো। তারপর হসপিটাল থেকে বাসায় এলাম। গোলগাল মিষ্টি মুখশ্রী ততদিনে জীর্ণ-শীর্ণ হয়ে গেছে। নতুন করে মাইগ্রেনের সমস্যা দেখা দিলো। ভীষণ কাঁদতে ইচ্ছে করতো কিন্তু পারতাম না কান্না করতে। তুমুল মাথা ব্যাথায় অস্থির হয়ে যেতাম। আমার দিন গুলো আরও অসহায়, অসহ্যকর হলো। যাকে মনে করতে চাইতাম না, তাকে ভেবেই আমার দিন-রাত কাটছিলো। এই হাজার রকম সমস্যার মাঝে নভেম্বর মাসে আমার টেস্ট পরীক্ষা শেষ হলো। কী পরীক্ষা দিলাম নিজেও জানিনা। সব পারি অথচ লিখতে ইচ্ছে করতো না। মাথা ধরে আসতো, চোখে অশ্রু আসতো, দমবন্ধ লাগতো। এতশত সমস্যা নিয়ে কোনোমতে পরীক্ষা টা দিলাম।
পরীক্ষার পরের দিন গুলো আমার আরও অসহ্য কাটলো। অনেক পড়াশোনা করা মেয়েটা পড়াশোনার থেকে ধীরে ধীরে বহুদূরে চলে গেলাম। একদিন মায়ের ফোন ঘেটে তুলি আপুর আইডি বের করলাম। আইডি ঘাটতে ঘাটতে তুলি আপুর সাথে সেই কাঙ্খিত পুরুষকে দেখতে পেলাম। চোখের সামনে মানুষটার হাসিমুখ ভেসে উঠলো। কী সুন্দর মানুষ! সৃষ্টিকর্তা কত যতন করে না গড়ে ছিলো এই সর্বনাশা পুরুষকে! তারপর আমি আশ্চর্য রকমের পাগলামি করে ফেললাম। বাবা রাতে খেতে ডাকলো আমি গেলাম। খাবার খেতে খেতেই বাবাকে বললাম,
“বাবা, আমার একটা মোবাইল লাগবে।”
আমার কথা শুনে বাবা মায়ের দিকে তাকালেন। দু’জন চোখে চোখে ইশারা করে কিছু একটা বললেন আমি আঁচ করলাম কিন্তু মুখ তুলে তাকালাম না। বাবা তারপর কিছুক্ষণ নিরবতার পর বললেন,
“এখনই লাগবে মা? আর কয়েকটা দিন অপেক্ষা করো, পরীক্ষা শেষ হলেই দিবো। নতুন, দামী ফোন।”
আমি চোখ তুলে একবার বাবার দিকে তাকালাম। আমি জানি, বাবা কখনোই না করতেন না। নিশ্চয় মায়ের চাওয়া এটা। আমি তবুও শান্ত কণ্ঠে বললাম,
“মোবাইল দামী লাগবে না। কোনোরকম একটা স্মার্ট ফোন হলেই হবে।”
বাবা আবার মায়ের দিকে তাকালেন। আমিও তাকালাম এবার মায়ের দিকে। মা হয়তো কিছুটা আঁচ করতে পারলেন। যতই হোক, মায়ের মন কিনা! আঁচ তো করবেই। মেয়ের অবনতি সে তো নিজের দু-চোখ মেলে দেখেছেন, মেয়ের আর অধঃপতন হয়তো সে চাচ্ছিলেন না। তাই কিছুটা গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
“না, পাবে না ফোন এখন। এ কয়েকমাস কেবল পড়বে।”
আমার মাথার আর ঘাড়ের রগ ফুললো। আমি বুঝলাম, আমি নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছি। তাও দাঁত কিড়মিড় করে রক্তচক্ষু নিয়ে বললাম,
“শেষবার বলছি, দিবে কি না?”
আমি যে রেগে গিয়েছি তা আমার বাবা-মা বুঝলেন। বাবা তাই ঠান্ডা মাথায় বললেন,
“হ্যাঁ দিবো, মা। তুমি শান্ত হও।”
বাবার এতটুকু কথায় হয়তো থেমে যেতো সবটা কিন্তু না, আমার মা বুঝলেন না আমার অবস্থান। হয়তো ততদিনে সে বিরক্তও হয়ে গিয়েছিল। তাই চেঁচিয়ে উঠলেন। ধমকে বললেন,
“কোনো ফোন-টোন পাবে না তুমি। কী পেয়েছো হ্যাঁ? জীবনটাকে ধ্বংস করে দিতে উঠে পড়ে লেগেছো! সাথে আমাদেরও জ্বালিয়ে মারছো। ভদ্র ভাবে থাকলে এখানে জায়গা হবে নাহয় বিদায় হও।”
আমার আবেগের বয়স তখন। বয়ঃসন্ধির প্রবল আবেগ আমাকে অন্ধ করে দিলো। আমি খাবার প্লেট টা ছুঁড়ে মারলাম। বাবা আমাকে শান্ত করতে আসার আগেই মা চ ড় বসিয়ে দিলেন গালে। আমার মস্তিষ্ক তখন কাজ করা বন্ধ করে দিলো। কেমন পাগল পাগল হয়ে গেলাম। ছুটে গেলাম নিজের ঘরে। দরজা আটকে দিলাম মুহূর্তে। বাবা-মা ঘরে ঢোকার সময়টাও পেলেন না। আমি জীবনের দ্বিতীয় ভুলটা করে ফেললাম। চলন্ত ফ্যানটা বন্ধ করে ঝুলে পড়লাম তার সাথে। বাহির থেকে মায়ের চিৎকার, বাবার আর্তনাদ ভেসে আসছিলো। আমার এতকিছু শোনার অবস্থা তখন ছিলো না। আমি মানসিক ভারসাম্য হীন হয়ে গিয়েছিলাম বোধহয়। একটা প্রেম নামক অনুভূতি আমাকে কোথায় নামালো! শেষমেশ কি-না পাগলের খাতায় নাম লিখাতে হলো! আর স্বত্তা ঝুলিয়ে দিতে হলো ফ্যানে। শেষ পরিণতি কী তবে আমার এটাই ছিলো! আমার চোখ বেয়ে অশ্রু গড়ালো। আমার মতন একটা শান্ত শিষ্ট মেয়ের আজ এমন পরিণতি আমাকেও কাঁদালো। কিন্তু ততক্ষণে বহু দেরি হয়ে গেছে।
#চলবে