রৌদ্রর শহরে রুদ্রাণী পর্ব-৩৫

#রৌদ্রর_শহরে_রুদ্রাণী
#পর্বঃ৩৫
#Saiyara_Hossain_Kayanat

“আম্মু বাবা কাল বাসায় যেতে বলেছে কেন?? বাসায় কি কিছু হয়েছে?? সব কিছু ঠিক আছে তো!!”

আরশির আব্বু ফোন কেটে দেওয়ার কিছুক্ষণ সময় বাদেই আরশির ওর আম্মুকে কল করে। ফোন রিসিভ হতেই আরশি চিন্তিত গলায় এক সাথে সব গুলো প্রশ্ন ছুড়ে দিল ওর আম্মুর দিকে।

“আমি কিছু জানি না আশু। তোর আব্বু আমাকে কিছু বলে নি। তুই বরং কাল বাসায় এসেই জেনে নিস।”

আরশি ওর আম্মুর কথা শুনে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। হতাশ হয়ে বলল-

“আচ্ছা ঠিক আছে এখন এখন রাখছি। ভালো থেকো।”

আরশি ফোন কেটে বিছানায় ধপাস করে বসে পরলো। দু পা আড়াআড়ি ভাজ করে বসলো। গালে হাত রেখে ভাবতে লাগলো কি এমন জরুরি কাজ হতে পারে যার জন্য তার বাবা এমন কড়া হুকুম দিয়েছে!! মিনিট পাঁচেক চিন্তা ভাবনা করে কোনো কারন খুঁজে বের করতে না পেড়ে আবারও একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। ফোন হাতে নিয়ে নীলদেরকে গ্রুপে কল দিল। সবাই কলে জয়েন হতেই আরশি মলিন কন্ঠে বললো-

“নীল, কাসফি, আদ্রাফ আর নিলু তোরা সবাই ব্যাগ গুছিয়ে নে। কাল বিকেলের মধ্যে আব্বু আমাদের সবাইকে ওনার সামনে দেখতে চায় বলে কড়া হুকুম দিয়েছেন।”

সবাই চমকে উঠে একসাথেই মৃদুস্বরে চেচিয়ে বলল-

“কিইইইই???”

আরশি বিরক্তিমাখা কন্ঠে বললো-

“উফফফ আস্তে কথা বলতো তোরা।”

“কিন্তু হঠাৎ করে তোদের বাসায় কেন যেতে বলেছে আশু??”

আদ্রাফের প্রশ্নে আরশি নির্লিপ্ত কণ্ঠে বললো-

“জানিনা রে। আব্বুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম কিন্তু কিছু বলেনি।”

“আশু তুই কি কোনো গন্ডগোল পাকিয়েছিস না-কি!! দেখিস নিজের সাথে সাথে আবার আমাদেরকেও ফাঁসিয়ে দিস না।”

নীলের কথা শুনে আরশি রাগান্বিত কন্ঠে বললো-

“চুপ কর হারামি। আমি আবার কি গন্ডগোল পাকাবো?? ফালতু কথা বলিস না।”

নীল এবার কাসফিয়াকে উদ্দেশ্য করে সন্দেহের গলায় বলল-

“কাসফি তুই আর আদ্রাফ মিলে কোনো আকাম-কুকাম করিস নি তো!!”

কাসফিয়া ভড়কে উঠে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললো-

“নীলের ডিব্বা বাজে কথা বলা বন্ধ কর। আশুর আব্বু ফোন দিয়েছে হয়তো কোনো জরুরী কাজ বলে। আংকেল তো আর বিনাকারণে আমাদের যেতে বলবে না তাই না।”

নীলা বিরক্ত হয়ে গম্ভীর গলায় বললো-

“উফফ তোরা এভাবে ঝগড়া করছিস কেন আজব!! কাল গেলেই তো জানতে পারবি কেন যেতে বলেছে। এখন সবাই চুপ থাক।”

আরশি ক্ষিপ্ত হয়ে বলল-

“হুম তোরা সবাই এখন ফোন রাখ। তোদের আজাইরা প্যাচাল শুনতে ভালো লাগছে না আমার। অসহ্যকর।”

আরশি রাগে গজগজ করে কথা গুলো বলেই ফোন কেটে দিল। রাতে ডিনার করে বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই ময়না পাখি “পাশের বারান্দা” “পাশের বারান্দা” বলে চেচামেচি করতে লাগলো। আরশি পাখিগুলোর শব্দে ভ্রু কুচকে পাশের বারান্দায় তাকালো। রৌদ্র রেলিঙে হাত রেখে সামনের দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে আছে। আরশির উপস্থিতি টের পেয়েও তার দিকে ফিরে তাকালো না। আরশি রৌদ্র দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে নম্র কন্ঠে বললো-

“গাড়ির বিব্রতকর ঘটানার জন্য দুঃখিত। আমি বুঝতে পারিনি এমন কিছু হবে।”

রৌদ্র আরশির দিকে ফিরে তাকালো৷ শীতল চোখে তাকিয়ে আছে আরশির মুখের দিকে। নরম গলায় বললো-

“লোকটা কে মিস আরু??”

“ওনার সম্পর্কে আমি তেমন কিছু জানি না। উনি প্রতিদিন ভার্সিটিতে এসে আমার জন্য দাঁড়িয়ে থাকতেন, ভালোবাসার কথা বলতেন ব্যস এটুকুই। তারপর একদিন আমার ব্যর্থতার কথা বলি সেদিনের পর থেকে তার সাথে আর দেখা হয়নি। কিন্তু আজ হঠাৎ করে কোথা থেকে আমার সামনে চলে আসলো কিছুই বুঝতে পারছি না।”

রৌদ্র আর কিছু বললো না। আবারও আকাশের দিকে দৃষ্টি দিল। আরশিও চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। কিছুটা সময় পর নিরবতা ভেঙে রৌদ্র জিজ্ঞেস করলো-

“আপনি কি রাজি লোকটাকে বিয়ে করতে??”

আরশি হকচকিয়ে উঠলো এমন প্রশ্নে। রৌদ্রর দিকে তাকিয়ে গম্ভীরমুখে বলল-

“আমি কাউকে বিয়ে করতে চাই না।”

“আর আমাকে!!”

আরশি চমকালো। কিছু বলতে পারছে না। গলার মধ্যেই শব্দ গুলো গুলিয়ে ফেলছে। রৌদ্র আবারও বলে উঠলো-

“অনেক রাত হয়েছে। এখন আপনার ঘুমিয়ে পরা দরকার। এখানে দাঁড়িয়ে না থেকে রুমে যান মিস আরু।”

আরশি রৌদ্রর গম্ভীরমুখের দিকে এক ঝলক তাকালো। এই গম্ভীর চেহারায় তাকে বড্ড বেমানান লাগিছে। লোকটার মুখে তো হাসি খুব বেশিই মানায়। তবুও যে কেন সব গম্ভীর হয়ে থকে!!আরশি কোনো কথা না বলে চুপচাপ রুমে চলে আসলো। রৌদ্র এখনো আরশির বারান্দার দিকে তাকিয়ে আছে। মনে চলছে হাজারো চিন্তা ভাবনা আর ভয়। বুক চিড়ে বেরিয়ে আসলো এক দীর্ঘশ্বাস।

—————————

সকাল সকাল আরশি আর ওর বন্ধুরা সবাই মিলে বেরিয়ে পরলো তাদের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। চিন্তায় আরশির মাথা পুরো এলোমেলো হয়ে আছে। পুরো পথ কেউ কোনো কথা বা দুষ্টুমি কিছুই করেনি। সবাই চিন্তিত মুখে বসেছিল। দুপুরের দিকে সবাই বাসায় পৌঁছে গেল। আরশি বাসার কাছে এসেই থমকে দাঁড়িয়ে যায়। অস্বস্তিতে হাত কচলানো প্রায় শুরু হয়ে গেছে তার। নীল আরশির অবস্থা দেখে ওর কাধে হাত রেখে বলল-

“আরে এতো চিন্তা করছিস কেন?? বাসায় তো এসেই পরেছিস এখন ভিতরে চল।”

আরশি নীলের দিকে তাকিয়ে একটা জোড়ালো শ্বাস ফেলে বাসার ভিতর চলে গেল। আরশি আর কাসফিয়ার বাবা মা সবাই ড্রয়িং রুমে বসে তাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। আরশি আর ওর বন্ধুরা সবার সাথে কুশল বিনিময়ের পর আরশি আদিব হাসানের সামনে এসে নিম্ন স্বরে জিজ্ঞেস করলো-

“বাবা হঠাৎ করে আসতে বলেছো কেন আমাদেরকে?? কিছু হয়েছে??”

আদিব হাসান মুখে গম্ভীরতা এনে বললো-

“আমার মেয়েকে আমি যখন ইচ্ছে আসতে বলতে পারি কিন্তু এর জন্য যে আমাকে এতো কৈফিয়ত দিতে হবে তা তো জানতাম না।”

আরশি ওর বাবার পাশে বসে শালীন গলায় বলল-

“আহহ বাবা আমি কি তা বলেছি না-কি!! এভাবে হঠাৎ করে আসার কথা বলেছো তাই আমার চিন্তা হচ্ছে। তুমি তো এর আগে কখনো এমন করনি”

আদিব হাসান তার মেয়েকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে বললেন-

“আসলে মা তোকে না জানিয়ে আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি।”

আরশি কৌতূহলী চোখে আদিব হাসানের দিকে তাকালো। সন্দিহান কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো-

“কিসের সিদ্ধান্তের কথা বলছো বাবা??”

“তোর বিয়ের।”

আদিব হাসানের এমন সহজ জবাব শুনে আরশি চমকে গেল। আরশির পায়ের নিচ থেকে মনে হচ্ছে মাটি সরে গেছে। আরশি প্রচন্ডরকম অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। বিস্মিত হয়ে বলল-

“বিয়ে মানে!! কি বলছো তুমি বাবা!!”

আদিব হাসান সোফা থেকে উঠে দাড়িয়ে গম্ভীর গলায় বললেন-

“যা বলেছি ঠিক শুনেছো। আগামীকাল তোমাকে ছেলে পক্ষ দেখতে আসবে। তার আগে তুমি নিজেকে সব কিছুর জন্য রেডি করে নাও। আগামীকাল আমি কোনো প্রকার ঝামেলা চাই না। আশা করি আমার কথা বুঝতে পেরেছো।”

আদিব হাসান গম্ভীরভাবে পা ফেলে দোতলায় চলে গেলেন। আরশি আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার বাবার দিকে। চোখ পানিতে টলমল করছে। আরশি ভেজা চোখে ওর আম্মু দিকে তাকিয়ে মলিন কন্ঠে বললো-

“আম্মু এসব কি হচ্ছে!!”

আরশির আম্মু আরশির কাছে এসে মাথায় বুলিয়ে দিয়ে বললেন-

“তুই তো জানিস তোর আব্বু এক বার যা বলে সেটাই করে। তুই চিন্তা করিস না আমি দেখছি তোর আব্বুর সাথে কথা বলে।”

আরশির আম্মু চলে গেলেন। কাসফিয়ার বাবা-মা আরশিকে নানানরকম সান্ত্বনার বানী শুনিয়ে তারাও চলে গেলেন। আরশি মাথা নিচু করে সোফায় বসে আছে। এতোক্ষন নীল ওরা সবাই চুপ থাকলেও এখন সবাই যাওয়ার সাথে সাথেই আরশির পাশে এসে বসে পরলো। সবাই এক প্রকার হামলে পড়েছে আরশিতে সান্ত্বনা দিতে। নীল আরশিকে শান্ত করার জন্য বলল-

“আশু চিন্তা করিস না। পাত্রপক্ষ দেখতে আসলেই তো আর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে না তাই না।”

নীলের কথায় সবাই তাল মিলিয়ে আরশিকে বোঝাতে লাগলো। আরশি আগের মতোই চুপচাপ মাথা নিচু করে বসে আছে। কারো কথার কোনো পাত্তা না দিয়ে দাঁড়িয়ে ভাবলেশহীন ভাবে বললো-

“তোদের সবার কষ্ট করে আমাকে মিথ্যা আশ্বাস দিতে হবে না।”

আরশি আর কোনো কথা না বলে নিজের রুমে চলে গেল। সারাদিন চুপচাপ রুমের মধ্যেই কাটিয়েছে। কারও সাথে কথা বলেনি। আর রুমের বাহিরেও যায়নি। নির্ঘুম সারারাত কাটিয়ে দেওয়ার পর সকালে একটু ঘুমিছে আরশি। কিন্তু ঘন্টা খানেক পেরুতেই কাসফিয়া আর নীলা এসে আরশিকে টেনেহিঁচড়ে ঘুম থেকে তুলে দিল। আরশি প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে ধমকের স্বরে বলল-

“উফফফ নিলু কি হয়েছে তোদের?? এভাবে গরুর মতো ধাক্কাধাক্কি করছিস কেন??”

কাসফিয়া আরশিকে তাড়া দিয়ে বলল-

“আংকেল আমাদের দু’জনকে কড়া গলায় হুকুম দিয়েছে তোকে এক ঘন্টার মধ্যে সাজিয়ে দিতে হবে।”

আরশি কিছু বলার আগে নীলা অসহায় কন্ঠে বললো-

“আশু প্লিজ তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে আয়। দেরি হলে আংকেল আমাদের দুজনকে বকা দিবে। তুই না আমাদের খুব ভালো বন্ধু প্লিজ আমাদের বকা খাওয়ার মতো কিছু করিস না। তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে বোন।”

আরশিকে এক প্রকার জোর করেই কাসফিয়া আর নীলা রেডি করিয়ে দিল। আরশি গোমড়া মুখে বসে আছে। তার বাবার উপর প্রচন্ড রাগ হচ্ছে তার। কিন্তু মুখ ফুটে কিছু প্রকাশও করতে পারছে না। আরশি খুব ভালো করেই জানে তার বাবা কাওকে একবার কথা দিয়ে দিলে সে কথা কখনো ফেলে না। ঘন্টা খানেক পর কাসফিয়ার আম্মু এসে বলল-

“কাসফি আর নিলা বাহিরে আসো। মেহমান এসেছে তাদের খেয়াল রাখো যাও।”

আরশিকে রেখে সবাই চলে গেল। আরশি হতভম্ব হয়ে বসে আছে। বুক ফেটে কান্না আসছে তার। কি থেকে হয়ে গেল আরশি কিছুই বুঝতে পারছে। মূর্তি ন্যায় স্তব্ধ হয়ে বসে আছে আরশি। চোখের সামনে বার বার সেই রঙিন চিরকুট গুলো ভেসে উঠছে। দুই চোখ পানিতে চিকচিক করছে।

চলবে…

(গল্প লিখতে লিখতে ঘুমিয়ে পরেছিলাম তাই আজ পর্ব ছোট হয়েছে আর দেরিও হয়েছে পোস্ট করতে। দুঃখিত। ধন্যবাদ আর ভালোবাসা সবাইকে।❤️❤️)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here