ভালোবাসার উষ্ণতা পাঠ-৪

#ভালোবাসার_উষ্ণতা
#৪র্থ_পর্ব

ধীরে ধীরে প্রাপ্তির দিকে এগিয়ে যেতে থাকলে কি মনে করে নিজেই থেমে যায়। মস্তিষ্ক আর মনের যুদ্ধে আহত সৈনিকের ন্যায় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে অয়ন। সুপ বানিয়ে পেছনে ফিরতেই খানিকটা ভয় পেয়ে যায় প্রাপ্তি। অয়ন মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। সে ভাই নিজের বড় ভাই এর জন্য জীবনটাও বাজি ধরতে পারে অথচ আজ পরাজিত সৈনিকের মতো দাঁড়িয়ে আছে যেখানে আবরারের অবস্থা ভালোর দিকে।
– কিছু লাগবে?

প্রাপ্তির কথায় মাথা তুলে বেশ কিছুক্ষণ তার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে অয়ন। আজ অয়নের চোখে কোনো ক্ষোভ দেখতে পাচ্ছে না প্রাপ্তি। বরং কিছু চাপা কষ্ট বুকের মাঝে আগলে রাখার প্রমাণ দিচ্ছে এই চোখ জোড়া। প্রাপ্তি অয়নের কাজ থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে আবার জিজ্ঞেস করে,
– কি হয়েছে আপনার? কিছু লাগবে?

প্রাপ্তির প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে আচমকা তাকে জড়িয়ে ধরে অয়ন, যেন ছেড়ে দিলে হারিয়ে যাবে। অয়নের পাগলামি আগেও দেখেছে প্রাপ্তি। এই বান্দার কাজের যে কোনো ঠিক ঠিকানা নেই খুব ভালো করেই জানা তার। তাই শান্ত ভাবেই নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে লাগলো সে। অয়ন বেশ কিছুক্ষণ জড়িয়ে ধরে একটা কথাই বললো,
– নিজেকে পরাজিত লাগছে, মন আর মস্তিষ্কের যুদ্ধে আমি আজ পরাজিত।

বলেই প্রাপ্তিকে ছেড়ে দিয়ে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে গেলো। প্রাপ্তি কিছুক্ষণ বোকার মতো অয়নের যাবার দিকে তাকিয়ে ছিলো। এই লোক কখন কি করে, কেনো করে তার কোনো ঠিক নেই। ভেবে মাথাটার বারোটা বাজবে এছাড়া লাভের লাভ কিছুই হবে না। প্রাপ্তি সুপ নিয়ে আবরারের রুমে প্রবেশ করলো। আবরারকে এখন নল দিয়েই খাবার দেয়া হবে, মুখ দিয়ে খেতে সময় লাগবে। এখনো সে কোনো কথা বলে নি। শুধু তাকিয়েই ছিলো, তবে রেসপন্স করছে। ঘুমের ঔষধ নিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে তাকে। কি এমন হলো যে, এতোটা খারাপের দিকে চলে গেলো বুঝতে পারছে না প্রাপ্তি। আবরারের মুখের দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো সে। খুব শান্ত লাগছে তাকে, মুখের বা পাশটা পুড়ে গেছে এক্সিডেন্টে। যতদূর শুনেছিলো আবরারের ৬০ শতাংশ শরীর পুড়ে গিয়েছিলো। এ যাবৎ চার বার সার্জারী হয়েছে। এটা প্রাপ্তিকে জানানো যে হয়েছিলো তা কিন্তু নয়। এ বাড়ির কাজের লোকদের কানাগুসাতে সে জানতে পারে। এই জন্য হয়তো বাসর রাতের দিন এতো ভয় পেয়েছিলো। আবরারের অবস্থা ভালো হলে ইউ.এস.এ এর ক্যালিফোর্নিয়াতে পাঠিয়ে দিবে অয়ন তাকে। প্রাপ্তির এসব কিছুই জানা নেই। জানার সুযোগ সে কখনো পায় নি আর চেষ্টা সে করে নি। আজ নিজেকে বড্ড অপরাধী লাগছে এই লোকটার দেখভাল তার দায়িত্ব ছিলো অথচ সে কিছুই করে নি। এসব ভাবতে ভাবতেই আবরারের পাশে ঠায় বসে থাকে সে।।

রাত ৮টা,
স্থানঃ জার্মান ক্লাব, গুলশান।
একের পর এক হুইস্কির বোতল শেষ করে যাচ্ছে অয়ন। মনকে শান্ত করাটা দুষ্কর হয়ে পড়েছে। এমনটা হোক এটা তো এতোদিন দোয়া করতো তবে আজ কি হলো। নিজের আবেগগুলো কেনো আজ বেসামাল হয়ে পড়েছে। তবে কি ভেতরে থাকা বরফ কঠিন হৃদয় উষ্ণতার আভা পেয়েছে? তার কাঠিন্য হৃদয়ে কি তবে অনুভূতির বীজ রোপিত হয়েছে?
– লিভারটা তো খেয়ে ফেলবি রে এভাবে মদ খেলে! আর কত খাবি?

পাশে বসতে বসতে সামি বলে উঠে। সামি অয়নের খুব বিশ্বস্ত বন্ধুদের একজন। অয়নের এ টু জি সব খবর সামির জানা। আজ অয়ন মুখে কিছু না বললেও সামি খুব ভালো করেই জানে অয়নের মন যে খারাপ এবং সে নিজের সাথে নিজেই যুদ্ধ করে চলেছে। মদের গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে বলে উঠে,
– ভাই এখনো ওই মেয়েকে ভালোবাসে।
– ও, তো?
– তো মানে? ওই মেয়েটা তো আমার
– তোর কি? বউ? ওটা তো শুধু কাগজের, আর মেয়েটাও জানে সে আবরার ভাইয়ের বউ। আর তুই তো ওকে অন্য একটা কারণে বিয়ে করেছিলি! নাকি এখন তোর লক্ষ্য বদলে দিয়েছিস? নাকি তুই এখনো মেয়েটাকে ভালোবাসিস?
– কি যা তা বলছিস?
– আমি কিছুই বলছি না। তোর মনের খবর তো তুই জানবি! আমি তো যা দেখতে পারছি তাই বলছি। তোর আজ খুশি হবার কথা অথচ তুই আজ মদ খেয়ে নিজের কষ্টটাকে লুকোচ্ছিস। কেনো কষ্ট হচ্ছে? এজন্য না যে, ভাই যদি জানে তার ভালোবাসাকে তুই বিয়ে করেছিস তখন তোকে ভুল বুঝবে। এজন্য যে তুই যাকে বিয়ে করেছিস সে তোর ভাইয়ের ভালোবাসা।
– তোর ফালতু কথা শোনার বিন্দু মাত্র ইচ্ছে আমার নেই।
– তাই?
– হ্যা, আমি ওই মেয়েটাকে বিয়ে করেছি ওর প্রাপ্য শাস্তি তাকে দিতে পারি।
– তাহলে দে, মানা কে করেছে।
– ভাই তো
– ভাই এখনো অসুস্থ, তার জন্য কোথাও না কোথাও মেয়েটা কিন্তু দায়ী। আর আমাদের হাতে সময় কিন্তু নেই বললেই চলে৷
-…
– দূর্বলতা খুব খারাপ জিনিস, কারোর প্রতি দূর্বল হয়ে গেলে সে লক্ষ্য থেকে নিজেকে সরিয়ে ফেলে। বাকিটা তোর উপর।

সামির কথাগুলো যেনো অয়নের ঔষধের ন্যায় কাজ করেছে। সত্যিই তো, তার ভাই এর এই অবস্থার জন্য প্রাপ্তি দায়ী। প্রাপ্তি তার প্রাপ্য শাস্তি তো পেতেই হবে।

রাত ১১টা,
আজ কাজের লোকেদের হাতের খাবার প্রাপ্তি খায় নি। নিজেই রান্না করেছে, রান্না শেষে খেয়ে খাবার গুলো গুছাচ্ছিলো। হুট করেই অয়নের কথাটা মনে পড়ে, লোকটা সেই বিকেলে বেরিয়েছে এখনো বাড়ি ফিরে নি। আচ্ছা, লোকটা খেয়েছে তো? পরমূহুর্তে চিন্তাটা ঝেড়ে ফেলে দিলো মাথা থেকে। ওর চিন্তা করার লোকের অভাব নেই। অহেতুক নতুন করে কারোর চিন্তা করা লাগবে না। এই তিন মাসে কম মেয়েকে তো বাড়িতে আনে নি। দেখা যাবে মদ খেয়ে কোনো নারী সঙ্গে লিপ্ত আছে। খাবার গুলো রাখা শেষে রুমের দিকে যেতে লাগলেই কলিং বেলটা বেজে উঠলো।

দরজাটা খুলতেই দেখে অয়ন অপাশে দাঁড়িয়ে আছে। শার্টের ইন নষ্ট হয়ে আছে, চুল এলোমেলো। আজও ছাইপাশ খেয়েছে এটা বুঝা খুব কঠিন নয়। ঢুলু ঢুলু চোখে প্রাপ্তির দিকে তাকিয়ে রয়েছে অয়ন। তার কাছে এই মূহুর্তে প্রাপ্তিকে কোনো অপ্সরার থেকে কম মনে হচ্ছে না। মাথায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে রয়েছে, পাতলা ঠোঁট জোড়া যেনো গোলাপের ভেজা পাপড়ির ন্যায় লাগছে। ফর্সা নাকটায় ঘামের বিন্দু গুলো স্পষ্ট। ওড়না মাজায় বেধে রেখেছে। পুরো যেনো পাকা গিন্নি তার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। একবার ইচ্ছে করছিলো ঠোঁট জোড়া ছুয়ে দিতে। কিন্তু নিজেকে আটকে রেখে রুমের দিকে রওনা দিলো অয়ন।

প্রাপ্তি বিকেল থেকেই অয়নের পরিবর্তন লক্ষ্য করে যাচ্ছে। আজ অয়নকে বড্ড অন্যমনস্ক লাগছে প্রাপ্তির। কি এমন হলো তার? বিছানাতে শুয়েও কিছুতেই শান্ত করতে পারছে না নিজেকে। আচ্ছা এতো কেনো ভাবছে অয়নের জন্য সে? অয়ন যে কিনা পদে পদে তাকে অপমান করতে পিছ পা হয় না।
এসব ভাবতে ভাবতেই হুট করে দরজার খুট খুট শব্দ শুনতে পায় প্রাপ্তি। খুব মনোযোগ দিয়ে শুনলে বুঝতে পারে তার দরজার লক কেউ খুলছে। প্রাপ্তি বুকে কামড় পড়ে যায়, এই রাতে কে আসবে তার রুমে? খুট করে দরজা খুলে কেউ ভেতরে আসে। প্রাপ্তির পিঠ দরজার দিকে ছিলো বলে মানুষটার চেহারা সে বুঝতে পারে নি। ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে সে। অচেনা ব্যাক্তিটি তখন…..

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here