অবেলায় বসন্ত (পর্ব – ২)

অবেলায় বসন্ত (পর্ব – ২)
লেখাঃ শামীমা জামান

চিত্রাকে আজ যে ছেলের দেখতে আসার কথা তার নাম আরমান হোসেন। চিত্রা বলেছিল কোন রেস্টুরেন্টে গিয়ে দেখা হোক। কিন্তু ছেলে বাসায় আসবার জন্য পিড়াপীড়ি করছিল। চিত্রা এক প্রকার জোর করেই রেস্টুরেন্টে দেখা করাটা ফিক্সড করে। বাসায় এসব ঝামেলা সে আর চায় না। আজ বিকেলে তার দেখা করতে যাবার কথা। সে তৈরি হচ্ছিল এমন সময় তার ভাবি এসে বলল-

-সাজতে বসেছ? মা পাঠাল তোমার কাছে, আমার কিছু করতে হবে?

-না ভাবি আমি পারব। আর তাছাড়া জানোই তো আমি এত সাজগোজ পছন্দ করি না তাই সাজিও না।

-ঠিক আছে, অবশ্য তুমি সেজেই করবে কী? এই চেহারার কতটুকুই আর ঠিক করা যাবে বলো? মেকাপ করাটাই বেকার।

-ভাবি সব সময় এভাবেই কথা বলে। প্রথম প্রথম চিত্রা খুব কষ্ট পেত, চোখে পানি চলে আসত, খুব কষ্ট হত কান্না চেপে রাখতে। কিন্তু এখন সব গা সওয়া হয়ে গেছে। সে হাসতে হাসতে বলল- মেকাপের নামে মুখোশ পরাটা আমার বরাবরই অপছন্দ। মন এবং মুখ কোথাও আড়াল রাখতে নেই। তুমি তো খুব সুন্দরী কিন্তু তুমি কী পারছ তোমার কদর্য মনটা আড়াল করতে? আসলে শাক দিয়ে কখনো মাছ ঢাকা যায় না, বুঝলে ভাবি? যাক, বুঝতেই পারছ তোমার এখানে কোন কাজ নেই, চলে যেতে পারো। বলে চিত্রা চুল বাঁধায় মন দিল।

-খুব চ্যাটাংচ্যাটাং কথা শিখেছ আজকাল। ডানা নেই তবু উড়বার সাধ!

-যাদের ডানা জোর করে ছেটে রাখা হয় উড়বার সাধ তাদেরই তীব্র হয়। বলে চিত্রা উঠে বের হয়ে গেল। এখানে বসে থেকে ভাবির কটু কথা শোনার কোন মানে হয় না।

চিত্রা ইচ্ছে করেই প্রায় ১ ঘন্টা লেট করে যথা স্থানে উপস্থিত হল। গিয়ে দেখে আরমান হোসেন বসে আছে। চিত্রা গিয়ে বসতেই আরমান বলল-

-অনেক লেট করছেন। একা খালি মুখে বসে থেকে বোর হয়ে গেছিলাম তাই এক বোতল পানি খেয়ে ফেলছি।

-অফিসে কাজের প্রেশার ছিল তাই লেট হয়েছে, স্যরি। আর, শুধু পানি না খেয়ে অন্য কিছুও তো অর্ডার করতে পারতেন?

-আরে নাহ, আপনাকে রেখে খাই কীভাবে? আর তাছাড়া ভাবলাম যদি না আসেন তাহলে খেয়ে শুধু শুধু টাকা নষ্ট হবে, কী দরকার?

-ও… সেটাও তো কথা! তো এখন খাবার অর্ডার করুন?

-আমি আবার বাইরের খাবার বেশি পছন্দ করি না। অসাস্থ্যকর খাবার খাওয়া ঠিক না। আপনি কী খাবেন বলেন? এইখানকার খাবার দাবার আবার কেমন তা তো জানি না। অল্প কিছু অর্ডার করে দেখেন ভালো লাগলে পরে আবার কিছু নিয়েন।

-ঠিক আছে, অর্ডার করছি।

-আপনেই অর্ডার দিবেন?

-হুম। কোন সমস্যা?

-না সমস্যা না… দেন আপনিই দেন অর্ডার।

-কী খাবেন বলুন?

আরমান সাহেব তখন মেন্যু বইটা নিয়ে একগাদা খাবার সিলেক্ট করলেন। সেটা দেখে চিত্রা প্রথমে একটু অবাক হল তারপর বুঝতে পারল কী হয়েছে। চিত্রা অর্ডার দিচ্ছে তার মানে বিলটা চিত্রাকে পে করতে হবে আর সেকারণেই সে ইচ্ছে মত অর্ডার করছে অথচ প্রথমে অল্প খাবারের কথা বলছিল। ব্যাপারটা নিয়ে চিত্রা হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারছে না। আর সবে সন্ধ্যে এই বেলায় কী কী অর্ডার করা যায় সে ব্যাপারেও সে কোন ধার ধারছে না। সব ভারী খাবার অর্ডার করে বসেছে! অর্ডার শেষ করে সে চিত্রাকে বলল-

-আমরা আলাপ শুরু করি। আপনি যেন কী চাকরি করেন?

-আমি ইন্টেরিওর ডিজাইনার। একটা ইন্টেরিওর ডিজাইনিং কন্সাল্টেন্সি ফার্মে আছি।

-ও… কেমন চলে এসব কাজ?

-হুম, খুব ভালো। আজকাল তো এসবের খুব চাহিদা।

-আচ্ছা আচ্ছা… তাহলে তো মনেহয় আপনার স্যালারি বেশ মোটা। কী রকম ফিগারের স্যালারি পান?

-স্যরি?

-না মানে শুনছিলাম ভালোই নাকি বেতন পান তাই জানতে চাইলাম ভালোর ফিগারটা কেমন?

-কাউকে সরাসরি তার স্যালারি জিজ্ঞেস করাটা যে এক ধরণের অভদ্রতা এই লোকের তো এই সামান্য জ্ঞানটুকুও নেই! চিত্রা তখন ইচ্ছে করে তাকে মিথ্যে বলল। বলল- টেনেটুনে ২০ হাজার টাকার মত পায়। সেটা শুনে আরমান প্রায় আর্তনাদ করে বলে উঠল-

-২০ হাজার! এইটাকে ভালো স্যালারি বলে?

-আমার জন্য হয়ত এটাই ভালো।

আরমান তখন উসখুস করতে লাগল। চিত্রা তখন তাকে তীক্ষ্ণ নজরে খেয়াল করছিল। ২০ হাজার শুনে বেচারা প্রায় মুষড়ে পড়েছে। হয়ত ভেবেছিল দেখতে যেমনই হোক টাকা দিয়ে সেটা কাভার করে নেবে কিন্তু এখন তো দেখা যাচ্ছে পরিস্থিতি অন্য রকম! চিত্রার তখন একটু মায়া লাগল ভদ্রলোকের জন্য। এই সময় খাবার চলে এলো। খাবার দেখে আরমান সাহেবের চোখ চকচক করে উঠল। সে মনেহয় বেতনের দুঃখ ভুলে গেল! চিত্রা অতি সন্তর্পণে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। আরমান খুব আগ্রহ নিয়ে তৃপ্তিসহকারে খাচ্ছিল। চিত্রা যে খাচ্ছে না সেটা নিয়ে তার কোন মাথা ব্যথা হচ্ছে না। একবার শুধু মুখ তুলে বলল-

-আপনি খাবেন না?

-না। খেতে ইচ্ছে হচ্ছে না।

-আমি তো এত খাবার একা খাইতে পারব না… তাহলে পার্সেল করে নিয়ে যাই কী বলেন? খাবার নষ্ট করা তো ঠিক না।

-ঠিক আছে। চিত্রা আর কিছু বলল না। কারণ সে বুঝে গেছে এই লোকের আর কোন কথা নেই তার সাথে। কথা না থাকাতে তার অবশ্য খুশিই লাগল। কারণ এমন লোকের সাথে জীবন জুড়ে গেলে বাকি জীবন এই লোকের দেখানো দয়া আর টাকার হিসেব কষেই পার করতে হবে তাকে। দুজন মানুষ মিলে সুন্দর কোন মুহূর্ত তৈরি করা সম্ভব হবে না। তার নৈঃশব্দ্যময় জীবনে সে কখনো শব্দ হতে পারবে না। এর হাত ধরে কখনোই স্নিগ্ধ সকালের আবির্ভাব হবে না।

-আমরা এখন উঠি? ফোন করে আপনাকে জানাব বাকি কথা।

আরমানের কথায় চিত্রার ধ্যান ভাঙল। বলল- হুম… চলুন উঠি। রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে দেখল আকাশে মেঘ করেছে। বৃষ্টি হবার পুরো সম্ভবনা দেখা যাচ্ছে। মেঘলা আকাশ চিত্রার খুব পছন্দ। আরমান তখন কোন রকম বিদায় নিয়ে দ্রুত চলে গেল। চিত্রার একটু কষ্ট হল। কষ্ট এটা নিয়ে না যে আরমান তাকে অপছন্দ করল। কষ্ট এটা নিয়ে যে, সকলে তাকে শুধুমাত্র তার গায়ের রঙ আর উপার্জন দিয়ে মূল্যায়ন করে। কেউ তাকে দেখে না। দেখলে হয়ত বুঝতে পারত বুকের ভেতর কী অসম্ভব মায়া আর ভালোবাসার আস্ত একটা নদী নিয়ে সে বসে আছে। যেখানে টুকুস করে ডুব দিয়ে এক নিমিষেই শীতল হয়ে যাওয়া যায়। চিত্রা আনমনে হাঁটতে লাগল ফুটপাথ ধরে। তার রিকশা নিতে ইচ্ছে করছিল না। কিছুক্ষণ হেঁটে তারপর নাহয় রিকশা নেয়া যাবে। এর মধ্যে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল… চিত্রা তবুও হাঁটছিল। বৃষ্টির কারণে পথিকরা সব ছোটাছুটি করে আশ্রয় খুঁজছিল। খুব দ্রুতই রাস্তা ফাঁকা হয়ে গেল। কিন্তু চিত্রা শান্ত পায়ে হেঁটে যাচ্ছিল, হাঁটতে ভালো লাগছিল তার… কখনো কখনো সমস্ত পৃথিবীকে উপেক্ষা করে নিজের চাওয়াকে প্রাধান্য দিতে হয়। কে কী ভাবল সব সময় তা নিয়ে ভাবতে নেই। আর যেখানে সমস্ত পৃথিবী তার কাছে এসে থেমে যায় সেখানে কে কী ভাবল সেটা ভেবে তার থেমে থাকার কোন মানে হয় না। এমন সময় একটা কালো গাড়ি এসে তার পাশে থামল। গাড়ির গ্লাস নামতেই চিত্রা অবাক হল, প্রফেসর ফাইজ! ফাইজ বলল-

-are you here? why are you getting wet?

-আপনি শেষ কবে বৃষ্টিতে ভিজেছিলেন বলুন তো?

-I don’t remember… why?

-ভিজবেন আমার সাথে?

ফাইজ গাড়ির দরজা খুলে কড়া গলায় বলল- get in the car.

চিত্রা ফাইজের দিকে তাকিয়ে রইল… আচ্ছা শিক্ষকরা কী সবাইকেই তার ছাত্র মনে করে? এমনভাবে আদেশ দিচ্ছে যে? ফাইজের এমনভাবে বলায় কী এমন ছিল যে চিত্রা কোন কিছু না বলে গাড়িতে উঠে পড়ল। ফাইজ চিত্রার দিকে ভালো করে তাকাল। চিত্রাকে কেমন দুঃখী দেখাল! তার পুরো চেহারায় বিষণ্ণতার স্পষ্ট ছাপ দেখা যাচ্ছে যেটা চিত্রা আড়াল করতেও চাইছে না। অনেকটাই ভিজে গেছে সে… তার সারা শরীরে বিন্দু বিন্দু পানি, ভেজা কিছু চুল তার কপাল বেয়ে গালের সাথে লেগে আছে, পার্পেল কালারের শাড়িটা ভিজে তার গায়ের সাথে লেপ্টে গেছে। ফাইজ কেমন মোহাচ্ছন্ন হয়ে গেল! পরমুহুর্তেই সে নিজেকে সামলে নিয়ে অন্য দিকে তার দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল।

গাড়িতে উঠার পর চিত্রা একটু অস্বস্তি বোধ করল… এসিতে তার ঠান্ডাও লাগছিল তাই সে তার ভেজা আঁচলটা দিয়েই নিজেকে ভালো করে ঢেকে নেবার চেষ্টা করল। ফাইজ সেটা খেয়াল করে বলল-

-আপনি চাইলে আমার স্যুটটা পরে নিতে পারেন।

চিত্রা ফাইজের হাত থেকে স্যুটটা নিয়ে পরে ফেলল। স্যুট থেকে কড়া পারফিউমের ঘ্রাণ আসছিল। মনে মনে বলল- ব্যাটা মনেহয় পারফিউমের বোতল ঢেলে দিয়েছে স্যুটের মধ্যে। নিশ্চই ফ্রিতে পাওয়া পারফিউম এটা। ফাইজ তখন বলল-

-কোথায় যাবেন আপনি?

চিত্রা বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে উদাস গলায় বলল- “লং ড্রাইভে”।

ফাইজ অবাক হয়ে বলল- do you always act so weird?

-yep.

ফাইজ চিত্রার দিকে তাকিয়ে ওকে ভালো করে বোঝার চেষ্টা করল… তার মনে হল মেয়েটা বুকের ভেতর আস্ত বিষাদ সিন্ধু চেপে রেখে ঘুরে বেড়ায়। জীবনে এমন একজন লাগে যার কাছে সময়ে অসময়ে নিজেকে ভেঙেচুড়ে জমা রাখা যায়। এই মেয়েটার মনেহয় তেমন কেউ নেই। ফাইজ চিত্রাকে কী বলবে খুঁজে পেল না, তবে মেয়েটার প্রতি সে আগ্রহ বোধ করতে লাগল।

চিত্রা বাসায় এসে শাড়ি পাল্টে ফ্রেস হয়ে নিল। বৃষ্টিতে ভেজার কারণে তার মনে হচ্ছে সর্দি লেগে যাবে। নাক দিয়ে ইতিমধ্যেই পানি আসতে শুরু করেছে। এখন এক মগ ধোয়া ওঠা কফি পেলে বেশ হত। কিন্তু চিত্রার এক মগ কফি খেতে চাওয়াটাও এখন বাড়ির লোকের কাছে বিলাসিতা মনেহয়। তাই সে কারো কাছে না চেয়ে নিজেই বানাতে গেল। কফি নিয়ে এসে ঘরে ঢুকতেই তার মা এসে কড়া গলায় জেরা শুরু করল। সে কেন আরমান সাহেবকে উল্টা পাল্টা কথা বলেছে এই নিয়ে তিনি চূড়ান্ত বিরক্ত হয়েছেন। চিত্রা জানত বাসায় এসে তাকে এসব ঝামেলায় পড়তে হবে। আরমানকে দেখে বোঝাই গেছে সে কতটুকু কী বলতে পারে। চিত্রা বলল-

-মা তোমার কী মনে হচ্ছে না আমি কাজটা ঠিক করেছি?

-তুই কী চাস বল তো? মানুষ কী সব কিছুতে পার্ফেক্ট হয়? তোর পছন্দ মত চললে তো আর তোকে বিয়ে দেওয়া সম্ভব না। নিজের দিকে তাকিয়ে তোর চলা উচিৎ।

-দিও না বিয়ে। এমন কারো সাথে বিয়ে হবার চেয়ে একা থাকা ভালো মা।

-তুই কী সমাজে আমাদের মুখ দেখাতে দিবি না?

চিত্রার অবাক লাগে তার মা যখন এভাবে কথা বলে। আর কেউ না হোক মা তো তার ব্যথাটা বোঝার চেষ্টা করবেন? তার চোখে পানি চলে আসতে চায়। সে অভাগী চোখের পানি চোখেই আটকে ফেলে বলে- মা, পৃথিবীর সমস্ত দায় ভুলে একবার তুমি শুধু আমায় নিয়ে ভাবো তো? আমি কী নিজের ইচ্ছেয় শ্বাস্টুকুও নিতে পারব না?

চিত্রার মা স্তব্ধ চোখে চিত্রার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তার চোখে কী এক পষলা মায়া দেখা গেল? চিত্রা উঠে বারান্দায় চলে গেল। মেয়েটার জন্য তার কষ্ট হয় না এমন নয়। কিন্তু সমাজকে তিনি উপেক্ষা করতে পারেন না। তার মেয়েটার গায়ের রঙটাই শুধু দেখে সবাই। দেখে না এমন মেধাবী, মায়াময় মেয়ে আর ২য়টা নেই! তার ইচ্ছে করে এই বিষাক্ত সমাজের মুখ থেকে চিত্রাকে বুকের ভেতর পাখির ছানার মত লুকিয়ে রাখতে। তার চিত্রার জন্য একজন রাজপুত্র আসুক। তার জনম দুঃখী মেয়েটাকে নিয়ে তৈরি করুক একটুকরো স্বর্গ। সমাজের কুৎসিত মুখে এঁটে দিক শক্ত তালা।

আকাশের দিকে তাকিয়ে চিত্রা কফিতে চুমুক দিল। এই বারান্দাটা তার, এখান থেকে যতটুকু আকাশ দেখা যায় সবটুকু আকাশ তার, আকাশ থেকে নেমে আসা বৃষ্টি তার, আকাশের যত গুলো তারা দেখা যায় সবগুলো তার, বাতাসের ঝাপটা তার… এখান থেকে যা কিছু দেখা যায় সব তার। সে বারান্দার রেলিং এর সাথে দুটো পেয়ালা বেঁধে রেখেছে। একটায় পানি আর অন্যটায় খাবার দেয়া থাকে। রোজ কত পাখি এসে নিয়ম করে খেয়ে যায়। প্রথম দিকে একটা দুটো পাখি আসলেও এখন ঝাকে ঝাকে আসে। চিত্রার ভালো লাগে। কিছুদিন আগে চিত্রা খেয়াল করল দুটো বুলবুলি তার এরিকা পাম গাছে খড়কুটো এনে জমা করছে। সে প্রতিদিন আগ্রহ নিয়ে সেটা খেয়াল করতে লাগল। একটা সময় সেটা বুলবুলির বাসা হয়ে গেল! তার মনের মধ্যে তখন কেমন করে উঠল… সে নিজেও তো মনে মনে একটু একটু করে তার সংসার সাজাতে চায় কিন্তু সে ঘরে যে কেউ পা রাখতেই চায় না! সে মন দিয়ে বুলবুলির বাসা দেখে। সেখানে এখন ৪টা ডিম। ক’দিন গেলেই ছানা বের হবে। সেটা নিয়ে চিত্রা খুব এক্সাইটেড থাকে। রোজ এসে টুক করে দেখে যায় ডিম থেকে ছানা বের হয়েছে কিনা? তবে আজ সে বুলবুলির কথা ভাবছে না। ভাবছে প্রফেসর ফাইজের কথা। প্রফেসর সাহেবকে তার ভীষণ জানতে ইচ্ছে হচ্ছে। দীর্ঘ সময় পর কাউকে নিয়ে তার ভাবতে ভালো লাগছে। তার গায়ের গন্ধ যেন এখনো চিত্রার গায়ে লেগে আছে! যতবার বাতাসের ছোঁয়া লাগছে ততবার স্মেলটা পাচ্ছে আর ততবারই তার অদ্ভুত এক ভালো লাগা কাজ করছে। চিত্রাকে তিনি বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে গেছে। পুরো রাস্তায় কোন কথা বলেনি। শুধু নামার সময় বলেছে-

“I will take you on a long drive. Just let me know when you can go.”

চিত্রা কিছু না বলে চলে এসেছে। বাড়িতে ঢোকার আগে একবার পেছনে তাকিয়ে দেখে প্রফেসর সাহেব এখনো দাঁড়িয়ে আছে! চিত্রা ভেতরে ঢোকার পর তিনি চলে গেছেন। লোকটা দায়িত্ববান। এমন পুরুষকেই কী চিত্রা খুঁজে বেড়ায়?

ফাইজ রাতে বাড়ি ফিরে ফ্রেস হয়ে ডিনার করতে নিচে এলো। সে যেখানেই থাকুক রাতের খাবারটা মায়ের সাথে খায়। আর তার মাও যত রাতই হোক ছেলের জন্য অপেক্ষা করে। এই সময়টা তিনি ফাইজের জন্য নিচেই অপেক্ষা করেন। আজ নিচে এসে ফাইজ তার মাকে দেখতে পেল না। সে মাকে ডাকতে উপরে মায়ের ঘরে চলে আসে। এসে দেখে তার মা শুয়ে আছে। ফাইজের কপালে ভাজ পড়ে যায়। এই সময় তো মা শুয়ে থাকে না। সে কাছে গিয়ে ডাকল দুবার। মিসেস চৌধুরী চোখ খুলেন। তার দৃষ্টি কেমন ঘোলাটে! ফাইজ বলল-

-মা তোমার কী শরীর খারাপ করেছে?

-হুম, মনে হচ্ছে টেম্পারেচার বেড়ে গেছে।

ফাইজ মায়ের কপালে হাত রেখে দেখল বেশ গরম। বলল- কখন থেকে জ্বর? দুপুরেও তো ভালো ছিলে।

-সন্ধ্যার পর থেকে। প্রচন্ড মাথা ব্যথা হচ্ছে। তুই খেয়েছিস?

-মা তুমি এই অবস্থায়ও আমার খাওয়ার চিন্তা করছ! তোমাকে ছাড়া আমি খাই? দাঁড়াও আগে জ্বরটা মেপে নেই। ফাইজ জ্বর মেপে দেখল ১০৩ ডিগ্রি, অনেক জ্বর! বলল- তুমি নিশ্চই কিছু খাওনি? চলো খাবে। তারপর তোমাকে ওষুধ খেতে হবে।

-আমার ইচ্ছে করছে না তুই খেয়ে নে যা।

-কিছু না খেলে তো চলবে না। তুমি থাকো আমি দেখছি, বলে ফাইজ নিচে এসে রান্নাঘরে গিয়ে মেইডকে বলে স্যুপ করে দিতে। স্যুপ আর মেডিসিন নিয়ে ফাইজ মায়ের ঘরে এসে নিজেই খাইয়ে দেয়। তারপর মাকে ঘুম পাড়িয়ে নিজে ডিনার করে নেয়।

মিসেস চৌধুরীর জ্বর নামছিল না সাথে মাথা ব্যথা, ঠান্ডা আর গলা ব্যথাও আছে ফাইজ চিন্তায় পড়ে যায়। সে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায় মাকে। সেখানে গিয়ে টেস্ট করে পরদিন জানতে পারে তার মা কোভিডে আক্রান্ত হয়েছে! ফাইজ বেশ চিন্তিত হয়ে গেল। এই এক মা ছাড়া তার জগৎ অন্ধকার। কী হবে এখন? তিনি ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করলেন হসপিটালে এডমিট করতে হবে কিনা? ডাক্তার বলেছেন প্রয়োজন হবে না। বাসায় টেক কেয়ার করুন। কী করতে হবে কী খেতে হবে সব বলে দিলেন। ফাইজ মাকে নিয়ে বাসায় এসে কী কী করতে হবে সব গুছিয়ে নিলেন। ইন্টেরিয়র অফিসে ফোন করে জানিয়ে দিলেন কিছুদিনের জন্য কাজ বন্ধ রাখতে। দুটো দিন মাকে নিয়ে ফাইজের অনেক ঝক্কি পোহাতে হল। এখনো মিসেস চৌধুরীর জ্বর ঠান্ডা কমেনি। তার ঘরে খাবার দিয়ে এসে ফাইজ নাশতা করতে বসল আর তখনই চিত্রা হাজির হল। ফাইজ অবাক হয়ে বলল-

-আপনি এখানে? আমি তো কিছু দিনের জন্য কাজ বন্ধ রাখতে বলেছি।

-জানি। আমি এসেছি আন্টির সাথে দেখা করতে। আন্টি কোথায়?

-মা উপরে তার ঘরে আছেন। একটু অসুস্থ।

-আমি কী তাহলে উপরে গিয়ে আন্টির সাথে দেখা করব?

-না। তার সাথে দেখা করা বারণ।

-কেন বারণ?

ফাইজ কিছুক্ষণ চুপ রইল তারপর বলল- মা করোনা পজেটিভ।

চিত্রা একটু অবাক হল। বলল- কী অবস্থা এখন উনার? মেডিসিন খাচ্ছে ঠিক মত? ওনার টেক কেয়ার কে করছে?

-আমিই দেখা শোনা করছি। ওষুধ খাচ্ছে।

-আমি যাব উপরে উনার কাছে।

-করোনা শুনেও যাবেন?

-হুম।

-আপনার কী মৃত্যু ভয় নেই?

-একেবারেই নেই সেটা যেমন না তেমন খুব যে আছে তাও না। আর আমি যদি মরেও যাই এই পৃথিবীর খুব বেশি ক্ষতি হবে না।

-আর আপনার পরিবার?

চিত্রা একটু চুপ থাকল তারপর বলল- আপনি কী জানেন পৃথিবীতে এমন অনেক মানুষ আছে যার মৃত্যুতে তার পরিবার হাফ ছেড়ে বেঁচে যায়?

-আপনি কী বলতে চাইছেন আপনি সেই সব পরিবারের?

-আমি বলতে চাইছি, আপনি যদি দেখাশোনার জন্য আপনার মায়ের কাছে যেতে পারেন তাহলে আমি কেন যেতে পারি না? ঝুঁকিটা তো সবার জন্যই সমান, তাই না?

-তিনি আমার মা তাই যত যা-ই হোক না কেন আমাকেই তার জন্য যা কিছু সম্ভব সবটা করতে হবে। ঝুঁকি আছে সেটা জেনে মায়ের সেবা না করাটা যেমন আমাকে মানায় না তেমনি আপনি ঝুঁকি নেবেন সেটাও মানায় না।

-মানায়। একজন সৃষ্টির সেরা জীব হয়ে অন্য একজন সৃষ্টির সেরা জীবের বিপদে পাশে থাকব না সেটা হয় না। আর ভয় তো আমার পাওয়ার কথা আপনি কেন পাচ্ছেন?

এরপর ফাইজ কী বলবে ভেবে পেল না। কিন্তু সে কিছুতেই চায় না অন্য কেউ তার কারণে বিপদে পড়ুক। তাও আবার জীবনের ঝুঁকি! কিন্তু চিত্রাকে সে বোঝাতেও পারছে না। চিত্রা তখন বলল-

-এত কিছু ভাবার কারণ নেই। আমার যদি কিছু হয় সেটা আমার দায়, আপনার নয়। বলে চিত্রা আর দাঁড়াল না, উপরে চলে গেল। ফাইজও পেছন পেছন গেল।

চিত্রা মিসেস চৌধুরীর ঘরের সামনে এসে দেখল মিসেস চৌধুরী রকিং চেয়ারে চোখ বন্ধ করে বসে আছে। দু’দিনেই চেহারা কেমন ভঙ্গুর হয়ে গেছে! কেমন প্রাণহীন দেখাচ্ছে… চিত্রা বলল- আন্টি আসব?

মিসেস চৌধুরী তাকিয়ে দেখলেন চিত্রা দরজায় দাঁড়িয়ে। চিত্রাকে দেখে তার খুশি লাগল। সে “এসো” বলতে গিয়ে থেমে গেল… বলল- না, এসো না। তোমাকে কেউ বলেনি আমি অসুস্থ আমার ঘরে আসা বারণ?

-বলেছে। আপনার ছেলের সাথে রীতিমত যুদ্ধ করে পানিপথ জয় করে তারপর উপরে এসেছি। এই যে দেখুন মাস্ক, গ্লাভস, স্যানিটাইজার সব কিছু পরে যুদ্ধের সাজেই আছি। হাঁসের মাংস খাব বলে দাওয়াত নিয়েছি সে ব্যাপারে আলাপ আলোচনা না করেই চলে যাব নাকি?

মিসেস চৌধুরী হেসে ফেললেন। বললেন- বুঝতে পারছি আমার ছেলেকে তুমি পরাস্ত করে ফেলেছ। ঐ স্প্রেটা নাও আগে পুরো ঘর স্প্রে করে নাও। আর হ্যাঁ খুব বেশি সময় তুমি এখানে থাকবে না।

-কতক্ষণ থাকব সেটা এখন কী করে বলব? সেটা তো গল্পের উপর নির্ভর করবে। তারপর সমস্ত জটিলতা ভুলে চিত্রা আর তার আন্টি অনেকটা সময় গল্প করল। পুরো সময়টা ফাইজ দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে উপভোগ করল। মেয়েটার মধ্যে অদ্ভুত এক ক্ষমতা আছে। সে যেখানে থাকে সেই জায়গাটাকে আলো ঝলমল করে ফেলার ক্ষমতা। কিন্তু অদ্ভুত বিষয় মেয়েটার চেহারা আর কথার গভীরে সব সময় বিষাদের ছায়া থাকে। যে অন্যকে ভালো রাখতে জানে তার মনে কেন বিষাদের গহীন সমুদ্র???

আগের পর্বের লিংক
https://www.facebook.com/groups/boipokaofficial/permalink/1355867711885388/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here