অবেলায় বসন্ত (পর্ব – ১)

দুহাতে চোখের পানি মুছতে মুছতে চিত্রা অফিসে যাবার জন্য তৈরি হচ্ছিল। চুলগুলো কোনোমতে পিছমোড়া করে বেঁধে ব্যাগটা কাধে ঝুলিয়ে নাশতা না করে সমস্ত পৃথিবীর উপর এক বুক অভিমান নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে গেল। পেছন থেকে চিত্রার মা জাহানারা বেগম একবার ডাকলেন খেয়ে যাবার জন্য, তবে সে ডাকে ভালোবাসা নয় বিরক্তির প্রাধান্য ছিল। ভালোবাসা যেমন উপেক্ষা করা যায় না তেমন বিরক্তি সহ্য করা যায় না। তাই চিত্রা মায়ের ডাকের পরোয়া না করে চলে গেল। অফিস যেতে তার প্রায় ঘন্টাখানেক লাগে। রাস্তায় বের হয়ে নিজেকে ধাতস্ত করার চেষ্টা করল। অফিস বাসে উঠে সে মনের যত ব্যথা আওড়াতে লাগল। আজকাল প্রায় রোজই তাকে না খেয়ে বের হতে হচ্ছে। মাঝে মাঝে রাগ করে রাতেও না খেয়ে থাকে। সে কী ধীরেধীরে খুব বেশি রাগী হয়ে যাচ্ছে নাকি ইমোশনাল আর অভিমানী হয়ে যাচ্ছে? সে তো এমন ধারার মেয়ে নয়… এই পৃথিবীর নিম্ন মানসিকতা তাকে এমন করে দিচ্ছে। একটু একটু করে রোজ তাকে আরও বেশি অভিমানী করে তুলছে। জীবন সম্পর্কে আজকাল সে খুব বেশিই অসহায় বোধ করে। এই অসহায়ত্বের পরিসমাপ্তি কবে কোথায় গিয়ে ঘটবে কে জানে? একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে বাসের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল।

চিত্রা বাবা মায়ের ২য় সন্তান। বড় ভাই আর ছোট একটা বোন আছে। ছাত্র হিসেবে তারা সবাই ভালো ছিল। তার ভাইয়া চঞ্চল হাসান পাবলিক ভার্সিটি থেকে পড়াশোনা করে বের হয়ে এখন সরকারি চাকুরিজীবি। নিজের পছন্দে বিয়ে করেছে। ভাবী হাউজ ওয়াইফ। সংসারে ভাবীর প্রধান কাজ চিত্রাকে ছোট করে নানান উছিলায় কথা শোনানো। মানুষ পারেও বটে! নিজে একজন নাড়ী হয়ে অন্য একজনের প্রতি এমন মনোভাব নিয়ে কীভাবে বাস করে তা চিত্রা বুঝে উঠতে পারে না। ছোট বোন চন্দ্রা রাজশাহী মেডিকেলের ছাত্রী, সেই সাথে দেখতে সুন্দরী। তাই তার প্রতিনিয়তই ভালো বিয়ের প্রস্তাব আসত। কিন্তু চিত্রার বিয়ে না হবার কারণে তাকে বিয়ে দেওয়া যাচ্ছিল না। কিন্তু এভাবে আর কতদিন? দেখতে দেখতে চন্দ্রা মেডিকেল পাস করে ঢাকা মেডিকেলে ইন্টারনি শুরু করে দিল। তাই এক সময় চিত্রাকে রেখেই চন্দ্রার বিয়ে দেওয়া হল। ছেলে ডাক্তার সাথে বিত্তশালী পরিবার। যাদের গা থেকে আভিজাত্য ঠিকরে বেরোয়। PHD করতে স্বামী-স্ত্রী দু’জন জাপান চলে গেছে। চন্দ্রার যেন রাজ কপাল। আর চিত্রা… চিত্রা তো তার পরিবারের দীর্ঘশ্বাস কেবল! তার গায়ের রঙ একটু চাপা… না, ঠিক “একটু চাপা” নয় অনেক বেশিই চাপা। এত সুন্দর পরিবারে সে এক অন্ধকার অপ্রয়োজনীয় অংশ। গায়ের রঙ এর কারণে সেই ছোট্ট থেকেই তাকে তিরষ্কার বাণী শুনে আসতে হয়েছে। যত বড় হয়েছে তত সে নিজেকে নিয়ে অস্বস্তি বোধ করেছে, অসহায় বোধ করেছে। নিজেকে সব সময় গুটিয়ে রাখতে হয়েছে গভীর হীনমন্যতায়। কখনোই প্রজাপতির মত পাখা মেলে ওড়া হয়নি ওর। পড়াশোনাটাকে একমাত্র প্রিয় সঙ্গী করে নিজেকে এগিয়ে নিয়ে গেছে স্বপ্নের পথে। আজ সে একজন সফল ইন্টেরিয়র ডিজাইনার। একটি ইন্টেরিয়র ডিজাইনিং কন্সাল্টেন্সি ফার্মে কাজ করছে ৩বছর ধরে। যখন যে প্রজেক্টে হাত দিয়েছে অভাবনীয় সাফল্য পেয়েছে। মোটা অংকের মাইনে পায়। কিন্তু তার এই মেধা, ক্রিয়েটিভিটি, উপার্জন, সাফল্য সবই দিন শেষে তার গায়ের কালো বর্ণের কাছে হেরে গিয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে যায় ভোজবাজির মত! সমাজের চোখে একজন নারীর সফলতা তো কেবল তার রূপ আর ভালো পাত্রস্থ হওয়ার মাঝে! তাই যখন থেকে চিত্রা বুঝতে শিখেছে তখন থেকেই নি*র্বোধ সমাজের উপর একটু একটু করে অভিমান জমেছে। বিন্দু বিন্দু করে জমা সে অভিমান আজ সিন্ধুতে পরিনত হয়ে গিয়েছে।

চিত্রা অফিসে এসে তার কেবিনে ঢুকে আরাম করে বসল। আজ তার কর্ম ব্যস্ততা রয়েছে অথচ কোনো কাজ করতে তার মন চাইছে না। খেয়ে না আসার কারণে খিদেটা কেমন ছটফট করছে পাখির ছানার মতন। চাইলেই অফিস ক্যান্টিন থেকে নাশতা আনিয়ে খাওয়া যায় কিন্তু তার ইচ্ছে হল না। সে চোখ বন্ধ করে চেয়ারে হ্যালান দিয়ে পড়ে রইল। তার এই শরীরটারই তো যত দোষ! থাকুক সে অভুক্ত… শরীরের কারণে শুধু মন কেন একা কষ্ট নেবে শরীরের নিজেরও তো উচিৎ এই ভার বহন করা? তারপর আজ অফিসে কী কী কাজ আছে মনে মনে সেসব গুছিয়ে নিল। দু’দিন হল গুলশানের একটা এ্যাপার্টমেন্টে নতুন একটা প্রজেক্ট নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। আজ সেটা তার সরেজমিনে দেখতে যাবার কথা। সে সেখানে যাবার প্রস্তুতি নিল। অফিসের টুকটাক কাজ ছিল সেটা ২০ মিনিটে শেষ করে বের হয়ে গেল গুলশানের উদ্দেশ্যে।

গুলশানের যে এ্যাপার্টমেন্টে কাজ চলছে সেটা খুঁজে বের করে তার সামনে এসে রিকশা থেকে নামল চিত্রা। রিকশাটা বিল্ডিং এর গেটের মাঝ বরাবর দাঁড়িয়েছে। চিত্রা ভাড়া দিচ্ছিল, এমন সময় গেট থেকে একটা গাড়ি বের হচ্ছিল। গাড়িটা হর্ণ দিল, চিত্রা বিরক্ত হল। আশ্চর্য, ভাড়া দিতে কতই বা সময় লাগবে এত অস্থির কেন? রিকশায় এসেছে বলে কী তার কোন মান নেই নাকি? সে তখন ইচ্ছে করে দেরি করল। টাকা বের করার নামে অনেক্ষণ ধরে ব্যাগ ঘাটাঘাটি করল তারপর ১হাজার টাকার একটা নোট বের করল খুচরো টাকা থাকা সত্যেও। রিকশাচালক বলল তার কাছে এত বড় নোটের ভাংতি নেই। ওদিকে গাড়ি হর্ণ দিয়েই যাচ্ছে। এক সময় গাড়িচালক গাড়ি থেকে মাথা বের করে বলল- excuse me… can’t you leave the road and stand back a little?

চিত্রা তখন পেছনে তাকিয়ে ছোটখাটো একটা ধাক্কা খেল… এত সুদর্শন পুরুষ হয়? ঝকঝকে কালো মার্সিডিজ গাড়ি, রেড পোলো টিশার্ট, চোখে হালকা ফ্রেমের চশমা সবই যেন লোকটার জন্যই তৈরি হয়েছে! একে দেখে যে কারোই বুকে ব্যথা শুরু হবার কথা। না জানি ব্যাটার বউ কী করে এমন সৌন্দর্য সহ্য করে? তার তো দিনে হাজারবার মরে যাবার কথা! লোকটা তখন আবার হর্ণ বাজাল… চিত্রা তখন লোকটার দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল- আপনার কাছে ১হাজার টাকার নোটের ভাংতি হবে?

-what?

-আমার কাছে ভাংতি নেই, রিকশা ভাড়া দিতে হবে। থাকলে দিন না? মাত্র ৫০ টাকা… আমি পরিশোধ করে দিব ডোন্ট ওয়ারি।

-but I don’t know you, so how do you pay?

-I will manage…

লোকটা কিছুক্ষণ অদ্ভুত দৃষ্টিতে চিত্রার দিকে তাকিয়ে রইল তারপর ড্যাশবোর্ডের উপর রাখা ওয়ালেট থেকে ১০০ টাকা বের করে বলল- I don’t have 50 tk.

-no problem… চিত্রা ১০০ টাকার নোটটা নিয়ে রিকশাচালকে দিয়ে বলল- পুরোটা আপনার যান। রিকশাচালক খুশি হয়ে চলে গেল।

লোকটা তখন অবাক হয়ে বলল- the rent is 50 tk. why did you pay 100 tk?

চিত্রা গাড়ির কাছে এগিয়ে এসে মুচকি হেসে বলল- ওটা ওকে খুশি হয়ে দিয়েছি। তারপর ব্যাগ থেকে ৫০ টাকা বের করে বলল- এই নিন আপনার ৫০ টাকা। আমি কখনো ঋণ রাখি না। পরিশোধ করে দিলাম।

লোকটা আগের চেয়েও বেশি অবাক হয়ে বলল- oh God! you had money, but why did you take it from me? আর ১০০ টাকা নিয়ে ৫০ টাকা কেন ফেরত দিচ্ছেন?

-বাহ্ আপনি দেখছি ভালো বাংলা জানেন! তো এতক্ষণ ইংলিশ কেন আওড়াচ্ছিলেন?

-এটা আমার প্রশ্নের উত্তর হল না।

-আমি আপনার কাছে ৫০ টাকাই চেয়েছিলাম তো ৫০ টাকা ফেরত দিব না?

-কিন্তু নিয়েছেন তো ১০০ টাকা?

-বাকিটা তো রিকশাচালকের বকশিস ছিল সেটা কেন আমি ফেরত দিব?

-you are a strange creature, did you know that?

চিত্রা হাসতে হাসতে বলল- yes, I know, তারপর সে বিল্ডিং এ ঢুকে পড়ল।

চিত্রা যে এ্যাপার্টমেন্টের কাজ পেয়েছে সেটা ৭ তলায়, ডুপ্লেক্স ফ্ল্যাট। ফ্ল্যাটের মালিক এক ভদ্রমহিলা। মহিলা দু’মাস হল অস্ট্রেলিয়া থেকে এসেছেন একমাত্র ছেলেকে নিয়ে। এখানে তাদের স্থায়ী হবার ইচ্ছে নেই তবু যত দিন আছেন ফ্ল্যাটটাকে গুছিয়ে নিতে চান। সে কারণেই চিত্রার এখানে আসা।

সাজানো গোছানো বিশাল ড্রইং রুমে চিত্রা বসে আছে। মিনিট পাঁচেক পর ভদ্রমহিলা উপর থেকে নেমে এলেন। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় চিত্রা মহিলাকে ভালো করে খেয়াল করল… ভদ্রমহিলার চেহারা, পোশাক আর চলনে আভিজাত্যের ছাপ স্পষ্ট। অতি রূপবতীদের চেহারায় মায়াভাবটা থাকে না তাদের চেহারায় থাকে রূপের অহংকার, কাঠিন্য আর আভিজাত্যের ছাপ। কিন্তু এই মহিলার চেহারায় মায়াভাব আছে এবং বেশ ভালোভাবেই আছে। চেহারাটা কোথায় যেন দেখেছে বলে মনে হল চিত্রার… কোথায় দেখেছে?

ভদ্রমহিলা ততক্ষণে চিত্রার সামনে এসে সরাসরি বসে অবাক হয়ে বলল- কী অদ্ভুত!!!

চিত্রা বুঝতে পারল না এখানে “কী অদ্ভুত” বিষয়টা কী? মহিলা এই বয়সেও যথেষ্ট রূপবতী সে কারণেই কী সে চিত্রার রূপ দেখে এভাবে বলল? সেটাই স্বাভাবিক… সেই ছোট্ট বেলা থেকেই তো তাই হয়ে আসছে। কিন্তু এখানে সে কাজে এসেছে, এখানে তাকে এধরণের কথার সম্মুখীন কেন হতে হবে? চিত্রার রাগ হল তাই সে কিছুটা বিরক্ত মাখা গলায় বলল- sorry…?

-মানে, তোমার চোখ। কী অদ্ভুত মায়াময় চোখ… এত সুন্দর চোখ আমি আগে কখনো দেখিনি!

চিত্রা একটু বিষম খেল যেন। এভাবে কেউ কখনো কোনদিন তাকে বলেনি। সে নিজে যখন আয়নায় নিজেকে দেখে তখন সে তার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার খুব আফসোস হয় এই সুন্দর চোখ জোড়ার জন্য। তার গায়ের রঙের কারণে এত সুন্দর চোখ দুখানা সব সময় আড়াল হয়ে যায়… আজ প্রথম সে ছাড়া অন্য কারো কাছে এই সৌন্দর্য ধরা পড়ল! চিত্রার চোখে ততক্ষণে পানি চলে এসেছে। চিত্রা ভদ্রমহিলাকে হৃদয়ের গহীন থেকে ধন্যবাদ জানাল।

চিত্রার মুখের অভিব্যক্তি দেখে ভদ্রমহিলা কী বুঝলেন জানি না তবে তিনি চিত্রার প্রতি অন্য রকম এক অনুভূতি অনুভব করলেন। বললেন- যদিও প্রফেশনালি তোমার সাথে আমার দেখা তবু তুমি আমার সন্তানের বয়সী তাই “তুমি” করে বলছি। আসলে তুমি শব্দটায় আমি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি, শব্দটায় একটা ম্যাজিক আছে খুব সহজেই মানুষকে আপন করে ফেলা যায়। আর তাছাড়া…

-তাছাড়া?

-আসলে ব্যাপারটা ঠিক বোঝাতে পারছি না… তোমার সাথে ক’দিন গেলে হয়ত বোঝাতে পারব।

চিত্রা বুঝল মহিলা একাকীত্ব ফিল করেন, তার আশেপাশে হয়ত মানুষের সংখ্যা খুবই কম। কোথাও না কোথাও এই ভদ্রমহিলার সাথে তার মিল রয়েছে! কারণ সে নিজেও একা! সে বলল- আন্টি আপনি খুব অন্য রকম। আমাকে আপনি “তুমি” বলতেই পারেন সমস্যা নেই।

ভদ্রমহিলা খুশি হয়ে বললেন- চলো চা খেতে খেতে আমরা গল্প করি?

চিত্রা এসেছে এ বাড়ির ইন্টেরিয়র কাজের অগ্রগতি দেখতে ভদ্রমহিলা হয়ত সেটা ভুলে বসে আছেন! চিত্রার ইচ্ছে হল না তাকে কাজের কথা মনে করিয়ে দিতে। আজ নাহয় গল্পই হোক।

চিত্রার অনেকদিন পর আজকের দিনটা ভালোই কাটল। মিসেস চৌধুরীর সাথে অনেক গল্প হয়েছে। ভদ্রমহিলা দুপুরে চিত্রাকে নিয়ে একসাথে খেলেন। তবে কথার ফাঁকেফাঁকে নিজের ছেলের খুব গল্প করছিলেন। অস্ট্রেলিয়ার মেলবর্নে ছিলেন তারা। সেখানে তাদের নিজেদের বাড়ি আছে। উনার ছেলে ফাইজ চৌধুরী ইউনিভার্সিটি অফ মেলবর্নে প্রকৌশল বিভাগের জনপ্রিয় প্রফেসর। ছেলের বয়স বাড়ছে কিন্তু এখনো বিয়ে করেনি। তিনি একা থাকেন ছেলের বউ এলে অন্তত কথা বলার একজন মানুষ হত। কিন্তু তা আর হচ্ছে কই? এমনও হয়েছে মেয়ে বাড়ি পর্যন্ত চলে এসেছে ফাইজের জন্য কিন্তু ফাইজ কাউকে পাত্তাই দেয় না। মিস্টার ফাইজের এসব গল্প শুনে চিত্রার মনে হয়েছে ভদ্রমহিলা হয়ত বাড়িয়ে বলছেন। নিজের ছেলে তার উপর যোগ্যতাও ভালো তাই মা হিসেবে একটু রঙচঙ মেখেই হয়ত বলছেন। তবে একটা ব্যাপার কী ভদ্রমহিলা নিজের, নিজের ছেলের এত গল্প করছেন অথচ একবারও ছেলের বাবার কথা কিছু বললেন না! চিত্রার অনেকবারই ইচ্ছে হয়েছে জিজ্ঞেস করতে কিন্তু অভদ্রতা হতে পারে ভেবে আর করেনি। আর তাছাড়া সময় আছে পরেও জানা যাবে। ওদিকে দুপুরের পর থেকে চিত্রার মা ফোন দিয়েই যাচ্ছে কিন্তু চিত্রা ফোন ধরছে না। ব্যাপারটা এক সময় মিসেস চৌধুরী খেয়াল করলেন বললেন-

-আমি তো আসলে সুযোগ পেলেই গল্প নিয়ে বসে পরি। তোমার হয়ত জরুরী কোন ফোন আসছে, তুমি কথা বলো?

-না আন্টি সমস্যা নেই, আপনি বলুন আমার ভালো লাগছে শুনতে।

-ফোনটা রিসিভ করো অনেক্ষণ ধরে বাজছে।

চিত্রা উঠে গিয়ে ফোন পিক করল। তার মা ফোন করছিল। কেন করছিল চিত্রা জানে সেকারণেই ধরতে চাইছিল না কিন্তু শেষ পর্যন্ত ধরল। ফোন ধরতেই ওর মা কড়া গলায় বললেন-

-ফোন কেন ধরছিস না? তোকে না বলেছি আজ তাড়াতাড়ি বাসায় আসতে?

-মা আমি একটা প্রাইভেট জব করি সেটা ভুলে যাও কেন? চাইলেই বের হওয়া যায় না।

-কী করা যায় না যায় আমাকে শেখাতে আসবি না। পৃথিবীর এমন কোন প্রতিষ্ঠান নেই যেখানে কোন মেয়েকে বিয়ে সংক্রান্ত বিষয়ে কিছু সময়ের জন্য ছুটি দিতে পারে না। ফোন রাখছি তুই তাড়াতাড়ি বাসায় আয়।

চিত্রা বিরক্তির সাথে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। দু’দিন আগে তার মা তাকে একটা ছেলের বায়োডাটা দিয়েছিল আজ সেই ছেলের তাকে দেখতে আসবার কথা। কিন্তু চিত্রার আজকাল দেখতে আসার কথা হলেই রাগ এবং হতাশ লাগে। তার গায়ের রঙ আর বয়সের কারণে যে কোন ছেলেকেই পাত্র হিসেবে তার সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়া হয়। যেন ছেলে হলেই হল কোয়ালিফিকেশ কী দরকার? বিয়ে হওয়াটাই মূল বিষয়। কিন্তু চিত্রা এমন জীবন চায় না। বিয়ে করে শুধু রান্নাবান্না আর বাচ্চা পয়দা করার জীবন তার কাছে কোন জীবন নয়। বিয়ে মানে প্রথমত এমন একজন মানুষ তার জীবনে আসুক যে তার মানসিক শান্তির জায়গা হবে। সে চায় একজন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন গোছানো মানুষ যার সাথে সকাল সন্ধ্যা কথা বলা, সময় কাটানোটা হবে প্রিয় অভ্যাস। বহমান শান্ত অথচ স্রোতস্বিনী নদীর মত কলকল ছন্দ তুলে সময় বয়ে যাবে। ইচ্ছে হবে সময়গুলো ধরা থাকুক হাতের মুঠোয়। আর আক্ষেপ হবে “সময় এত দ্রুত কেন চলে যায়?” বন্ধুত্বের প্রাচীরে আগলে রাখুক। কিন্তু তেমন পুরুষ কই? যারা তাকে বিয়ে করতে আগ্রহী তারা কেবল তার চাকরির পদবী বা বেতন স্কেল দেখে আসে। নাহয় পাত্রের কোন দিক থেকে বড় কোন কমতি আছে। এসব তেলতেলে মানুষ চিত্রার কাছে অসহ্য মনেহয়। এমন মানুষের সাথে জীবন কাটাবার চেয়ে একলা থাকা বেস্ট অপশন। সে আছে তো, বেশ আছে তার এই একলা জীবনে। জগতে তার মতন হয়ত আরও অনেকে আছে যাদের কষ্ট, অপ্রাপ্তি, কান্নাগুলো অন্ধকারের নৈঃশব্দে মিলিয়ে যায়। তারা কখনো শব্দ বা ভাষা হয়ে উঠতে পারে না। তার এই অনুভূতি, চাওয়া, ইচ্ছেগুলো তার পরিবারকে কিছুতেই বোঝাতে পারছে না সে। কারো নিজের পরিবার যখন এভাবে বুঝতে চায় না, পাশে থাকতে চায় না তখন এর চেয়ে দুর্বিষহ জীবন আর কারো হতে পারে না। তার এখন ইচ্ছে করে মরে গিয়ে সবাইকে উদ্ধার করে দিতে… এসব ভাবতে ভাবতে চিত্রা লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মিসেস চৌধুরীকে বলল-

-আন্টি আমি যাচ্ছি। কাজ তো দেখলাম ডিরেকশন আর প্ল্যান তো সব দেয়া আছে এরপরেও হয়ত আমাকে ২/১ দিনের মধ্যে আবার আসতে হবে। আর যে কোন প্রয়োজনে ফোন তো আছেই, কল করবেন।

-ঠিক আছে। কিন্তু তুমি অবশ্যই আসবে। তোমাকে আমি হাঁসের মাংস রান্না করে খাওয়াব। আমার ছেলের খুব পছন্দ তোমারও পছন্দ হবে।

চিত্রা মনে মনে বলল- হাঁসের মাংস আমার একদমই পছন্দ না আর উনার ছেলের পছন্দ দিয়ে আমি কী করব? কিন্তু ভদ্রমহিলার খুশি দেখে বলল- ঠিক আছে আন্টি খাব একদিন।

চিত্রা বের হবার জন্য দরজার কাছে আসতেই কলিং বেল বেজে উঠল। দরজা খুলতেই যে এসেছে চিত্রা তার মুখোমুখি হয়ে গেল। আগুন্তুকের চেহারা দেখে চিত্রা চোখ বন্ধ করে ফেলল! ঘুমের ঘোরে দুঃস্বপ্ন দেখলে আমরা যেমন করে জেগে উঠি সেটা থেকে বের হয়ে আসতে তেমন করে জেগে থাকা অবস্থায় ভয়ংকর কিছু দেখলে চোখ বন্ধ করে ফেলি সেটা থেকে লুকানো যাবে বলে! যদিও দৃশ্যটা ভয়ংকর নয় তবু এই মুহূর্তে এটাকে ভয়ংকরই বলা যায়… ততক্ষনে আগুন্তুক তাকে দেখে চমকে উঠে বলে উঠল-

-you!!?

চিত্রা লম্বা শ্বাস নিয়ে চোখ খুলে বলল- জ্বী, আমি।

-what are you doing here?

-ভাবলাম ৫০ টাকা দিয়ে খসানো শুরু সেটাকে যদি ৫লাখে নেয়া যায় তো মন্দ কী? ট্রাই করে দেখি?

আগন্তুক স্তম্ভিত চোখে তাকিয়ে রইল। তখন মিসেস চৌধুরী এসে বললেন- ফাইজ এসে পরেছিস, ভালো হয়েছে। এ হচ্ছে চিত্রা, আমাদের বাসার ইন্টেরিয়র ডিজাইন ও-ই করছে। আজ কাজ দেখতে এসেছিল। আর একটু দেরি হলেই তো ওর সঙ্গে তোর দেখা হত না। তোর না কী কী ডিরেকশন দেয়ার ছিল তাহলে আলাপ করে নে। মেয়েটা খুব ভালো। তবে আমি খুব আশ্চর্য হয়েছি ওর চোখ দেখে, এত সুন্দর চোখ আমি আগে কখনো দেখিনি।

ফাইজ দিশেহারা চোখে চিত্রার দিকে তাকিয়ে আছে। তার কাছে মনে হচ্ছে এই মেয়ে মহা ধড়িবাজ আর তার মা অতি সহজ সরল খোলামেলা মনের। একদিনেই এ তাকে আর তার মাকে যে রূপ দেখিয়েছে তাতে একে মানুষ হিসেবে বিচার করা কঠিন হয়ে গেল। তবে এই মেয়ে যেমনই হোক সে আসলেই তার পকেট থেকে লাখ টাকা খসিয়ে ছাড়বে। এখন কাজ কেমন করে সেটাই দেখার বিষয়। সে চিত্রাকে উদ্দেশ্য করে বলল-

-Are you an interior designer? I had some instructions to give…

চিত্রা ফাইজকে থামিয়ে দিয়ে বলল-এটা আপনার অস্ট্রেলিয়া নয়, বাংলা যেহেতু বলতেই পারেন সেহেতু বাংলায় বলুন। শুনতে ভালো লাগে।

ফাইজ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল চিত্রার দিকে তারপর বলল- ইংরেজিতে বলাটা আমার দীর্ঘদিনের অভ্যেস। তাই ওটাতেই আমি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি।

-কিন্তু বাংলায় বললে আপন লাগে।

-ঠিক আছে I will try. আমরা কী এবার আলোচনায় বসতে পারি?

-না। আমার হাতে আজ সময় নেই আপনি বরং ওয়েট করুন আমি এরপর যেদিন আসব সেদিন যা বলার বলবেন। নতুবা আমার কার্ডটা রাখুন ফোন করবেন। আজ আসি। তারপর ফাইজের মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল- আন্টি আসি তাহলে, আপনার হাতের হাঁসের মাংস খেতে অবশ্যই আসছি। ভালো থাকবেন। আর আপনার যদি গল্প করতে ইচ্ছে হয় অবশ্যই ফোন করবেন। আল্লাহ্‌ হাফেজ, বলে চিত্রা চলে গেল।

পুরো ব্যাপারটায় ফাইজ হতভম্ব হয়ে গেল! মেয়েটা তাকে এভাবে ইগনোর করে চলে গেল? মেয়েরা যেখানে তার এতটুকু সঙ্গ পেতে মরিয়া সেখানে এই মেয়েটা তাকে পাত্তাই দিল না! সে একটু অপমান বোধ করল।

চিত্রা চাইলেই কিছুক্ষণ সময় দিতে পারত মিস্টার ফাইজকে কিন্তু ইচ্ছে করেই ইগনোর করল। তার মতে এইসব হ্যান্ডসাম হাঙ্কদেরও যে কেউ পাত্তা না দিতে পারে সেই অনুভূতি তাদের থাকা উচিৎ। তাছাড়া কাউকে পাত্তা না দেয়াটাকে স্মার্টনেস আর নিজের প্রতি অন্যের আকর্ষণ তৈরি হয় বলেই লোকের বিশ্বাস। কিন্তু সমস্যা হল, এই হ্যান্ডসাম হাঙ্কের বাড়িতেই তাকে কাজ করতে হচ্ছে! মাঝে মাঝেই হয়ত তার সাথে দেখা হবে, কথা হবে? এখন একে দেখলে বুকের ভেতরে যে প্রলয়ঙ্করী ঝড় উঠে যায় সেটা কী করে সামলাবে চিত্রা? এর অবিবাহিত থাকাটা কী এতই জরুরী ছিল? আচ্ছা এসব কী ভাবছে সে? কী সব শব্দ তার মাথায় আসছে? মনে হচ্ছে ১৬ বছরের কিশোরী হয়ে গেছে! এ তো ভয়ংকর! চিত্রা জীবনে কম পুরুষ দেখেনি, তাদের কাউকে যে তার ভালো লাগেনি তাও নয়। কিন্তু প্রকাশের সাহস কখনোই সে করে উঠতে পারেনি। তার নিজেরও যে একটা সুন্দর মন আছে, কাউকে উজার করে ভালোবাসতে ইচ্ছে করে সেটা সে কোনদিন কাউকে বুঝতেও দেয়নি। নিজেকে বুঝিয়েছে সবার জীবনে সব কিছু থাকতে নেই! সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মায়ের ঠিক করা পাত্রের সাথে দেখা করার প্রস্তুতি নিল…

গল্পঃ অবেলায় বসন্ত (পর্ব – ১)
লেখাঃ শামীমা জামান

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here