রৌদ্রর শহরে রুদ্রাণী পর্ব -৩৮

#রৌদ্রর_শহরে_রুদ্রাণী
#পর্বঃ৩৮
#Saiyara_Hossain_Kayanat

প্রিয় রুদ্রাণী,
প্রিয় ভালোবাসার বউ,

শুধু শুধু এতো রাগ করছো কেন রুদ্রাণী? রাগলে যে তোমার নাক লাল টমেটোর মতো হয়ে যায় জানো! একদম পুরো রুদ্রাণীর মতো রাগে জ্বলজ্বল করে উঠো। আমি তো তোমার এইরকম রূপ দেখে বার বার তোমার ভালোবাসায় পরে যাই। কখনো লজ্জায় লাল হয়ে যাও আবার কখনো রাগে লাল হয়ে যাও। আমার মনে হয় তুমি ইচ্ছে করেই এমন রুদ্রাণীর রূপ ধারন করো যেন রুদ্রাণীর উত্তাপে এই নিরীহ রৌদ্রকে জলসে দিতে পারো। ঠিক বলেছি না!

[বিঃদ্রঃ ভেবো না ভুলে দুবার প্রিয় লিখেছি। সত্যি বলতে তোমাকে কি বলে সম্মোধন করবো সেটা নিয়ে আমি খুবই কনফিউজড। তাই বেশি না ভেবে দুইবার প্রিয় লিখলাম। রুদ্রাণী নামটা আমার ভালোবাসার তাই এটা বাদ দিতে পারছি না। আর ভালোবাসার বউ লিখেছি তোমাকে মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য যে কিছুক্ষণ পরেই তুমি আমার বউ হবে। যেন-তেন বউ না এক্কেবারে খাঁটি ভালোবাসার বউ। লাল টকটকে রুদ্রাণী বউ হাহাহ..]

ইতি
তোমার হবু জামাই(রৌদ্র)

রৌদ্রর দেওয়া চিরকুট পড়ে আরশি আনমনেই হেসে দিল। সব রাগ অভিমান নিমিষেই হারিয়ে গেল ভালো লাগার ভিড়ে। রৌদ্রর চিঠি পড়ে আরশির মন সব সময়ই ভালো লাগায় ছেয়ে যায়। আরশি চিঠির দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে। ডক্টর রোদ ঠিকই বলে চিঠির মধ্যে আলাদা এক অনুভূতি আছে যা মুখের কথায় কখনো অনুভব করা যায় না। এই লোকটার চিঠি পড়ে তার উপর রেগে থাকা বড়ই দায়। অসভ্য লোকটার জন্য ঠিক মতো রাগ করেও থাকতে পারি না। হুহ আস্ত এক অসভ্য ডাক্তার।

“এই আশু কোথায় হারিয়ে গেলি! এভাবে মুচকি মুচকি হাসছিস কেন?”

কাসফিয়ার চেচিয়ে বলা কথায় আরশির হুশ ফিরলো। অপ্রস্তুত হয়ে অগোছালো ভাবে বললো-

“কই না তো কিছু না।”

কাসফিয়া সন্দেহের দৃষ্টিতে আরশির দিকে চেয়ে বলল-

“চিঠিতে কি লেখা আছে যে মুহুর্তেই তোর রাগ চলে গেল?”

আরশি হকচকিয়ে চিঠিটা দ্রুত হাতের মুঠোয় শক্ত করে চেপে ধরলো। একটা মেকি হাসি দিয়ে বলল-

“না না কিছু না। এমনিতেই রাগ কমে গেছে।”

কাসফিয়া কিছু বলার আগেই আদ্রাফ দরজার কাছে এসে বলল-

“কাসফি একটু এদিকে আয় তো।”

আদ্রাফের কন্ঠ শুনে নীলা দরজার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। কাসফিয়া আদ্রাফের সামনে আসতেই আদ্রাফ তাড়া দিয়ে বলল-

“কাসফি আমার সাথে একটু চল তো। আমার জামাকাপড়ের ব্যাগ তোদের বাসায় রাখা। ব্যাগটা নিয়ে আসতে হবে তাড়াতাড়ি চল।”

কথা গুলো বলেই আদ্রাফ কাসফিয়ার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল। নীলা তাদের দিকে অপলকভাবে তাকিয়ে থেকে চোখমুখ শক্ত করে অন্য দিকে চোখ ফিরিয়ে নিল। আদ্রাফ আর কাসফিয়াকে এখন একসাথে দেখলে আগের মতো চোখ ভিজে আসে না। বরং চোখে কঠোরতা ফুটে ওঠে। চোখমুখ শক্ত হয়ে আসে। আরশি নীলার দিকে শান্ত চোখে চেয়ে আছে। মেয়েটা আগের মতো নেই। অল্পতেই আবেগী হয়ে পরা মেয়েটা এখন নিজের সকল অনুভূতি, আবেগ আর কষ্ট নিজের মধ্যে লুকিয়ে রাখতে শিখে গেছে। এখন আর চোখের মধ্যে পানি টলমল করছে না। কান্না করতে করতে হয়তো চোখের পানি শুকিয়ে গেছে।

“নিলু তোর সাথে আমার কিছু কথা আছে। এখানে আমার কাছে এসে বস।”

নীলা চুপচাপ গম্ভীরমুখে আরশির পাশে এসে বসলো। আরশির দিকে তাকিয়ে ভ্রুক্ষেপহীন ভাবে জিজ্ঞেস করল-

“কি বলবি আশু? তাড়াতাড়ি বল।”

আরশি নীলার গম্ভীরমুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চোখ ফিরিয়ে নিল। হাতের কাগজটা দিকে নজর দিয়ে শান্ত গলায় বলল-

“তুই যে দিন দিন গম্ভীর হয়ে যাচ্ছিস সেটা কি তুই বুঝতে পারছিস!”

“শোন আশু তুই যদি এখন ওই লোকের তরফ দারি করিস তাহলে আগেই বলে রাখি ওনার কথা আমার একদমই সহ্য হয়। প্রথম দিনই আমার সাথে কতো বাজে ভাবে ব্যবহার করেছে তুই জানিস! আমি তো ওনাকে চিনিই না তবুও কেন আমার সাথে এমন ব্যবহার করেছেন! আমি তো ওনার সাথে যেচে কথা বলতে চাইনি। উনি নিজেই তো আমার সাথে ধমকে কথা বলা শুরু করেছিলেন।”

” আমি এসবের কথা বলছি না নিলু। তুই কিছুদিন খুব গম্ভীর হয়ে থাকিস, কথা কম বলিস আর অল্পতেই রেগে যাস৷ তুই তো আগে এমন ছিলি না নিলু। আমি তো তোকে বলেছি তোর কোনো কথা থাকলে আমার সাথে শেয়ার করবি। তোর কষ্ট হলে আমাকে বলবি। হয়তো আমি তোর কষ্ট দূর করতে পারবো না কিন্তু তোর মন থেকে কষ্টে বোঝা একটু হলেও তো কমবে তাই না!”

নীলা কিছুটা সময় চুপ থেকে মাথা নিচু করে জড়ানো কন্ঠে বললো-

“আমি আর পারছি না আশু। প্রতিনিয়ত ভালো থাকার অভিনয় আমি করতে পারছি না। আমি সব মেনে নিয়েছি। আদ্রাফ আমার না আর কখনো আমার হবেও না আমি জানি। কাসফিয়া আর আদ্রাফ একে অপরকে ভালোবাসে। আদ্রাফের ভালোবাসা আমার জন্য না এটাও আমি জানি। সব মেনে নিয়েছি আমি সব। এসব কিছু নেমে নিয়ে এখন আমি আর আগের মতো থাকতে পারছি না। আর না পারছি হাসি খুশি থাকার অভিনয় করতে।”

নীলার কন্ঠস্বর আটকে আসছে কথা গুলো বলার সময়। শরীরর কেঁপে উঠছে তার। চোখ দুটো লাল আকার ধরন করছে। তবুও চোখে পানির ঝলক দেখা যাচ্ছে না। আরশি নীলার কাধে হাত রেখে নরম গলায় বললো-

“আমি তোকে অভিনয় করতে বলছি না নিলু। তবে তোর এটা খেয়াল রাখতে হবে তোর ব্যবহারে যেন কেউ কষ্ট না পায়। তোর রাগ বা মন খারাপ দেখে যেন অন্য কারও মন খারাপ না হয়। আশেপাশে তাকিয়ে দেখ আমরা অনেকেই তোকে নিয়ে চিন্তিত। আমরাও তোকে ভালোবাসি। এখন তুই যদি একজনের ভালোবাসা না পেয়ে আমাদের সবাইকে দূরে ঢেলে দিস এটা কি ঠিক হবে? একজনের জন্য কি তুই আশেপাশের সবার ভালোবাসাকে ইগ্নোর করবি নিলু? এটা কি আমাদের প্রতি প্রতি অন্যায় করা হচ্ছে না নিলু!!”

নীলা চুপ করে আছে। তার মাথা পুরো এলোমেলো লাগছে। আমার এখন কি করা উচিত আর কি করা উচিত না কিছুই বুঝতে পারছে না। কিন্তু আশুর বলা কথা গুলো একদমই ঠিক। আমি তো সত্যিই তাদের সাথে অন্যায় করছি। নীলা চোখ বন্ধ করে বড় একটা শ্বাস নিল। মুখে হাল্কা হাসির রেখা টেনে বলল-

“আমি চেষ্টা করবো আশু। নিজেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করবো। আমি চাই না আমার জন্য তোরা সবাই মন খারাপ করে থাক।”

আরশি একটা মুচকি হাসি দিয়ে নীলাকে এক পাশ থেকে জড়িয়ে ধরলো। নীলা দুষ্টুমি করে আরশির হাত থেকে চিঠিটা ছিনিয়ে নিতে চাইলেই আরশি দ্রুত চিঠিটা দূর সরিয়ে ফেলে। নীলা সরু চোখে আরশির দিকে তাকিয়ে বলল-

“চিঠিতে কি লেখা আছে রে আশু? আমাকে দেখাতে চাচ্ছিস না কেন!”

আরশি নীলার হাতে চাপড় মেরে বলল-

“তোর মাথা আছে গাধী।”

নীলা দু হাত আড়াআড়ি ভাজ করে নাক ফুলিয়ে বলল-

“আমি গাধী না তুই গাধী।”

আরশি হেসে দিল। তার সাথে তাল মিলিয়ে নীলাও হাসলো।

—————————

“এই যে ভাইয়া একটু এদিকে আসুন তো। আপনার সাথে কিছু কথা ছিল।”

নীলার কথা শুনে নির্বান ভ্রু কুচকে তার দিকে তাকালো। নীলার মুখে এমন মিষ্টি মধুর সুরেলা ডাকে তার প্রচুর সন্দেহ হচ্ছে। এই মেয়ের সাথে তো তার কখনো এতো সুন্দর করে কথা হয়নি। নির্বানকে কপাল কুচকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নীলা আবারও নম্র কন্ঠে বলল-

“এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন? এদিকে আসুন কথা আছে আপনার সাথে।”

নির্বান তার ভাবনার জগৎ থেকে ফিরে আসলো৷ বারান্দায় নীলার দিকে এগিয়ে গেল। নীলা নিচে বাগানের দিকে দৃষ্টি দিয়ে বিনয়ের সাথে বলতে লাগল-

“আসলে আপনাকে সরি বলার ছিল। কিছুদিন দিন ধরে আমার মন মেজাজ কিছুটা বিগড়ে ছিল তাই আপনার সাথে নিজের অজান্তেই খারাপ ব্যবহার করে ফেলেছি।”

“মন খারাপ কেন? ব্রেকআপ হয়েছে বুঝি!”

নীলার কথার মাঝে নির্বান হুট করেই প্রশ্ন করে বসলো। নীলা নির্বানের দিকে একঝলক তাকিয়ে আবারও চোখ নামিয়ে ফেললো। কিছুটা সময় চুপ থেকে শান্ত গলায় বললো-

“নাহ তেমন কিছু না। যাইহোক আবারও সরি। আপনি আমার থেকে বড় তার উপর আবার এ বাসার মেহমান। আপনার সাথে এমন বাজে ব্যবহার করা আমার একদমই ঠিক হয়নি। আমি আন্তরিক ভাবে দুঃখিত। ভুলবশত আপনার মনে কোনো কষ্ট দিয়ে থাকলে মাফ করবেন।”

নির্বান হতবাক হয়ে গেছে। বিস্মিত চোখে নীলার দিকে তাকিয়ে আছে। নীলার মুখটা মলিন হয়ে আছে। বড্ড বেমানান লাগছে নীলার এই মলিন চেহারাটা। নিচের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মৃদু বাতাসে চুল গুলো সামনের দিকে এসে পড়ছে আর তার সাথেই নীলার মুখে বিরক্তির রেশ ফুটে উঠছে।

“বার বার সরি বলতে হবে না তোমাকে। আমি কিছু মনে করিনি। ওইদিন আমারই ভুল ছিল ব্যস্ততার জন্য শুধু শুধুই তোমার উপর ক্ষেপে গিয়েছিলাম। আর এখন তো আমরা বেয়াই-বেয়াইন হতে যাচ্ছি একটু আধটু রাগারাগি এসব তো নরমাল।”

নীলা নির্বানের দিকে চোখ তুলে তাকালো। একটা মলিন হাসি দিয়ে বলল-

“আচ্ছা এখন আসি রেডি হতে হবে।”

নীলা চলে যাচ্ছে হঠাৎই পেছন থেকে নির্বান বলে উঠলো-

“সবই তো ঠিক আছে তবে নেক্সট টাইম থেকে আমার আর কখনো ভাইয়া বলে ডাকবে না।”

নীলা থমকে দাঁড়ালো। পেছন ফিরে নির্বানের দিকে ভ্রু কুচকে জিজ্ঞাসুক দৃষ্টিতে তাকালো। নির্বান গম্ভীর গলায় বলল-

“আসলে আমি তোমার ছাইয়া হতে চাই না।”

নীলা বিস্ময়ের চোখে নির্বানের দিকে চেয়ে বলল-

“মানে!”

নির্বান একটা দুষ্টু হাসি দিয়ে বলল-

“মানে আজকাল ভাইয়া বলতে বলতে যে কখন ছাইয়া হয়ে যায় কেউ-ই যানে না। তাই বলছি ভাইয়া ভাইয়া ডাকো না।”

নীলা নির্বানের কথা শুনে বোকার মতো গোলগোল চোখে তাকিয়ে আছে। নির্বান একটা চোখ টিপ দিয়েই চলে গেল। নীলা ভ্রু কুচকে নির্বানের যাওয়ার পানে তাকিয়ে আছে। পাগল নাকি এই লোক! সব সময় কি সব উল্টাপাল্টা কথা বলে। যত্তসব ফাউল! নীলা বিরবির করতে করতে চলে গেল রুমে।

—————————

লাল রঙের জামদানী শাড়ি গায়ে জড়ানো। মেকাআপ বিহীন মুখ। চোখে হাল্কা কাজল। খুলে রাখা চুল গুলো এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে আছে। লাল শাড়ির সাথে তাল মিলিয়ে লজ্জায় আরশির গাল গুলোও লাল আভা ধারণ করছে। অস্বস্তিতে দু হাত অনবরত কচলাচ্ছে। লাল কাচের চুড়ি গুলো বার বার ঝনঝন শব্দে বেজে উঠছে। রৌদ্র ঘোর লাগা চোখে আরশির দিকে তাকিয়ে আছে। রৌদ্রর পাশ থেকে নির্বান ভ্রু কুচকে বলল-

“আর কতো দেখবে ভাই! আংটিবদলের কাজটা সেরে ফেলো তাড়াতাড়ি।”

ড্রয়িংরুমে সবার সামনে রৌদ্রর ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকাতেই আরশির অস্বস্তির পরিমান দফায় দফায় বৃদ্ধি পাচ্ছিল। নির্বানের কথায় রৌদ্র চোখ ফিরিয়ে নিতেই আরশি একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। রৌদ্র মা আরশির পাশে এসে আরশিকে ধরে সোফা থেকে উঠিয়ে দাঁড় করিয়ে দেয়। রৌদ্রর দিকে একটা আংটি এগিয়ে দিয়ে বলল-

“রৌদ্র আংটি পড়িয়ে দিয়ে আরশিকে।”

রৌদ্র আংটিটা হাতে নিয়ে আরশির দিকে একঝলক তাকালো। সবাই তাড়া দেওয়া রৌদ্র আরশির হাত ধরে আংটি পড়াতে নিবে তার আগেই কলিং বেল বেজে উঠলো। সবাই প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে হতাশ নিঃশ্বাস ফেলল। আবারও কলিং বেল বাজতেই অতিমাত্রায় বিরক্ত হয়ে নীল দরজার দিকে এগিয়ে গেল।

চলবে….

(দুঃখিত ব্যক্তিগত কিছু কারণে গত দু’দিন গল্প লিখতে পারিনি। আশা করি আপনাদের লেখিকার পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করবেন। আমার লেখায় এর আগে এতোটা অনিয়ম হয় নি। আপনাদের অপেক্ষা করানোর জন্য আন্তরিক ভাবে দুঃখিত। ধন্যবাদ আর ভালোবাসা সবাইকে।❤️❤️ আর হ্যাঁ অনেক গুলা সরিইইইই।😥)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here