#রৌদ্রর_শহরে_রুদ্রাণী
#পর্বঃ৩২
#Saiyara_Hossain_Kayanat
“হ্যাঁ আমি আরুকে ঠকাচ্ছি তবে এতে বিন্দুমাত্র আক্ষেপ আমার নেই।”
রৌদ্র কফির মগ তুলে এক চুমুক দিয়ে শান্ত চোখে নীল আর কাসফিয়ার দিকে তাকালো। তাদের চোখেমুখে কৌতূহলের ছাপ। চোখে ফুটে উঠেছে জানার তীব্র আগ্রহ। রৌদ্র একটা মুচকি হাসি দিয়ে বলল-
“আমার যতটুকু ধারন আরু অন্য কারও কষ্টের কথা শুনলেই অস্থির হয়ে পরে। এমনকি অন্য কারও মন খারাপে আরু নিজেও মন খারাপ করে ফেলে। তাই আমি জানতাম আমি বাবা হতে অক্ষম এই কথা শুনে আরু মন খারাপ করে ফেলবে। আমার জন্য কষ্ট পাবে এমনকি আমার এই কথাটা নিয়ে এতটা-ই মন খারাপ করবে যে আরু এটাও যাচাই করবে না আমি সত্যি বলেছি নাকি মিথ্যা।”
রৌদ্রর কথা শুনে নীল আর কাসফিয়া দুজনের চোখ বিস্ময়ে গোলাকৃতি হয়ে গেল। নীল জোড়ালো কন্ঠে জিজ্ঞেস-
“আপনি আরু মানে আমাদের আশুকে মিথ্যা কথা বলেছেন??”
রৌদ্র সহজ গলায় উত্তর দিল-
“এটা ছাড়া আর কোনো উপায় রাখেনি আরু।”
কাসফিয়া কিছুটা নেড়েচেড়ে বসলো। খানিকটা ইতস্ততভাবে বলল-
“আপনি নিজেকে নিয়ে এত বড় মিথ্যা কথা বলেছেন কেন?? আপনি কি বুঝতে পারছেন আপনি কতো বড় একটা বিষয় নিয়ে মিথ্যে বলেছেন??”
রৌদ্র ঠোঁটের কোণে এক তৃপ্তিদায়ক হাসির রেখা টেনে বলল-
“এটা তেমন কোনো বড় কথা না। আমার কাছে ফাস্ট প্রায়োরিটি হচ্ছে আমার ভালোবাসা। আর আমার ভালোবাসা মানেই আরু। তার মানে আরু হচ্ছে এখন আমার জীবনের ফাস্ট প্রায়োরিটি। আরুর মনে আমার জন্য অনুভূতি আছে সেটা জেনেও কিভাবে আমি ওর প্রত্যাখ্যান গ্রহণ করি তোমরাই বল!! আরু মা হতে পারলো কি পারলো না এই তুচ্ছ কারনে আমি আমার ভালোবাসা থেকে পিছিয়ে যাবো ওতটা কাপুরষ এই রৌদ্র নয়। আমি জানি প্রতিটি মেয়েই চায় মা হতে। একটা মেয়ের জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হলো নিজের সন্তানের মুখ থেকে মা ডাক শুনতে পারা। আমার সম্পূর্ণ বিশ্বাস আছে আরুও সেই সুযোগটা পাবে। আরু নিজের সমস্যাটাকে যতটা বড় করে দেখছে সমস্যা পুরপুরিই তার উল্টো৷ সামান্য চিকিৎসার মাধ্যমেই এই প্রব্লেম ঠিক হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। যাই হোক আমি এসব নিয়ে ভাবতে চাই না। এখন তোমাদের কাছে একটাই অনুরোধ আমার এই কথা গুলো যেন আমাদের তিনজনের মধ্যেই থাকে।”
রৌদ্রর কথা শুনে কাসফিয়ার চোখ পানিতে চিকচিক করে উঠলো। কাসফিয়ার বলা সেই রাজকুমারকে এখন নিজের সামনে দেখে খুশিতে চিকচিক করে উঠেছে তার চোখ। কাসফিয়া রৌদ্রর চোখে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে আরশির প্রতি তার অসীম ভালোবাসা। এইটাই সেই রাজকুমার যে কি-না সকল বাধাবিপত্তি পেরিয়েই আরশিকে তার রাজকুমারীর করে নিয়ে যাবে। নিজের কাল্পনিকতাকে এভাবে বাস্তবিক রূপ পেতে দেখে কাসফিয়ার খুশি উপচে পরতে চাইছে সুখের অশ্রুপাত হয়ে। নীল চুপচাপ চেয়ার ছেড়ে রৌদ্রর কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। রৌদ্রর সাথে সাথে দাঁড়িয়ে গেল। কিছুটা ভ্রু কুচকে নীলের দিকে তাকাতেই নীল ঝড়ের বেগে রৌদ্রকে জড়িয়ে ধরলো। রৌদ্র হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নীল এভাবে হুট করেই তাকে জড়িয়ে ধরবে সেটা রৌদ্র বুঝতে পারেনি। নীল খানিকটা আবেগী কন্ঠে বললো-
“আপনাকে অনেক ধন্যবাদ আমাদের আশুর জীবনে আসার জন্য। আশুকে আপনার থেকে বেশি আর কেউ ভালোবাসতে পারবে না তা আমি বুঝে গেছি। আমরা সবাই আশুকে নিয়ে ভয়ে ছিলাম কিন্তু এখন বিন্দুমাত্র ভয় নেই। আমার বিশ্বাস আপনি আশুকে সারাজীবন আগলে রাখবেন।”
রৌদ্র মুচকি হেসে নীলের পিঠে আস্তে আস্তে চাপড় মেরে বলল-
“এবার তোমরাও আমাকে একটু হেল্প কর। তোমাদের ফ্রেন্ড তো খুব পাজি মেয়ে। আমার কাছে নিজেকে ধরা দিতেই চায় না।”
নীল রৌদ্রকে ছেড়ে দিয়ে দুষ্টামি করে বলল-
“আপনি আশুকে পটানোর কাজ চালিয়ে যান। আর আপনাদেরকে বিয়ে পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব আমাদের।”
কথাটা বলেই নীল উচ্চস্বরে হেসে উঠলো। নীলের সাথে সাথে রৌদ্র আর কাসফিয়াও তাল মিলিয়ে হেসে যাচ্ছে। রেস্টুরেন্টের চারপাশের টেবিলের কয়েক জোড়া উৎসুক চোখ তাদের তাকিয়ে আছে। কাসফিয়া আশেপাশে তাকিয়ে কিছুটা বিব্রত হয়ে নীলকে চাপা কন্ঠে বললো-
“নীল হাসি বন্ধ করে চুপচাপ বসে পর। আশেপাশে তাকিয়ে দেখ সবাই অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে।”
কাসফিয়া কথা শুনে রৌদ্র আর নীল হাসি থামিয়ে চারদিকে এক নজরে চোখ বুলিয়ে নিল। সবাইকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে কিছুটা অস্বস্তিবোধ করছে। রৌদ্র আর নীল একে অপরের দিকে তাকিয়ে একটা মেকি হাসি দিয়ে আবারও নিজেদের জায়গায় বসে পরলো।
————————
শেষ বিকেলের শান্ত শীতল পরিবেশ। পশ্চিম আকাশে ক্লান্ত হয়ে ঢলে পরা সূর্যের রক্তিম আভা। কিছুটা সময় পরপর বয়ে যাওয়া ধমকা হাওয়া সব মিলিয়ে আরশির মন বার বার প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে ফেলছে। একাকিত্বের সময় এই প্রকৃতিই তার একমাত্র সঙ্গী হয়ে ওঠে। কাসফিয়া বাসায় না থাকায় আরশি একা একা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। নিজেকে বিলিয়ে দিচ্ছে প্রকৃতির মুগ্ধতার মাঝে। নিঃস্তব্ধতা ঘিরে ধরেছে আরশির চারপাশে। পাখিগুলোও আজ কেমন যেন চুপচাপ হয়ে আছে, কোনো কিচিরমিচির শব্দ করছে না। আরশি এক মনে তাকিয়ে পশ্চিমা আকাশের এই রক্তিমা আভা গুলোর কালো হয়ে যাওয়া দেখিছে।
“এই পাশের বারান্দা এখানে চুপচাপ দাঁড়িয়ে কি করছো??”
আচমকা নির্বানের কন্ঠ শুনে আরশি কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পরলো। আরশি গোলগোল চোখ চোখ দিয়ে নির্বানের দিকে তাকাতেই নির্বান বলল-
“উফফফ.. পাশের বারান্দা আমাকে এতো ভয় পাও কেন বলো তো!! আমি রোদ ভাইয়ের মতো এতো গম্ভীর আর রাগী না তাই আমাকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। তুমি আমাকে নিজের ফ্রেন্ড মনে করতে পারো।”
আরশি ভ্রু কুচকে নির্বানের দিকে তাকিয়ে সন্দিহান কন্ঠে বললো-
“এভাবে আচমকা ডাক দিলে তো ভয় পাবোই।”
“তুমি নিজেই তো গভীর ভাবনায় ডুবে ছিলে তাই আমার উপস্থিতি টের পাওনি এটা কি আমার দোষ!!”
আরশির ভ্রু জোড়া আগের চেয়েও কিছুটা কুচকে এলো। নির্বানের সামনা-সামনি দাঁড়িয়ে বলল-
“আপনি-ও আপনার রোদ ভাইয়ের মতো কথা প্যাচান। যাই হোক এসব বাদ দিয়ে আপনার সম্পর্কে কিছু বলুন পরিচিত হই।”
নির্বান একটা অমায়িক হাসি দিয়ে বলল-
“বাহহহ ভাবি না মানে তুমি তো দেখছি আমার স্বাভাবিক ভাবেই কথা বলছো। ভালো লাগলো দেখে। আমি নির্বান হাসান নীড়। বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে আর রোদ ভাইয়ের একমাত্র মামাতো ভাই। এবার মাস্টার্স ফাইনাল ইয়ারে। এবার তুমি বলো।”
নির্বানের কথায় আরশি বিস্মিত হয়ে বলল-
“কিহহ আপনি মাস্টার্স ফাইনাল দিবেন!!”
নির্বান মাথা দুলিয়ে হ্যাঁ জানালো। আরশি অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল-
“কিন্তু আমি ভেবেছিলাম আপনি আমার বয়সি হবেন। আপনার কথাবার্তা আর চালচলন দেখে তো মনে হয় আপনি আমার থেকে-ও ছোট।”
নির্বান সরু চোখে আরশির দিকে তাকিয়ে বলল-
“তোমাকে দেখেও আমার মনে হয়েছে তুমি বাচ্চা মেয়ে।”
নির্বানের কথা শুনে আরশি হেসে দিল। আরশির সঙ্গে তাল মিলিয়ে নির্বানও হাসতে লাগলো।
————————
“আচ্ছা তাহলে এখন আপনার কি প্ল্যান রৌদ্র ভাই?? আশুকে কিভাবে লাইনে আনবেন?”
নীলের কথায় রৌদ্র কিছুক্ষন চুপ করে থেকে গম্ভীর গলায় বললো-
“তোমাদের ফ্রেন্ড লাইনে না আসলেও ওকে লাইনে কীভাবে আনতে হবে তা আমার খুব ভালো করে জানা আছে। কালকের দিনটা শুধু অপেক্ষা করবো তারপর সব আমার মতো হবে। সোজা আঙুলে ঘি না উঠলে আঙুল বাঁকা করতে।”
কথা গুলো বলেই রৌদ্র একটা রহস্যময় হাসি দিল। কাসফিয়া একটা শুকনো ঢোক গিলে বলল-
“মানে কি করবেন?”
“আজ সময় নেই৷ পরে সব জানিয়ে দিব৷ তোমরা দুজন শুধু আমাকে একটু হেল্প করো তাহলেই হবে। বাকি আমি ম্যানেজ করে নিব।”
নীল রৌদ্রকে আস্বস্ত করে বলল-
“আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। আমরা আপনার কথা মতোই সব কাজ করবো।”
“আচ্ছা তাহলে আজ উঠছি।”
রৌদ্র নীল আর কাসফিয়ার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল। কাসফিয়া চিন্তিত গলায় নীলকে জিজ্ঞেস করল-
“দোস্ত রৌদ্র ভাই কি করবে রে??”
“যা-ই করুক না কেন এতটুকু বিশ্বাস রাখ আমাদের আশুর কোনো ক্ষতি হবে না। বুঝলি গাধি!!”
নীলের ভ্রুক্ষেপহীন প্রতিত্তোর শুনে কাসফিয়া অবাক দৃষ্টিতে নীলের দিকে তাকালো। নীল কিছুটা বিরক্তি প্রকাশ করে বলল-
“উফফফ এতো চিন্তা করিস না তো কাসফি। ওনার বলা কথা গুলো মনে মনে ভাব সব চিন্তা এমনিতেই গায়েব হয়ে যাবে।”
কাসফিয়া কিছুটা সময় চুপ থেকে মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল-
“আচ্ছা চল এখন। আশু বাসায় একা।”
——————————
আরশি নির্বানের সাথে জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছে আর রৌদ্র আবছা আলোয় আরশির দিকে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছে। আরশিকে আগে কখনো তার সামনে এতটা হাসিখুশি থাকতে দেখেনি। সব সময় লজ্জায় আর না হয় অস্বস্তিতে চুপটি মেরে থাকতো। কিন্তু আজ কথার ঝুলি নিয়ে বসেছে। অবশ্য নির্বানের মতো পাজি ছেলের সামনে কেউ-ই চুপচাপ বসে থাকতে পারবে না। আরশি রুম থেকে কয়েকটা চকলেট এনে নির্বানের দিকে ছুড়ে মারলো। নির্বান একটা চকলেট রৌদ্রর দিকে এগিয়ে দেয় কিন্তু রৌদ্র এখনো মুগ্ধ হয়ে আরশির দিকে তাকিয়ে আছে।
“এই যে মুগ্ধ প্রেমিক একটু ভাবনার জগৎ থেকে ফিরে আসুন।”
নির্বানের কথায় রৌদ্র আর আরশি দুজনেই কিছুটা লজ্জা পেল। রৌদ্র নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে বলল-
“তুই দিন দিন অনেক ফাজিল হয়ে যাচ্ছিস নির্বান।”
নির্বান কিছু ভাব নিয়ে বলল-
“আমি একদম পারফেক্ট আছি। কিন্তু তুমিই দিন দিন বয়ষ্ক মানুষদের মতো গম্ভীর হয়ে যাচ্ছো। আমি ঠিক বলেছি না পাশের বারান্দা???”
নির্বান আরশির দিকে জিজ্ঞাসুক দৃষ্টিতে তাকাতেই আরশি একটা মুচকি হাসি বলল-
“হুম এই জন্যই তো ওনার নাম এ্যাংরি বার্ড রেখেছি।”
“ভাবি তুমি তো খুব ভালো নাম রাখতে পারো। ভাইয়ের সাথে একদম মিলে গেছে।”
কথাটা বলেই নির্বান ঝংকার তুলে হাসতে লাগলো। আরশিও ঠোঁট চেপে হাসছে।
“নির্বান তুই কিন্তু এখন আমার হাতে মাইর খাবি ফাজিল কোথাকার।”
রৌদ্রর রাগী কন্ঠ শুনে নির্বান দৌড়ে রুমে চলে গেল। রৌদ্র আরশি দিকে তাকিয়ে বলল-
“আপনি এখানেই দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করুক আমি আসছি।”
রৌদ্র কথা বলে এক মুহূর্ত দেরি না করে নির্বানের পেছনে ছুটে গেল। আরশি হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে তাদের যাওয়ার পথের দিকে।
চলবে…
[ সামনে ধামাকা আসতে চলছে অপেক্ষা করুন সবাই। ধন্যবাদ আর ভালোবাসা সবাইকে।❤️]