#প্রিয়কাহন❤️
#লেখিকা ‘কায়ানাত আফরিন’
#পর্ব |১৮|
‘ বাব্বাহ! পুত্রবধূর ঠিকানা পেয়ে একই সাথে শ্বশুড় দেবর, বর সবগুলো উড়ে এসে জুড়ে বসেছে। কাজি ডাকো আপু, এক্ষুণি বিয়ে সেরে ফেলো এই মুহূর্তকে স্মরণীয় বরণীয় রেখে। সাক্ষী নাহয় আমি থাকবো!’
মিথির কথাটা বলতেই দেরি, ঠাস করে মেয়েটার মাথায় বারি মারলো প্রিয়তা। মিথির খুশিতে ঝুমঝুম করা মুখ নত হয়ে গেলো। ঘটনাটি ঘটেছে কয়েক সেকেন্ডে। তাই প্রিয়তার নুরুল স্যার ওরফে হবু শ্বশুরমশায় এবং তার বাতাসে ফুলে ওঠা বাচ্চা দেবর তা দেখতে পারেনি। প্রিয়তা গম্ভীর কন্ঠে বললো,
‘ কেক খাওয়ার শব্দ ছাড়া তোমার মুখে যেন আর কোনো শব্দ না শুনি!’
মিথি আড়চোখে তাকালো। গদগদ করা মুখ এখন নিকষ কালো। হিম ধরা গলায় বললো,
‘ তুমি খুব খারাপ আপু৷ কই তোমার বিবাহের সাক্ষী হতে চেয়েছিলাম। আর তুমি সবাইকে সাক্ষী রেখে আমায় মারলে। পরে যদি আমার সাহায্যের দরকার পড়ে- আমার অনলাইন প্রেমিকদের কসম! জীবনেও তোমায় হেল্প করবো না।’
প্রিয়তা কঠিন চাউনি দিলো। তবে কিছু বললো না৷ হবু শ্বশুরমশায় ইতিমধ্যে এগিয়ে আসছেন। প্রিয়তা শশব্যস্ত হয়ে বললো,
‘ আসসালামু আলাইকুম!’
ভদ্রলোক আরও হাসলেন। এজন্যই হয়তো প্রিয়তাকে এত পছন্দ করেন তিনি। আজকালের মেয়েরা সালাম দেওয়া তো দূরে থাক, বড় কেউ এলে তাদের সম্মানার্থে একটু যে দাঁড়াতে লাগে তাও জানেনা৷ অথচ প্রিয়তা সেদিকে একেবারেই অন্যরকম। কলেজে পড়ানোকালীন সময় প্রিয়তাকে তিনি যখন দেখেছিলেন, তখনই বুঝেছিলেন- ভদ্রতার শিক্ষা এ মেয়ের চূড়ান্ত। নুরুল স্যার প্রতিউত্তরে বললেন,
‘ওয়ালাইকুম আসসালাম। কি অবস্থা প্রিয়তা? এই সময় এভাবে তোমার দেখা পাবো আশা করিনি৷’
প্রিয়তা একটু একটু করে চোখ বাকিয়ে অভীর দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। বাবার বাধ্যগত ছেলে অভীর ঠোঁটকোলে এখন একটা প্রগাঢ় হাসি৷ চোখে মুখে খেলা করছে কৌতুহলতা। প্রিয়তা অবনত হলো। বিভ্রান্ত হলো অভীর এমন কার্যকলাপে। ভদ্রলোককে বললো,
‘ আসলে আমার স্টুডেন্ট মিথিকে কেক খাওয়াতে নিয়ে এসেছিলাম এখানে।’
বলেই সে তাকালো মিথির দিকে। মিথি দু’গাল হেসে তাকে অভিবাদন জানাতে যাবে তখনই চতুরতার সাথে মিথির হাত চিমটে লাল করে দিলো প্রিয়তা। চোখ গরম করে ইশারায় বললো সালাম দিতে। মিথি সাথে সাথেই থতমত হয়ে হাসার চেষ্টা করে বললো,
‘স্লামালাইকুম আঙ্কেল!’
বিভৎস মেয়ে! সালাম কিভাবে দিতে হয় সেই আক্কেলটা পর্যন্ত মিথির কিশোরী মাথায় নেই৷ তবুও অভিভূত হলেন নুরুল স্যার৷ বললেন,
‘ বাহ! স্টুডেন্ট দেখি তোমার মতোই ভদ্র, বিনয়ী প্রিয়তা। কথায় আছে না, গুরু যেমন- শিষ্যও তেমন?’
প্রিয়তা শুকনো কেশে উঠলো। মনে মনে অত্যন্ত কুৎসিত গালাগাল দিলো যে এত বিশ্রি প্রবাদের রচনা করেছে। নুরুল স্যার যদি জানতো এই সুন্দরী কিশোরী পেকে ঝুরঝুরে হয়ে গিয়েছে এতক্ষণে মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকতো৷
শান্তনু এগুলো প্রিয়তার দিকে। বললো,
‘ এই আপু! তোমার কি আমার কথা মনে পড়ে না? আগে তো কত আসতে। আমার সাথে গল্প করতে, খেলা করতে! আর এখন তো তোমায় খুঁজেই পাওয়া যায় না।’
প্রিয়তা বললো,
‘ আরে সময় পাই না তো শান্তনু। একদিন আসবো সময় করে। ‘
ভদ্রলোক নিজের ছোটছেলের জন্য বেকারি থেকে পেস্ট্রি কেক আর বাড়িতে শুকনো খাবার হিসেবে টোস্ট বিস্কুট নিলেন। প্রিয়তারও চট করে মনে পড়লো বিস্কুট নেওয়ার কথা৷ ফুপি নিতে বলেছিলো তুশি রুশির জন্য৷ কিন্তু এখন নিলে ব্যাপারটা কটু দেখায় বিধায় আর নিলো না।
পুরোটা সময় বাবার আদর্শ ছেলে হয়ে রইলো অভী৷ ভয়ে হোক বা সম্মানেই, বাবার সামনে প্রিয়তার সাথে টু’কথা পর্যন্ত বললো না৷ মেয়েটার সাথে কথা বলার জন্য মনে ঝড় উঠলেও সে হয়ে রইলো সাগরের ন্যায় স্থির। মিথি বেরোলো প্রিয়তাকে নিয়ে বেকারী থেকে। বের হলো অভীরাও। নুরুল স্যার বললেন,
‘ এত ব্যাগ নিয়ে যেতে পারবে?’
প্রিয়তা দু’হাতে ভরপুর ব্যাগের দিকে তাকালো। আজ সকালেই মিথির মা এগুলো দিয়েছেন প্রিয়তাকে বাসায় নিয়ে যাওয়ার জন্য। মিথির গ্রাম থেকে কি দেওয়া হয়েছে কে জানে? প্রিয়তা বিনয়ী হয়ে বললো,
‘ সমস্যা নেই স্যার, মিথি আছে তো? একটা রিক্সা চেপে বাসায় যেতে পারলেই হবে।’
লাফিয়ে উঠলো মিথি। খপ করে বললো,
‘ কি বলো আপু? আমার তো কোচিং আছে। আমি তোমার সাথে এত নাদুসনুদুস ব্যাগ নিতে পারবো না।’
ডাহা মিথ্যে কথা। প্রিয়তা রাগে থমথমে হয়ে গেলো এবার। তবে কিছু বলতে পারলো না৷ নুরুল স্যার তারপর গম্ভীর হয়ে একবার দেখে নিলেন অভীকে৷ তারপর বললেন,
‘ ওকে বাসায় দিয়ে আয় অভী!’
প্রিয়তা এর জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলো না৷ কিছু বলার আগেই বাধ্য ছেলের মতো একটা রিক্সা ডাকলো সে। প্রিয়তা তাকালো মিথির দিকে করুন চোখে। মিথি রাজ্যজয়ী হাসি হেসে চলে গেলো। চোখেই জানান দিলো এটাই হলো প্রিয়তার তার মাথায় বারি দেওয়ার শাস্তি৷ প্রিয়তা হতাশার শ্বাস ছাড়লো৷ সময় সবারই একসময় আসে। তখন সে জিতলেও এখন মিথি জিতলো। হতাশায় আষ্টেপৃষ্টে ডুবুডুবু জল খাওয়ার আগেই প্রিয়তাকে রিক্সায় উঠতে বললো অভী। ব্যাগগুলো হাতে নিয়ে সযত্নে রেখে প্রিয়তার পাশে বসে পড়লো। অন্য রিক্সা নিয়ে বাড়ির দিকে চলে গিয়েছে নুরুল স্যার। অভী পাশে বসা মাত্রই প্রিয়তা অস্বস্তিতে গাট হয়ে বসে রইলো।
__________
ভর দুপুরে তপ্ত গরমের খেলা। পুরো সড়ক নীরব। আজ সময়টা যেন খুব দীর্ঘ আর ধীরগতির মনে হচ্ছে। অভীর পাশে আধঘন্টা ধরে বসে থাকা প্রিয়তার মনে হচ্ছে রিক্সা বুঝি বহু সময় ধরে চলমান।
এর মধ্যে অভী কথা বললো না কোনো। শুধু নীরবে শশব্যস্ত হয়ে রইলো। তবে এখন আচমকা বললো,
‘ বাচ্চা মেয়েটাকে খামোখা মারলে কেন তখন?’
‘ আপনি দেখেছেন?’
প্রিয়তার চমক গলা। অভী হাসলো। বললো,
‘ বাবা আর শান্তনু ছাড়া আমি মনে করি সবাই দেখেছে।’
কথা খুঁজে পেলো না প্রিয়তা। কি বলবে এখন সে? বলা উচিত যে মিথি কাজী ডেকে বিয়ের কথা বলেছে? জীবনেও না। যেদিকে অভীকে দেখলে এখন ওর লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করে সেখানে এসব কথা ও বলতেই পারবে না৷ তাই চোখ রাঙা করে বললো,
‘ ও নিশ্চয়ই এমন কাজ করেছে যার জন্য আমি মেরেছি, সেটা আপনার না জানলেও চলবে কেমন? বাসায় দিয়ে আসার কথা৷ চুপচাপ দিয়ে এসে ভদ্র ছেলের মতো বিদায় নিবেন।’
কথাটা নিজেই বলে থম খেলো প্রিয়তা৷ নিজের কাছেই কথাটি বিদ্ধ করলো তীরের মতো। এমনি এক ধরনের ধারালো সংলাপ অভী সবার সামনে ছুড়েছিলো। বলেছিলো যে, ‘দেখতে এসেছো, দেখে চলে যাও।’ প্রিয়তার কষ্ট লেগেছিলো খুব। অজান্তেই কেঁদেকেটে ঘর একাকার করেছিলো। এর জন্য অভীকেও তো কম কষ্ট দেয়নি ও আর অদ্রি মিলে। ইউনিভার্সিটিতে, ক্লাসে -সবজায়গায় চোখাচোখি হওয়া মাত্র নির্বিকারে তাকে এড়িয়ে চলে যেত। আর আজ কি করলো সে? সেই একই কাজ করলো অভীর মতো৷ শুধু পরিস্থিতি ভিন্ন। তবে প্রিয়তাকে অবাক করে দিয়ে অভী কোনো প্রতিক্রিয়া করলো না৷
শীতল চোখে, নির্বিঘ্নে তাকালো প্রিয়তার দিকে। পথ নীরব। দুধারে সবুজে আচ্ছাদিত গাছপালায় পড়ছে হলদে আলোর ছটাক। অভী গম্ভীর কন্ঠে বললো,
‘ বিদায় নিলে অনেক আগেও বিদায় নিতাম তোমার কাছ থেকে প্রিয়তা৷ বিদায় যেহেতু নেইনি এর মানে কি বুঝো?’
প্রিয়তা ভীমড়ি খেলো। কথা বলা ভুলে গেলো। হৃদয়ে লাগিলো তোলপাড়। আমতা আমতা করে বললো,
‘ অভী….আপনি…?’
অভী হেসে দিলো প্রিয়তার হতভম্ব মুখ দেখে। উজ্জল গায়ের গড়নে লালচে আভার ছটাক। মোহনীয় আখিতে দগদগ করছে উত্তেজনা। মেয়েটা বোকা, অল্পতেই হতভম্ব হয়, তবে সেই দরুন যখন কপালে, নাকে ঘামে শিশির বিন্দুর মতো পানি জমে- দারুন লাগে নিশ্চিত। যদি আল্লাহ চাইলে কখনোও ওদের বিয়ে হয়, এই রূপময়ী নারীকে শাড়িতে দেখে সে ঘায়েল হবে। শত সহস্রবার ঘায়েল হবে।
অভী পকেট থেকে একটা চকলেট বের করলো। এগিয়ে দিলো প্রিয়তার হাতে। প্রিয়তা তখনও বিষ্ময়ে। বাকশক্তি হারিয়েছে পরিস্থিতির কবলে। সে তাকালো হাতে থাকা চকলেটের দিকে। বিশাল বড় চকলেট, হয়তো অভী জানে প্রিয় এই দুর্বলতার কথা৷ অভীর দিকে তাকিয়ে বললো,
‘ এটা কেন?’
অভী প্রতিউত্তর দিলো না। বললো,
‘ মামা রিক্সা থামান।’
রিক্সা হঠাৎ থামিয়ে দিলো মামা। বললো,
‘ এখানেই নামবেন?’
অভী তাকে এগিয়ে দিলো ২০ টাকার নোট৷ বললো,
‘ চা খেয়ে আসেন মামা। বাকি টাকা রেখে দিয়েন নিজের কাছে। আমরা একান্তে একটু কথা বলবো।’
ভড়কে গেলো প্রিয়তা। হয়তো রিক্সাওয়ালাও। এমন ছেলে ইহজিন্দেগিতেও সে দেখেনি৷ এমন একান্ত কথা তো আজকাল সিনেমাহলে, পার্কে, রেস্টুরেন্টেই করা যায়- কিন্তু এভাবে রিক্সা একা রেখে চা খেতে যেতে বলাতে রিক্সাঅলার মন খচখচ করতে লাগলো৷ বললো,
‘ কিন্ত ভাইজান! ‘
‘ আরে রিক্সা চুরি করবো না মামা। আপনি যেতে পারেন নিশ্চিন্তে। ‘
কেন যেন ছেলেটাকে বিশ্বাস করলো রিক্সাওয়ালা৷ পান খাওয়া দাঁতে হাসি দিয়ে চলে গেলো সে। প্রিয়তা ভয়ে সিটিয়ে গেলো৷ একে তো ভরদুপুর। রাস্তায় একটা কুকুরও নেই, মানুষ তো দূরের কথা। একপাশে মোনালী পার্ক, তারই উত্তরদিকে বলাকা লেক। দুপুর হলেও ভ্যাপসা বাতাস আসছে সেখান থেকে। হলদে আলো আর সবুজের খেলায় অভীর চোখ দেখে প্রিয়তার হৃদয়ে তোলপাড় লাগলো পুনরায়। কিন্তু ভয়টাকে প্রকাশ্য রেখেই সে বললো,
‘ তাকে চলে যেতে বললেন যে?’
অভী সে কথার প্রতিউত্তর না দিয়ে বললো,
‘ আমায় অপছন্দ করো তুমি?’
প্রিয়তা কথার উত্তর খুজে পেলো না৷ মনে হলো কেউ গলা চেপে রেখেছে।
‘ কি হলো বলো?’
‘ করতাম।’
চট করে বললো প্রিয়তা। বলেই বোকা বনে গেলো। অভীর চোখের অতলে এতটাই হারিয়ে গিয়েছিলো যে সে খেয়াল করেনি ব্যাপারটা। অভীর চোখ প্রগাঢ় হলো। বললো,
‘ আর এখন? এখন পছন্দ করো?’
প্রিয়তা নিশ্চুপ৷ নিশ্চুপ আধাঁরের স্তব্ধতার মতো। উত্তেজনা গ্রাস করলো তাকে। অভীর বুদ্ধিমান চোখ চটপটে বুঝে নিলো এর মানে। তাই চোখে খেলা করলো মাদকতা। হুট করেই সে এগিয়ে গেলো প্রিয়তার দিকে৷ প্রিয়তা পাথর হলো। হারিয়ে ফেললো নিজের চটপটে বুদ্ধি। নিঃশ্বাস প্রগাঢ় হয়ে এলো। দ্বিধা নিয়ে বললো,
‘ কি করছেন?’
অভী দেখছে প্রিয়তার ভয়ার্ত মুখ। এই মেয়েটা ভয় পায়৷, অল্পতেই একটু বেশি ভয় পায়। আজ তার কি হয়েছে সে নিজেও জানেনা। শুধু ঘোরগ্রস্ত কন্ঠে কানের কাছে ঝুঁকে বললো,
‘ সরি প্রিয়তা। রিয়েলি রিয়েলি সরি সেদিনকার মিসবিহেভ এর জন্য।’
কানে এসে ধাক্কা দিলো অভীর উত্যপ্ত নিঃশ্বাস। কথাগুলো বেজে উঠলো নুপুরের ন্যায়। থমকে আছে সময়। প্রিয়তার মনে হলো সে স্বপ্নে ভাসছে। একটা সুন্দর স্বপ্ন। অভী এখনও সরেনি প্রিয়তার কাছ থেকে। কথা না বলে তাকিয়ে থাকলো মেয়েটার দিকে। এ চোখ স্পষ্ট জানান দিচ্ছে অন্যকিছুর। এমন কোনো গল্প যেটা মোহনীয়। এর নাম কি তাহলে…’প্রিয়কাহন?’ আনমনেই আওড়ালো শব্দটা প্রিয়তা। অতঃপর আলতো হাসলো। আজ, মাসের ২১ তারিখের এই হলদে ভরদুপুরটা সাক্ষী হয়ে রইলো শুধু এক অপ্রেমিকের অভিমান ভাঙানোর গল্প হিসেবে……
.
.
.
.
.
#চলবে