পদ্মদিঘি পাঠ-২

#পদ্মদিঘি_
১ম পরিচ্ছেদ

০২.
–“আপনি কী কথা বলতে পারেন না শহুরে বাবু? কিছুক্ষণ আগে তো দিব্যি কথা বললেন।”

–“উত্তর দেয়ার মতো মনে হয়নি তাই বলিনি। এই যে কিশোরী তোমার নাম কী?”

–“আমি সেহনাত, আপনি?”

–“শাদবিন, শাদবিন শাহীর!”

শাদবিন ভেবেছিলো, কিশোরী এবার তাকে চিনবে, কিন্তু তার ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো। শ্যামবতীর মুখশ্রীতে সেই একই হাসি লেপ্টে রইলো। হঠাৎ সেহনাতের স্মরণ হলো মায়ের কথা! বলেছে দ্বিপ্রহরের পূর্বেই বাড়ি ফিরতে, নয়তো তার অধ্যায়নের সময় পেরিয়ে যাবে। কিশোরী মাথায় ভালো করে ঘোমটা দিয়ে তাড়া দিয়ে বলে,

–“দুঃখিত শহুরে বাবু। আমায় ফিরতে হবে, আল্লাহ চাইলে আবার নিশ্চয়ই দেখা হবে। আসসালামু আলাইকুম!”

বলেই সেহনাত উল্টোপথে হাঁটা দেয়। শাদবিন ওখানে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রয় আনমনে। অতঃপর আপনমনেই বলে উঠলো,

–“এতো শুদ্ধ তার কথার তেঁজ? অবিশ্বাস্য!”

রমনীকে নিয়ে ভাবতে ভাবতেই শাদবিন ঘোড়ায় চড়ে বসলো এবং চলে গেলো তার নির্ধারিত মসলিন কারিগরদের উদ্দেশ্যে।

সেহনাত বাড়ির কাছাকাছি আসতেই তার বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় মোহিনী। কিড়মিড় দৃষ্টিতে সেহনাতকে আপাদমস্তক দেখে কটাক্ষের স্বরে বলে,

–“কী আমার বইন!! তোমার মায়ের মতো পুরুষগো মাথা খাইয়া আইসো নাকি?”

এমন বিকৃতি কথাবার্তা শুনে সেহনাত চোখ বুজে ফেললো। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালালো। হাত দুটো মুঠিবদ্ধ করে চোখ মেলে তাকায় কিশোরী। মোহিনীর মুখশ্রীতে তখন বিজয়ের হাসি। সেহনাত অধর জোড়া প্রসারিত করে বললো,

–“না, আমার বুবু। আমি ওই বাড়ির কৌশিকের খোঁজ-খবর নিতে গেছিলাম। শুনেছি তার সাথে তোমার বেশ সখ্যতা।”

মোহিনীর মুখশ্রী রক্তিম বর্ণ ধারণ করলো ক্রোধে। সে ঝাঁঝালো কণ্ঠে কিছু বলতে নেয়ার পূর্বেই সেহনাত তাকে থামিয়ে দেয়।

–“ভুলেও এই স্পর্ধা দেখাতে এসো না। শোকরানা করো যে তোমার এই মতিগতির সুসংবাদ মামীর কর্ণধারে লাগাইনি।”

বলে সেহনাত মোহিনীর পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলে থেমে যায় এবং মোহিনীর উদ্দেশ্যে আবারও বলে উঠলো,

–“আমার সাথে উঁচু গলায় কথা বলবে না মোহিনী। আমি তোমার চেয়েও বয়সে বড়ো। বড়োদের অসম্মান করার শিক্ষা নিশ্চয়ই আমার মামীজান দেয়নি!”

সেহনাত আর এক মুহূর্তও দাঁড়ায় না। চলে গেলো বাড়ির অভ্যন্তরে। মোহিনী সেখানেই ফোঁস ফোঁস করতে লাগলো। মস্তিষ্কে ভর করলো প্রতিশোধের দহন।

সেহনাত যোহরের আগ অবধি মায়ের কাছে পড়াশোনা করলো। শবনাম সব পড়াতে না পারলেও তার কিছুটা জ্ঞান আছে। শবনাম কোনো একসময় পাঠশালায় গেলেও তার একমাত্র মেয়ের সেই সৌভাগ্য হয়নি। তাই নিজ মেয়েকে নিজ শিক্ষায় শিক্ষিত করছেন প্রতিনিয়ত। গ্রামের কম বেশি মানুষ নিজ আঞ্চলিক ভাষায় কথা বললেও শবনাম এবং সেহনাত আলাদা। তারা মা-মেয়ে সবসময় শুদ্ধ ভাষায় নিজেদের বহিঃপ্রকাশ করেন। এতে করে বাহিরের কোনো ক্রেতা আসলেই শবনাম তার সাথে বেশ সখ্যতার সাথে কথা বলে। এতে করে ক্রেতাও খুশি হয় সাথে তাদেরও লাভ দ্বিগুণ হয়। আয়েশা এ বিষয়ে বেশ ঈর্ষা করেন শবনাম এবং সেহনাতের উপর। ঈর্ষাটা হচ্ছে তাদের শুদ্ধ ভাষা নিয়ে। শবনামকে কিছু বলতে পারেন না কারণ তার শুদ্ধ ভাষার জন্যে তাদের বেশ লাভই হয় কিন্তু সেহনাত? আয়েশা অনেক চেষ্টা করেছে সেহনাতকে নিজেদের মতো করে গড়ে তুলতে। কিন্তু মা-কন্যা কেউ কারো থেকে কম নয়।

সেহনাত তার অধ্যায়ন শেষে উঠে দাঁড়ায়। এতক্ষণ একভাবে বসে থাকায় কোমড় যেন নড়াচড়া বন্ধ করে দিয়েছে। হালকা হাই তুলে সেহনাত মসলিনের আঙিনা ছেড়ে ভেতরে চলে যায়। শবনাম মসলিন বুননের ফাঁকে ফাঁকেই সেহনাতকে পড়াচ্ছিলেন। সেহনাত ভেতরে প্রবেশ করতেই তার উপর যেন বিরাট ঝড় এলো।

সেহনাত এক চিৎকার দিয়ে মাটিতে বসে পরলো। সেহনাতের চিৎকার শুনে শিউলি দৌড়ে আসলো। সেহনাত আরও চিৎকার করার পূর্বেই আয়েশা সেহনাতের মুখ চেপে বললো,

–“চুপ! একদম চুপ! তোর সাহস কেমনে হয় আমার মেয়েরে অপমান করার? তারে করছিস তো করছিস-ই সাথে আমার শিক্ষাকে বলিস কুশিক্ষা? আমার খাস, আমার পড়োস তাও তোর এতো সাহস! গরম কাঠ গলা দিয়ে ঢুকায় দিমু, চিনোস আমারে? পোড়া-মুখো! নাই কোনো রূপ, গুণ তাও অহংকারে মাটিতে পা পরে না! অপয়া, চরিত্রহীনা!”

সেহনাত তার হস্ত চেপে ধরে নিরবে কেঁদেই চললো। বড্ড জ্বালা করছে এই হাতটা। সেহনাত চারপাশে নিজের মাকে খুঁজলো। হ্যাঁ, রমনীর ধারণাই ঠিক। তার মা শুনতে পাননি। আয়েশা তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে নিজের কাজে চলে গেলো। মোহিনী তখন অদূরে দাঁড়িয়ে পৈশাচিক হাসি দিচ্ছিলো। নৈশব্দে হাসতে হাসতে নিজের কক্ষের দিকে চলে গেলো। সেখানে শুধু উপস্থিত রইলো শিউলি। শিউলির দৃষ্টি নির্বিকার, ভয়ার্ত। শিউলি বড্ড ভয় পায় তার মালকিনকে। তাই তার সাহস কুলাচ্ছে না সেহনাতের দিকে এক পা এগোনোর। সেহনাত সেখানে কিছুক্ষণ কেঁদে কোনো রকমে উঠে দাঁড়ায়। অতঃপর সদর দরজা দিয়ে এলোমেলো অবস্থায় দ্রুত বেরিয়ে যায়।

——————

ঘাট থেকে অনেকটা দূরে একটা আম গাছের নিচে নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে সেহনাত। এখনো ফোঁপাচ্ছে সে। হস্ত কিছুক্ষণ পরপরই নদীর পানিতে ভেঁজাচ্ছে সে। কিন্তু জ্বালা যেন বাড়ছে অনবরত। একদিক দিয়ে পোড়া হস্ত অপরদিকে চিত্তের গভীর ক্ষত। এতো এতো অপমান, অত্যাচারে যেন তার সহ্যের সীমা অতিক্রম করে যাচ্ছে। আর কতো সহ্য করবে? কিশোরী হওয়ার পর থেকেই তাকে এসব সহ্য করতে হচ্ছে তাও তারই মায়ের অগোচরে। সেহনাত ফোঁপাতে ফোপাঁতে আপনমনে বলে উঠলো,

–“যাদের সাহস নেই তারা পিছ থেকেই ছুঁরি বসায়। কু-নারী তারা একেকজন।”

সেহনাত পিছে উষ্ণ কিছু অনুভব করলো। সেহনাত নাক টেনে পেছনে ফিরলো। পুরুষ অবয়ব বুঝতে পেরে দ্রুত তার অবাধ্য চুল কাপড় দ্বারা আবৃত করলো। মাথা উঁচু করে অবয়বটির মুখশ্রীতে দৃষ্টি বুলালো। অস্ফুট স্বরে বলে উঠলো, “শহুরে বাবু!”

শাদবিন নির্বিকার হয়ে রক্তিমা মুখশ্রীর দিকে দৃষ্টি বুলাচ্ছে। কিয়ৎক্ষণ পূর্বের চঞ্চলা মুখশ্রীর সঙ্গে এই ক্রন্দনরত মুখশ্রী কিছুতেই মেলাতে সক্ষম হচ্ছে না শাদবিন।

–“নেত্র অশ্রুসিক্ত কেন চঞ্চলীনি?”

সেহনাত কিছুটা হতবিহ্বল হলো। অপ্রস্তুত হয়ে হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে নেত্রপল্লব মুছে নিলো। সেহনাত সোজা হয়ে বসলো। কোনো উত্তর দেয়নি। সেহনাতের এই উপেক্ষা শাদবিন শাহীরের অহং এ লাগলেও প্রকাশ করলো না। নিজ রাগ দমিয়ে কিশোরীর থেকে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে বসলো। কিছুক্ষণ চললো নিরবতা। প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য দেখে ঘাড় বাঁকালো শাদবিন। কিশোরীর মুখশ্রী তখনো নির্বিকার।

–“কোনো সমস্যা চঞ্চলীনি?”

–“সমস্যা বললে কী সমাধান পাবো?” নির্বিকার হয়ে প্রশ্ন করে সেহনাত। দৃষ্টি তার নদীর পানিতে স্থির। শাদবিন শাহীর কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পরে রমনীর পাল্টা প্রশ্নে।

–“সমস্যা যেমন আছে তার সমাধানও রয়েছে। আমাদের মাবুদ এতটাও নির্দয় নন।”

সেহনাত এবার নীল অম্বরের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো। অতঃপর অধরে ক্লান্তিমাখা হাসি দিয়ে বলে,

–“সেই সমাধানের অপেক্ষায় রইলাম, শহুরে বাবু।”

“শহুরে বাবু” ডাকটা শাদবিনের হৃদয় কাঁপিয়ে দেয়ার মতোন দুটো শব্দ। এবারও অদ্ভুত, অজানা শিহরণ খেলে গেলো সর্বাঙ্গে। এরকম মোহনীয় ডাক আগে শুনেছে কি না সেটা তার নিকট সন্দেহ-ই রয়ে গেলো। শাদবিন আবারও দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো কিশোরীর দিকে। কী আছে এই কিশোরীর মাঝে, যা জমিদার নবাব শাদবিন শাহীরকে দুর্বল করে দিচ্ছে প্রতিবার দর্শনে?

শাদবিনের ভাবনার মাঝেই তার চোখ পরলো কিশোরীর হস্তে। কিশোরী বারংবার তার ডান হাতটা কাপড়ে লুকানোর আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু শাদবিনের সূক্ষ্ম চিলের দৃষ্টি থেকে লুকাতে পারলো না সে। শাদবিন আংশিক দেখে ফেলে হাতের কালচে দাগ। শাদবিন এ বিষয়ে প্রশ্ন করতে নিবে তৎক্ষনাৎ তার ঘোড়া ডেকে উঠলো। শাদবিনের ধ্যান ভাঙ্গে। শাদবিন ঘাড় ঘুরিয়ে পিছে তাকালো। অদূরে তার ভৃত্য হাতে ছাতা নিয়ে তাকেই খুঁজে বেড়াচ্ছে। শাদবিন বিড়ম্ব না করে দ্রুত উঠে দাঁড়ায় এবং পা চালিয়ে নিজের ঘোড়ার নিকট গিয়ে দাঁড়ায়। কিশোরী নিজেও ঘাড় ঘুরিয়ে পিছে তাকিয়ে আছে। দৃষ্টি তার শহুরে বাবুর দিকে। শাদবিন কিছুটা চেঁচিয়ে বলে,

–“আল্লাহ চাইলে ইনশাল্লাহ আবার দেখা হবে। ভালো থাকবে চঞ্চলীনি!”

বলেই ঘোড়ায় চড়ে বসলো। অতঃপর আবারও বলে ওঠে,

–“আজ আমি আসি, আল্লাহ হাফেজ!”

কিশোরীর অধরে তখন হাসি ফুটেছে। সেই অমূল্য হাসি দেখে শাদবিনের মনে হলো, এই হাসির জন্যে তার যেকোনো যাত্রাই শুভ হবে। শাদবিন আর মায়াকে পশ্রয় না দিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে চলে গেলো তার পথে। কিশোরী যুবকের যাওয়ার পানে স্থির দৃ্ষ্টি নিক্ষেপ করে অমায়িক হেসে বলে,

–“এরকম সময় আরও আসুক, শহুরে বাবু। যেন আমি এইটুকু সময়গুলোর মাধ্যমে আপনার সঙ্গ পেয়ে নিজের ভেতরকার ক্ষতগুলো দ্রুত সারিয়ে নিতে সক্ষম হই। আমার জীবনে বন্ধুর খুব অভাব, শহুরে বাবু!”

~চলবে, ইনশাল্লাহ।

__লাবিবা ওয়াহিদ__

বিঃদ্রঃ কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ। ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গঠনমূলক মন্তব্যের প্রত্যাশায় রইলাম, আসসালামু আলাইকুম।

গ্রুপঃ LaBiba’s Typescripts

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here