#ফেরারি_প্রেম
#পর্ব_২৫
#নিশাত_জাহান_নিশি
“তারছেঁড়া মেয়ে কোথাকার!”
রগচটা ভাব নিয়ে রূপল মুহূর্তেই বাইকটি ছেড়ে দিলো। অমনি নীহারিকা হাপিত্যেশ করে পেছন থেকে রূপলকে ডাকল! অস্থির গলায় বলল,
“আরে আরে থামুন। আমাকে তো নিয়ে যান।”
ঝট করে বাইকটা থামিয়ে দিলো রূপল। নীহারিকা স্বস্তি পেল! আশ্বস্ত হয়ে রূপলের দিকে তাকালো। অমনি রূপল পিছু ফিরে আক্রোশভরা দৃষ্টিতে মৃদু হেসে ওঠা নীহারিকার দিকে তাকালো। কঠিন স্বরে বলল,
“উঁহু। আপনাকে আর প্রশ্রয় দেওয়া যাবেনা। বলা যায়না এত ইয়াং, স্মার্ট, হ্যান্ডসাম বেয়াই আপনার কখন চান্স নিতে লেগে পড়েন! তাই আগে থেকেই সর্তক হয়ে গেলাম!”
বলেই রূপল ব্যগ্র হাসল! মোটামুটি ভাবসাব নিয়ে পুনরায় বাইকটা স্টার্ট করে দিলো। নীহারিকা তাজ্জব দৃষ্টিতে রূপলের যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইল। কোমরে হাত গুজে সে হেনস্তা গলায় বলল,
“এই লোক আমার ডায়লগ আমার সাথেই প্রয়োগ করল? লিফট দিবে বলেও চলে গেল? ধ্যাত্তেরি ভাল্লাগেনা। বার বার এই লোকের সামনে আমাকে নত হতে হয়। ইনসাল্টেড হতে হয়!”
রাগে গাঁ রি রি করছে নীহারিকার। মনে মনে রূপলকে অকৃতজ্ঞ এবং স্বার্থপর লোক বলে বকাও দিচ্ছে! মিনিট কয়েক বাদে একটি রিকশা খুঁজে পেতেই নীহারিকা রিকশাটিতে ওঠে গেল। তবে সে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা না হয়ে তার কলেজের উদ্দেশ্যে রওনা হলো। অনেকদিন কলেজে যাওয়া হয়না তার। কিছুদিন পর ইনকোর্স এক্সাম শুরু হয়ে যাবে। এটেন্ডেন্সের উপর মার্কস দেওয়া হবে। তাই এখন আর হেলাফেলা করা যাবেনা। ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করে নীহারিকা তার মায়ের নাম্বারে কল করল। বাড়িতে খবরটা জানিয়ে দেওয়া উচিৎ। প্রথম কল বেজে উঠতেই নীহারিকার মা মারজিনা বেগম কলটি তুললেন। ঐপাশ থেকে মারজিনা বেগম হ্যালো বলতেই নীহারিকা বলল,
“আম্মু আমি ভাবিদের বাড়ি থেকে বের হয়ে গেছি। এখন কলেজে যাচ্ছি।”
মারজিনা বেগম জিজ্ঞাসু গলায় বললেন,
“তোর ভাবি কই?”
“ভাবি আজ আসবেনা মা।”
“আসবেনা মানে? নিহাল তো বলল আজ তোরা একসাথে আসবি।”
“আমিই ভাইয়াকে বলেছিলাম আমরা একসাথে আসব। কিন্তু এখন ভাবি বলছে আজ আসবেনা ভাবি। আমিও তেমন ফোর্স করিনি। দেখলাম ভাবির মন খারাপ! মিস্টার রাতুলের বিষয়টা নিয়ে বাড়ির সবার-ই মন খারাপ। তাই আমিও আর জোর করিনি! থাক, কয়েকদিন থেকে মনটা ফ্রেশ করে আসুক। আর তুমিও ভাবিকে কিছু বলতে যেয়ো না আবার। মন ভালো হলে ভাবি নিজেই আমাদের বাড়িতে চলে আসবে।”
রুক্ষ গলায় মারজিনা বেগম বললেন,
“বেড়াক সমস্যা নেই। কিন্তু একটা বার তো ফোন করে আমাদের খবর নিবে! পরের মেয়ে বলে কী কোনো দায়-দায়িত্ব নেই?”
মারজিনা বেগমের কথায় যুক্তি আছে জেনেও নীহারিকা তার মাকে প্রশ্রয় দিলোনা! বরং তার মাকে শাসিয়ে বিরক্তিকর গলায় বলল,
“মা হইছে তো! কেন বিষয়টাকে নিয়ে এত বাড়াচ্ছ? এটা যার যার ইচ্ছা, রুচি, মর্জির উপর ডিপেন্ড করে। সবার মনমানসিকতা কী আর তোমার মনমতোন হবে? বাদ দাও এসব। কারো উপর প্রয়োজনের তুলনায় বেশী এক্সপেকটেশন রাখবে না! তাহলেই ভালো থাকতে পারবে। আচ্ছা আমি এখন রাখছি। কলেজে যাচ্ছি।”
মেয়ের কথায় চুপ হয়ে গেলেন মারজিনা বেগম! তবুও তিনি ক্ষীণ গলায় প্রশ্ন ছুড়লেন,
“কখন আসবি?”
“আসতে আসতে দুপুর হবে।”
“কী রান্না করব আজ?”
“যা ইচ্ছা।”
“আমি আরও ভেবেছিলাম আজ চিংড়ি মাছের মালাইকারি রান্না করব! এই ডিশটা তোর ভাবির খুব পছন্দ। যেহেতু মেয়েটা কাজ আসবেই না তাহলে মাছটা ফ্রিজে তুলে রেখে দিই। কী বলিস?”
“হুম। রেখে দাও। ভাবি এলে রান্না করো।”
“আচ্ছা রাখি। কলেজে যা। সাবধানে যাস মা।”
“ঠিক আছে মা। রাখছি।”
”এই দাড়া দাড়া৷ কল কাটিস না। খাতা, কলম ছাড়া তুই ক্লাস করবি কীভাবে?”
“আরে মা চিল! আমার তো জাস্ট এটেন্ডেন্সেরই দরকার! খাতা-কলম, ব্যাগপত্র দিয়ে কী হবে?তাছাড়া কলেজে এসব টিচাররা চেক করেনা! প্রেজেন্ট থাকলেই এনাফ!”
কলটা কেটে নীহারিকা লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল! পিয়াসাকে নিয়ে সে চিন্তিত। মেয়েটা তাদের সাথে ঠিকঠাকভাবে মানিয়ে চলতে পারবে কী-না তা নিয়ে সে বড়োই দ্বিধাগ্রস্ত। এভাবে বেশিদিন চলতে থাকলে তো সংসারে অশান্তি বাড়তেই থাকবে। কতদিন আর সে তার মাকে বুঝিয়ে রাখবে? যা বুঝা যাচ্ছে, পিয়াসাকে বেশী একটা প্রশ্রয় দেওয়া যাবেনা! তার ছেলেমানুষীও মেনে নেওয়া যাবেনা।
কলেজের কাছাকাছি যেতেই নীহারিকা তার বেস্টফ্রেন্ড তুলিকে কল করল। দু-একজন সাঙ্গ পাঙ্গ ছাড়া কলেজে ক্লাস করাটা যেন পানসে লাগে। এত স্টুডেন্টের মাঝে ক্লাসে থেকেও নিজেকে একা মনে হয়! তুলি আগে থেকেই ক্লাসে বসে আছে! এই কয়েকদিনে তুলি আর না হয় একশ কল করেছে নীহারিকাকে। অসুস্থতা এবং সবদিকের ভেজালে ফোন বেশী একটা হাতে নেওয়া হয়নি নীহারিকার। তাই তুলির সাথেও যোগাযোগ করা হয়নি। এই নিয়ে তুলি নীহারিকার উপর বেশ রেগে থাকলেও নীহারিকা ঠিকই তার বান্ধবীকে মানিয়ে নিলো।
শাফকাতকে কলেজের কোথাও দেখা গেলনা আজ! অথচ এই শাফকাত কলেজে আছে ভেবে নীহারিকা খুব ভয়ে ভয়ে চলাফেরা করছিল! উপর থেকে নীহারিকা যতই শাফকাতকে ভয় না পাওয়ার ভান করুক না কেন ভেতরে ভেতরে সে শাফকাতকে ঠিকই প্রচুর ভয় পায়! কারণ, ছেলেদের মন। কখন কী থেকে কী করে বসে বলা যায়না। তাই এক্ষেত্রে মেয়েদেরকে যতটা সম্ভব সতর্ক থাকা উচিৎ।
ক্লাস শেষ হতে হতে দুপুর হলো। তুলি এবং নীহারিকা বেশ ফুরফুরা মেজাজ নিয়ে কলেজ থেকে বের হয়ে এলো। আলাপচারিতা শেষে তুলি তার নিজের বাড়ির দিকে রওনা হয়ে গেল। আর নীহারিকাও তার বাড়ির দিকে। রিকশায় কিছুদূর যাওয়ার পর নীহারিকার আকস্মিক দৃষ্টি পরল একটি আবাসিক হোটেলের দিকে। নীহারিকার বয়ফ্রেন্ডকে কেড়ে নেওয়া তারই এক সময়ের বেস্ট ফ্রেন্ড দিশা একটি অচেনা ছেলের হাত ধরে হোটেলটির ভেতরে ঢুকে গেছে! পুরোপুরি নিশ্চিত না হলেও নীহারিকা তার দূরদৃষ্টিতে যতটুকু দেখেছে ততটুকুতে খুব সম্ভবত ভুল কিছু দেখেছে বলে মনে হলোনা!
শীঘ্রই নীহারিকা রিকশা থেকে নেমে পড়ল। রিকশাটিকে দাড় করিয়ে সে রাস্তা পাড় হয়ে দ্রুত পায়ে হেঁটে হোটেলটির ভেতরে ঢুকে গেল! মুখে ওড়না প্যাঁচিয়ে সে হোটেলটির কাউন্টারে যেতেই দেখতে পেল সত্যিই দিশা ছেলেটির সাথে দাড়িয়ে রুম বুক করছে! দিশার চরিত্র আগে থেকেই খারাপ ছিল! দিশার চলাচলও নীহারিকার পছন্দ ছিলনা৷ সন্দেহ হত তাকে। তবে বেস্টফ্রেন্ড ছিল বিধায় তার উপর কখনও আঙুল তোলা হয়নি। কিন্তু এখন যেহেতু সম্পর্কটা নষ্ট হয়ে গেছে সেহেতু এত ভালোমানুষী দেখানোর কোনো প্রয়োজনই পরেনা!
মেয়েটি যে দিশা তা পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়ার পর নীহারিকা আড়ালে লুকিয়ে গেল। রুমের চাবি নিয়ে দিশা এবং ছেলেটি হাসতে হাসতে দু-তলায় তাদের বুক করা রুমের উদ্দেশ্যে ওঠে গেল। যে করেই হোক দিশার মুখোশ আজ খুলতে হবে। তাকে হাতেনাতে ধরতে হবে। এতদিনের জমিয়ে রাখা হিসেব মিটাতে হবে! সুযোগ পেলে নীহারিকা কাউকে এমনি এমনি ছেড়ে দেয়না! তার স্বভাব ছাড় দেওয়া কিন্তু ছেড়ে দেওয়া না।
হোটেলে অবস্থান করেই নীহারিকা তার নতুন নাম্বার থেকে সানিকে কল করল! মুখে ওড়না চেপে ধরে সে নিজের গলার স্বর পাল্টানোর চেষ্টা করল! তার গলার স্বর যেন সানি কোনোভাবে ধরতে না পারে সেই জন্যে। ঐপাশ থেকে সানি কলটি তুলল৷ অমনি নীহারিকা ক্ষীণ গলায় বলল,
“আপনি সানি বলছেন না?”
ঐপাশ থেকে সানি স্বাভাবিক গলায় বলল,
“হ্যা বলছি। বাট হু আর ইউ?”
“আপনার শুভাকাঙ্ক্ষী! দিশা আপনার গার্লফ্রেন্ড হয় তাইতো?”
নির্বোধ গলায় সানি বলল,
“হ্যা। কেন?”
“তাকে দেখলাম একটি ছেলের সাথে আবাসিক হোটেলে ঢুকতে! যদি আমার কথা বিশ্বাস না হয় আমি ঠিকানাটা আপনাকে দিচ্ছি। আপনি নিজের চোখে এসে দেখে যান।”
বিপরীতে সানিকে কিছু বলার সুযোগ দিলোনা নীহারিকা! ঠিকানাটি বলেই সে ফট করে কলটি কেটে দিলো! দ্রুত পায়ে হেঁটে সে হোটেল থেকে বের হতেই চমকে গেল! বুকে হাত গুজে রূপল বদরাগী ভাব নিয়ে নীহারিকার দিকে তাকিয়ে আছে! অপ্রত্যাশিতভাবে রূপলকে দেখে নীহারিকা অস্বস্তিতে পরে গেল। শুকনো ঢোঁক গিলে সে রূপলের দিকে এগিয়ে এলো। কম্পিত গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,
“আআআপনি এএখানে কী করছেন?”
বুকের পাঁজর থেকে হাতদুটো ছাড়িয়ে রূপল বিক্ষুব্ধ গলায় চ্যাচিয়ে বলল,
“আগে বলুন আপনি এখানে কী করছেন? কার সাথে এসেছেন এখানে?”
রূপলের চিৎকারের আওয়াজে নীহারিকার কান দুটো ঝালাফালা হয়ে গেল! চোখ জোড়া খিঁচে ধরে সে কান দুটো চেপে ধরল। বিব্রতকর গলায় বলল,
“আরে আস্তে! এত চ্যাচাচ্ছেন কেন? আমি কানে কালা না-কী? যে আস্তে বললে শুনতে পাব না?”
পূর্বের মতই জেদ বজায় রেখেই রূপল কর্কশ গলায় নীহারিকাকে বলল,
“আমার জায়গায় অন্য কেউ থাকলে না? ঠাটিয়ে দুটো চ/ড় মারত! আমিতো আপনার সাথে জাস্ট চ্যাচিয়ে কথা বলছি।”
অবুঝ ভাব নিলো নীহারিকা। নির্বোধ গলায় শুধালো,
“আজব! করলামটা কী আমি?”
“এই আবাসিক হোটেলে আপনি কী করছিলেন হুম? আপনি জানেন না? এসব আবাসিক হোটেলে ছেলেমেয়েরা এমনি এমনি আসেনা?”
“আরেহ্, আপনি বুঝছেন না ব্যাপারটা। আমি এখানে এসেছিলাম অন্য কারণে। কিন্তু আপনি জেনেশুনে এসব জায়গায় আসলেন কেন? তাহলে কী আমিও ধরে নিব আপনিও….”
“হেই শাট আপ! সামনের গ্যাস পাম্প থেকে বাইকের তেল পুরাতে এসেছিলাম এখানে। হঠাৎ চোখ পরল আপনার দিকে। তাই আপনাকে হাতেনাতে ধরতে এখানে আসা!”
“কিন্তু আপনি আমাকে হাতেনাতে ধরতে এসে তো, আপনি নিজেই ধরা খেয়ে গেলেন!”
“এই আপনি কী আমার সাথে ইয়ার্কি করছেন? আমি এখানে এসেছি আপনাকে ধরতে, নিজে ধরা খেতে না।”
“সবসময় ইয়ার্কি করতে আমার ভালো লাগেনা বুঝলেন? লজিক্যালি বিষয়টা একবার ভাবুন তো৷ এইযে আমরা দুজন এখন একই সাথে এই আবাসিক হোটেলের নিচে দাড়িয়ে আছি বাই অ্যানি চান্স আমাদের পরিচিত কেউ যদি আমাদের দুজনকে একসাথে এখানে দেখে ফেলে? তাহলে বিষয়টা কী দাড়াবে?”
নীহারিকার যুক্তিবাদী কথায় কাশি ওঠে গেল রূপলের! গলা খাঁকিয়ে সে বলল,
“চলে আসুন এখান থেকে! আপনার মত বিচ্ছু মেয়ে আমি দ্বিতীয়টি দেখিনি।”
নাক ঘঁষল নীহারিকা। বেশ ভাবসাব নিয়ে বলল,
“বিচ্ছু না। কথাটা জ্ঞানী হবে!”
“হোয়াটএভার। আমি এক্ষুণি জিজুর কাছে ফোন করছি! বাড়িঘর রেখে যে আপনি এসব জায়গায় ঘুরাঘুরি করেন সব বলছি। অন্যায় তো করবে করবে আবার নিজেকে জ্ঞানী বলেও দাবি করবে। ডিজগাস্টিং।”
ফোন হাতে নিতেই রূপলকে বাঁধা দিলো নীহারিকা! নাক ফুলিয়ে কর্কশ গলায় বলল,
“এই? সবসময় নাকের ডগায় এত রাগ নিয়ে ঘুরেন কেন? রাগী ভীমরুল একটা!”
তিরিক্ষিপূর্ণ মেজাজে রূপল যেইনা নীহারিকাকে কিছু বলতে যাবে অমনি নীহারিকা ঝট করে রূপলের হাত ধরে রূপলকে নিয়ে পিছনে ঘুরে গেল! অস্থিরতা নিয়ে সে বিড়বিড় করে রূপলকে বলল,
“একটু চুপ থাকুন প্লিজ। জাস্ট ফর টু মিনিটস। এরপর আপনি যা ইচ্ছা তা করুন। আমি কোনো অভিযোগ করবনা।”
#চলবে…?