#ফেরারি_প্রেম
#পর্ব_১৩
#নিশাত_জাহান_নিশি
“আমি আমার ছেলেকে সুখী দেখতে চাই আর কিছুই না। তুমি আমার হেল্প করতে পারবে কী-না বলো?”
মহা ঝঞ্জাটে ফেসে গেল নীহারিকা! ভেবে কুল কিনারা পাচ্ছিলনা এই প্রতিকূল পরিস্থিতি থেকে কীভাবে বের হবে সে। কোনদিকে যাওয়া উচিৎ তার। মুহূর্ত কয়েক পর ঠাণ্ডা মাথায় কিছু একটা ভেবে নীহারিকা স্পষ্ট গলায় বলল,
“আন্টি আমি এই ব্যাপারে আপনার সাথে সরাসরি কথা বলব। সরি টু সে এই মুহূর্তে আমি আপনাকে কিছু বলতে পারছিনা!”
বলেই নীহারিকা ঝট করে কলটি কেটে দিলো। ফোনের ঐ প্রান্তে থাকা নাজনীন বেগম নীহারিকার ব্যবহারে বেশ অবাক হলেন। পাশাপাশি অসন্তোষও প্রকাশ করলেন! রূঢ় গলায় বললেন,
“এ কেমন ব্যবহার তার? মুখের উপর এভাবে কলটা কেটে দিলো? সহবোধ কী জানা নেই তার?”
ফোনটা বিছানার উপর ছুড়ে ফেলে নীহারিকা চিন্তিত হয়ে মাথার চুলগুলো টেনে ধরল। সারাঘর জুড়ে পায়চারি করে সে উপায় খুঁজতে লাগল। কিছুতেই যেন কোনো ভালো উপায় তার ছোটো মাথায় কাজ করছিলনা। এরই মধ্যে পুনরায় নীহারিকার ফোন বেজে উঠল। বিরক্ত হয়ে নীহারিকা ফোনের স্ক্রীণের দিকে তাকাতেই দেখল অচেনা নাম্বার থেকে ফোন। পরিচিত কেউ হবে সেই ভেবে নীহারিকা ফোনটি তুলতেই ঐ পাশ থেকে অপরিচিত পুরুষালী গলার স্বর ভেসে এলো। কর্কশ গলায় ছেলেটি বলল,
“রূপলের সাথে খুব ভাব হয়েছে তোর তাইনা? প্রেম চলছে তার সাথে?”
অবিলম্বেই ছেলেটির গলার স্বর ধরতে পেরে নীহারিকা রাগে গিজগিজিয়ে উঠল। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে সে উঁচু গলায় বলল,
“এত বড়ো সাহস আপনার? আপনি আমার নাম্বারে কল করে আমার সাথেই খারাপ ব্যবহার করছেন? কিছু বলছিনা বলে ভেবেছেন আপনি যা ইচ্ছা তা করে পার পেয়ে যাবেন? এতই সহজ সব?”
“দেমাগ কমেনা তাইনা? এত বড়ো একটা ছ্যাকা খেয়েও দেমাগ কমেনি তোর? এই ভাঙাচূড়া চেহারা নিয়েই তোর এত দেমাগ? আর দেখতে যদি একটু উঁচু, লম্বা, সুন্দরী হতি তাহলে তো তোর পা মাটিতেই পরত না। দেশের প্রধানমন্ত্রীর মত ভাব নিয়ে চলতি! আমার মুখে মুখে তর্ক করা তাইনা? দেখে নিব তোকে আমি।”
বলেই কলটি কেটে দিলো শাফকাত! রাগে সে নিজেই নিজের গাঁয়ে আ’ঘা’ত করতে লাগল। গালে চড়, থাপ্পর, ঘুষি মারতে লাগল! অতিরিক্ত চাওয়া মানুষকে হিংস্র করে তুলে। প্রতিহিংসায় মাতিয়ে তুলে। তখন যেন মানুষ বিবেক বিবেচনাবোধ সব হারিয়ে ফেলে। এদিকে নীহারিকা তব্দা হয়ে একই জায়গায় ঠায় দাড়িয়ে রইল। কান থেকে ফোনটাও নামানোর সুবোধ পাচ্ছিলনা সে! চোখ থেকে কেবল টলটলিয়ে জল গড়াচ্ছিল! তাকে মোটামুটি সব জায়গাতেই গাঁয়ের রঙ এবং উচ্চতার জন্য অপমানিত হতে হয়! যদিও গাঁয়ে এসব সয়ে গেছে তার। তবে মাঝে মাঝে শোক সামলানো যায়না। কাতর হতে হয়। নিজের প্রতি নিজের ঘৃণা তৈরি হয়। কাঁদতে কাঁদতে নীহারিকা বিছানার উপর বসে পড়ল। নিজের কুৎসিত চেহারা নিয়ে নানান খারাপ চিন্তাভাবনা করতে লাগল। এক পর্যায়ে সে মুখ হাত রেখে হাউমাউ করে কেঁদে বলল,
“কেন আমাকে দেখতে এতটা কালো আর বেঁটে বানালে আল্লাহ্? কেন একটু সুন্দর করে আমাকে তৈরি করলে না? কেন প্রতি পদে পদে আমাকে হেনস্তা হতে হয়? লোকজন কেন আমাকে অপমান করতে ছাড়েনা?”
কান্নাকাটির মাঝেই নীহারিকার ফোনটি পুনরায় বেজে উঠল। সেদিকে মনোযোগ নেই নীহারিকার। অঝরে কান্নায় ব্যস্ত সে। পর পর দশ থেকে বারো বার কলটি অনবরত বেজে যাওয়ার পর নীহারিকা শেষের বার বাধ্য হয়ে কলটি তুলল। অমনি রূপল ঐ পাশ থেকে তিরিক্ষিপূর্ণ গলায় বলল,,
“কোথায় থাকেন আপনি? কতবার কল করেছি দেখেননি আপনি?”
প্রত্যত্তুরে মৌন রইল নীহারিকা! কেবল মাথা নুইয়ে হেঁচকি তুলতে লাগল। নীহারিকার হেঁচকির আওয়াজ শুনামাত্রই রূপল নরম হয়ে এলো! ভাবল তার হুমকি ধমকির কারণে হয়ত নীহারিকা কেঁদে ফেলেছে! রাগ শান্ত করে রূপল নম্র স্বরে বলল,
“কোথায় ছিলেন আপনি? কতগুলো কল দিলাম দেখেননি?”
নীহারিকা ভেজা গলায় বলল,
“দেখেছি।”
“দেখলে কলগুলো তুলেননি কেন?”
“মন চায়নি।”
“মন চায়নি মানে?”
“কেন ফোন করেছেন বলুন?”
“কাল পিয়াসাকে হসপিটাল থেকে রিলিজ দেওয়া হবে এটা জানানোর জন্যই কল করেছিলাম।”
“ভাইয়া তো হসপিটালেই আছে। প্রয়োজনে আমিও কাল যাব। ভাবিকে এই বাড়িতে নিয়ে আসব।”
“না। পিয়াসা আমাদের বাড়িতে উঠবে। পুরোপুরি সুস্থ না হওয়া অবধি পিয়াসা আমাদের কাছেই থাকবে।”
“ভাইয়া যদি কোনো আপত্তি না করে তাহলে আমাদেরও এখানে কোনো আপত্তি নেই।”
“কাল কখন যাবেন এনজিওতে?”
“বলতে পারছিনা! মন ভালো থাকলে যাব।”
“মন ভালো থাকলে যাব মানে? ভুলে যাবেন না আপনি একটা দায়িত্ব নিয়েছেন। সেই দায়িত্বটা ঠিকঠাকভাবে পালন না করা অবধি আপনি এভাবে পল্টি খেতে পারেননা!
মাথায় কেন যেন জেদ চেপে বসল নীহারিকার। অস্বাভাবিকভাবে রেগে ওঠে সে চ্যাচিয়ে বলল,
“কী পেয়েছেনটা কী আপনারা আমাকে হ্যাঁ? যে যেভাবে পারছেন আপনাদের সিদ্ধান্ত আমার উপর চাপিয়ে দিচ্ছেন! দেখতে বিশ্রি আর বেটে বলে কী আমার কোনো দাম নেই? যে যেভাবে পারবে সেভাবে ইউজ করতে পারবে আমাকে?”
অঝরে কেঁদে নীহারিকা কলটি কেটে দিলো। তাজ্জব বনে গেল রূপল! অবাক হয়ে সে ফোনের স্ক্রীণের দিকে তাকিয়ে রইল। ভ্রু কুঁচকে বলল,
“কী হলো ব্যাপারটা? কীসের সাথে কী মিলালো এই মেয়ে? মাথার তার টার ছিঁড়ে গেছে নাকী তার? আমি কখন তাকে বিশ্রি আর বেটে বললাম? আমিতো ভুলেও তাকে নিয়ে এসব ভাবিনি।”
রাতটা কোনো রকমে পার হতেই রূপল পরদিন সকালে নীহারিকাদের বাড়িতে এলো। সরাসরি নীহারিকার রুমে ঢুকে গেল সে! সকালের নাশতা খেয়ে নীহারিকা মাত্র-ই তার রুমে ঢুকেছিল। এরই মধ্যে হঠাৎ রূপলের আগমন। সারারাত বালিশ ভিজিয়ে কান্নার দরুন নীহারিকার চোখমুখ বেশ ফুলে ফেঁপে ছিল। রূপলের মুখোমুখি হতেই সে মুখটা নিচু করে নিলো। রূপলকে এই অসময়ে তার রুমে দেখে নীহারিকা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। আমতা আমতা করে বলল,
“আপনি এখানে?”
“আপনি কী কেঁদেছেন?”
“কই না তো!”
“আমার ব্যবহারে কষ্ট পেয়েছেন?”
“উঁহু।”
“তাহলে কাল হঠাৎ আমাকে ঝারি দিলেন কেন? আপনার কাছে হেল্প চাওয়াটা কী আমার ভুল হয়েছে?”
“কাল যা হয়েছে ভুলে যান। আমিও ভুলে গেছি।”
“না। কীভাবে ভুলব? এভাবে হুটহাট রেগে গেলে আমি আপনার উপরে ট্রাস্ট রাখব কীভাবে? এখন বলবেন এক কথা। কিছুক্ষণ পরে বলবেন আরেক কথা! এমন দুমুখো মানুষ আমার পছন্দ না।”
আনমনেই কেন যেন নীহারিকার চোখের কোণে জল জমে এলো! ছলছল দৃষ্টিতে সে রূপলের দিকে তাকালো। শুকনো ঢোঁক গিলে ভরাট গলায় বলল,
“আমাকে কেউই পছন্দ করেনা রূপল! আমি কখনও কারো মনমতো হতে পারিনি! আমার সাথেই কেন বার বার এমন হয় বলুন তো? আমার জন্ম হওয়াটাই কী পাপ ছিল?”
ভ্রু যুগল কুঁচকে নিলো রূপল। কৌতূহলী হয়ে উঠল সে। আগ্রহী গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,
“কী হয়েছে আপনার বলুন তো? কাল থেকে এসব অদ্ভুত অদ্ভুত কথা কেন বলছেন? কে আপনাকে কী বলেছে?”
হেয়ো হাসল নীহারিকা! বিদ্রুপের স্বরে বলল,
“যে যাই বলুক খারাপ তো কিছু বলেনি! আপনি বরং যান এখন। আমি সময়মত এনজিওতে পৌঁছে যাব।”
বলেই নীহারিকা পিছু ঘুরে নিলো। হাতের উল্টো পিঠ দ্বারা চোখ দুটো মুছে নিলো। নীহারিকার হেয়ালি আচরণে অধৈর্য্যে হয়ে উঠল রূপল। কপাল ঘঁষতে ঘঁষতে সে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“কে আপনাকে কী বলেছে বলুন? কথা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলা আমার পছন্দ না। যা বলার ডিরেক্টলি বলুন।”
“আপনি খামোখা রেগে যাচ্ছেন! কেউ কিছু বলেনি আমায়। সব তো আমার কপালের দোষ। নিজের দোষেই নিজে কষ্ট পাই।”
এরই মধ্যে রূপল অবাক করা এক কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলল। টি-টেবিলের উপর থাকা ফুলদানিটা সে ভেঙে গুড়িয়ে দিলো! আতঙ্কিত হয়ে নীহারিকা পিছু ঘুরতেই রূপল চোয়াল শক্ত করে বলল,
“বলুন কে আপনাকে কী বলেছে?”
রূপলের ভয়ে সিটিয়ে উঠল নীহারিকা! কাঠ কাঠ গলায় সে গড়গড় করে শাফকাতের কথা সব বলে দিলো! অমনি রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে রূপল আচমকা নীহারিকার ডান হাতটা টেনে ধরল! নীহারিকাকে নিয়ে সে শোঁ শোঁ বেগে রুম থেকে বের হয়ে গেল! রাগমিশ্রিত কঠিন গলায় বলল,
“শুধু দেখুন আজ আমি শাফকাতের কী অবস্থা করি!”
#চলবে…?
[কলেজ থেকে ট্যুরে গিয়েছিলাম আজ। মাথায় অনেক প্রেশার নিয়ে আজকের পর্বটা লিখেছি। সময়ের অভাবে রি-চেইকও করা হয়নি। ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।]