তাসের ঘরে তুমি আমি পাঠ-৪

#তাসের_ঘরে_তুমি_আমি
#পর্ব_০৪
#লেখক_আয়াশ

‘কি বলছেন এসব? পুতুল চাকুরি ছেড়ে দিয়েছে?’
‘হ্যা সেটা তো অনেক আগে।’

শান যেন আকাশ থেকে পড়ল। ‘পুতুল এতদিন চাকুরির নাম করে বাড়ির বাইরে যাওয়া আসা করে। সেইজন্যই কি টাকার কথায় ওইরকম বিহেভ করে মায়ের সাথে!!!’

তখনই পাশ দিয়ে আরেকজন মেয়ে যাচ্ছিল। শান যার কাছে এসব শুনছিল তাকে জিজ্ঞেস করলো ওই মেয়েটি, ‘কিরে লাবনী ইনি কে? তোর রিলেটিভ? আগে তো দেখিনি!!’
‘আরেহ না, আমার রিলেটিভ হবে কেন? ইনি তো পুতুলকে খুজতে এসেছেন।’
‘কিহ! পুতুল? এতদিন পর হঠাৎ?’
‘ইনি নাকি জানতেন না যে এখন আর পুতুল এখানে জব করে না।’
মেয়েটি তাচ্ছিল্য হেসে বলল,’জব করবেই বা কেন? বড় মাছ আটকেছে না জালে!! এখন আর এসব ছোট খাট চাকুরি কি পুতুলের করা লাগে?’

মেয়েটির কথায় শান অবাক হয়ে চেয়ে রইল। বলল, ‘কি বলছেন আপু? বুঝতে পারলাম না।’
মেয়েটি হেসে আবার বলল,’বুঝবেন কিভাবে। যদিও আপনার রিলেটিভ তারপরও বলছি, আমরা তো শুধু দেখতাম। আমাদের ম্যানেজার সাহেবের বন্ধু সাব্বিরের সাথে তার উঠা বসা বেশি হত পুতুলের। তার কিছুদিন পরই তো পুতুল জবটা ছেড়ে দিলো।’
‘সাব্বির!!!’

বেলকনিতে বসে গোধূলির রক্তিম আকাশের পানে চেয়ে আছে শান। ভাবছে কিছুসময় আগে পুতুলের অফিস থেকে শুনে আসা কথা গুলো।

পুতুলের এনজিও তে একটা প্রোগ্রামে তার ম্যানেজারের বন্ধু সাব্বিরের সাথে পরিচয় হয় পুতুলের। সেখানেই সাব্বিরের নজর পুতুলের দিকে পড়ে যায়। তারপর নাকি অফিস শেষে প্রায়ই গাড়ি নিয়ে আসত সাব্বির, পুতুলের সাথে দেখা করতে। প্রথম প্রথম পুতুল সায় না দিলেও পরে নাকি তাদের প্রায়ই কথা বলতে দেখতো লাবনীরা অর্থাৎ পুতুলের কলিগরা।
এনজিওর ম্যানেজারের ব্যাপারটি দৃষ্টিকটু লাগলে একদিন নাকি তিনি সাব্বিরকে এই নিয়ে বলেন। তার কিছুদিন পরই পুতুল জব ছেড়ে দেয়।

শান শুনেছে সাব্বির একটা খারাপ ছেলে অনেক মেয়ের জীবন নষ্ট করেছে। এবার হয়ত পালা পুতুলের। কিন্তু পুতুল! এভাবে তার ভালোবাসাকে তুচ্ছ করলো!!

হায়রে ভালোবাসা! আজকালকার ভালোবাসা বুঝি এমনই হয়! যাকে আপনি যতটা ভালোবাসার অধিকার দিবেন, সে ঠিক ততটা কষ্টই আপনাকে ফেরত দেয়ার ক্ষমতা পাবে। মনের গহীনে যতটা স্থান একজনের জন্য বরাদ্দ করা যায়, তার অনুপস্থিতি অবহেলা সেই স্থানটাই কষ্টে পরিপূর্ণ করতে পারে।
‘তোমাকে এতটা বিশ্বাস এতটা ভালবাসার প্রতিদান এভাবে দিলে পুতুল!!’

এসব ভাবতে ভাবতে আঁখিদুটি অশ্রুসিক্ত হল শানের। কিন্তু মায়ের ডাকে তৎক্ষনাৎ সেটা আড়াল করে মুছে ফেললো সে।
‘কিরে খেয়ে নে, আবার তো তোকে কাজে যেতে হবে।’
‘মা আজ খেতে ইচ্ছা হচ্ছে না।’
‘বাবা এরকম করলে তো শরীর খারাপ হবে।’
‘অফিস থেকে আজ একটু তাড়াতাড়ি যেতে বলেছে আমায়। অফিসেই খেয়ে নিব মা। তোমরা খেয়ে নিও।’
শানের মা মন খারাপ করে চলে গেলো। হাজার হোক মা তো৷ ছেলের মনবোঝে। সেও হয়ত বুঝেছে এই বদলে যাওয়া পুতুলের সাথে তার ছেলেটা ভালো নেই।

সন্ধ্যা হলেই শান বেরিয়ে পড়ল। রিয়াদ ভাই যে বিশ্বাসের সাথে তার চাচার কাছে তার কথা বলে জব দিয়েছে সেই বিশ্বাসের সম্মানটুকু তো দিতে হবে! কাজ সে মন দিয়ে করবে। এটা ভেবেই বের হল ঘর থেকে।

বাড়ির সদর দরজা পেরোনোর পরই একটা মেয়ের কন্ঠ আসলো তার কানে।
‘আপনারা আমাকে ডিসটার্ব করছেন কেন? যান এখান থেকে।’
‘এখানে একা একা দাঁড়িয়ে আছো, চলোনা আমাদের সাথে বসে আড্ডা দাও, আমাদেরও একটি মনোতৃপ্তি হোক।’

শান দেখলো কালকের সেই মেয়েটাকে কয়েকটা পাড়ার লাফাঙ্গা টাইপ ছেলেরা জ্বালাচ্ছে। সেই মেয়েটা ভয় পেয়েছে মনে হচ্ছে। এর মধ্যেই একটা ছেলে হঠাৎ মেয়েটার হাত ধরে ফেলল,
‘হা…হাত ছাড়ুন বলছি! বেয়াদবি করলে লোক ডাকবো আমি।’
‘আহা আমরা তো তোমার বন্ধুর মতই। চলো না আমাদের সাথে।’

‘এই কি হচ্ছে এখানে?’ শান জোড়ে বলে উঠল। ছেলেগুলো হঠাৎ হাত ছেড়ে দিয়ে তার দিকে তাকালো, সাথে মিথুও তাকালো।

‘এলাকায় অসভ্যতা করিস মেয়েদের সাথে! দাড়া তোদের আমি….’ বলে শান লাঠি উচু করে মারার জন্য আসলো।

ছেলেগুলোর বয়স খুব বেশি না, কলেজ পড়ুয়া। শানের হাতে লাঠি আর মারতে আসা দেখে তারা এক দৌড় দিল।

মিথু শানের দিকে দৌড়ে আসল।
‘আপনি! আপনি কথা বলতে পারেন?’
‘চুপ করো মেয়ে, তুমি এখানে কি করছো? সন্ধ্যায় বাড়ির বাইরে কেনো?’
‘আ, আসলে,,’
‘আসলে কি?’
‘আচ্ছা আপনি লাঠি হাতে উচু করে আসলেন! কিছু না দেখে ওদের সাথে মারামারি করে পারতেন?’
শান মুচকি হেসে বলল, ‘শরীরের শক্তির চেয়ে বুদ্ধির জোড় বেশি। ওরা কি বুঝেছে এটা অন্ধের লাঠি? ওরা তো ঠিকই মনে করেছে আমি লাঠি নিয়ে মারতে আসছি।’
‘হুম, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, আপনি না থাকলে আজ,,, ‘
‘আমি কিন্তু আমার কথার জবাব পাইনি। তুমি বাড়ির বাইরে কি করছো?’
মেয়েটি মাথা নিচু করে ফেলল। চোখে ইতিমধ্যে জলের আভা প্রকট হয়েছে।
‘অনাথ এতিমদের জীবনটাই কষ্টের।’
‘মানে?’
‘থাক অন্যদিন বলব।’
‘তাহলে তো আমারও আজ না অন্যদিন তোমাকে সাহায্য করা উচিত ছিল।’
‘আসলে,,’
‘তুমি কি বলবে না কি?’
‘মামী আর মামাতো বোন আমাকে রেগে বাড়ির বাইরে করে দিয়েছে। আজ নতুন না মাঝে মাঝেই দেয়। রাগ হলে অথবা আমার কাজে একটু ভুল হলেই বের করে দেয়। আজ যেমন খাবারে লবন একটু বেশি হয়ে গেছিলো। তার তরকারির প্লেট ফেলে দিয়ে আমাকে থাপ্পড় মেরে বের করে দিয়েছে।’ বলতে বলতে কেদে দিল মেয়েটি।

শান এখন খেয়াল করল মেয়েটির গালে হাতের ছাপ বসে গেছে।
‘কিন্তু তুমি এখন বাইরে দাঁড়িয়ে কি করছো?’
‘মামা অফিস থেকে আসলে তার সাথে ঢুকবো। তাই অপেক্ষা করছিলাম। এর মাঝেই ওই ছেলেগুলো,,,,’
শানের মেয়েটির জন্য কষ্টই লাগলো। এখন একা দাড়ালে আবার কেউ এসে ডিসটার্ব করতে পারে। তাই সে মেয়েটির সাথেই দাঁড়িয়ে রইল।
দুজনই চুপচাপ। এক দুই মিনিট পরই মেয়েটি বলল,’আমার নাম মিথিলা, আপনি?’
‘পিছনে যে বাড়িটা দেখছো ওটা আমাদের৷ আর আমার নাম,,,,,’
শান বলতে বলতে মেয়েটি আবার বলল,”ওই যে আমার মামা হেটে আসছে। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।’
‘হুম।’ বলে শান আবার লাঠি নিয়ে বিপরীতে এগোতে লাগলো।
‘আপনি রাতে একা যেতে পারবেন?’
‘হাহা অন্ধদের তো রাত আর দিন সবই এক।’
‘আচ্ছা ভাল থাকবেন।’
‘তুমিও সাবধানে থেকো।’
বলে শান অফিসের দিকে রওনা দিল।

অফিস থেকে এসে আজকেও পুতুলকে ঘুমন্ত অবস্থায় পেলো শান। তার যেন পুতুলের দিকে তাকাতেও ইচ্ছা করছে না। বিশ্বাসঘাতক একটা।
খুব জলদি একটা কিছু করতে হবে আর এই অন্ধের নাটক করতেও ভালো লাগছে না তার।

পরের দিন সকালে আবারো ফলো করলো পুতুলকে শান। আজ আর কোনো ভুল নয়। সে দেখলো গাড়িটা পাশের এক পার্কের কাছে থামল। পুতুল আর সাব্বির নামের ছেলেটা হাত ধরাধরি করে নামলো।
শান পিছনে লুকিয়ে ফলো করছে তাদের। একটা বেঞ্চে বসছে দুজন। পুতুল সাব্বিরের কাধে মাথা রাখলো। শানের চোয়াল মুহুর্তেই রাগে শক্ত হয়ে গেলো।
সে নিজের মোবাইলে পিছন থেকে ভিডিও করতে লাগলো।

পুতুলের আওয়াজ ভেসে আসলো হঠাৎ।
‘তুমি আজকেই চলে যাবে? এই পনেরো দিন আমি কিভাবে থাকবো?’
‘আহা বেবি আমার বিদেশে কয়েকটা গাড়ির পার্টসের জন্য যেতে হবে। বুঝতেই তো পারছো। আর কয়েকটা দিন এমনিতেই চলে যাবে।’
‘আমি আর ওই বাসায় থাকতে পারছি না। এতদিন তো তোমার অফিসে না হয় বাসায় বসিয়ে রাখো। আর একয়দিন কি করবো?’
‘আরে চাকুরীর কথা না বললে কি তোমাকে তোমার শশুর শাশুড়ী বাইরে বেরোতে দিত?? আর আমি তো সারাদিন কাজের ফাকে তোমাকে নিয়েই ব্যস্থ থাকি।’ একয়দিন বলবে ছুটি নিয়েছো অফিস থেকে। আর এই নাও কিছু টাকা। এই দিয়ে চলবা এই কয়দিন।’
‘না থাক আগে যা দিয়েছো সেটাই তো আছে। আর দিচ্ছো কেনো?’
‘আমার সব তো তোমারই।’
‘শানের কি করা যায় কিছু ভেবেছো?’
‘ওর কাছে তুমি বলতে না পারলে আমি কি করব। আচ্ছা এবার আমি বিদেশ থেকে এসে নেই তারপর দেখা যাবে। ওর তো কিছু একটা করাই লাগবে। তবে যাই বলো চোখ না ভালো হওয়ায় আমাদের জন্য ভালোই হয়েছে।’
‘হুম।’
‘কিন্তু তুমি কিন্তু শানের কাছেও আর ঘেষবে না।’
‘আরেহ না, আমি ওর সাথে একটা ভাল করে কথাও বলি না। জানো আমি তোমার সাথে দেখা হওয়ার পর বুঝেছি আসলে শানের প্রতি আমার মোহ ছিল। সেটা তোমার ভালোবাসায় কেটে গেছে। কিন্তু মাঝখানে বিয়েটা হয়ে আমার জীবন নষ্ট হয়ে গেলো।’
‘চিন্তা করো না। আমি এসে নেই। তারপর শান সোজা ভাবে রাজি না হলে আমারও পথ জানা আছে।’

এই কথাটা শুনে শান আর এক সেকেন্ড দেরি করলো না। চলে আসলো সেখান থেকে। এই মেয়েকে সে ভালোবেসেছিলো? ছি!

সে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো৷ আগে সাব্বিরকে শেষ করবে, তার সম্পদ, প্রোপার্টি সব ধ্বংস করে পথে বসাবে তাকে। তারপর পুতুলকে৷ আর সাব্বিরের একয়দিন বিদেশে থাকাও শানের জন্য কাজটা সহজ করে দিল।

পরের কয়দিন পুতুল বাড়িতেই থেকেছে। বলেছে ছুটি নিয়েছে অফিস থেকে।
পুতুল কিন্তু প্রতিদিন মেসেজ করে শানের সামনেও। আর শান না দেখার ভান করে থাকে।

অফিসে ভালই কাজ চলছে শানের। রেডিও জকি হিসেবে সে আর তার কন্ঠ অনেক পরিচিত এই অল্প কয়দিনেই। সবাই এখন তাকে আর জে শান নামে চেনে। কিন্তু তাকে কেউ দেখেনি বা পরিচয়ও জানে না। কিন্তু অনেক মেয়েই তার গলার আওয়াজে পাগল। এর মধ্যে একটি নেয়ে প্রতিদিন তার শোয়ের সময় কল করে। শানের মুখের আওয়াজে নাকি তার দিনটা ভালো যায়। শান তার জন্য অনেক পছন্দের গান শোনায়।

এর মধ্যে সাব্বির বিদেশে থেকেই খবর পেয়েছে তার দুইটি গ্যারেজ পুলিশ সিল করেছে সেখানে নানা রকম মাদক দ্রব্য পাওয়ার জন্য। ইয়াবা,, ড্রাগস, ফেনসিডিলের কারবার করে এমন অভিযোগও এসেছে তার উপর৷
টিভিতেও এই খবর পাওয়া যাচ্ছে। সেটাই অবাক হয়ে দেখছে পুতুল। শান অফিসে যাচ্ছিল। খবর দেখে ক্রুর হাসি ফুটে উঠলো মুখে।
‘মা অফিসে যাচ্ছি আমি।’
‘সাবধানে যাস বাবা।’

পুতুল শানের কথায় পেছনে তাকালো, শান লাটজির সাহায্যে চলে যাচ্ছে দরজা দিয়ে। আজকাল শান তার সাথে সেরকম কথা বলেনা। তাহলে কি শান তাকে সন্দেহ করছে? পুতুলের মনে প্রশ্ন জাগে। সব কি জেনে গেছে কোনো ভাবে? কিন্তু সেটার তো উপায় নেই। একজন অন্ধের অপক্ষে কিভাবে সম্ভব জানা? পুতুল মাথা থেকে চিন্তা ঝাড়লো।

রাতে অফিস থেকে এসে ঘরে ঢোকার আগেই বুঝতে পারলো পুতুল ঘরে ভিডিও কলে কথা বলছে।
‘আচ্ছা তোমার কে শত্রু আছে?’
‘সেটা তো আমিও বুঝতেছি না। আমাকে কালকেই দেশে আসতে হচ্ছে। দুইটা গ্যারেজ অলরেডি শেষ আরেকটা আছে। এটা শেষ হতে দেয়া যাবে না, তাহলে তো পথে বসে যাব আমি।’
‘আচ্ছা এসো আমিও তোমাকে ছাড়া ভাল নেই, আমরা মিলে কিছু একটা করব।’
‘হুম। কে আমার পিছনে লেগেছে সেটা বের করতেই হবে। তাকে জানে মারব আমি।’

শান তাদের কথা শুনে মুচকি হাসলো। ‘দেশে আয় সাব্বির। এখনো যে অনেক কিছু বাকি আছে তোর সাথে হওয়ার।’

কিন্তু কে জানত, শানের জীবনে সামনে এক ভয়াবহ ঝড় অপেক্ষা করছে!!!

চলবে,

গল্পে এখনো অনেক টুইস্ট বাকি আছে৷ সবাই একটু মনোযোগ সহকারে পড়তে থাকুন, বুঝে যাবেন। ধন্যবাদ।।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here