তাসের ঘরে তুমি আমি পাঠ-২

#তাসের_ঘরে_তুমি_আমি
#পর্ব_০২
#আয়াশ_রহমান

নিজের স্ত্রীর শরীরে কেমন যেন পরপুরুষ এর ঘ্রাণ পাচ্ছে শান। এ বিষাক্ত অনুভূতির চেয়ে মৃত্যূও শ্রেয়।

কিছুসময় আগে শানকে দেখে পুতুল এগিয়ে আসলে শান তাকে জড়িয়ে ধরে। কিন্তু তার কেন যেন মনে হচ্ছে এ সেই আগের পুতুল নয়। কেমন পাল্টে গেছে৷

‘পুতুল।’
‘শান তুমি কখন এলে? আর তোমার চোখে চশমা হাতে লাঠি! তার মানে কি?’
পুতুলকে ছেড়ে দিয়ে কেমন দুঃখী ভাব নিয়ে বলল, ‘বলেছিলাম না পুতুল, ওরা পারলো না, পারলো না আমাকে ঠিক করতে।’
‘মানে!!!’

আমি বোধহয় আর পারবই না দেখতে।’

শান চশমার আড়ালেই খেয়াল করলো কথাটি শুনে পুতুলের চোখে মুখে কষ্টের বদলে কেমন নিশ্চিন্ত হওয়ার আভাস। পদে পদে যেন নতুন কিছুর সম্মুখীন হচ্ছে সে। এই কি সেই পুতুল? তার পুতুল? যাকে শান জীবনের চেয়েও বেশি ভালোবাসত?

হঠাৎ দরজা খুলে গেলো। শানের মা বাবা যেন কোথায় যাচ্ছিল। হাতে কাথার ব্যাগ দেখে বুঝলো মা বাবা হয়ত এগুলোর সাপ্লাই দিতেই যাচ্ছিল। শানকে দেখেই হাতের ব্যাগগুলো পড়ে গেল তাদের।
ছেলেকে এতদিন পর কাছে দেখতে পেয়ে কেদেই দিল তার মা। শানের বাবাও ছেলেকে দেখে খুব খুশি কিন্তু শানের চোখে চশমা দেখে অবাক হল সবাই। তার মানে সে কি সুস্থ হয়নি? এত সময় তো শানকে কিছু বলতে না দিয়েই তাকে দেখা মাত্রই জড়িয়ে ধরে কাদছিলো তার মা।

‘বাবা তোর চোখে চশমা, হাতে লাঠি?’
শান মাথা নিচু করে বলল, ‘মা-বাবা, আমাকে সুস্থ করতে পারেনি তারা, বলেছে তিনমাস পরে আবার আসতে, তখন আরেকটা অপারেশনের পর আশানুরূপ ফলাফল আসতে পারে। ওখানে থাকার আর টাকা ছিল না তাই আমি চলে এসেছি।’

শানের মা ছেলেকে জড়িয়ে আরো জোড়ে কাদছে। শান তার মাকে জড়িয়ে স্বান্তনা দিচ্ছে। সে চাইলেও পারছে না তার মার চোখের জল মুছে বলতে যে মা আমি ভাল হয়ে গেছি। এই দেখো, তোমাকে বাবাকে দেখতে পাই। কিন্তু শান অপারগ তার যে অনেক কিছু জানার আছে। যে পুতুল কোনো পরপুরুষ এর দিকে তাকাতো না পর্যন্ত আজ সে পুতুলের হাত স্পর্শ করে এক বাইরের পুরুষ ওষ্ঠের ছোয়া দিয়ে গেছে, তারই সামনে।
এর কারণ শানকে বের করতেই হবে।

সেই চিরচেনা পুতুলকে আজ যেন কেমন অচেনা লাগছে শানের কাছে। ঘরে এসেছে প্রায় এক ঘন্টা মত আগে, শানকে বিছানায় বসিয়ে পুতুল নিজে ফ্রেশ হতে গেছে এখনো বেরোয়নি। কিন্তু একসময় শান অফিস শেষে বাসায় আসলে তার কাছেই ঘুরঘুর করতো পুতুল। আর আজ এতদিন পর এসেও পুতুলের এমন অনিহা। চোখের কোটর থেকে এক বিন্দু অবহেলা বেরিয়ে আসলো যেন। ওইভাবেই মুছে নিল শান। কিন্তু সে মনে মনে ভাবছে,
‘আমাকে খুব সতর্ক থাকতে হবে, নাহলে সব আমি কোনোভাবেই জানতে পারবো না। খুব ভালোভাবে আমার এই মিছে অন্ধত্বকে কাজে লাগিয়ে সত্য সামনে আনতে হবে। কেন আমার পুতুল এমন করছে? কেনো?’

এসব মনের মাঝেই বলতে বলতে পুতুল বের হয়ে
আসলো। তাকে এক পলক দেখে শান মাথা নিচু করলো। আগের অনুভুতি চেয়েও সে বাইরে আনতে পারছে না। পারছে না এই পুতুলকে ভালবেসে বুকে টেনে নিতে।

‘চলো তোমাকে ওয়াশরুমে দিয়ে আসি। ফ্রেশ হও, তারপর একসাথে খাই।’
‘না আমি যেতে পারব।’
‘মানে?’
‘আসলে একয়দিন তো একাই ছিলাম, সব কিছুতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। আরো সেটা তো অচেনা জায়গা ছিল আর এটা আমার চিরচেনা ঘর। আমি নিজেই পারব।’
‘অহ আচ্ছা।’ বলে পুতুল আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আচড়াচ্ছে। অন্য সময় হলে হয়ত শান পেছন থেকে জড়িয়ে ধরতো তাকে। কিন্তু সেদিকে একবার দৃষ্টি দিয়েই লাঠি হাতাতে হাতাতে ওয়াশরুম যেতে ধরল শান।

খেতে বসেছে সবাই৷ শানের বাবা প্রশ্ন করলো,
‘বাবা সব জমি জমা বিক্রি করেই তো তোকে বিদেশে পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু আবার কিভাবে যাবি?’
‘কেন বউমা তো চাকুরি করে টাকা জমাচ্ছিল? সেই টাকা তো আমরা আগের বার নেইনি, আরো তিনমাস আছে সময়, একয়দিনে আরো জমবে, সবমিলে এবারের খরচ তো হয়ে যাওয়ারই কথা তাইনা মা?’

শানের মার কথা শুনে পুতুলের চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। পরে নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল,
‘আ আসলে মা, আমার তো এখনো অভারটাইমের টাকা পাইনি, কি করবো বল, বেসরকারি এনজিও তো, এই কয়দিনে পেলেই তো কিছু একটা দেয়া যাবে।’
‘সে কি বউমা! অভারটাইম ছাড়াও তো তোমার বেতনের যথেষ্ট টাকা থাকার কথা, কারন আমার কাথা সেলাই করে যেটাকা হয় সেটা দিয়েই তো আমি পরিবার চালাই, তুমি আর কয় টাকাই দাও?’
‘মা আপনি বলতে চাচ্ছেন আমি সংসারে টাকা দেই না?’
”দেখো বউমা,,,,’

‘আচ্ছা মা থামো তোমরা, পুতুলের সমস্যা থাকতেই পারে চাকুরীতে। বেসরকারি জব তো। আমি তো আগেই বলেছিলাম আমার আর সুস্থ হওয়ার আশা নেই, মাঝখান থেকে তোমার মায়ের জমিটুকু বিক্রি করা লাগলো এমনি এমনি।’

‘কি বলছিস এসব বাবা?’
‘মা বাদ দাও, খাইয়ে দাও না, কতদিন তোমার হাতে খাইনি আমি।’
শানের কথায় তার মার চোখে পানি চলে আসলো৷ সে তরি হরি করে উঠে শানের পাশে গেলো শানকে খাইয়ে দিতে।
‘আজ শুধু মা কেনো? আমার ছেলেকে আমিও খাইয়ে দিব।’ বলে শানের বাবাও নিজের প্লেট নিয়ে শানের পাশে গেল।

খুব যত্ন করে খাইয়ে দিচ্ছে শানকে তার বাবা মা। শান মাঝে মাঝে আড়চোখে খুব সতর্ক ভাবে পুতুলের কার্যকলাপ লক্ষ করছে। মন দিয়ে খেয়ে যাচ্ছে পুতুল, আশেপাশের কোনো চিন্তা নেই মনে হয় তার। আগের দিন হলে হয়ত পুতুল শানের বাবা মার কাছে নালিশ দিত যে আপনাদের ছেলেকেই খাওয়াবেন! মেয়ে কি দোষ করলো?
কিন্তু আগের পুতুল আর এখন সামনে বসে থাকা মানুষ কি আদৌ এক আছে? ভেবেই শান তাচ্ছিল্য হাসলো।

পুতুল নিজের খাওয়া শেষ করে রুমে চলে গেল কাউকে কিছু না বলে। ‘দেখেছিস বাবা,বৌমার আচরণ? আগে তো বৌমা আমার সাথে ছাড়া খেতই না, আর আমার মুখে মুখে কথা বলছে এখন! তুই ছিলি না, তোর বাবার ঔষধ শেষ হয়ে গেছিলো, পুতুলকে বলায় সে যে কিরকম ব্যবহার করেছে আমাদের সাথে কি বলব তোকে। যে তারপর থেকে আমি বেশি করে কাথা সেলাই করি যেন এই বুড়ো বুড়ির কারো কাছে আর হাত পাতা না লাগে কিন্তু বাবা বৌমা,,,,’

শান আগেই মাকে চিন্তিত করতে চায় না। সে মাকে বুঝ দিল, ‘মা চিন্তা করো না, হয়ত অফিসে কাজের চাপ বেশি তাই এমন করছে। দেখো ঠিক হয়ে যাবে দুইদিন পরে।’

লাঠি মেঝেতে ঠেকাতে ঠেকাতে নিজের ঘরে গেলো শান। পুতুল বিছানায় বসে মোবাইল টিপছিল। শানকে দেখা মাত্র মোবাইল রাখতে গেল কিন্তু কি মনে করে যেন মুচকি হেসে আবার মোবাইল চালানো শুরু করলো।

শান সেটা দেখে মুচকি হাসলো,’ হয়ত ভাবছে এ তো অন্ধ দেখবে কিভাবে?’

শান বেডে গিয়ে বসল, পুতুলের হাতের মোবাইলের দিকে তাকানোর চেষ্টা করেও তেমন কিছু দেখতে পারলো না। বেশি দেখিতে গেলে পুতুলের কাছে ধরাও খেয়ে যেতে পারে। তাই পুতুলকে হঠাৎ প্রশ্ন করল,
‘পুতুল?’
– – –
‘পুতুল??’
‘কি হয়েছে?’ বিরক্তির সাথে বলল পুতুল।
‘চলো আজ দুজন বেলকনিতে বসে গল্প করি।’
‘দেখ আমি ভীষন ক্লান্ত। কালকে আবার সারাদিন অফিস আছে। আমি ঘুমাব।’
‘অহ আচ্ছা। ঘুমাও লাইটটা নিভিয়ে দাও।’ বলে শান পাশ ফিয়ে বিছানায় মাথা দিয়ে ভাবতে লাগলো আগের দিনের কথা।
——
‘এই বউ কি হয়েছে? কথা বল না কেনো?’
– – – –
‘রাগ করেই থাকবা?’
‘নাহ আমি আবার রাগ করার কে?’
‘কি হয়েছে বলো!’
‘তুমি এখনো বুঝতে পারছোনা কি হয়েছে?’
‘বুঝলে কি বলতাম?’
‘থাক আর বুঝা লাগতো না আপনার।’
‘আবার রাগ করলে?’
‘আমার কথার কি কোন দাম আছে তোমার কাছে?’
‘তোমার দাম না থাকলে কার দাম থাকবে বলো তো?’
‘আমি যে বললাম চল আজ দুজনে একটু আকাশ দেখি, তুমি কি বললে? কাজ আছে তোমার কালকে রেস্ট নিতে হবে, তো এখন আবার আমাকে বলছো কেনো?’
‘হাহাহা তো এই ব্যাপার!!’ বলেই পুতুলকে কোলে তুলে বেলকনির দিকে এগুলো শান। পুতুলও রাগ অভিমান ভুলে শানের কাধ জড়িয়ে গালে একটা অধরের স্পর্শ দিয়ে দিল শানকে।
——-

আগের স্মৃতিগুলোর কথা ভেবে মুহুর্তেই চোখ ভিজে গেলো শানের। পাশে ফিরে দেখলো পুতুল লাইট বব্ধ করে এখনো চ্যাট করেই যাচ্ছে।
‘পুতুল ঘুমিয়েছো?’ পুতুলের দিকে তাকিয়ে বলল শান কথাটি।

পুতুল শানের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভেবে একটু পর বলল,’ আমি চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করছি কখন থেকে একটু চুপ করে ঘুমাতে দাও প্লিজ। কাল অনেক কাজ আছে।’
‘আচ্ছা ঘুমাও।’ বলে শান মুচকি হাসল আর পুতুল মোবাইলে চ্যাট করেই যাচ্ছে।
‘আজকাল এত বড় মিথ্যা বলতেও একবার বাধে না পুতুল!!’ মনে মনে বলল শান, দৃষ্টি এখনো পুতুলের দিকেই।
নিকনেমে কয়েকটা ফুলের স্টিকার দেয়া জন্য আইডির মালিকের নাম পাশ থেকে দেখা যাচ্ছে না। শান কিছু একটা ভেবে শুয়ে পড়লো।

পুতুলকে হাত পা বেধে ফেলে রাখা হয়েছে একটা কালো অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘরে। পুতুল হাত মুখ বাধা অবস্থায়ই শান শান বলে চিৎকার করছে আর বলছে,
‘আমাকে বাচাও আমাকে নিয়ে যাও তুমি শান, শান।।।।।’

ধড়ফড়িয়ে উঠল শান, কি বাজে স্বপ্ন দেখলো সে!! পাশে তাকালো, পুতুল এখনো ঘুম। ভোরের আকাশে হালকা আলোর আভা দেখা দিয়েছে মাত্র৷

খুব সন্তর্পণে পুতুলের পাশে গিয়ে মোবাইল হাতে নিল শান। পাসওয়ার্ড দেয়া। শান নিজেই বসিয়েছিলো পুতুলের মোবাইলের পাসওয়ার্ড। নিজের নাম লিখলো সে, হলোনা, অবাক হল শান। পুতুল আর তার নাম একসাথে লিখলো তাও হচ্ছিল না। পুনরায় আবার তাদের বিয়ের ডেট লিখলো, এবারও ফলাফল শূন্য। প্রচন্ড রাগ হল শানের।তখনই পুতুল আড়মোড়া ছাড়ল। শান তড়িঘড়ি করে মোবাইল পুতুলের পাশে রেখে ক্রোধিত মনে বাথ্রুমে ফ্রেশ হতে গেলো।

সকালে ড্রয়িংরুমে বসে আছে শান, পুতুল আফিসে যাবে তাই শাড়ি আর বোরকা আয়রণ করছে ড্রয়িংরুমের টেবিলে আর পাশের সোফায় তার বাবা বসে কাথার কাপড় দেখছে। রান্না ঘরে মা রান্না করছিলো৷ শানের বাবার সাথে কথা বলতে এসেছে সে কাথার কাপড়ের বিষয়ে। হঠাৎ শানের রান্না ঘরের দিকে নজর গেলে দেখতে পেলো দুধ উপরে পড়ছে চুলা থেকে।

সে আনমনে বলে ফেললো, ‘মা রান্নাঘরে যাও তোমার দুধ তো পুড়ে গেলো।’

সবাই শানের দিকে অবাক হয়ে চোখ বড় বড় করে তাকালো। পুতুলের চোখ যেন কোটর থেকে বেরিয়ে আসছে। শানের মা বাবারও একি অবস্থা।।
শান ভালোই বুঝতে পারছে সে কি ভুল করে ফেললো অজান্তে।

চলবে,

ভালো লাগলে সবাই গঠনমূলক মন্তব্য করুন, আরো দ্রুত গল্প দেয়ার ট্রাই করবো। সবাইকে অগ্রিম ধন্যবাদ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here