অবেলায় বসন্ত (পর্ব – ৮)

অবেলায় বসন্ত (পর্ব – ৮)
লেখাঃ শামীমা জামান

চিত্রা আর ফাইজের বিয়েটা হয়ে গেল। খুব বেশি জাকজমক না হলেও দুই পরিবার কোন কমতিও রাখেনি। চিত্রার যেমন যেমন পছন্দ জাহানারা বেগম ঠিক তেমন তেমনই করেছেন। তার চিত্রা এক জীবনে অনেক কষ্ট ভোগ করেছে অথচ তার নিজের কোন দোষ নেই তাতে। সব কিছুর চাপে পড়ে তিনি নিজেও একসময় মেয়েটার সাথে খারাপ আচরণ করেছে। যে আচরণের জন্য তিনি প্রতি রাতে চোখের পানি ফেলেছেন জায়নামাজে বসে। আজ চিত্রা নতুন জীবন শুরু করেছে, আল্লাহ ওকে রহমতে বরকতে ভরিয়ে রাখুক প্রাণ খুলে তিনি শুধু এই দোয়াই করছেন। চিত্রা চলে যাবার সময় তার মনে হয়েছে আজ তার বুক যেন খালি হয়ে গেছে! চিত্রাকে তিনি নতুন গহনার সাথে তার নিজের গহনাও দিয়েছেন। তবে অদ্ভুত ব্যাপার হলো সবাই এতকাল চিত্রাকে তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দেখলেও আজ প্রত্যেকটা মানুষ চিত্রার জন্য খুশি, সবাই ওর জন্য মন খুলে দোয়া করেছে। চন্দ্রা আসতে না পারলেও ভিডিও কলে পুরো বিয়ে উপভোগ করেছে আর আনন্দে চোখের পানি ফেলেছে। চঞ্চল এতটা দায়িত্ব পালন করেছে যে সবার কাছে মনে হয়েছে এমন একটা পুত্র, এমন একটা ভাই সবার থাকুক। এত এত ভালোবাসা যার সবই চিত্রার জন্য চিত্রা তা বিশ্বাসই করতে পারছিল না। আজ সে তার দুচোখের আনন্দধারা কিছুতেই আটকে রাখতে পারছিল না। জীবন এতটাও সুন্দর হতে পারে???

চিত্রা ফাইজের বিশাল শোবার ঘরে বসে আছে। তার করা পেইন্টিংটা ঘরে এমনভাবে ঝোলানো হয়েছে যে দিনের শুরু এবং শেষ এই ছবিটা দেখেই হয়। ব্যাপারটা চিত্রার খুব পছন্দ হয়েছে। ঘরটায় তার আগেও যাতায়াত হয়েছে তাই বাসরঘরের সাজসজ্জা ছাড়া নতুন করে দেখার কিছু নেই। তারপরও চিত্রা সব কিছু আগ্রহ নিয়ে দেখছে। কারণ এর আগে যখন এই ঘরে এসেছিল সেটা শুধুই একজন ক্লায়েন্টের ঘর ছিল, এখন তার নিজেরও। বিয়েবাড়ি হলেও বাড়িটা এখন চুপচাপ। আত্মীয়স্বজন যারা এসেছিল তারা সবাই মনেহয় চলে গেছে। এখন শুধু তারা নিজেরাই আছে। ফাইজ এখনো ঘরে আসছে না কেন কে জানে, তার তো অপেক্ষার প্রহর কাটছেই না… বসে থেকে থেকে তার হাত পায়ে খিল ধরে গেছে। তার উপর এত ভারী পোশাক, গহনাও প্রচুর। তার মা যেমন অনেক দিয়েছে তেমন ফাইজদের বাড়ি থেকেও দিয়েছে। গহনার ভারে সে রীতিমত হাপিয়ে উঠেছে। সব তো পরেইনি। বাকি গহনা বৌ-ভাতে পরেও শেষ হবে না। একবার ভাবল কিছু গহনা খুলে রাখে সবাই তো চলেই গেছে আবার ভাবল সেটা কী ঠিক হবে? সে যখন এসব ভাবছিল তখন ফাইজ এলো। ফাইজ ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে চিত্রার দিকে এগিয়ে যেতে লাগল। চিত্রা ফাইজের দিকে তাকাতেই দেখল ফাইজ কেমন এলোমেলো ভঙ্গিতে হেঁটে আসছে! তার পা কেমন টালমাটাল হয়ে যাচ্ছে। চিত্রা উদ্বিগ্ন চোখে তাকিয়ে রইল। ফাইজ চিত্রার সামনে ধপাস করে বসে বলল-

-বেগম, আপনাকে বাদশা ফাইজ চৌধুরীর খাস কামরায় স্বাগতম। আজ পুরো রাত আপনি আমার মনোরঞ্জন করবেন। বিনিময়ে আমি আপনাকে আমার চরণতলে ঠাই দিব।

-চিত্রা অবাক হচ্ছে… ফাইজের কথা কেমন জড়িয়ে যাচ্ছে। আর এসব কী বলছে সে? চিত্রা দেখল ফাইজের গা থেকে কেমন বিশ্রী একটা কটু গন্ধ আসছে। ফাইজ কী তবে ড্রিংকস করেছে? মাতাল হয়ে এসেছে সে? এসব কী দেখছে সে!!! চিত্রা কড়া গলায় বলল-

-আপনি এসব কী বলছেন হুস আছে আপনার? কী খেয়েছেন কী আপনি?

ফাইজ চিৎকার করে বলল- খামস! তারপর জড়ানো গলায় বলল- তুমি আমাকে প্রশ্ন করছ? এই বাদশাকে প্রশ্ন করছ? তোমার এত বড় স্পর্ধা? এই মুহূর্তে আমি তোমার কী হাল করতে পারি জানো? তোমার সকল স্পর্ধা আমি এই মুহুর্তে ধ্বংস করে দিব। বলে ফাইজ চিত্রার কাছে যেতে চাইল… চিত্রা তখন প্রচন্ড রাগে ফাইজকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়। ফাইজ টাল সামলাতে না পেরে ফ্লোরে পরে যায়। সে তখন প্রচন্ড রেগে বলে-

-তোর এত বড় সাহস! তুই বাদশার গায়ে হাত তুলিস? তোকে এইভাবে পাবার জন্য আমি কত কী করেছি… আজ তোকে আমি… এই বলে ফাইজ চিত্রাকে ধরতে যেতেই চিত্রা দ্রুত সরে যায়। সে লাঠি বা স্কেল জাতীয় কিছু খুঁজতে লাগল। আজ তার এই দুর্ভাগ্যকে পিটিয়ে শেষ করবে সে। জীবনের এতটা পথ পাড়ি দিয়ে তার সবে সুখের দিন শুরু হতে যাচ্ছিল সেই দিন এমন গ্রহণলাগা দুঃস্বপ্ন হবে তা কে কল্পনা করেছিল? ভদ্র চেহারার আড়ালে যে এত বড় বদমাইশ লুকিয়ে ছিল সেটা সে মেনেই নিতে পারছে না। এই জন্যই বড়লোকদের বিশ্বাস করতে নেই। তাদের তো অভ্যাসই এমন। ফাইজ এমন হবে আগে জানলে একে নিয়ে স্বপ্নও দেখত না সে। চিত্রা তখন কিছু না পেয়ে ফুলদানী থেকে রজনীগন্ধার দুটো স্টিক নিয়ে ফাইজকে পেটাতে গেল। ফাইজ তখন উল্টো ঘুরে সরে গিয়ে চোখ লাল করে বলল-

-একজন চরণদাসী হয়ে আমার সাথে এমন ঔদ্ধত্য আচরণ! এই কে আছিস এই দাঙ্গাবাজ নারীকে এক্ষুণি কয়েদ করে রাজ বন্দিশালায় নিয়ে যা।

-“করাচ্ছি তোকে বন্দি” এই বলে চিত্রা টালমাটাল ফাইজকে ধরে আরও কয়েক ঘা দিয়ে বসল। ফাইজ আহ-উহ করে বলল-

-আরে থামো থামো লাগছে তো। আমি মজা করছিলাম। ইসস এত সিরিয়াস হয়ে কেউ বিয়ের রাতে বরকে পেটায়?

চিত্রা সাথে সাথে থেমে গিয়ে সরু চোখে তাকায়…

-আরে আমি তো মজা করছিলাম। কাজিনদের সাথে বাজি ধরেছিলাম… এই তোরা কে কোথায় আছিস বের হয়ে যা। সাথে সাথেই পর্দার আড়াল থেকে, আলমারির পেছন থেকে আর বারান্দা থেকে ৩ জন বের হয়ে এলো। এরা সবাই ফাইজের কাজিন। চিত্রা অবাক হয়ে গেল, ঘরের ভেতর এত মানুষ ঢুকে বসে আছে! এরা তখন চিত্রার সাথে গল্প করে এক এক করে তাহলে এখানেই লুকিয়ে গেছে। ৩ জনের একজন বলল-

-ভাবি আমরা ভাইয়ার সাথে বাজি ধরেছিলাম। ভাইয়াকে যখন আমরা সবাই বলছিলাম- ভাবির চেহারায় কেমন একটা মায়া আছে তুমি খুব লাকি ভাইয়া। ভাইয়া তখন বলল- মায়া? আরে ওই চেহারার পেছনে শুধু কংক্রিটের দেয়াল আছে। বিয়েতে রাজি করাতে কত দৌড় করিয়ে নিয়েছে তোরা তো কিছুই জানিস না। এতটুকু রোমান্টিক হতে জানে না। আজ আমাকে একলা পেয়ে মারতে না বসলেই হয়! তখন আমরা বললাম- ঠিক আছে একটু মার খেয়ে দেখাও, আমরাও দেখি ভাবি কোন ব্র‍্যান্ডের কংক্রিট? ভাইয়া তখন বলল- ঠিক আছে তবে একটা শর্ত। মার খেয়ে দেখাতে পারলে তোরা ঘর সাজানোর টাকা পাবি না। আমরা তো নিশ্চিত ছিলাম ভাইয়া পারবে না। কিন্তু এখন তো…

চিত্রা হতভম্ব হয়ে গেল। ফাইজ তখন বলল- এবার তোরা সব বিদায় হ। আমার অনেক সময় নষ্ট করেছিস। সবার মুখে তখন মন খারাপের ছাপ বাজিতে হেরে। কোথায় বাজিতে জিতে মোটা অংকের টাকা পাওয়ার কথা ছিল… কিন্তু এখন কিছু করার নেই। ওরা চলে যেতে নিলেই চিত্রা ওদের থামিয়ে বলল- দাঁড়াও, তারপর ফাইজকে বলল ওদের টাকাটা দিয়ে দিন।

ফাইজ বলল- বাজিতে জিতেও কেন টাকা দিতে হবে?

-আমি বলেছি তাই। তারপর ফাইজকে আস্তে করে বলল- এবার সত্যি সত্যি মার খেতে না চাইলে দিয়ে দিন।

-ফাইজ পকেট থেকে টাকা বের করে ওদের হাতে দিয়ে বলল- নে ধর, পুরো লস প্রজেক্ট! সবাই খুশি হয়ে চলে গেল। ফাইজ তখন বলল- এটা কী হলো? বিয়ের রাতে এভাবে কেউ নিজের হাজবেন্ডকে শাসায়? নিজের হাজবেন্ডকে সাপোর্ট না করে কেউ অন্যকে সাপোর্ট করে?

চিত্রা মুখ টিপে হেসে বলল- আমি করি। আমি তো কংক্রিটের দেয়াল। তার আগে বলুন আপনার গা থেকে যে বিশ্রী গন্ধটা আসছে সেটা কিসের?

-ভিনেগারের।

চিত্রা হেসে ফেলল। তারপর বলল- আমি তাহলে কংক্রিটের দেয়াল, চরণদাসী, দাঙ্গাবাজ তাই না?

-আরে ওগুলো তো নাটকের সংলাপ ছিল…

-কিন্তু আমি তো সিরিয়াসলি নিয়ে নিয়েছি। তাছাড়া একটা টিনএজ ছেলের সাথে এইঘরে থেকেও লাভ নেই। সে বাসরঘরের বুঝবেই বা কী?

-তুমি ফাইজ চৌধুরীকে বলছ “বাসরঘরের বুঝবেই বা কী?” আরে টিনএজ বলে যাকে আন্ডারএস্টিমেট করছ তোমার ধারণাই নেই টিনএজ মস্তিষ্কে কী চলে। সমস্যা নেই অনেক বড় বড় ছাত্র পড়িয়ে অভ্যেস আমার। তোমার মত একজনকে শেখাতে খুব বেশি সময় আমার লাগবে না।

-আমি আপনাকে যত দেখছি তত অবাক হচ্ছি। প্রথমদিকে দেখা আপনি আর আজকের আপনিতে বিস্তর ফারাক। তখন কেমন গুরুগম্ভীর ছিলেন আর এখন! পুরো ২০/২২ বছরের ছেলের মত আচরণ!

-তাই নাকি! ব্যাপারটা তো ঠিক হলো না। আমার তো টিনএজ ক্যারেক্টারে থাকার কথা ছিল, ২০/২২ বছরের যুবক বয়সে কী করছি? তাহলে কী ফেল করে ফেললাম!

-আজকাল তো ফেল করার অপশন নেই বললেই চলে। “অটো পাস” পেয়ে গেছেন এই আর কি…

-হুহ এই কংক্রিটের দেয়াল থেকে বের হবে অটো পাস? স্বীকার করে নিচ্ছ না কেন যে গোল্ডেন মার্ক নিয়ে পাস করেছি? তবে ঘটনা যা-ই হোক এটা তো ক্লিয়ার প্রেমে পড়লে মানুষের বয়স কমে যায়।

চিত্রা তখন মুচকি হেসে ফাইজের কলার চেপে ধরে বলল- তো মিস্টার অল্প বয়সী টিনএজ জামাই, ট্রিপল নাইনে কল করে বলব যে, আপনি বাল্যবিবাহ করেছেন?

ফাইজ চিত্রার কোমড় জড়িয়ে ধরে বলল- “বলে দাও…”

চিত্রা সারাজীবন যে ভালোবাসার অনুসন্ধান করে এসেছে তা সে এই অবেলায় এসে পেয়েছে। সে মাঝে মাঝেই আকাশের দিকে তাকিয়ে এই অসীম আকাশের মালিকের কাছে কৃতজ্ঞতা জানায়। তার অন্ধকার জীবনে আলোর বন্যা বইয়ে দেয়ার জন্য কৃতজ্ঞতা জানায়। সে মনপ্রাণ উজাড় করে চেষ্টা করে ফাইজকে ভালোবাসা দিতে। আর ফাইজ অবাক হয়ে দেখে চিত্রা নামক শক্ত মেয়েটা কেমন ১৬ বছরের দুষ্টু কিশোরী হয়ে গেছে! ফাইজের আগেপিছে থেকে তাকে ভালোবাসা ছাড়া তার যেন আর কোন কাজ নেই। সারাক্ষণ আদুরে বেড়াল হয়ে থাকে। সে বুঝতে পারে চিত্রা যা করে তাই তার ভালো লাগে। চিত্রা পাশ দিয়ে আসতে যেতে একটা খোচা দেয়, একটা চিমটি কাটে, ধাক্কা মারে তার ভালো লাগে। অনেক রাতে ঘুম ভেঙে গেলে মাঝে মাঝেই দেখে চিত্রা তার দিকে তাকিয়ে আছে, তার ভালো লাগে। সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে চিত্রার সুখী মুখটা দেখতে। অবেলার ভালোবাসায় আসলেই গভীরতা একটু বেশি।

গল্পটা এখানেই শেষ হতে পারত। একটা হ্যাপি এন্ডিং দিয়ে। কিন্তু সব সময় সব গল্পের এন্ডিং এত সহজেই হ্যাপি হয় না। চিত্রার গল্পটাও হলো না। চিত্রার গল্পটায় শুরু হলো আবার এক অন্ধকার অধ্যায়ের… ভাগ্যের নির্মম পরিহাসের স্বীকার হলো সে!

বিয়ের প্রায় ৩ মাস পর ফাইজের ছুটি শেষ হয়ে এলো। অনেকদিন তো থাকা হলো। তাই সে অস্ট্রেলিয়া যাবার প্রস্তুতি নিতে লাগল। চিত্রার সব রেডি করতে তাকে অনেক দৌড় ঝাপ করতে হচ্ছে। চিত্রার ভিসা হয়ে গেলেই তারা অস্ট্রেলিয়া উড়াল দেবে। চিত্রা তার চাকরিটা ছেড়ে দিচ্ছে। অস্ট্রেলিয়াতে কয়েক জায়গায় অনলাইনে এপ্লাই করে রেখেছে আর এ ব্যাপারে ফাইজ তাকে সব রকম সাহায্য করেছে। সব হয়ে গেলেই সে চাকরি ছেড়ে দেবে এমন কথাই অফিসে বলা আছে।

ফাইজের ছুটি শেষ হয়ে গেল কিন্তু চিত্রার ভিসা এখনো করা যায়নি। চিত্রার NID কার্ডসহ আরও ছোটখাটো সমস্যার কারণে ভিসা আটকে গেছে। ফাইজ এর মধ্যে ছুটি বিয়ে উপলক্ষে একবার বাড়িয়ে নিয়েছিল বলে সে এবার আর ছুটি বাড়াতে পারল না। তাই চিত্রাকে রেখেই তারা চলে গেল। কাগজ রেডি হলেই চিত্রাও চলে আসবে সেই কথা রইল। এটা নিয়ে চিত্রা অনেক মন খারাপ করল কিন্তু ফাইজের কিছু করার নেই।

ফাইজ চলে গেছে দুদিন পার হয়ে গেছে কিন্তু এখনো তার কোন ফোন আসেনি! চিত্রা একটু চিন্তায় পড়ে গেল। ওখানে যোগাযোগ করবার জন্য তার কাছে কোন নাম্বারও নেই। কী করবে ভেবে পেল না। ধরে নিল কোন ব্যস্ততা যাচ্ছে… কিন্তু মনকে মানাতে পারছে না। আরও দুদিন চলে গেল কিন্তু কোন ফোন এলো না! চিত্রার ভাবি তখন পুরোনো ফর্মে ফিরে এলো। চিত্রাকে খোঁচা দিয়ে অনেক কথাই বলতে লাগল। ফাইজ নাকি চিত্রাকে ধোকা দিয়ে বিয়ে করেছে। বড়লোকের কত রকমের সখ থাকে এটাও তাদের একটা সখ ছিল হয়ত, নয়ত কোন খেলা ছিল। তা না হলে চিত্রার মত এমন মেয়েকে এমন রাজপুত্রের মত ছেলে বিয়ে করে? বিয়ে করে এভাবে ফেলে রেখে যায়? বিয়ের আগে তো ফাইজ সম্পর্কে তারা কোন খোঁজই করেনি। তাদের উদ্দেশ্য খারাপ ছিল বলেই তারা এমন তড়িঘড়ি বিয়েটা করিয়েছেন। রুনার মুখে এসব শুনে শুনে চিত্রার মা, বাবা, ভাইয়াও চিন্তায় পড়ে গেল। তবে কী তারা আসলেই ভুল করে ফেলল? ফাইজের জন্য দুঃশ্চিন্তা, ভাবির এমন সব কথা, সব মিলিয়ে চিত্রা এসব আর নিতে পারছিল না। এদিকে সে বুঝতে পেরেছে সে মা হতে যাচ্ছে! সব মিলিয়ে সে দুঃশ্চিন্তা আর কটু কথার চাপে অসুস্থ হয়ে যেতে লাগল। তার নাওয়া খাওয়া এক প্রকার বন্ধই হয়ে গেল। একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে মাথা ঘুরে পড়ে গেল! জাহানারা বেগম মেয়েকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেলেন। চিত্রার এমন অবস্থা তিনি আর দেখতে পারছিলেন না। ডাক্তার চিত্রাকে চেকাপ করে বললেন- চিত্রার এখন মোটেও মানসিক চাপ নেয়া যাবে না। এই মুহূর্তে তার এতটুকু মানসিক চাপ বাচ্চার জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে।

দিন চলে যেতে লাগল… চিত্রাকে বাসার সবাই যথাসম্ভব আগলে রাখে তারপরও চিত্রা কেমন বিষণ্ণতায় ঘিরে থাকত। প্রায় এক মাস হয়ে গেছে এখনো ফাইজের কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। চিত্রার ভাইয়া চঞ্চল সব রকমভাবেই চেষ্টা করেছে কিন্তু কোন কিছুই জানতে পারেনি। চিত্রার ভাবির মত আজকাল সবাই একই কথা বলে ফাইজ চিত্রাকে শুধুমাত্র সখের বশে বিয়ে করে এখন ফেলে রেখে চলে গেছে। নিয়মিত এসব শুনতে শুনতে চিত্রা এখন ফাইজের আশা প্রায় ছেড়ে দিয়েছে। মেনে নিয়েছে ফাইজ হয়ত আর আসবে না। এটাই তার নিয়তি… সুখের স্বপ্ন দেখা তার বারণ ছিল কিন্তু সে সুখের মাঝে ডুবে গিয়ে সেটা ভুলে গিয়েছিল। আজ তারই ফল ভোগ করছে! সে ধীরে ধীরে সব মেনে নিয়ে নিজেকে নিয়ে ভাবতে লাগল। ভাবতে লাগল তার অনাগত সন্তানকে নিয়ে। তার একান্তই নিজের বলে যদি এই পৃথিবীতে কিছু থেকে থাকে তাহলে সেটা তার ভেতরে বেড়ে ওঠা তারই অস্তিত্ব। তাই একে আর এক বিন্দু অবহেলায় সে রাখতে চায় না। সমস্ত পৃথিবীকে উপেক্ষা করে চিত্রা ব্যস্ত হয়ে গেল তার অনাগত সন্তানকে নিয়ে। আর প্রতিদিন একটু একটু করে ভুলে যাবার চেষ্টা করতে লাগল ফাইজের অনুপস্থিতিকে…! ফাইজ এখন তার জীবনের বন্ধ করে ফেলে রাখা একটা ফাইল মাত্র।

চিত্রা তার চাকরিটা শেষ পর্যন্ত ছাড়েনি। সে নিয়মিত অফিস করছে। ফাইজ চলে যাবার পর দুমাস তাকে খুব কষ্ট করতে হয়েছে। কারণ সে যখন যেখানে গেছে চারদিক থেকে শুধু তাকে ফাইজকে ঘিরে প্রশ্ন শুনতে হয়েছে। যেটা তাকে মানসিকভাবে ভেঙে দিত। স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসাটা তার জন্য চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়ায়। সময়ের সাথে সাথে সে নিজেকে শক্ত করে নিয়েছে। কারণ তাকে বাঁচতে হবে। তার ভালো থাকার উপর আরও একজনের ভালো থাকা নির্ভর করছে। সে এখন প্রতিটা দিন নতুন করে বাঁচে, নতুন করে নিজেকে সাজায়। সন্তানকে ঘিরে নিজের মনে হাজারটা স্বপ্ন তৈরি করে। তবু একটা প্রশ্ন প্রতিদিনই তার মনে উঁকি দিয়ে যায়… তার সন্তান দেখতে কেমন হবে? ফাইজের মত? আচ্ছা ফাইজ কী সত্যিই প্রতারক? চিত্রার প্রতি তার অনুভূতির কিছুই কী সত্য ছিল না? সবই সাজানো নাটক? তার সাথে কাটানো মুহূর্তগুলো সবই কী মিথ্যে? একটা মানুষ কী এতটাও মিথ্যে হতে পারে? মানুষ কী মানুষকে সামান্য বিশ্বাসটুকুও করতে পারবে না? আর ফাইজের মা? সেও কী প্রতারক? তার ওই সহজ সরল চেহারের পেছনে সত্যি কী এমন ভয়ংকর মুখোশ ছিল? চিত্রা এগুলো কিছুতেই মানতে পারে না। ফাইজকে প্রতারক ভাবতে তার বুকে বাঁধে… তার মনে এখনো ক্ষীণ আশা ফাইজ নিশ্চই বড় ধরনের কোন সমস্যায় পড়েছে, সে নিশ্চই একদিন ফিরে আসবে। চিত্রা যতই ভুলে থাকার চেষ্টা করুক ফাইজের ভাবনা ঠিকই কোন না কোনভাবে চলে আসে। চিত্রা কী এখনো ফাইজের জন্য বুকের ভেতর ভালোবাসা লালন করে?

দেখতে দেখতে আরও ৬ মাস চলে গেল। চিত্রা এখন ৭ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। তার এখন অফিস করতে একটু কষ্টই হয়। প্রেগন্যান্সি টাইমে একজন মায়ের কত রকম সমস্যা হয়, কত রকম ইচ্ছে হয় সেগুলো চিত্রার মা আর ভাইয়া সবই খেয়াল করে। কোন কিছুর অভাব বোধ করতে দেয় না। কিন্তু তারপরও চিত্রার মনে কিছু অপূর্ণতা থেকে যায়। তার মাঝেই মাঝেই মনের ভেতর খুব অসময়ে অসম আবদার চলে আসে, যেটা সে কাউকে বলতে পারে না। হয়ত ফাইজকে ঠিক তা বলা যেত। এখনো মাঝ রাতে ঘুম ভেঙে গেলে তার ফাইজের মুখটাই দেখতে ইচ্ছে হয়… সেই মুখ আর দেখতে পারবে না সেটা ভাবতেই দুচোখে অশ্রুধারা নেমে আসে। তার সন্তান এখন নিজের উপস্থিতি জানান দেয়। হাত পা ছুড়ে দিব্যি তার পেটের ভেতর খেলতে থাকে। চিত্রা হাত দিয়ে সে স্পর্শ নেয়। তার চোখ আনন্দে ঝাপসা হয়ে আসে। তার কেবলই মনেহয় এই সময়গুলো ফাইজ উপভোগ করতে পারল না! তার সন্তান নিজেও কী কম অভাগা? সে এই পৃথিবীতে আসছে অথচ তার পাশে তার বাবা নামক বটবৃক্ষের ছায়া নেই! সুন্দর পৃথিবীটা তার কাছে হয়ে যাবে কঠিন। তার সন্তানও কী তাহলে তার মতই আজীবন দুঃখ বয়ে বেড়াবে? চিত্রার তখন বুকের ভেতরটা ফাঁকা হয়ে যায়। না, সে তার সন্তানকে একাই পৃথিবীর সবটুকু সুখ এনে দিবে। সে মা, এটুকু তো তাকে পারতেই হবে। সে দিন গুনতে থাকে তার ভেতর বাড়তে থাকা তারই অংশকে নিজের হাতে ছুঁয়ে দেখার, কোলে নিয়ে আদর করার… এই ছোট্ট প্রাণটা তো তার একার অংশ নয়, ফাইজেরও অংশ তাই না? সে কী পারবে ফাইজের অংশের ভালোবাসাটাও ঠিকঠাক ওকে দিতে?

আগের পর্বের লিংক
https://www.facebook.com/groups/boipokaofficial/permalink/1360940658044760/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here