এক_কাপ_ঠান্ডা_কফি
পর্ব:- ১১
ওসির কথা শুনে পুতুল ঘাবড়ে গেলেও সাজু ভাই একটুও বিচলিত হলেন না। গতকাল রাতে যখন জানতে পেরেছেন ও বাসায় তার ছবি পাওয়া গেছে তখন থেকে এটা ধারণা ছিল। পুলিশের সঙ্গে সামান্য ঝামেলা হতে পারে এটা আগেই সে আন্দাজ করে রেখেছে।
এমন সময় সেখানে প্রবেশ করলো পুতুলের মামা, তার হাতে একটা কাপ। সেই কাপের মধ্যে রয়েছে কফি ” এক কাপ ঠান্ডা কফি। ”
★★ ★
আজকে সকালে নাস্তা করার জন্য সাব্বির যখন হোটেলে এসেছিল তখনই তাকে চিনতে পারে সেখানকার এক কাস্টমার। তিনি পত্রিকা পড়েন নিয়মিত, পত্রিকায় উত্তর বাড্ডা লাশ পাওয়ার ঘটনা ও সেখানে সাব্বিরের ও তার বাবার ছবি ছাপা হয়েছে।
লোকটা তখনই আশেপাশে দুজনের সাহায্য নিয়ে সাব্বিরকে ধরে ফেলে। সাব্বির কোনো পেশাদার খুনি নয়, সে কোনো উপায়ে পালিয়ে যেতে পারে নাই। স্থানীয় থানায় খবর দেবার পরে তারা এসে সাব্বিরকে ধরে নিয়ে যায়। তারপর তাকে সরাসরি পাঠিয়ে দেওয়া হয় সেই ওসি সাহেবের কাছে।
সকাল সাড়ে দশটার দিকে ওসি সাহেবের সামনে সাব্বিরকে হাজির করা হয়। ওসি সাহেব তাকে বেশ কিছু প্রশ্ন করে,
– তোমার নাম কি?
– সাব্বির।
– ওই মেয়েটাকে খুন করলে কেন?
– আমি খুন করিনি।
– এতকিছুর পরও অস্বীকার করো?
তারপর সাব্বির সেই রাতের ঘটনা সবকিছুই ওসি সাহেবকে বলে। সবটা শুনে ওসি সাহেব সাব্বিরের বেশিরভাগ কথা বিশ্বাস করে নাই। খুনিরা ধরা পড়ার পরে এমন অসংখ্য গল্প বলে আর সেসব গল্প শোনার অভ্যাস তার আছে।
ওসি সাহেব সাজুর সেই ছবিটি সাব্বিরের সামনে দিয়ে বললো,
– তুমি যাকে ফ্ল্যাটের মধ্যে দেখেছ এটাই কি সেই লোক?
সাব্বির ভালো করে তাকালো। সাজুকে তার চেনার কথা নয়, তাছাড়া সেই রাতে সাব্বির রাব্বি কে নিজের চোখে দেখেনি। তাই বললো,
– স্যার আমি এই ছবির মানুষটাকে চিনি না। আর সেই রাতে তো আমি ওই অজ্ঞাত লোকটার মুখ দেখতে পারিনি। শুধু কণ্ঠ শুনেছিলাম।
– তোমার বাবা এখন কোথায়?
– আমি জানি না। বাবা আমার উপর প্রচন্ড রেগে গেছে তাই তার সামনে দাঁড়ানোর সাহস নেই।
– লাশ গুম করতে পারো নাই তাই রেগে আছে?
– জ্বি।
– তুমি আমার সঙ্গে কত% সত্যি বলছো।
– যা বলেছি সবটাই সত্যি বলছি।
– কিন্তু আমি বিশ্বাস করতে পারলাম না কারণ ছবির ছেলেটা একজন গোয়েন্দা।
– ওহ্।
– তুমি বরং সিদ্ধান্ত নাও, তোমরা কার হুকুমে লাশ গুম করো, তারপর সেদিন রাতে ওই মেয়ের সঙ্গে কি কি হয়েছে। কেন খুন করেছ আর কার কথাতে খুন করেছ সবকিছু বলার জন্য প্রস্তুতি নাও। পরে যখন তোমার সঙ্গে দেখা করবো তখন আমার এই ভদ্র ব্যবহার পাওয়া যাবে না।
ওসি সাহেব উঠে গেলন। তারপরেই মাহিশার বাবা ও খালু আর দুলাভাই আসেন। তাদের নিয়ে তিনি চলে যান ঢাকা মেডিকেলের মর্গে। সেখানে গিয়ে তিনি সাজুর বিষয় বেশ সন্দেহের আলামত লক্ষ্য করেন।
★★★
রাব্বির দিকে তাকিয়ে রামিশা বললো,
– আপনি আমার অনেক উপকার করেছেন, এখন শেষ একটা কাজ করে দিবেন?
– বলেন।
– আমাকে একটু মিরপুরে পৌঁছে দিতে পারবেন? সেখানে আমার বোনের বাসা।
– সাজু ভাইয়ের কাছে যাবেন না?
– না। তার সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছেটা মরে গেছে। আপনি যদি এই উপকারটা করেন আমি তাহলে নিশ্চিন্তে আপুর বাসায় যেতে পারবো।
– ঠিক আছে আপনি তৈরি হয়ে নেন আমি ফ্রেশ হয়ে আপনাকে ডাক দেবো।
রামিশার রুম থেকে বের হতেই রাব্বির মোবাইল বেজে উঠলো। স্ক্রিনে খুব পরিচিত একটা নাম্বার দেখে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল রাব্বি। তারপর অস্ফুটে মুখ থেকে বের হয়ে গেল ” দাদাজান “।
– হ্যালো রাব্বি?
– জ্বি দাদাজান।
– তোমাকে আমি বলেছিলাম না যেকোনো কাজ করার আগে বিশেষ করে খুনের আগে আমার সঙ্গে একটু কথা বলে নিবা।
– কিন্তু সবকিছু তো ঠিকই চলছে। আর আমি আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছি আপনি দেশে ছিলেন না।
– তাই বলে অপেক্ষা করা যেত না?
– মেয়েটার বিয়ে হয়ে গেলে তার সঙ্গে আরেকটা পরিবার জড়িয়ে যেত। বিয়ের আগেই কাজটা করতে হতো তাই বেশি ঝামেলা করিনি।
– চরম ভুল করেছ। আর সাজু ছেলেটাকে এর মধ্যে ফাঁসাতে গেলে কেন? যাকে তাকে খুন করার জন্য কিন্তু আমি তোমাকে সুরক্ষিত রাখি না। তুমি বলেছিলে যে খারাপ কাজে জড়িত এমন কাউকে মারার কন্ট্রাক্ট পেলে তুমি করবে। কখনো ভালো কাউকে তুমি টাকার বিনিময়ে হলেও মারবে না।
– হ্যাঁ মনে আছে।
– তাহলে এখানে সাজুর দোষ কি? আর যে মেয়ে কে খুন করছো তার দোষ কি?
– ওই গোয়েন্দা সাজু ভাই একটা নিরপরাধ ব্যক্তি কে আসামি বানিয়ে দিয়েছে। কৌশলে এমন কাজ করেছে যে লোকটা আর নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে পারে নাই। আর যে মেয়েকে খুন করেছি সে কয়েকটা ছেলের সঙ্গে বেঈমানী করেছে। আপনি তো জানেন দাদাজান, মেয়ে মানুষের বেঈমানী আমি সহ্য করতে পারি না।
– মেয়েটার সম্পর্কে আমি বেশি কিছু জানি না তবে সাজুর সম্পর্কে যেটা বলছো সেটা একদমই ভুল কথা। ওই ছেলে কোনো নিরপরাধ মানুষকে ফাঁসাবে না, সে সখের জন্য গোয়েন্দার কাজ করে। পেশা হিসেবে নয়।
– রাব্বি চুপচাপ।
– তুমি কি জানো যে সাজু ছেলেটাকে গুলি করা হয়েছে? আর সে হাসপাতালে ভর্তি, এবং তাকে সেই অবস্থায় আবার ওসি সাহেব গেছে গ্রেফতার করার জন্য।
চমকে গেল রাব্বি। সাজু ভাইয়ের প্রতি হামলা হবে এটা তার আশঙ্কা ছিল কিন্তু এতো তাড়াতাড়ি সেটা হবে তার ধারণা ছিল না।
– আপনি কীভাবে জানেন?
– আমি অনেক কিছুই জানি। যে লোকটার সঙ্গে তোমার চুক্তি হয়েছে আমি তার সম্বন্ধে খোঁজখবর নিয়েছি।
– কীভাবে?
– তুমি কার কার সঙ্গে কথা বলো সেই কল করার সব লিস্ট করা হয়। সেখান থেকেই আমি দুটো নাম্বার আলাদা করেছি, কারণ তুমি তো তোমার পারসোনাল নাম্বার দিয়ে খুব বেশি মানুষের সঙ্গে কথা বলো না।
– এটা আপনার ঠিক হয়নি।
– অবশ্যই ঠিক আছে। তুমি না জেনে বিপদের মধ্যে জড়াবে এটা তো হবে না। সাভারের সন্ত্রাসী আলাউদ্দীনকে তো চেনো তুমি, তাই না?
– হ্যাঁ।
– সাজুকে খুন করার বর্তমান দায়িত্ব এখন তার হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। এমনকি তোমাকেও।
– মানে?
– ওরা তোমাকেও সরিয়ে ফেলার প্ল্যান করেছে, কারণ তারা জানে তুমি আমার ডানহাত।
– আপনি কার কথা বলছেন?
– তুমি আগে আলাউদ্দীনকে থামাও, তাকে শেষ করো তারপর আসল লোকের ঠিকানা দিচ্ছি।
– ঠিক আছে হয়ে যাবে।
– আমি চাই সাজুকে মারার আগে তুমি কাজটা করে ফেলো। কারণ সাজু বেঁচে থাকলো তোমার খুব একটা সমস্যা হবে না।
– আমি চেষ্টা করবো।
– আরেকটা কথা।
– বলেন।
– যার সঙ্গে তোমার চুক্তি হয়েছে তার প্রধান লক্ষ্য ছিল সেই মেয়েটা। কিন্তু কেন তাকে মেরে ফেলা হয়েছে সেই তথ্য পুলিশ বের করুক। তবে তারা জানতো যে মেয়েটাকে মারার জন্য তোমাকে চুক্তি করা হলেও কিছুটা ঝামেলা হতে পারে। তাই ওই এলাকার একজনকে তারা টাকা দিয়ে কিনতে চায়। কিন্তু সেই লোকটা কাজটা করতে রাজি হয় ঠিকই তবে সেটা টাকার বিনিময়ে নয়।
– তাহলে?
– সাজুর জীবনের বিনিময়।
– বুঝতে পারলাম না।
– সেই লোকটা বলেছিল, ওই একই ব্যক্তিকে দিয়ে যদি সাজুকে খুন করাতে পারে তাহলে সে সকল ঝামেলা নিজে টেক্কা দেবে।
– এবার বুঝতে পারছি। তাই তারা আগে সাজুকে মারার কন্ট্রাক্ট করে আমার সঙ্গে। তার একদিন পরে বলে আরেকটা মেয়ে খুন করতে হবে।
– হ্যাঁ সেটাই। মেয়েটা তাদের টার্গেট হলেও সাজু হচ্ছে যিনি সবকিছু ধামাচাপা দেবেন সেই লোকটার টার্গেট।
– দাদাজান।
– হুম।
– আমি জানি আমার মতো অনেক রাব্বি আছে আপনার আয়ত্তে। তাই তাদের মাধ্যমে এসব বের করা আপনার কাছে কোনো ব্যাপার না। তবে সত্যি বলতে আজকে আপনি অনেক কিছু বের করে দিলেন যেটা খুব জরুরি ছিল।
– আমি স্বার্থ ছাড়া কিছু করি না রাব্বি। সামনে আবার নির্বাচন, তাই সেই পর্যন্ত তোমাকে নিজের কাছে সাবধানে রাখা আমার একান্ত জরুরি।
– আপনি একটা উপকার করবেন?
– কি?
– ওসি সাহেবকে কল দিয়ে বলবেন সাজু ভাইকে ছেড়ে দিতে। আমি জানি সাজু নিজেই এটা থেকে বের হতে পারবে, কিন্তু সময় লাগবে। আমি চাই না সে জেলে যাক বা তার সম্মানে আঘাত লাগুক।
– ওকে আমি দেখছি বিষয়টা। তুমি আজকে রাতের মধ্যে আলাউদ্দীনকে শেষ করার ব্যবস্থা করো।
নিজের পিস্তলটা সঙ্গে নিয়ে রামিশার কাছে চলে গেল রাব্বি। রামিশাকে মিরপুর পৌঁছে দিয়ে তাকে যেতে হবে সাভারে। আলাউদ্দীনের খোঁজ বের করতে হলে তাকে সেখানে যেতেই হবে।
★★★
কোনো ধরনের কথাবার্তা না বলে চুপচাপ ঠান্ডা কফি শেষ করলেন সাজু ভাই। তারপর ওসি সাহেবকে বললো,
– আমি জানি আমার ছবি উত্তর বাড্ডা ওই বাড়ির মধ্যে পাওয়া গেছে। আমার এক বন্ধু আরেকজন সাংবাদিকের সঙ্গে আপনার সঙ্গে দেখা করতে গেছিলো। তিনি হয়তো আপনাকে বলেছিল ওই ছেলেটা আমি।
– হ্যাঁ বলেছিল। কিন্তু তখন বুঝতে পারিনি সব তুমি প্ল্যান করে করেছো।
– একজন ওসি হয়ে বাচ্চাদের মতো কথা বলেন বিষয়টা খুবই দুঃখজনক। মাহিশা যে রাতে খুন হয়েছে তখন আমি খুলনা ছিলাম, আর আমার ওই ছবির বিষয় নিয়ে আমিও কৌতূহলে আছি।
– আপনি বললেই তো বিশ্বাস করবো না আপনি সেদিন কোথায় ছিলেন বা কি করেছেন।
– আপনারা আমার মোবাইল নাম্বার চেক করুন। বিগত মাস খানিকের মধ্যে আমার মোবাইল ট্রাক্ট করুন।
– কি কি করবো সেটা তো আপনার কাছে জিজ্ঞেস করতে হবে না। গোয়েন্দা হয়েছেন বলে সবসময় জ্ঞান দিবেন নাকি?
সাজু খেয়াল করলো ওসি সাহেব তাকে একবার আপনি আরেকবার তুমি করে সম্বোধন করছে। এরমানে লোকটা একটু নার্ভাস হয়ে গেছে, কিন্তু সাজু বরাবরের মতোই শান্ত হয়ে বসে আছে।
এমন সময় ওসি সাহেবের ফোনে কল এলো। তিনি বিরক্তি নিয়ে কলটা রিসিভ করলেন। অপর প্রান্ত থেকে কিছু একটা শুনে নড়েচড়ে বসেছেন।
কল করেছে একটু আগে রাব্বির সঙ্গে যে লোকটা কথা বলছিল সেই লোক।
– জ্বি স্যার।
– সাজু সাহেব কি আপনার সামনে?
– হ্যাঁ স্যার।
– তাকে গ্রেফতার করবেন না, উনি এই মামলায় ঘটনাচক্রে জড়িয়ে যাচ্ছেন। আমি তার হয়ে কথা দিচ্ছি আপনি আসল খুনিকে ঠিকই পাবেন। আর সেজন্য আপনার দরকার কিছু শক্ত প্রমাণ, আর সেটা আপনাকে এই সাজু সাহেব বের করে দেবে।
– কিন্তু স্যার।
– সে পালাবে না ওসি সাহেব। আপনি একটু সময় দেন সে সবটা বের করতে পারবে, তাকে জেলের মধ্যে আটকে রাখলে সেটা সম্ভব না।
– ঠিক আছে স্যার।
– এখন সাজু সাহেবের হাতে মোবাইলটা দিয়ে আপনারা রুম থেকে বের হয়ে যান। আমি একটু তার সঙ্গে কথা বলতে চাই।
সাজুর হাতে মোবাইল দিয়ে সবাই রুম থেকে বের গেল। সাজু প্রথমে সালাম দিল,
– আসসালামু আলাইকুম।
– ওয়া আলাইকুম আসসালাম, ভালো আছেন সাজু সাহেব?
– জ্বি। আপনাকে ঠিক চিনতে পারলাম না।
– আমি আমার পরিচয় ওসি সাহেবের কাছে প্রকাশ করেছি। আপনার সঙ্গে প্রকাশ না করলে চলবে, তবে আমি সরকারি দলের কেউ।
– এতবড় কেউ আমার সঙ্গে কথা বলছে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে।
– আপনার উপর এই হামলা কে করেছে এবং কে আপনাকে খুন করতে চায় আমি জানি। একটা রাজনৈতিক চক্র মোংলার ওই মেয়েকে খুন করে এবং সেখানে নিরাপত্তার আশায় আরেকটা লোকের কথায় আপনাকেও খুন করার প্রচেষ্টা করা হয়েছে।
– আমি বুঝতে পারছি।
– কে আপনাকে খুন করাতে চায় সেটা আপনি নিজেই বের করতে পারবেন আশা করি। তারপর ওই মেয়ের খুনের অপরাধীকেও আপনি বের করবেন আশা রাখি।
– আমি আমার শত্রুকে বুঝতে পারছি।
– কে বলেন তো?
– মোংলা থানার দারোগা সাহেব। ওই দারোগা সাহেবের নির্দেশে আমার উপর হামলা হচ্ছে। তিনিই আমাকে খুন করাতে চায় সেটা আমি কিছুক্ষণ আগে নিশ্চিত হয়েছি।
[ মন্তব্য করার জন্য কি প্রতিদিন অনুরোধ করতে হবে? 😌 ]
চলবে…
লেখাঃ- মোঃ সাইফুল ইসলাম।