অতিরিক্ত চাওয়া { ২ }
৫
স্বপ্নের দুনিয়ায়, গাছগাছালির আড়ালে মাতাল বেলী! সকালের শীতল আবহাওয়া শরীরে ছোঁয়াচ্ছে! ভিজে-ভিজে উষ্ণ ঘাসে পা দুলিয়ে হেঁটে যাচ্ছে ! হাতের তালু দিয়ে ছুঁয়ে দিচ্ছে হালকা ভেজা গাছগুলো! এমন সুন্দর কেনো লাগছে আজ পৃথিবী? ঠোঁটের কোণে মিষ্টি হাসি ঝুলিয়ে দিব্বি নেচে-কুঁদে এগোচ্ছে এ-ই সুন্দর পৃথিবীতে! হঠাৎ সামনে রক্তচক্ষু তৃষ্ণা কে দেখে সে থেমে গেলো! বেলী বারবার চোখ উল্টিয়ে তাকাচ্ছে! বাম-পা ধীরগতিতে পেছনে নিলো। ডান-পা ভালোভাবে নাড়িয়ে নিলো পিছনে দৌড় দেওয়ার জন্য! কিন্তু, তার আগেই তৃষ্ণা তার মাথায় এক বালতি ঠান্ডা পানি ঢেলে দিলো! স্তব্দ বেলী বারবার ভাবছে! এখন না শীতকাল? এটা না শীতকালীন ভোরের সকাল! তারমানে তার শরীরে কনকনে ঠান্ডা পানি ঢেলে দেওয়া হয়েছে, এ-ই শীতকালীন ভোরে? বেলী স্তব্দ গলায় বড়সড় এক চিৎকার দিয়ে উঠলো..
— আম্মুরে ঠান্ডা পানিইইইইইই!
খুশি ফজরের নামাজের জন্য মাত্র দাঁড়িয়ে ছিলো! মেয়ের চিৎকার শুনে, সে পাশের রুম থেকে দৌঁড়ে উঠানের রুমে চলে এলো! এতোক্ষণে বিমানও বেলির পাশ থেকে লাফিয়ে উঠে নেমে দাঁড়িয়ে! দু’জনই কৌতূহল নিয়ে বেলীর দিক তাকিয়ে! যিনি আপাতত বিছানায় বসে! চিৎকার দিয়ে সে নিজেও আহত হয়ে আছে! স্বপ্নে চিৎকার করা আজ নতুন মনে হচ্ছে! ছোট ঢোক গিলে বলল..
— কি ঠান্ডা তাই না? পানি ছিটকে শরীরে পড়েছিল হয়তো! টেনশান কি কোয়ি বাত নেহি হে! আপ সাব আপনে কাম পে লাগ যাইয়ে! ধান্যেবাদ!
বিমান হনহনিয়ে বালিশ নিয়ে অন্য রুমে চলে গেলো! খুশি যাওয়ার আগে বেলীর মাথায় ঠাস করে থাপ্পড় মেরে গেলো!
— ফাজিল মেয়ে।
মাথায় হাত বুলাতে-বুলাতে বেলীর একটাই ভাবনা! সকালের স্বপ্ন তো সত্যি হয়? তারমানে কি আজ তৃষ্ণা ভাইয়া আসবে? বেলী বড়সড় এক শ্বাস নিলো! এ-ই ১ মাসে করা কাহিনী তার ধীরেধীরে মনে পড়ছে! নির্ঘাত তাকে জীপগাড়ি দিয়ে পিশে দেবে রাস্তায় এইবার !
ঢাকায় মামার ইলেকশনের কারণে দ্রুত চলে যায় তৃষ্ণা! ১ মাস প্রচন্ড ট্বাফ সিডিউল ছিলো তার ! শ্বাস নেওয়ার সময় ছিলো ! মামার ইলেকশন! বাবার আন্দলোনের সিচুয়েশন! চাচার নামে খুনের মামলা! এতোকিছু ঘুরে-ঘুরে হ্যান্ডেল করছে সে! এ-ই তিনজনের দালানকোঠা তৃষ্ণা! কিন্তু, এইবার সমস্যা একসাথে এসেছে! এতো চাপের মাঝেও সে ২-৪ দিন পরপর ক্রিষ্ণপুর এসেছে! শুধুমাত্র একটা রিজনে ! রিজন টা বেলী জানে না! যতটুকু জানে তাও শিলা থেকে! কিন্তু বেলী , সে অভিমানে তৃষ্ণার সামনেই যায় নি! পিছনের গাছগাছালির রাস্তা দিয়ে, ৫ টাকার নৌকা ভাড়া দিয়ে স্কুল পৌছিয়েছে, পিছন গেইট দিয়ে! যখনই শুনেছে তৃষ্ণা এসেছে, সেদিন আর বেলীকে কেউ দেখতে পেয়েছে নাকি সন্দেহ !
এখন বেলীর ভয় হচ্ছে, তৃষ্ণা নাকি তাকে খুঁজেছে! একবার না অনেকবার! যতবার এসেছে ক্রিষ্ণপুর ততবার! শিলা কষ্ট মনে বলেছিল…
— তুই জানিস? তৃষ্ণা ভাইয়া তোকে হন্য হয়ে খুঁজে ছিলো! তোদের বাড়ির সামনেও গিয়েছিল!হয়তো দরকারী কথা ছিলো! কিন্তু তুই? ফিরতে দে ভাইয়াকে! তুই পস্তাবি দেখিস!
হন্যহয়ে খুঁজেছে শুনলেই বেলির বুক কেঁপে উঠে! শিলাকেও পাঠিয়ে ছিলো বেলিদের বাড়িতে! বেলি ঘুমের ভান করে উঠেই নি আর! এগুলো খুব মনে পড়ছে বেলীর! আচ্ছা, ভয় হওয়ার তো প্রশ্ন নেই! তৃষ্ণা তাকে কেনো খুঁজবে? খুঁজলে যেতেই হবে তার-ও তো কোনো পার্মানেন্ট রিজন নেই! ইচ্ছে হয় নি তাই যায় নি। ব্যাস! ভয় কেনো পাবে বেলী? কি করবে তাকে? ফুলো বডি আর, খাম্বার মতো লম্বা শরীর নিয়ে বেলীকে ভয় দেখানো যাবে না! একদম যাবে না! বেশি তিরিং-বিরিং করলে কলম দিয়ে গুঁতো দিয়ে দেবে!
স্কুল ড্রেসে ব্যাগ কাঁধে হেঁটে চলেছে বেলী ! ভয়ে বুক কাঁপছে! একটু পরপর মাথায় তৃষ্ণার রাগী ফেইস ভেসে আসছে! আজ তার স্কুল যেতে একদমই ইচ্ছে করছে না! ভেবেছিল জংগলের রাস্তা দিয়ে যাবে, কিন্তু আনন্দ নিজের সাথেই ছেলে-মেয়ে নিয়ে রওনা হলো! টমটমগাড়িতে বসে বেলী শুধু আল্লাহ আল্লাহ করছে, যাতে আজ তৃষ্ণা না আসে! কেনো এতো ভয় পাচ্ছে সেটাও মাথায় আসছে না! শুধু ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছে অজানা চিন্তায়!
টমটমে বসেই স্কুলের সামনে তৃষ্ণার জিপগাড়ি দেখেই ” আল্লাহ গো ” বলে উঠলো! ভাংগা গলায় ঢোক গিলল সে! টমটম স্কুলের সামনে থামতেই আনন্দ ভাড়া দিয়ে হাঁটা দিলো! পিছনে বাবলু তৃষ্ণার গাড়ি দেখে দৌঁড়! বেলো দ্রুততম গতিতে আনন্দের হাত ধরে টেনে হাঁটতে লাগলো! কিন্তু, পিছনে তৃষ্ণার আওয়াজে আনন্দ থেমে গেলো! সাথে বেলীকে ও থামতে হলো !
— আসসালামু আলাইকুম চাচা!
আনন্দ চোখের চশমা ঠিক করলো! তৃষ্ণার দিক তাকিয়ে, বড় এক হাসি দিলো..
— আলাইকুম আসসালাম বাবা! কি অবস্থা?
তৃষ্ণা আনন্দের পিছনে লুকানো বেলির দিক আঁড়চোখে তাকিয়ে দাঁত খিঁচিয়ে বলল..
— এইতো ভালো! আপনাদের কি অবস্থা?
— আল্লাহ রহমতে আছি ভালোই! তা কবে ফিরলে? শুনেছিলাম তোমার ছোট চাচার নামে নাকি খুনের মামলা হয়েছে?
— জ্বি! বিপক্ষের দল থেকে মিথ্যে মামলা! এখন ঠিক আছে! রিলিজডেট কোর্ট থেকে দিয়ে দিয়েছে ! আমি ফিরেছি ২ ঘন্টা হচ্ছে!
— আলহামদুলিল্লাহ এখন ঠিক আছে তাহলে তোমার চাচা! তা তুমি বাড়িতে গিয়ে রেস্ট না নিয়ে এখানে কি করছো?
— ও-ই তো আড্ডা দিচ্ছিলাম!
— তোমার বাবার আন্দলোনের সমস্যা ঠিক হয়েছে?
— হ্যাঁ! পরশু এসে ঠিক করে গিয়েছিলাম! বাবা আপনার সাথে দেখা করতে চান বলেছিলেন!
আনন্দ হেসে চশমা ঠিক করে জবাব দিলো..
— স্কুলের পরিক্ষা চলছে ত, তাই একটু বিজি! সময় করে দেখে আসবো বলিয়ো!
— জ্বি চাচা!
বেলী আঁড়চোখে তৃষ্ণার দিক তাকিয়ে বাবার হাত টানতে লাগলো! আনন্দ গাড়িতে বসে থাকে বাবলু কে ঝাড়ি দিয়ে উঠলো..
— ঘন্টা দিয়ে দিছে! তুই এখনো বসে?
বাবলু দ্রুত তৃষ্ণাকে ভাইয়া বলে, চোখে-চোখে বুঝালো ছুটি হলে গাড়িতে চড়বে! তারপর এক দৌঁড়ে স্কুলের ভিতর! বেলি তৃষ্ণার চাহনি দেখে আনন্দের হাত আরো টাইট করে ধরে টানতে লাগলো! আনন্দ হালকা হেসে তৃষ্ণা কে বলে উঠলো..
— বাসায় এসো বাবা সময় করে! ক্লাস শুরু হয়ে যাচ্ছে আসি!
তৃষ্ণা হাসার চেষ্টা করে মাথা নাড়ালো!
ক্লাসে বেলী একদম মনোযোগ দিতে পারলো না! তৃষ্ণার চিন্তায় আর শিলার ভয় দেখানো কথা বার্তায় আরো কুঁকড়ে গেলো! ক্লাস শেষে গেইট দিয়ে উঁকি দিলো! হ্যাঁ, এখনো গাড়ি দাঁড়িয়ে! গাড়ির উপর বসে সিগারেট খাচ্ছে! পিছনে আবিদ, অভি, আয়ুশ ও নিজেদের মতো শুয়ে, বসে রয়েছে! শিলা বেলীর পিছন থেকে দৌঁড়ে তৃষ্ণার গাড়ির সামনে হাজির! হাত দিয়ে বেলীকে দেখাতেই বেলি দ্রুত ভিতরে ঢুকতে নিলেই তৃষ্ণার গর্জন..
— স্টপ দেয়ার বেলী !
তৃষ্ণার চিৎকারে শুনে শিলা একটু দূরে চলে গেলো! তেমনি আবিদ, আয়ুশ, অভিও গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালো! বেলী সেখানেই স্ট্যাচু!
— সোজা সামনে এসে দাড়াবি! এখনি..
বেলী আঁড়চোখে আবিদের দিক তাকাতে তাকাতে এগোচ্ছে! আবিদ বেলির চেহরা দেখে হাত নাড়িয়ে বুঝালো সে কিছু করতে পারবে না! বেলী তৃষ্ণার সামনে এসে দাঁড়ালো মাথা নিচু করে!
— গাড়িতে বস!
বেলী চোখ বড়সড় করে তাকালো! তৃষ্ণা ভাড়ি আওয়াজে আবার বলল..
— দ্রুত..
শিলার দিক আড়চোখে তাকিয়ে, অন্যসাইডে গিয়ে গাড়িতে বসলো! তৃষ্ণা তার ভাইদের দিক তাকিয়ে বলল..
— হ্যান্ডেল করিস!
আবিদ ১০-১২ বার সমানে মাথা নাড়ালো! তৃষ্ণা চোখ উল্টিয়ে গাড়িতে উঠে পড়লো! বেলীর দিক তাকিয়ে চোখ-মুখ খিঁচে গাড়ি স্টার্ট দিলো! পিছনে মুখ হা করে শিলা তাকিয়ে রইলো! তার মাথায় কিছুই ঢুকলো না! বেলী পুতুলের মতো গুটিশুটি মেরে বসে রইলো! ভয়ে সে যে কোনো মুহুর্তে আউট ওফ ওয়ার্ল্ড হয়ে যাবে! গাড়ি চলতেই
শোঁ-শোঁ বাতাস শরীরে ছুঁয়ে দিতে লাগলো! বেলীর বিনুনি থেকে চুল আওলে_ঝাওলে হতে লাগলো! কাঁধের ব্যাগটা বারবার নাড়িয়ে-চাড়িয়ে অহেতুক কাহিনি করছে ভয়ে! হঠাৎ তৃষ্ণার আওয়াজে প্রায় সিট থেকে কেঁপে উঠলো..
— কথা বলতে থাক! আমার রাগ বাড়ছে!
বেলী অসহায় গলায় বলল..
— আ..আপনি এমন কেনো করছেন?
গাড়ির স্ট্রিং টাইট করে ধরে, গাড়ির ব্যাগ আরো বাড়িয়ে দিলো তৃষ্ণা..
— তুই আমার রাগ আরও বাড়াচ্ছিস! ভালো কিছু বল!
বেলী আঁড়চোখে তৃষ্ণার দিক তাকিয়ে থাকলো! কি বলবে ভাবতে লাগলো! সে আবিদ থেকে শুনেছিল! তৃষ্ণার রাগ মাথায় উঠলে আর রক্ষে নেই। একদম নেই। আশপাশ ভস্ম করে দেয়। তখন ভালো কিছু কথা বললে একটু কাজে দেয়! কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এখন বেলী কি বলবে! বড় এক শ্বাস নিয়ে মনের কথাটাই বলল..
— মিস করেছি!
গাড়ি ততক্ষণাত থেমে গেলো!
চলবে…
নাবিলা ইষ্ক