পদ্মদিঘি পাঠ-১৪+১৫

#পদ্মদিঘি_ [১ম পরিচ্ছেদ]
১৪+১৫.

[কপি সম্পূর্ণ নিষেধ]
সর্বশান্ত রাত্রী বিষ্ময়ের দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রইলো সদর দ্বারের পানে। তার ময়ূরী মসলিনের আঁচলটা মেঝের কিছু অংশ জুড়ে লেপ্টে আছে। দাসীরা শাহাজাদীর দিকে ভড়কানো দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রইলো। যার থেকে এই কঠিন সত্যটি গোপন ছিলো সেই মানুষটা ঠিকই জেনে গেলো? প্রবাদে আছে, সত্য কোনদিন চাপা থাকে না। সে তার রূপ দেখাবেই। সেহনাত গুটিশুটি মেরে শাদবিনের প্বার্শে দাঁড়িয়ে। শাদবিনের এক অংশ খামচে ধরে উৎসুক নজরে চারপাশ দেখছে। তাদের সম্মুখীনে দাঁড়ানো অপরূপ কন্যাও কিশোরীর নজর এড়ায় না। তবে সে যথা-সম্ভব নিজেকে সামলানোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।

জমিদারি জিনিসটা স্ব-চক্ষে কখনো না দেখলেও সকলে বলতো সেহনাতের চলাফেরা, আচরণ, স্বভাবের মাঝে জমিদারি ভাব আছে। এ কথা প্রায় সময় ফিরোজ সাহেব-ই বলতেন। এজন্যই হয়তো সেহনাতের সহপাঠীরা ঈর্ষাম্বিত ছিলো! তাইতো তারা নানান ভাবে কিশোরীকে অপমান করে তাদের পায়ের নিচ দেখাতে চেয়েছিলো। হয়তো সেহনাতের পিতা থাকলে এমন অপমান সহ্য করতেন না। প্রায় সময়ই পিতাহারা কন্যাটিকে নিয়ে কঠিন কটাক্ষ করেছে সহপাঠীগণ! তারা বারংবার কিশোরীর মা-বাবা উভয়েরই চরিত্রে দাগ কাটতো, যা একদমই সহ্য-সীমার বাহিরে ছিলো। তাইতো কিশোরী তাদের যথা-সম্ভব এড়িয়ে চলার চেষ্টা করতো।

বেগম আকলিমা ঠিক ভাবে কোনো খুঁত পাচ্ছে না, এই কিশোরী। সকলকে এভাবে থম মেরে থাকতে দেখে শাদবিন মুখ খুললো,

–“আম্মিজান? আপনি কী বরণ করে স্ব-সম্মানে আমার স্ত্রীকে ঘরে তুলবেন নাকি “বিসমিল্লাহ” বলে অন্দরমহলে পদচারণ করবো?”

বেগম মালিহা ফ্যাকাসে মুখশ্রী নিয়ে পাশে ফিরলো। দাসী দাঁড়িয়ে। বেগম মালিহা নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে চললো পুত্রের বরণ করতে। বরণ সমাপ্তি হতেই বেগম মালিহা দোয়া পড়ে দুজনের মাথায় ফুঁ দিলো। কিশোরী আবেশে চোখ বুজে ফেলে। অধরে অধর চেপে রেখেছে, জড়তায়! বেগম আকলিমা ললাটে বিরক্তির ভাঁজ ফেলে অন্যদিকে দৃষ্টি ফেরালেন। মিনমিন করে বললেন,

–“যত্তোসব ঢং!”

ওদিকে ইসরাত ক্রন্দন রত। আঁচলে মুখ গুঁজে বিলাপ করছে। তার নেত্রপল্লবে জল নেই, তবুও সে কাঁদছে! নাটকীয় কান্না যাকে বলে! ছোট রত্না মায়ের হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে বলে,

–“ও আম্মি! ওদিকে নতুন বউ আর তুমি কাঁদছো? আচ্ছা, নতুন বউয়ের মুখশ্রী কখন দেখবো?”

ইসরাত ক্রোধে কন্যার পিঠে এক ঘা লাগিয়ে দিলো। রত্না আর্তনাদ করে উঠলো। ইসরাত ক্ষিপ্ত স্বরে বললো,

–“আহাম্মক! এদিকে নিজের ঘর ভাঙলো আবার আসিস এসব গুণগান গাইতে? বুদ্ধু মেয়ে! আমার তোকে নিয়ে স্বপ্ন দেখাই ভুল ছিলো। উহু, ভুল নয়! আকাশচুম্বী অপরাধ! দূর হ, সামনে থেকে। নয়তো তোকে এখানেই চিবিয়ে খাবো!”

মায়ের এমন ক্রোধ দেখে রত্নার ভীতিতে মুখশ্রী ফ্যাকাসে হয়ে যায়। সে দ্রুত প্রস্থান করলো।
কিশোরী কালো নিকাব এবং আলখেল্লায় আবৃত। যখন নিজ কক্ষে তাকে নিয়ে যাওয়া হলো তখন সে অবাক নয়নে চারপাশ দেখছিলো। বেগম শর্মিলা এবং মালিহা দু’জনেই উপস্থিত হলো কিশোরীর গোছালো কক্ষে। দুই ভদ্র মহিলাকে দেখতেই কিশোরী মাথায় ঘোমটা তুললো। রুমে আসার পরপরই খাস বাঁদী রূপার সহযোগিতায় আলখেল্লা খুলে শাড়িতে আবৃত ছিলো। হাম্মামখানা থেকে হস্ত-মুখমন্ডল ধৌত করে এসে ক্লান্ত দেহটা নিয়ে আরামদায়ক শয্যায় বসেছিলো।

কিশোরী সালাম জানায়। দু’নারী-ই সালামের উত্তর দেয়৷ কিশোরী পা ধরে সালাম করার পূর্বেই বেগম মালিহা তাকে থামিয়ে দেয়। কিশোরী মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,

–“আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো সামনে মাথা ঝুকাতে নেই, কন্যা! তা মায়াবতী, নাম কী তোমার?”

–“সে..হনাত আহিম!”

–“মাহশাল্লাহ!”

শ্যামবতীর মুখশ্রীতে চোখ ধাঁধানো হাসি ফুটে ওঠে। বেশ কিছুক্ষণ কথা হলো। বেগম মালিহা এবং শর্মিলা মুগ্ধ সেহনাতের আচরণে। তাদের জানামতে সেহনাত এক সাধারণ ঘরের কন্যা৷ কিন্তু আচরণ তাদের ভাবনার বাহিরে। বেগম শর্মিলা তখন তাড়া দিয়ে বলে,

–“ঠিক আছে কন্যা। বিশ্রাম করো, আমরা যাই মধ্যাহ্নের আহার প্রস্তুত করতে। এছাড়াও সালাতের সময় হয়েছে৷ সালাত কিন্তু প্রতি ওয়াক্ত পড়বে। সালাত আদায় করা জমিদার মহলে বাধ্যতামূলক। এক ওয়াক্ত বাদ পরলেও সে ক্ষমার অযোগ্য!”

কিশোরী দৃঢ়তার সাথে মাথা নাড়ায়। তার বেশ ভালো লেগেছে বেগম শর্মিলাকে। বেগম মালিহাও খারাপ নয়। দু’জনই বিনয়ী হেসে কক্ষ প্রস্থান করলো। সালাত আদায় করে বসতেই রূপা তার পাশে দাঁড়ালো। রূপা বয়সে তার থেকেও বড়। তবে কর্মমুখর। প্রতিটি দাস-দাসী হয়তো এমনই। তবে রূপার সঙ্গে মিশতে কিশোরীর দ্বিধার শেষ নেই। তবুও সে নিজের উদ্বিগ্নতাকে বহিঃপ্রকাশ করলো না। নিরবে বসে রইলো। পুরো কক্ষ নজর বুলাতে বুলাতে অপেক্ষা করতে লাগলো তার শাহীর বাবুর। কিন্তু শাদবিনকে সে ফেরার পর থেকে একবারও দর্শন করেনি। বেহায়া হৃদয় বড্ড করে চাচ্ছে শাদবিনকে কাছে পেতে। উগ্র কিশোরী দাসীর উদ্দেশ্যে বলে ওঠে,

–“তোমাদের জমিদার হুজুর কোথায় খবর আছে?”

–“জ্বী বেগম! তিনি খামার পরিদর্শনে বেরিয়েছেন।”

এমন উত্তরে অসন্তোষ প্রকাশ করলো কিশোরী। মনটা কালো আঁধারে ছেয়ে গেলো। সকাল হতেই শাদবিন তাকে এড়িয়ে চলছে। কথা কম বলছে, ভালো ভাবে তাকিয়েও দেখেনি। সে কী কোনো ভাবে রাগাম্বিত? কিছুক্ষণ পর বেগম মালিহা আসলেন দাসীদের নিয়ে। প্রতিজন দাসীর হস্তে খাবারের পাত্র। কিশোরী কিছুটা বিষ্মিত হয়ে প্রশ্ন করে!

–“আম্মিজান, আপনি কষ্ট করে খাবার এনেছেন কেন? আমায় ডেকে পাঠালে আমি নিজেই আসতাম!”

প্রসন্ন হাসে বেগম মালিহা। মেয়েটার কথা-বার্তায় যেন একটা প্রাণ আছে! মালিহা দাসীদের ইশারা করে খাবার সাজাতে বলে। তারা সম্মতি জানিয়ে খাবার সাজিয়ে কক্ষ ত্যাগ করে। কিশোরী তখনো উত্তরের অপেক্ষায়। রূপা কিছুটা অদূরে অবস্থান করছে। বেগম মালিহা কিশোরীর পাশে বসলেন। অতঃপর খুব নরম গলায় বললেন,

–“আজ তোমার বিয়ের প্রথম দিন। আমার তোমাকে এমন কিছু বলার ইচ্ছে ছিলো না যেটা তোমার প্রফুল্ল হৃদয় আহত করবে। তাও আমি নিরূপায়! তবে তোমার ভালোর জন্য-ই বলছি। এই সংসার, এই জমিদারী তোমার জন্যে কঠিন সংগ্রাম। জমিদার পরিবারের বর্তমান অপছন্দের পাত্রী হচ্ছো তুমি! অনেকেই চেষ্টা করবে, শাদবিনের জীবন হতে তোমার অস্তিত্ব বিলীন করে দিতে। ইতিমধ্যে ভয়ংকর জ্বাল বিছানো শুরু হয়েছে। তাই এই মায়ের কথা শুনো, নিজেকে শক্ত রাখবে প্রতিনিয়ত। নিজেকে কোমল ভাবে উপস্থাপন করবে না কারো সামনে। শাদবিন সবসময় থাকবে না তোমায় রক্ষা করতে, নিজ সত্ত্বা তোমার নিজেকে-ই রক্ষা করতে হবে। পারবে না, জমিদার শাদবিনের যোগ্য জমিদারনি এবং বেগম হতে? পারবে না নিজ বরকে আঁচলে শক্ত করে বেঁধে রাখতে?”

মুহূর্তে-ই ভয় ঝেঁকে বসলো কিশোরীর চিত্তে। নিজের জন্যে নয়, তার শাহীর বাবুকে হারানোর তীব্র ভয়। এতটাই ভীতি তাকে ঘিরে ধরেছে যে, হৃদপিণ্ড তীব্র গতিতে লাফাচ্ছে। অন্তঃস্থলও অস্বাভাবিক ভাবে দহনে পুড়ছে। কিশোরী কম্পনরত কন্ঠে বললো,
-“পা..রবো!”

–“তবে খেয়াল রেখো বাঁধন যেন হালকা না হয়। দেখা যাবে বাঁধন খুলে গেলো আর তুমি চিরজীবনের মতো শাদবিনকে হারিয়ে ফেললে।”

এতটুকুই যেন কিশোরীকে নাড়িয়ে সক্ষম৷ কিশোরী নির্বিকার দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো বেগম মালিহার নিকট। ওনার আঁখিযুগল জলে টইটম্বুর! এক মুহূর্তের জন্যে নিজ আম্মি শবনামের প্রতিচ্ছবি দেখলো বেগম মালিহার মধ্যে। বেগম মালিহা নিজ অশ্রু গোপন করতে দ্রুত কক্ষ হতে বের হয়ে গেলো। কিশোরীর নেত্রপল্লব অশ্রুসিক্ত। রূপা দ্রুত মালকিনের কাছে আসলো এবং উত্তেজিত কন্ঠে বললো,

–“কাঁদবেন না আমার বেগম। আপনার জীবনে অনেক লড়াই! আর কিছু না হোক, জমিদার নবাবের জন্যে হলেও আপনাকে এই কঠিন লড়াই লড়তে হবে। মনে রাখবেন বেগম, এই লড়াইয়ের জিত হচ্ছে আপনার বর। আপনার বরকে পাওয়ার জন্যে হলেও আপনাকে জিততে হবে, কাঁটাযুক্ত এই পথে হাঁটতে হবে। মাবুদ কে স্মরণ করুন আমার বেগম। আমার বিশ্বাস তিনি আপনার প্রতি এতোটাও নির্দয় হবেন না। আল্লাহ ভরসা!”

রূপার বলা প্রতিটি উক্তি কর্ণগোচর হতেই এক ফোঁটা অশ্রুও কপোল বেয়ে পরলো না। কিশোরী হাতের উল্টোপিঠে নিমিষেই মুছে ফেললো। নিজেকে শক্ত করতে কয়েকবার সুদীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো। বেগমকে স্বাভাবিক করতে রূপা আহারের তাড়া দিলো,

–“দ্রুত আহার করুন বেগম! আপনি ক্ষুদার্ত থাকলে আপনার শাহীর বাবু আমার গর্দান নিবে।”

অধর প্রশস্ত করলো কিশোরী। এই হাসিতে মুগ্ধ হয় সকলেই। রূপাও বাকিদের ব্যতিক্রম নয়। মালকিনের এই অমূল্য হাসি দেখে রূপা আনমনেই বলে ফেললো,

–“আপনি এভাবেই হাসতে থাকুন বেগম! আপনার এ মুখে হাসিটা বড্ড মানায়!”

–“হুম হয়েছে। আবৃতি ছেড়ে খেতে আসো! তোমারও যে পেটে কিছু পরেনি!”

—————-

বদ্ধ কক্ষে এলোমেলো হয়ে বসে আছে শাহাজাদী রাত্রী। সকালের আকর্ষণীয় সাজ আর নেই। আঁখিযুগলের কৃষ্ণ কাজল লেপ্টে আছে অশ্রুতে। কী বিমর্ষ লাগছে। এক মুঠো ভাতও মুখে তুলেনি শাহাজাদী। খাস বাঁদী রিপা বারংবার আহার করাতে চেয়েছিলো কিন্তু শাহাদাজী রাত্রী প্রতিবার ভাঙ্গা গলায় বলতো,

–“আমায় একা থাকতে দাও, রিপা!”

তার ভালোবাসার মূল্য এভাবে পাবে কখনো কল্পনাও করেনি শাহাজাদী রাত্রী। হেরে গেলো সে, নিজ ভালোবাসার কাছে। সেই শ্যামবতী কন্যার কাছে, যে ইতিমধ্যে তার একমাত্র ভালোবাসার অর্ধাঙ্গিনী। বাস্তবতা এতো কঠিন না হলেই পারতো। খুব করে চাইছে সবটা একটি দুঃস্বপ্ন হোক, এই দুঃস্বপ্ন ভেঙ্গে যাক! সে শাদবিনকে নিজের করে পাক। কিন্তু তার এই ঠুনকো চাওয়া পূরণ হলো না। দ্বিপ্রহর হতে এখন সায়াহ্নের প্রথম ভাগ। এভাবে হেরে গেলো এই শ্যামবতীর কাছে? কী এমন ছিলো ওই শ্যামবতীর নিকট, যা এই শুভ্র কন্যার নিকট একবিন্দুও নেই? ব্যাকুল হৃদয় বড্ড ঈর্ষাম্বিত ওই সাধারণ নারীর প্রতি। ঈর্ষাম্বিত হবেই না কেন, প্রিয় পুরুষের প্বার্শে কোন নারী অন্য নারীকে সহ্য করতে পারে? বাকি নারীদের মতোন শাহাজাদী রাত্রীও যে ব্যতিক্রমধর্মী নন! এর মানে কী এই অনুভূতি গুলো মূল্যহীন? একসময় এই অনুভূতি গুলোতে মরিচিকা ধরে যাবে?
মুহূর্তেই আবারও ডুকরে কেঁদে ওঠে শাহাজাদী রাত্রী। তার এই ক্রন্দন চার দেয়ালের মাঝেই সীমাবদ্ধ।

———————

সারাদিন প্রতিক্ষায় রইলো কিশোরী কিন্তু জমিদার যুবকের সাথে তার সাক্ষাৎ হয়নি। কম চেষ্টা করেনি শাদবিনের খোঁজ করতে। কেউ মনমতো উত্তর এনে দেয়নি কিশোরীকে। কিশোরী ভাবান্তর। মোনাজাতে অনেকক্ষণ কান্নাকাটি করলো। বারংবার বললো তার কাছে যেন তার শাহীর বাবুকে ফিরিয়ে দেয়। এই দূরত্ব, অবহেলা যে সহ্য করার মতোন নয়।

রজনীতে কিশোরীর পেটে দানা পরলো না। কী করে নিবে, মুখে নিলেই তো গলায় গিয়ে আটকে যাবে। রূপা অনেকবার করে বললো আহার সেরে নিতে। কিন্তু জেদী কিশোরীর জেদের কাছে একসময় সে নিজেও হার মেনে নিলো। কক্ষ হতে বের হয়নি কিশোরী সারাদিন! তাই এই সৌখিন অন্দরমহলকেও তার চেনা হলো না। কী করে এগোবে শাদবিন ব্যতীত জীবনের বাকিটা পথ। এরকম নানান ভাবনা ভাবতে ভাবতে কিশোরীর নেত্রে তন্দ্রা নেমে এলো।

ভুলবশত কিশোরীর আজ ফজরের ওয়াক্তের পরপর ঘুম ভাঙে। পিটপিট করে উঠে বসে নিজ অবস্থান পর্যবেক্ষণ করলো কিশোরী। পরমুহূর্তে সব স্মরণে আসতেই দর্পণের নিকট তাকিয়ে চমকে উঠলো। শাদবিন দাঁড়িয়ে। নিজের কৃষ্ণ কেশে হাত বুলাতে ব্যস্ত যুবক। চোখ কিছুটা ফুলে আছে, যেন কিছুক্ষণ পূর্বেই তন্দ্রা কেটেছে তার। কিশোরী অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয় যুবকের নিকট। এ যেন শ’ত বছরের তৃষ্ণা। অথচ গতকালই যুবককে দেখেছিলো কিশোরী। ভালোবাসার মানুষগুলোর দৃষ্টি এতো তৃষ্ণার্ত হয় কেন? এই তৃষ্ণা কবে ফুরোবে? কবে ব্যাকুলতা কমবে? দর্পণে শাদবিনও খেয়াল করলো কিশোরীর চাহনি। তবে সে কোনোরূপ আগ্রহ প্রকাশ করলো না। অবহেলায় আঁখিযুগল অশ্রুসিক্ত কিশোরীর। মিইয়ে যাওয়া গলায় বললো,

–“আর কতো আমায় দহনে পোড়াবেন শাহীর বাবু? কেন দিচ্ছেন এতো শাস্তি? এতোটা নির্দয় তো নন আপনি!”

যুবক নিরুত্তর। শান্ত চাহনি নিক্ষেপ করে রইলো ক্রন্দনরত কন্যার নিকট। অভ্যন্তরে বলে ওঠলো,

–“তুমি যে এর চাইতেও বড় শাস্তির প্রাপ্য ভ্রমরাণী! শোকর করো এর চাইতে বড় শাস্তি তোমায় আমি দিতে পারি না। নয়তো আমার ক্ষতটা আরও ভালো করে উপলব্ধি করতে। তোমায় যে খারাপ স্পর্শ করার স্পর্ধা আমার নেই। সেই দুঃসাহস থাকলে এই অন্দরমহলে তোমায় এতো শীঘ্রই তুলতাম না!”

–“চুপ কেন, শাহীর বাবু? উত্তর দিন, কোথায় ছিলেন আপনি?”

–“নিজ কক্ষে!” শাদবিনের স্বাভাবিক উত্তর। সে ভেতরকার তোলপাড় এক মুহূর্তের জন্যেও প্রকাশ করলো না। কিশোরী বিষ্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ়! নিজ কক্ষে মানে? এটা কী তার কক্ষ নয়?

–“নিজ কক্ষ মানে? আপনাকে তো আমার কক্ষে একবারও দেখিনি!”

–“যেখানে তুমি অবস্থান করছো তার বিপরীতের কক্ষটি আমার। আসছি!”

–“শাহীর বাবু দাঁড়ান!” বলতে বলতে একপ্রকার তাড়াহুড়োয় শয্যা ছেড়ে উঠতে নিয়ে কাঁথায় পা জড়িয়ে পরে যেতে নিলো, ঠিক তৎক্ষনাৎ শাদবিন এসে বেসামাল কিশোরীকে বাহুডোরে আবদ্ধ করে ফেললো।
কিশোরী নাক টেনে বিমূঢ় দৃষ্টিতে শাদবিনের নিকট চাইলো। একমুহূর্তের জন্যে জমিদার যুবকের মুখশ্রীতে ভীতির ঢেউ দেখা গেলো। হৃদপিন্ডর দ্রুতগতি শ্রবণ হচ্ছে নির্দ্বিধায়! এই ব্যাকুলতা কী তাহলে কিশোরীর জন্যেই। কিশোরী ডাগর চাহনি নিক্ষেপ করে রইলো প্রিয় প্রেমিক পুরুষটির নিকট। কিন্তু এই চাহনি বেশিক্ষণ টিকলো না। শাদবিনের কন্ঠের ঝংকারে কেঁপে উঠলো কিশোরী।

–“ধ্যান, জ্ঞান কোথায় তোমার? এতোটা অগোছালো হলে চলবে কীভাবে? আমি সঠিক সময়ে না আসলে কী দুর্ঘটনা ঘটতো ভাবতে পারছো? আমায় কষ্ট দেয়ার নিয়ত করে থাকো নাকি তুমি? কেন প্রতি মুহূর্তে এভাবে হেলা-ফেলা করো আমায়? একবারও বুঝো না, এই বক্ষের বা-পাশের রক্তক্ষরণ! আমার বাগানের প্রতিটি ফুল মৃত, সেই খবর কী তোমার অজানা ভ্রমরাণী? নাকি জেনেও না জানার ভান করে থাকো?”

————————–

শাহাজাদী রাত্রী খুব ভোরেই চলে গেছে! এই সংবাদ এখন পৌঁছেছে বেগম আকলিমার কর্ণধারে। বেগম আকলিমা বর্তমানে ভিষণ রাগাম্বিত ওই শ্যামবতীর প্রতি। এতটাই রাগাম্বিত যে কিশোরীকে তার এক মুহূর্তের জন্যেও দেখতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু হাত গুটিয়েও যে বেশিদিন বসে থাকা যায় না। কিছু না কিছু ব্যবস্থা করতেই হবে। বেগম আকলিমা তার পরামর্শকারী কুলসুমের কাছে বলতে লাগলো,

–“বুঝলে কুলসুম! আজকের জন্যে ওই শ্যামবতী কন্যাকে শিক্ষা দেয়ার দারুণ মতলব এসেছে। এই কন্যার কারণে আমার শাহাজাদী মহল ছেড়েছে, কী করে ছেড়ে দেই তাকে? কঠিন যন্ত্রণা ভুগবে সে!”

বেগম আকলিমার হস্তে এক পান গুঁজে দিয়ে নিজে আরেক পান মুখে দিয়ে দিলো। অতঃপর মুখে থাকা পানটি বিশ্রী ভঙ্গিতে চিবুতে চিবুতে বলে,

–“ওটা আর বলার কী আছে বেগম? চেপে ধরুন ভালো ভাবে, দেখবেন দু’দিনও টিকবে না। খুব সখ তার, জমিদারনি হওয়ার। ঘুচিয়ে দিন সখ, চিরজীবনের জন্যে। শাদবিনের মতো চাঁদে কিনা ওই কন্যার কলঙ্ক লাগবে? আমাদের শাহাজাদী রাত্রীকেও দূরে সরিয়ে দিলো, একদিন না পেরোতেই? নিশ্চয়ই কোনো শয়তানি খেলছে এই কিশোরীর মস্তিষ্কে!”

–“আজকাল কী হয়েছে বলো তো কুলসুম? তোমার বিরক্তিমাখা কথাগুলো মধুর সুর লাগছে ইদানীং!”

বেগম আকলিমার বচনে কুলসুম পান চিবানো থামিয়ে লাল দাঁতগুলো বের করে ফিচেল হাসি দিয়ে বলে,

–“হি হি! সবই আপনার দোয়া বেগম!”

–“বেশ! এখন আমার নীল নকশা শুনো!”

বলেই বেগম আকলিমা নিজ পরিকল্পনা জানালেন। কুলসুম সব শুনে পান চিবুতে চিবুতে বললো,

–“প্রথম হিসেবে বেশি ভালোও না আবার খারাপও না। চেষ্টা করে দেখতে পারেন। আপনার এই পরিকল্পনা কাজে না দিলে দ্বিতীয় পরিকল্পনা আমি করবো, যদি আপনি হুকুম করেন!”

–“ঠিক আছে। দিলাম অনুমতি!”

~চলবে, ইনশাল্লাহ।

গ্রুপঃ LaBiba’s Typescripts

বিঃদ্রঃ আসসালামু আলাইকুম। ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। কেমন হয়েছে জানাবেন সকলে। পরীক্ষা, কোচিং, প্রাইভেট নিয়ে ব্যস্ত থাকায় তিনদিন লিখতে পারিনি। তাই মূলত আজ দুই পর্ব দেয়া। আপনাদের গঠনমূলক মন্তব্যই পারে পরবর্তী পর্ব লেখার অনুপ্রেরণা দিতে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here