হাতে রেখো হাত (৮)

0
349

#গল্পগুচ্ছ_সমগ্র
হাতে রেখো হাত (৮)

খুব সাহসী মেয়ে সীরাত। পায়ে এখনো ব্যথা। চোটটা ভালোই পেয়েছে। ডাক্তার বার বার বলেছেন রেস্ট করতে। অথচ সীরাত শুনে নি! এই ব্যথাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে চলে এসেছে রেসিং ফিল্ডে। চোট থাকাতে সীরাতকে বাদ দেওয়া হচ্ছিল। কিন্তু সীরাত জানায় সে পারবে। মেয়েটির জোরের কাছে হেরে যায় অথোরিটি। এর জন্য বন্ডে সাইন করতে হয়েছে। রেসিং এর জন্য কোনো প্রকার ক্ষতি হলে এর দায় নিবে না অথোরিটি। সীরাতের দ্বিমত ছিল না। সে পুরোপুরি প্রস্তুত। পায়ের গোড়ালির উপরটায় হাল্কা করে মালিশ করছিল। ওমন সময় এলো আবরাজ। সীরাতের জার্সি দেওয়া হয়েছে। নাম্বার ২৫১। আবরাজকে দেখে খুশি হলো। উঠে দাঁড়ানোর জন্য হাত বাড়িয়ে দিতেই পাশ থেকে রুস্মি এসে সাহায্য করল। মেয়েটাকে চিনতে পারে নি সীরাত। তাই খানিকটা অবাকের সহিত বলল “ও কে?”

“আমার কাজিন।”

“আচ্ছা। তোমরা আসবে আগে জানালে না যে?”

“আগে জানালাম,অথচ য‍দি না আসতে পারতাম। তুমি এমন ব্যথা নিয়ে, রেসটা স্কিপ করলেও হতো।”

“ভয়কে ভয় পেয়ে পিছিয়ে যাওয়াটা বড় বোকামি। আমি নিজেকে উৎসর্গ করতে চাই। এই সামান্য ব্যথার সাথে মোকাবেলা না করতে পারলে সামনের আঘা*ত গুলো সহ্য করব কেমন করে?”

মেয়েটার কথায় শীতল হয়ে আসে বুক। আবরাজের চোখ দুটো দেখতে পায় এক সাহসী নারীকে। সীরাতের প্রতিটা পদক্ষেপ যেন এক একটা আগুনের হল্কা হয়ে জ্বলতে শুরু করেছে। রেস শুরু হয়। আবরাজের ঠোঁট দুটো বলে “এভাবেই লড়ে যাও সীরাত।”

সীরাতের পা চলছে তবে চোখ দুটোও ফোয়ারা নামিয়েছে। রুস্মির শরীরে উত্তেজনা। সীরাতকে ভীষণ ভালো লেগেছে ওর। মেয়েটার ব্যপারে আবরাজের থেকে শুনেছিল। তখনি আগ্রহ জাগে। এখানে এসে আরও বেশি আকর্ষণ পায়। সীরাত যেন অদম্য শক্তি নিয়ে জন্মেছে। রুস্মির শরীর কাপছে। বিষয়টা চোখে পরতেই আবরাজ বলে “তুমি কি অসুস্থ বোধ কর রুস্মি?”

“আমার ভয় হচ্ছে। আমি চাই না ও হেরে যাক।”

আবরাজ নিজেও চিন্তিত। সীরাত অনেক চেষ্টা করল। তবে পারল না প্রথম হতে। অবশেষে সেকেন্ড হয়ে ফিরল মেয়েটি। এতে সামান্য মন খারাপ হলেও কোথাও একটা স্বস্তি খুঁজে পেল। ক্লান্ত সীরাত ধপ করে বসে পরল। রুস্মি পানি এগিয়ে দিতেই সীরাত বলল “আরও ইফোর্ট দেওয়া উচিত ছিল আমার। মাত্র ২ সেকেন্ড এর জন্য প্রথম হতে পারলাম না। এটা খুব ই দুঃখের।”

“তুমি খুব ভালো করেছ সীরাত। আমি ভাবি নি সেকেন্ড হতে পারবে। তোমার ব্যথা না থাকলে নিশ্চয়ই প্রথম হতে।”

কথাটা বলতে বলতে সীরাতের চোখের পানি মুছিয়ে দিল রুস্মি। মেয়েটি হাসল। আবরাজ মৌন। সীরাত কে দেখলেই ভেতরটা কেমন যেন করে। মনে হয় মেয়েটা জ্বলন্ত কোনো শক্তি।

ডিনার অফার করেছে সীরাত। আবরাজ প্রথমে না করলেও রুস্মির আগ্রহ ছিল। সীরাতকে ওর ভীষণ পছন্দ। আবরাজ লক্ষ্য করেছে কম কথা বলা রুস্মি সীরাতের সংস্পর্শে এসে পরিবর্তন হয়ে এসেছে। প্রচুর কথা বলছে! অথচ বিগত দুদিনে মেয়েটির মুখ থেকে অপ্রয়োজনীয় কথা শোনা হয় নি। খাবার অর্ডার করা হলো। সীরাতের পাশে বসা রুস্মি। “তুমি খুব দারুণ সীরাত। প্লিজ মাইন্ড করবে না নাম ধরে বললাম বিধায়। আমি খুব বেশি বড় না হলে নাম ধরেই সম্মোধন করি।”

হাসে সীরাত। রুস্মি তখন থেকে বকবক করে যাচ্ছে। অথচ মেয়েটাকে দেখলে মনে হয় খুব ই চুপচাপ। এত সময়ে আবরাজের সাথে কথা হয় নি। ছেলেটা যেন মৌনতার প্রতীক। সীরাত শুধায় “তোমার কি হলো? একদম ই নেতিয়ে পরলে যে।”

“এমনিই ভালো লাগছে। তোমাদের গল্প শুনতে।”

“কিছু বলো তুমিও।”

“তোমরা বলো আমি শুনি।”

“সেকি তুমি কি কথা না বলার প্রতিযোগিতায় নামলে নাকি?” রুস্মির কথায় হেসে ফেলল সীরাত। তবু কথা বলল না আবরাজ। খাবার এসে গেছে। সার্ভ করে দিল। খাবার মুখে দিয়ে বলল সীরাত “গত মাসের নিউজটা আমাদের জন্য হুমকিস্বরূপ। দেশের মানুষ যখন দেশের ধ্বংস চায় তখন সত্যিই কিছু করার থাকে না।”

“মনে হচ্ছে ফের যু*দ্ধের আভাস। ১৯৭১ সালের যু*দ্ধ কিংবা ১৭৫৭ সালের যু*দ্ধ।”

“১৭৫৭ সালের যু*দ্ধে হেরেছিল বাংলা। ১৯৭১ সালের যু*দ্ধে জিতেছিল বাংলা। এবার যদি যু*দ্ধ হয় তবে সেটা ফাইনাল ম্যাচের মতো। নেক্সট কোনো অপশন থাকবে না। হেরে গেলে সত্যিই হেরে গেলাম।”

রুস্মি খবর দেখে না। ভালো লাগে না। জানে না দেশের পরিস্থিতি। শুধু শুনেছিল অরিতার মৃ*ত্যু ঘটেছে বোমা আঘা*তে। এসবে ওর ভয়। ভীষণ ভয়। তাই ঘাটায় নি ফের। সে বোঝার চেষ্টা করে ও বুঝতে পারল না। তেমন আগ্রহও দেখাচ্ছে না। সীরাত খুব দ্রুত কথা শেষ করল। তারপর ই রুস্মির সাথে কথা এগোলো। অল্প সময়েই রুস্মির স্বভাব বুঝে ফেলে সীরাত। মেয়েটা সম্পর্কে একটা ধারণা আসে। পোকা ধরা গাছের সব থেকে সুন্দর আর শুদ্ধ ফুল।

.

আবরাজ বাড়ি ফিরতে চাইলেই বাধ সাজলেন আনিসুল সাহেব। ভদ্রলোক চাইলেন আবরাজ তাদের সাথে থাকুক। বাকি সময়টা অন্তত ভালো কাঁটুক। একা থাকলে কষ্ট হবে। বারংবার অরির কথা স্মরণ হবে। দুঃখে যাবে দিন। ছেলেটা প্রথমে চাইছিল না। তবে সকলের কথায় যুক্তি পেল। গত কয়েকদিন সত্যি ভালো গেছে ওর। অরি ওর জীবনের সবথেকে সুন্দর অধ্যায়। যেই মেয়েটা সার্বক্ষণিক স্মরণে থাকবে। তবে এটা সত্য একা থাকলে বুকে ভেতর মোচড় দেয়। কষ্টে চোখে জল আসে। আবরাজের মন চায় আসতে। তবে মস্তিষ্কে ভিন্ন কথ বলে। বাড়ি ফিরে টান হয়ে শুয়ে পরে আবরাজ। আজ ফেরার পথে অরির ক*বর জিয়ারত করে এসেছে। না চাইতেও চোখে বৃষ্টি নেমেছে। একটা শীতল স্রোত নেমেছে পিঠ বেয়ে। কেউ যেন বলছিল ভালো আছে অরি। অন্তত এই দুনিয়ার থেকে ভালো। সেই থেকে কেমন যেন লাগছে ওর। মনে হচ্ছে ভাই হিসেবে কতটা পেরেছিলাম আমি?
ছেলেটার বিষণ্নতা পার হলো। একটা সময় বিশ্বাসে এলো সৃষ্টিকর্তা চেয়েছেন অরি ভালো থাকুক। তিন বেলা আধপেটা হয়ে না থাকুক। শুরুতেই দুটো গোলাপ গাছ লাগিয়েছিল আবরাজ। সেগুলোতে ফুল ফুটেছে। লাল লাল ফুল যেন অরির হাসির মতো কব*রকে আলোয় পূর্ণ করেছে। ভালো লাগে দেখতে। ছোট সময় মনে হতো কব*রস্থান মানেই ভয়ের কিছু। অথচ এখন মনে হয় বড্ড আপন। সেখানে শুয়ে আছে প্রিয়জন। নিজের লোক। যারা ভালোবাসে আমাদের। খাঁটি ভেজালহীন ভালোবাসা। এর ই সাথে আরেকটা বিষয় অনুভব করেছে আবরাজ। আমাদের ভালোবাসা সময়ের সাথে সাথে কমতে থাকে। মনের দিক থেকে না হলেও স্বাক্ষাৎের দিক থেকে কমতে থাকে। সময় আর পরিবেশ আমাদের ব্যস্ত করে তুলে। আগে অরির সাথে নিয়মিত দেখা করত আবরাজ। অথচ গত কিছু সপ্তাহ দু একদিন পর পর দেখা হয়েছে। এসবে মেয়েটির অভিযোগ হলো কি না জানে না আবরাজ। জানার উপায় নেই। তবে ভেতরটা বলে রাগ করে নি অরি। সে জানে তার ভাই কেমন। ভাই তাকে নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসে। তবে সময় এই ভালোবাসায় ঘুন ধরাতে চাচ্ছে। বুদ্ধিমতি অরি। সে ঘুন ধরতে দিবে না। বরং অপেক্ষা করে থাকবে ভাইয়ের জন্য। কেন এমন মনে হয় জানে না ছেলেটা। একটা হীম শীতল বাতাস এসে স্পর্শ করে ওকে। এখান থেকে অরির কব*রটা বেশী দূরে নয়। জানালা দিয়ে তাকালে প্রাচীর গুলো দেখা যায়। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ফিরে আসে আবরাজ। রান্না বসায়। ফেরার পথে মাছ এনেছে। সেই মাছের ঝোল রান্না করে। খাওয়ার সময় গলা দিয়ে নামছিলই না। পুরোটা সময় পরিবারের স্মৃতি ওকে চেপে ধরে। মনে হচ্ছিল বুকের ভেতর কেউ সুচ ফুটাচ্ছে। সারারাত খারাপ লাগল। ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই আবরাজ বুঝল আপনজনের শূন্যতা। এসব ওকে পোড়াচ্ছে। জীবনে একা বেঁচে থাকা সত্যিই কঠিন। ভীষণ কঠিন।

পর পর তিন দিন নাইট ডিউটি করেছে আবরাজ। সমস্যা হচ্ছে দিনে ঘুম আসে না। রাতে তো প্রশ্নই উঠে না। এসবের প্যারায় ডুবে এক সন্ধ্যায় বের হয়ে এলো। বের হয়ে পাঁচ মিনিটের হাঁটা পথে একটা চায়ের দোকান। সেখানে এক বৃদ্ধ চা বিক্রি করেন। পরিবার পরিজন আছে কি নেই জানা নেই। হয়ত আছে তবে সময়ের সাথে হারিয়ে গেছে। চায়ের দোকানটা নিম্ন আয়ের মানুষ গুলার আড্ডাস্থল। আবরাজের গায়ে ফর্মাল পোশাক। ছেলেটা বসতেই কিছু লোক ফ্যাল ফ্যাল করে তাকাল। এর আগেও এমন হয়েছে। প্রথম দিকে আনইজি লাগলেও এখন স্বাভাবিক ই লাগে। বৃদ্ধ চা দিলেন। ছোট ১৪ ইঞ্চির টিভিটা চলছে। ক্রিকেট খেলা। গত দিনের ম্যাচের হাইলাইট। সেসব ই দেখছে তুমুল উৎসাহে। একটা উইকেট পরতেই পাশ থেকে একজন গালি দিয়ে বসল “হা*লার পুতেরা খেলবার ই পারে না।”

আরেকজন বলল “বা*ল খেলে।”

আরও কিছু অকথ্য ভাষা চলে এলো। এসব দেখে হতাশ হলো আবরাজ। কত রঙের মানুষ আমাদের দুনিয়ায়। চা শেষ করে উঠে যাচ্ছিল ওমন সময় ঘটনা টা ঘটনা। পর পর তিনটে ছয় এলো বাংলাদেশ টিমের। ওমনিই উল্লাসে মেতে উঠল লোকগুলো। আরও একবার বিস্মিত হয় আবরাজ। ফেরার পথে একটা শিক্ষা গ্রহণ করে। “তোমার ভালো গুণের পরিমান অনেক বেশি হলেও যদি সামান্য পরিমান খারাপ গুণ থাকে সেটাই তোমাকে হাসির পাত্র বানাবে!”

চলবে…..
কলমে ~ ফাতেমা তুজ

নতুন পর্ব পেতে পেজে ফলো করে রাখলে পোস্ট করলেই নোটিফিকেশন পেয়ে যাবেন প্লিজ ফলো 👍👍👍গল্পগুচ্ছ সমগ্র

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here