#লবঙ্গ_লতিকা
#নুজহাত_আদিবা
পর্ব ১১
তমা উঠোনের গাছের সাথে ঘুরপাক খাচ্ছে। আর বেসুরো গলায় বলছে,” ডিজে ওয়ালা বাবু মেরা গানা বাজা দো। ডিজে ওয়ালা বাবু মেরা গানা বাজা দো। গানা বাজা দো।”
সাদ চৌকাঠ মাড়িয়ে উঠোনের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলো। তমার বেসুরো গলার গান শুনে তমার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। তমা নিজের পাশে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে ফিরে তাকালো। সাদ ভ্রু কুঁচকে তমাকে বললো,” এই গান শিখলে কোথা থেকে? ”
তমা নিজের চুলে হাত বুলিয়ে উত্তর দিলো,” আপনার সঙ্গে বিয়ের দিন বক্সে গানটা বেজেছিলো। তখন শুনেছি।”
সাদ মাথা নাড়িয়ে বললো, ” হুম এসব গান মনে থাকে। কিন্তু, পড়ার কথা মনে থাকে না। পড়ার কোনো খবর নেই। আছে শুধু গান আর আচারের খবর!”
তমা তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো। সাদের উপর ক্ষেপে গিয়ে এক পা এক পা করে এগিয়ে গেল। সাদ সেদিকে পাত্তা না দিয়ে নিজের মতোই দাঁড়িয়ে থাকলো। তমা ক্ষিপ্ত কন্ঠে সাদকে বললো,” ভালো হচ্ছে না কিন্তু! আর আচার মানে কীসের আচার?”
সাদ গাছ থেকে একটা পাতা ছিঁড়ে বললো,” ছাঁদে তখন যে চুরি করে আচার খেলে। আমি দেখিনি বুঝি? সবাইকে বলে দেবো কিন্তু। ”
তমা আমতা আমতা করে বললো,”কী বলবেন শুনি?”
সাদ নির্লিপ্ত গলায় উত্তর দিলো, “এই যে তুমি চুরি করে আচার খেয়েছো। আচার চোর!”
তমা রেগে গিয়ে হাসফাস করতে করতে সাদের দিকে তাকালো। সাদ নিজের মতোই দাঁড়িয়ে আছে। তমা কী করছে না করছে সেদিকে কোনো খেয়ালই নেই।
“হরেক মাল দশ! হরেক মাল পাঁচ! ”
বাইরে ফেরিওয়ালার কন্ঠস্বর শুনে তমা এক ছুটে বাইরে বেড়িয়ে গেল। সাদ তমার এহেন কান্ড দেখে চমকে উঠলো। তমার পিছু পিছু সাদও নিজেও ছুট লাগালো।
তমা ফেরিওয়ালার ফেরির সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ফেরিওয়ালা কাঁচের চুড়ি,টিপ, নেইলপালিশ, আলতা এসব বিক্রি করছে। সাদ উদভ্রান্তের ন্যায় তমার দিকে ফিরে তাকালো। তমা গভীর মনোযোগ দিয়ে ফেরিওয়ালার ফেরি থেকে জিনিসপত্র খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। এক মুঠো চুরি নিজের হাতে পরে হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে দেখলো তমা।
সাদ ফেরিওয়ালাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো চুরির দাম কত? ফেরিওয়ালা সাদকে প্রত্যুত্তরে বললো,”২০ টাকা”
সাদ চুরির দাম মিটিয়ে তমার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। তমা আরও কী কী যেন খুঁটিয়ে নাটিয়ে দেখছে। সাদ একটা আলতার বোতল হাতে নিলো। তমা হেসে সাদকে বললো,”ছেলে হয়ে আলতা পরবেন না কি?”
সাদ তমার হাতে আলতার বোতলটা দিয়ে বললো,” তোমার জন্য নিয়েছিলাম। পরলে পরবে আর না পরলে অন্য কাউকে দিয়ে দিয়ো।”
তমা অবাক হয়ে সাদের দিকে তাকালো। বজ্জা/ত ছেলেটা আস্তে আস্তে ভালো হয়ে যাচ্ছে!
বাড়ি ফিরেই তমা আলতার বোতল নিয়ে বসলো। হাতে,পায়ে আলতা দিয়ে লাল টুকটুকে করে ফেললো। তমাকে আলতা দিতে দেখে নাদিয়া দৌড়ে এসে তমার পাশে বসলো। আঙুল দিয়ে আলতার বোতলের দিকে ইশারা করে বললো,” এটা কী?”
তমা পায়ে আলতা মাখতে মাখতে বললো,”এটা আলতা। তুমি দেবে?”
নাদিয়া ওপর নিচে মাথা ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে মিচের মতামত জানান দিলো। তমা নাদিয়ার ছোট্ট ছোট্ট পায়েও আলতা পরিয়ে দিলো।
আলতা পায়ে তমা বাড়ির এদিক ওদিকে ছুটে বেড়াচ্ছে। সাদের ছোট চাচী হেরা তো আঙুর বালা আর অনিতার সামনে বলেই ফেললো,” তমা মেয়েটা মাত্রাধিক চঞ্চল! বাড়ির এদিক ওদিক ছুটোছুটি করেই বেড়াচ্ছে! ”
আঙুর বালা হেরাকে ধমক দিয়ে বললো, “বউ মানুষ ঘুরবো ফিরবো খাইবো। ছোট মানুষ! ওর থেইক্যা আর এত কী আশা করো?”
অনিতা আঙুর বালাকে শান্ত করে বললো,” আহা হেরা, এমন ভাবে বলছিস কেন? তমা তো নিজের মতোই আছে। কাউকে বিরক্ত করতে দেখেছিস? বাড়ির বাইরেও তো যাচ্ছে না। নিজের মতোই নিজে ব্যস্ত। ওকে নিয়ে এত ঘামাস না তুই।”
হেরা আর কিছু বললো না। বলেও লাভ নেই। আঙুর বালা কারো কথাই কানে তোলেন না। হেরা সেই স্থান হতে দ্রুত প্রস্থান করলো।
দুপুরে সবাই একত্রে খাবার খেতে বসেছে।তমাও সবার সঙ্গে খেতে বসেছে। অনিতার সবার সামনে তমাকে বললেন,”তোমাকে একটা কথা বলার ছিল।বলবো বলবো করে ভাবছিলাম। খেয়ালই থাকে না!”
তমা নিচু গলায় জবাব দিলো,” জি, বলুন”
অনিতা ব্যস্ত গলায় বললো,” কালকে সকালে তোমাদের বাড়ি থেকে তোমার বই খাতা সব নিয়ে আসবে। এখানেই পড়াশোনা করবে। দরকার পরলে সাদও তোমাকে টুকটাক সাহায্য করবে। এতদিন অনেক দিয়েছো ফাঁকি। কিন্তু আর না। পড়াশোনা করলেই জীবনে বড় হতে পারবে।”
তমা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললো, “এ্যা! আমি তো বিয়ে করলাম পড়াশোনা করবো না বলে। এখন আবার পড়তে হবে কেন? এত পড়াশোনা করতে হবে কেন? একদিন তো মরেই যাবো।”
সাদ বিক্ষিপ্ত কন্ঠে বললো,” এত আচার খেতে হবে কেন? একদিন তো মরেই যাবে!”
তমা অগ্নি দৃষ্টিতে সাদের দিকে তাকালো। আসলেই ছেলেটা বেশি কথা বলে! অনিতা হালকা নিশ্বাস ফেলে বললো, ” এতকিছু আমি জানি না। কাল থেকে আবার পড়াশোনা শুরু করবে। বিয়ে হয়েছে বলে পড়াশোনা বন্ধ করার ভাবনা মাথায় ভুলেও এনো না।”
তমা খাবার টেবিলে মুখ বাঁকিয়ে বসে রইলো। ছাতার মাথা! ভালো লাগে না কিছু!
খাওয়া শেষ করে তমা হাত মুখ ধুয়েমুছে আঙুর বালার ঘরে গেল। আঙুর বালা তমাকে দেখে ভ্রু কুঁচকালো। কাঁপা কাঁপা গলায় বললো, ” এই ছে/ড়ি এদিকে আয় তো।”
তমা টলমলে পায়ে এগিয়ে গেল। আঙুর বালা তমাকে সামনে থেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করলো। চিন্তিত গলায় তমাকে বললো,” এই চুড়ি, আলতা এসব তোরে কে দিসে?”
তমা চুল আঙুল দিয়ে প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে বললো,” যাঁর ইচ্ছে করেছে সে দিয়েছে। তোমাকে এত কথা বলবো কেন বুড়ি?”
আঙুর বালা নিজের হাতে থাকা লাঠি ঘুরাতে ঘুরাতে বললো,” বুজছি! আমার নাতী দিসে এডি।”
তমা ব্যাঙ্গাত্বক কন্ঠে বললো, “বুঝতেই যখন পেরেছো তখন আবার জিজ্ঞেস কেন করো? না কি হিংসে হয়? আমার তো দেওয়ার মতো মানুষ আছে। তোমারটা তো তাও নেই! একেবারে পটল তুলেছে।”
আঙুর বালা নিজের হাতে থাকা লাঠিটা তমার দিকে তাক করে বললো,”তুই দেখসোস? আমারডা আমারে কত ভালোবাসতো। সারাদিন আমারে চোখে হারাইতো!”
তমা মুখ টিপে হেসে বললো, “ছাই বাসতো ছাই! সেই তো একা রেখে চলেই গেল।”
আঙুর বালা এবার খুব ক্ষেপে গেল। ক্ষিপ্ত কন্ঠে বললো,” ওই ছে/ড়ি আমারে যদি তোর দাদা ভালোই না বাসতো। তাইলে তোর শশুর তোর চাচা শশুর এডি পয়দা হইসে কইত্তে? বাইচ্চা থাকলে দেখতি তোর আরও কত চাচা শশুর আর ফুপু শাশুড়ী থাকতো!”
চলবে….