পুনরায় পর্বঃ৫

#পুনরায়
#অরিত্রিকা_আহানা
#পর্বঃ৫
এবারেও ভাগ্যদেবতা মেহরিনের প্রতি বিমুখ।সে যখন নিজেকে গুটিয়ে নিতে পুরোপুরি প্রস্তুত হয়ে মাঠে নেমেছিলো ঠিক সেই মুহূর্তেই সোহাগের সাথে দেখা হয়ে গেলো তার। মুহূর্তের জন্য আবারও সবকিছু থমকে গেলো। সোহাগ প্রথমে তার সাথে কথা বলতে চাইলো না। মাহমুদের কাছ থেকে মেহরিনের এখানে আসার কথা শুনে মনে মনে বিরক্ত হয়েছে সে। বস্তুত মাহমুদকে ছেড়ে আসার পর থেকেই মেহরিনের প্রতি কিছুটা নারাজ সে। মেহরিনই তাকে আটকালো। নিজের করা প্রতিজ্ঞা ভুলে গেলো সে। সোহাগের কাছ থেকে মাহমুদের সব খবরাখবর জেনে নেওয়ার কৌতূহল দমন করতে পারলো না সে।
সোহাগের মুখ থেকে যখন এনার মৃত্যুর খবর শুনে আবার সমস্ত পৃথিবী ওলটপালট হয়ে গেলো। সুজানের বয়স যখন একবছর, হঠাৎ রোড এক্সিডেন্টে মারা যায় এনা। সেই থেকে বিগত চারবছর মাহমুদ একা! হু হু করে উঠলো বুকের ভেতরটা! মেহরিন অসহায়, হতবম্ভ হয়ে মাহমুদের কাছে ছুটে যেতে উদ্যত হলো। অনেক কিছু জানার আছে তার! কেন মাহমুদ তাকে এনার মৃত্যুর কথা জানায় নি। কেন নিজেকে আড়াল করে রেখেছে? কিন্তু সোহাগ বাধা দিলো। বলল,
—” তিনি যখন এনার মৃত্যুর কথা তোমাকে বলে নি এর মানে তিনি তোমাকে জানাতে চায় না। ”
—“কেন?”
—“হয়ত তোমার ওপর অভিমান থেকে! কম কষ্ট-তো দাও নি তাকে? বিনা অপরাধে চারবছর তাকে ঘুরিয়েছো। তারপর যখন সব ঠিক হলো তখন এনার জন্য তার কাছ থেকে নিজেকে আড়াল করে নিলে। লুকিয়ে রইলে। হ্যাঁ সেই মানুষটা নিজের ভুলের দায় এড়াতে এনাকে বিয়ে করেছেন ঠিকই কিন্তু তোমাকে একমুহূর্তের জন্য। ভুলতে পারে নি। বাট সরি টু সে দ্যায় ইউ ডোন্ট ডিজার্ভ হিম। ইভেন ইউ ডোন্ট ডিজার্ভ সো মাচ লাভ।”
মেহরিন বিস্মিত গলায় বললো,
—“সোহাগ? তুমি তো সবই জানতে?”
—“হ্যাঁ সবই জানতাম। তাই জন্যই এই কঠিন কথাটা বলতে পারছি। তুমি তাকে ফেলে চলে যাওয়ার পর এনা কীভাবে তাকে সামলেছে তার সাক্ষি কেবল আমরা কয়েকজন মানুষ। অধিকাংশ দিন নেশায় বুঁদ হয়ে বাড়ি ফিরতেন। হ্যাঁ তিনি আর দশজনের মত নেশাগ্রস্ত অবস্থায় কোন অসংলগ্ন কথাবার্তা তিনি বলতেন না। চুপচাপ বিছানায় পড়ে থাকতেন। কিন্তু তাকে সামনে থেকে দেখা প্রতিটা মানুষ তার কষ্ট অনুভব করতে পেরেছে। তারপর যখন সুজান এলো। নিজেকে খানিকটা সামলে নিলেন। কিন্তু এবার তাকে সামলে রাখার মানুষটাই চলে গেলো।”
সোহাগ না থেমেই বললো,
—“আমি তোমাকে মনে মনে শ্রদ্ধা করি মেহরিন, তাই তোমাকে স্বচ্ছ দেখতে চাই। অন্তত ভালোবাসার দিক থেকে। বাকি সবার মত তুমি অন্তত যুক্তি দিয়ে ভালোবাসার বিচার করো না। প্লিজ!”
আবারও শুরু হলো প্রবল অশ্রুবর্ষণ। আত্মপক্ষ সমর্থনের কোন চেষ্টা করলো না মেহরিন। হ্যাঁ! যুক্তি দিয়ে সে বিচার করেছে ঠিকই। তবে ভালোবাসা নয়, তার যুক্তি কেবল ন্যায় অন্যায়ের মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিলো। ন্যায় অন্যায় বিচার করা প্রতিটা মানুষেরই উচিৎ। ভালোবাসা-তো কেবল নিজের স্বার্থের জন্য হতে পারে না। ভালোবাসা হতে হবে নিঃস্বার্থ। সে চায় নি তার ভালোবাসার মানুষটা কারো কাছে অপরাধী হয়ে থাকুক।তাকে মেহরিন অনেক দুঃখ দিয়েছে ঠিকই তবে কেবল নিরুপায় হয়ে। তা না হলে এনার সাথে অন্যায় করা হতো।তবে মুখে যাই বলুক না কেন সে জানে মাহমুদ আজও তাকে ভালোবাসে! মানুষটাকে দূরে সরিয়ে সে কেবল নিজেকে শান্ত করতে চেষ্টা করেছে, কিন্তু ভুলতে পারে নি। কিন্তু এবার আর ঐ মানুষটাকে একা ফেলে কিছুতেই বিয়ে করতে পারবে না সে।
সোহাগ নির্বোদ নয়। সে জানে মেহরিন নিরুপায় হয়ে মাহমুদকে ছেড়ে এসেছিলো। কতটা কষ্টে তার ভালোবাসার মানুষটাকে এনার কাছে তুলে দিয়ে এসেছিলো। হ্যাঁ সম্পর্ক হয়ত ভেঙ্গে গেছে তাদের। কিন্তু ভালোবাসা নয়। এখনো ঠিক আগের মতই দুজন দুজনে ভালোবাসে। তাই বাধ্য হয়ে তাকে আজকের এই কঠোর কথাগুলো বলতে হলো। তা না হলে পরস্পরের পাগলের মত ভালোবাসা এই দুটি মানুষ পুনরায় আলাদা হয়ে যেত। আবার না পাওয়ার তীব্র বেদনা, হাহাকার তাদেরকে কুঁড়ে কুঁড়ে খেতো।
ঝরঝর করে কাঁদছে মেহরিন! কি করবে সে? রায়হানকে কি জবাব দেবে? এদিকে মাহমুদ নেক্সট মান্থেই ফিরে যাবে। বাধ্য হয়ে সোহাগের সাহায্য চাইলো মেহরিন। যে করেই হোক মাহমুদের যাওয়া আটকাতে হবে। তারপর থেকেই দিনরাত ভেবে চললো দুজনে। কিভাবে মাহমুদকে আটকানো যায়।

সোহাগের সাথে দেখা হওয়ার পরেরদিন আবারো পার্কে গেলো মেহরিন। উদ্দেশ্য সুজানকে একনজর দেখা। মা-হারা এই ছোট শিশুটিকে সেদিন যখন মেহরিন বুকে টেনে নিয়েছিলো তারপর থেকেই অদ্ভুত এক প্রশান্তি অনুভব করছে সে। মাহমুদের প্রতিচ্ছবি এই ছোট্ট শিশুটি!
পার্কের একমাথায় সুজান আব্বাসের সাথে ব্যাডমিন্টন খেলছে। মেহরিন ইশারায় কাছে ডাকলো। থমকে গেলো সুজান। ব্যাট হাতে নির্বিকার ভাবে দাঁড়িয়ে রইলো। ধীরে ধীরে কাছে এগিয়ে এলো সে।
তার পরনে জগিং স্যুট। হলুদ স্পোর্টস জ্যাকেটের সাথে হলুদ ট্রাউজার এবং সাদা কেডস। ঘাড়ের দিকে খানিকটা নিচে নেমে গেছে জ্যাকেট। হাতে বাচ্চাদের দামি ঘড়ি! চুলের কাটিংটা বেশ স্টাইলিশ। বোঝাই যাচ্ছে ছেলের সাজসজ্জার ব্যাপারে মাহমুদ বেশ শৌখিন। মেহরিন হাসলো। এই ছেলের বড় হয়ে বাপের মত কত মেয়েকে নাকের ডগায় রেখে ঘোরাবে তা কেবল উপরওয়ালাই জানেন। কী ভীষণ আদুরে লাগছে সুজানকে।
হাতের কাছে আসতেই কষে চুমু খেলো তার গালে। সুজান তার স্বভাবসিদ্ধ শুচিবায়ু বজায় রাখতে ডান হাত দিয়ে গাল মুছলো। তা দেখে হাসলো মেহরিন। ইচ্ছে করেই আবার চুমু খেলো। সে যতবার চুমু খায় সুজান ততবার গাল মুছে। একসময় বিরক্ত হলো সুজান। ছাড়া পাওয়ার জন্য ছটফট শুরু করে দিলো। মেহরিনকে সরু চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বললো,
—“তোমার ছেলের কি হয়েছে?”
আচমকা এমন প্রশ্নে অবাক হলো মেহরিন। তার ছেলে? কোন ছেলে? কিসের ছেলে? সুজান কি বলছে? সে কি মেহরিনকে অন্য কারো সাথে গুলিয়ে ফেলেছে। আদুরে ধমক দিলো মেহরিন,
—“কি বলছিস তুই? আমার ছেলে আসবে কোথা থেকে?”
ধমক খেয়ে সুজান বোধহয় একটু ভয় পেলো। মিনমিন করে বললো,
—“বাবা যে বলল…!”
তার কথা শেষ হওয়ার আগেই মেহরিন বলল,
—“তোর বাবা বলেছে? কি বলেছে তোর বাবা?”
—“বাবা বলেছে তুমি তোমার ছেলেকে মিস করছিলে তাই আমাকে আদর করেছো!”
—“এসব বলেছে তোর বাবা? ঠিক আছে, তাকে আমি পরে দেখে নেবো। তুই এদিকে আয়। ”
—“না! তুমি পঁচা!”
—“কে বলেছে?.. তোর বাবা?”
—“না। বাবাকে একদম বকবে না।”
—“একশোবার বকবো। হাজার বার বকবো। তোর বাবা মিথ্যে বলল কেন?”
—“বাবা মিথ্যে বলে নি।”
—“তাহলে? তুই আমাকে পঁচা বললি কেন?”
সুজান মুখ কালো করে বললো,
—“তুমি আমাকে তুই বললে কেন? আমাকে কেউ তুই করে বলে না।”
মেহরিন হেসে উঠে বললো,
—“ইসশ রে আমার নবাবপুত্তুর! তো কি বলবো তোমাকে? আপনি করে বলতে হবে? আচ্ছা ঠিক আছে বলবো। এবার দিকে আসুন তো মি.জুনিয়র মাহমুদ!”
সুজান বুঝতে পারলো তাকে ব্যাঙ্গ করা হচ্ছে। ফিরে যেতে উদ্যত হলো সে। মেহরিন খপ করে ধরে ফেললো,
—“চলে যাচ্ছিস কেন? রাগ করেছিস?”
সুজান বেঁকে বসলো। বিরস মুখে বললো,
—“তোমার সাথে কথা বলবো না। তুমি পঁচা!”
হাল ছাড়লো না মেহরিন। সুজানে কাছে টেনে নিয়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
—“বোকা ছেলে। শোন আমি হচ্ছি তোর মা। মায়েরা ছেলেদের তুই করে বলে। বুঝলি?”
—“কে বলেছে তুমি আমার মা?”
—“কে বলবে? আমি বলেছি।”
—“তাহলে তুমি বাবার সাথে থাকো না কেন?”
—“তোর বাবার ওপর রাগ করেছি।”
সুজান বিশ্বাস করতে পারছে না। তার মায়ের ছবির সাথে এই আন্টির ছবির একটুও মিল নেই। তাহলে এই আন্টি তার মা হলো কি করে?
—“কি ভাবছিস?”
—“আমি বাসায় যাবো।”
—“বাসায় যাবি কেন? খিদে পেয়েছে?”
—“ইয়েস! আই এম হাংরী!”
—-“আমার সাথে ইংরেজী বলবি না। খবরদার।
—“কিন্তু স্কুলের মিস তো ইংরেজী শেখায়।”
—“শেখাক। তুই বাঙ্গালী। তোর বাপ বাঙ্গালী। তোর মা বাঙ্গালী। এখন থেকে রোজ আমার সাথে বাংলা শিখবি।”
এবার আলতো করে চুমু খেলো মেহরিন। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো সুজান। গালে থুথু লাগে নি। এতটা সময় আব্বাস কাছেই দাঁড়িয়ে রইলো। তবে কিছু বললো না। সে কি বুঝেছে কি জানে। এরপর থেকে রোজ মেহরিনের সাথে সুজানের দেখা হয়। মাহমুদ এই ব্যাপারে সম্পূর্ণ অনবগত। তবে এরমধ্যে সুজানের সাথে মেহরিনে ভাব হয়ে গেলো। আব্বাসকে সাথে নিয়ে রোজ ঘুরতে যায় তারা।

সপ্তাহ খানেক বাদে একদিন, মাহমুদ ড্রয়িংরুম পেরিয়ে কিচেনে যাচ্ছিলো। ড্রয়িংরুমের বিশাল টিভির পর্দায় সুজান রেসলিং দেখছে। হঠাৎ করেই চেঁচিয়ে উঠলো সে,
—“ঠেঙা!…আরো জোরে ঠেঙা।”
অবাক হলো মাহমুদ। সুজান এসব কি বলছে? কার কাছ থেকে শিখেছে? সুজানের পাশে গিয়ে বসলো সে। সুজানের মনোযোগ টিভির দিকে। এবার দ্বিগুণ ক্ষোভে চেঁচিয়ে উঠলো সে।
—“মেরে লুলা করে দে!…আরো জোরে!আরো জোরে!
মাহমুদ হাঁ করে ছেলের কান্ড দেখে যাচ্ছে। বিস্মিত গলায় প্রশ্ন করলো,
—“এসব কার কাছ থেকে শিখেছো বাবা?”
—“কি?”
—“এই যে মাত্র বললে? ঠেঙাতে?”
—“আমি ঠেঙাই নি তো বাবা। জন সীনাকে ঠেঙাতে বলছি!”
—“কিন্তু তোমাকে এসব কে শিখিয়েছে?”
—“মা!”
—“মা?…কে?”
সুজান বিরক্ত হলো। এইমুহূর্তে মাহমুদের জেরা তার বিনোদনে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বাবার হাত সরিয়ে দিয়ে টিভির দিকে মনোযোগ দিলো সে। মাহমুদ তাকে বিরক্ত করলো না। টিভির কাছ থেকে সরে বেডরুমে এসে ঢুকলো সে। কিন্তু চিন্তাটা ঝেড়ে ফেলতে পারলো না। তার মাথায় কেবল একটা নামই ঘুরপাক খাচ্ছে। মেহরিন! তার কেন যেন মনে হচ্ছে সুজানের মেহরিনের কথাই বলছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here