#প্রেম_তুমি
ফাবিহা নওশীন
পর্ব-১৪
ভর দুপুর। মাথার উপর তেজস্বী সূর্য তার উত্তাপ ছড়াচ্ছে। অর্ষা চুপচাপ বসে আছে কলেজের পেছনটায়। ভর দুপুরে পিনপতন নীরবতা বিরাজ করছে। সেখানে মাথার উপর বড় বড় পাম আর আম গাছ রাজত্ব করছে। পায়ের নিচে ছোট ছোট ঘাস লতা। দেয়াল ঘেঁষে একটা ছোট ঝোপের আনাগোনা। আম গাছে মৌমাছির চাঁক। মৌমাছি চাঁকের চারদিকে উড়ে বেড়াচ্ছে। অর্ষা বড় আম গাছের শেকড়ে বসে এক মনে সেদিকে চেয়ে আছে। ভর দুপুরে এই নিশ্চুপ পরিধিতে পাতার মরমর শব্দে অর্ষা চমকে গেল। চমকে গিয়ে চট করে পেছনে ঘুরল। দর্শন চিন্তিত আর বিমর্ষ মুখে অর্ষার দিকে আসছে। দর্শনের কপালে ভাজ পড়েছে। বিরক্ত আর রাগ ভ্রু যুগল, চোখ, ঠোঁট, নাক, গালসহ পুরো মুখে ছড়িয়ে পড়েছে।
অর্ষা ওকে দেখে মুখ ফিরিয়ে নিল। বুকের ভেতর চাপা যন্ত্রণাটা আবার চড়া দিয়ে উঠল।
দর্শন ঠিক ওর পেছনটাই দাঁড়িয়ে বলল,
“এসবের মানে কী অর্ষা? এখানে বসে আছো কেন? এটা তোমার বসার জন্য উপযুক্ত জায়গা বা সময় কোনটাই না। জানো কত বিপদ হতে পারত?”
অর্ষা মুখ ফিরিয়ে রেখেই মলিন হাসল। তারপর তাচ্ছিল্য করে বলল,
“চিন্তা করো না মরব না। মরার হলে মায়ের সাথেই মরে যেতাম। প্রাপ্ত বয়স্ক শক্তপোক্ত মানুষটা মরে গেলেও একদিন পূর্ণ না হওয়া অসহায়, দূর্বল বাচ্চাটা বেঁচে গেছে সেখানে এখন কীসের ভয়?”
অর্ষার অভিমানী কথাগুলো দর্শনকে নরম করে দিল। দর্শন ওর পাশে গিয়ে বসল। অর্ষা একটু নড়ে-চড়ে বসল। হাতটা গুটিয়ে নিল কিন্তু দর্শনের দিকে তাকাল না। দর্শন এক দৃষ্টিতে ওর দিকে চেয়ে আছে।
তারপর আকুলতা নিয়ে বলল,
“এসব কেন বলছো অর্ষা? তোমার কথাগুলো আমাকে কষ্ট দিচ্ছে।”
অর্ষা যথাসম্ভব চেষ্টা করছে কান্না আটকানোর। কিন্তু পারল না। চোখে পানি এসে পড়েছে। গলা ধরে আসছে। বুক ভারি হয়ে গেছে। ধরা গলায় বলল,
“কষ্ট হয়? যখন তোমার বন্ধু আমাদের সম্পর্ক নিয়ে ভবিষ্যৎ ধারণা দিল তখন তোমার কষ্ট হয়নি? যখন সবাই আমার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টি দিল তখন তোমার কষ্ট হয়নি? আমার অপমান চুপচাপ মেনে নিতে কষ্ট হয়নি? আমি কষ্ট পাচ্ছি বুঝেও তোমার কষ্ট হয়নি? তাহলে এখন কেন হচ্ছে?”
অর্ষার গাল বেয়ে পানি পড়ল। অর্ষা ডান হাত উল্টো করে গালের পানি মুছে বলল,
“কষ্ট তো আমার হয়েছে যখন তোমার চোখে অনিশ্চয়তা আর আমাকে নিয়ে ভীতি দেখেছি। কষ্ট তো তখন হয়েছে যখন তোমার চোখে অবিশ্বাস আর সন্দেহ দেখেছি। তোমার ওই দৃষ্টি আমাকে ক্ষত-বিক্ষত করে দিয়েছে।”
দর্শন দু’হাতে অর্ষার ডান হাত জড়িয়ে ধরে বলল,
“অর্ষা, কিছু সময়ের জন্য আমি ভয় পেয়েছি কিন্তু তোমাকে অবিশ্বাস করিনি। ট্রাস্ট মি প্লিজ। লুক, যারা সত্যিকারের অর্থে ভালোবাসে তারাই ভালোবাসা হারানোর ভয় পায়। আমিও পেয়েছি। তুমি আমার ভয় দূর করে দেও প্লিজ। আমি আর কিচ্ছু চাইনা।”
অর্ষা কথা বলছে না। এখনো কাঁদছে। দর্শন ওর চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল,
“ডোন্ট ক্রাই প্লিজ। যদি ভুল করে থাকি তবে সরি।”
অর্ষা ওর চোখে চোখ রেখে বলল,
“জন্মের সময় মা আমাদের বাবা-মেয়েকে নিঃস্ব করে চলে গেছেন। তাদের প্রেমের বিয়ে হওয়ায় শুধুমাত্র বাবার আদরে বড় হয়েছি। বাবা ছাড়া কারো ভালোবাসা পাইনি আর কাউকে ভালোবাসার সুযোগ পাইনি। আমি যদি তোমাকে ভালো না বাসতাম, না চাইতাম তবে এতদিন তোমার জন্য অপেক্ষা করতাম না। তোমার পেছনে যত সময় ব্যয় করেছি ততদিনে আমার একটা রিলেশনের দু’বছর হয়ে যেত। আমি তোমাকে সত্যিকারের অর্থে ভালোবেসেছি তাই অপেক্ষা করেছি। সেই ক্লাস টেনে তোমাকে প্রথম দেখেছি। তখন থেকে তোমার পেছনে পড়ে আছি….
দর্শন কিছুটা বিস্ময় নিয়ে বলল,
” ক্লাস টেন? আমি তো ভেবেছি কলেজ থেকে।”
“না, জানুয়ারি মাস। সেদিন আমাদের টেনের স্টুডেন্টদের ভর্তি ডেট ছিল। তুমি এসএসসি পরীক্ষার্থী। কোন একটা দরকারে তোমার বাবার সাথে স্কুলে এসেছিলে হেড স্যারের সাথে কথা বলতে। আমিও গিয়েছিলাম স্যারের রুমে। তুমি আর তোমার বাবা থাকায় আমাকে ওয়েটিংয়ে বসিয়ে রাখা হলো। তখন তোমাকে প্রথম দেখি। তুমি হেসে হেসে স্যারের সাথে কথা বলছিলে।”
অর্ষা কথাগুলো বলার সময় মনে হচ্ছিল অন্য জগতে বিরাজ করছে। ওর চোখেমুখে হাসির রেখা।
“আরে, এতগুলো দিন যদি অপেক্ষা করতে পারি তবে তুমি কী আমার উপর একটু ভরসা রাখতে পারবে না?”
“ওকে। আমি ভুল করেছি। আ’ম সরি। তবে প্লিজ আমাকে কখনো ছেড়ে যেও না।”
অর্ষা ওর আকুলিত চোখের দিকে তাকাল। তারপর বলল,
“ছাড়ব না। ছেড়ে যাব না। তুমি প্লিজ কখনো আমাকে ছেড়ে যেও না। আমাকে কখনো অবহেলা, অবজ্ঞা করো না। আমি কারো অবহেলা মেনে নিতে পারি না।”
“অবহেলা কেন করব? একটা সম্পর্কে একে অপরকে স্পেস আর সাপোর্ট দেওয়া দুটোই প্রয়োজন যা আমরা দু’জন দুজনকে দেব। তখন অবহেলা করার প্রশ্নই আসে না।”
“অবহেলা! অবহেলা হলো ধরো তুমি যদি কখনো আমাকে তোমার লাইফে সেকেন্ড অপশনে রাখলে অথবা আমার জন্য তোমার ফার্স্ট প্রায়োরিটির কোন ক্ষতি হলো অথবা তোমার মন পালটে গেল।”
“এমনটা কেন হবে? এমনটা কখনো হবে না। আমি অনেক ভেবেচিন্তে এই সম্পর্কে এসেছি। আমি টাইম পাস করার জন্য তোমার সাথে আছি তা নয়। কিংবা দু,চার-পাঁচ বছর তোমার সাথে কমিটেড থাকব তাও নয়। আমি তোমার সাথে সারাজীবন থাকতে চাই এজ হাসব্যান্ড ওয়াইফ। কারণ আমি মনে করি আমার লাইফ পার্টনার হওয়ার সব এবিলিটি তোমার আছে। কিছু এদিক সেদিক আছে সেটা সময়ের সাথে ঠিক হয়ে যাবে অথবা ঠিক করে নেব। আমি এইচএসসি পাস করে ডাক্তারি পড়ব। তারপর ভালো একটা হসপিটালে জয়েন করব। জয়েন করেই বিয়ে করব। ভালো ক্যারিয়ার হবে সে আশায় বসে থাকব না। যদি তোমার না প্রব্লেম থাকে। বিয়ের পরেও পছন্দসই ক্যারিয়ার পড়া যায়।”
অর্ষা ওর দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে। কেমন সব গুলিয়ে যাচ্ছে। দর্শন কতদূর পরিকল্পনা করে ফেলেছে। অর্ষা তো কোন পরিকল্পনা করেনি। ওর-ও কি পরিকল্পনা শুরু করে দেওয়া উচিত? কিন্তু কী পরিকল্পনা করবে?
দর্শন তো বিয়ের পরিকল্পনা করেছে। তাহলে ও কী পরিকল্পনা করবে? বাচ্চাকাচ্চার? আচ্ছা ক’টা বাচ্চা হবে ওদের? একটা, দুইটা না তিনটা? না দুইটাই ঠিক আছে। একটা ছেলে একটা মেয়ে। পারফেক্ট। কিন্তু ছেলে মেয়ের কী নাম হবে? অবশ্যই ইউনিক হতে হবে। আজ সারা রাত নাম ভাববে। কিন্তু প্রথমে ছেলে হবে না মেয়ে?
অর্ষা প্রশ্নটা দর্শনকেই করে বসল,
“আচ্ছা আমাদের প্রথমে ছেলে হবে না মেয়ে?”
অর্ষা সিরিয়াস ভঙ্গিতে চেয়ে আছে। দর্শন ওর কথা আর ভঙ্গিমা দেখে ভরকে গেল। তারপর খুক খুক করে কাশতে লাগল। অর্ষা দুম করে এমন একটা প্রশ্ন করে বসবে সেটা ভাবতেও পারেনি দর্শন।
ওর কথার উত্তর না দিয়ে একে বসা থেকে টেনে তুলল। তারপর বলল,
“এ-সব পরে ভাবা যাবে৷ এখন এখান থেকে চলো। আর কখনো এখানে একা একা আসবে না। যদি আসো তাহলে ভালো হবে না। আমি কিন্তু প্রচণ্ড রেগে যাব।…..
দর্শন নিজের মতো করে আরো কিছু বলছিল। কিন্তু অর্ষার কানে পৌছাল না। ও ভাবছে কিছুক্ষণ আগের কথা। হুট করে লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে দর্শনকে কি প্রশ্ন করে ফেলল। এখন তো চোখের দিকে তাকাতেও লজ্জা লাগছে। দর্শন ইচ্ছে করেই ব্যাপারটা এড়িয়ে গেল কিন্তু অর্ষার হুশ হলো প্রশ্ন করার পর। আগে কেন হলো না? দর্শন মনে মনে কী ভাবছে? ছিঃ ছিঃ।
……
অর্ষা অনেক ভেবেচিন্তে সাহস করে প্রিতমের কথা বাবাকে জানিয়েছে। ছেলেটা আজকাল বড্ড বিরক্ত করছে। আগে ছাদে গেলে বিরক্ত করত। তাই ছাদে যায় না। একটার পর একটা সিম দিয়ে কন্টিনিউয়াসলি বিরক্ত করে যাচ্ছে। অর্ষা নিজের সিমটা পাল্টাতে পারছে না। বাবাকে কি রিজন দেখাবে? তাই আজ বাবাকে বলেই দিয়েছে ওর কথা। অর্ষার বাবা প্রিতমের বাবাকে বাসায় ডেকে জানিয়েছে ব্যাপারটা। তিনি বলেছেন এর একটা সমাধান করবেন। ভদ্রলোক প্রায়ই ওদের বাসায় এসে বাবার সাথে গল্প করে। আজও এসেছে। কি সমাধান করলেন তাই জানাতে। আগের মতোই অর্ষা সালাম দিয়ে ঘরে চলে যায়। বুয়া চা নাস্তা দিয়ে নিজের কাজে চলে যায়।
ফ্রিজ থেকে পানি নিতে এসে হঠাৎ করে দাঁড়িয়ে পড়ল অর্ষা। ওর কানে কিছু একটা ভেসে এল। চাপা কন্ঠস্বর বোঝার জন্য অর্ষা কান পেতে রাখল।
“আপনি কী বলছেন বুঝতে পারছেন? আমার মেয়ে এখনো ছোট। এখনো আঠারো হয়নি। সতেরোতে পড়েছে। আপনার ছেলে ওকে প্রেম ভালোবাসার কথা বলছে। প্রেম ভালোবাসার বয়স কি ওর হয়েছে? আমার মেয়ের এ-সব নিয়ে কোন জ্ঞান নেই। ও আরেকটু বড় হবে। বুঝতে শিখবে। তখন আমিও ওকে বাঁধা দিতে পারব না। কিন্তু যতদিন পর্যন্ত আমার মেয়ে বলবে বাবা আমি ডিস্টার্ব ফিল করছি হেল্প করো। আমি করব।”
“আমি জানি আপনি ওকে খুব ভালোবাসেন। আর অর্ষা মেয়ে হিসেবে খুবই ভালো। ওকে আমার ভীষণ পছন্দ। প্রিতম যখন ওকে….
” দেখুন প্রিতম নাহয় অবুঝ কিন্তু আপনি এই কথা কী করে বলছেন? অর্ষা ছোট। ভালো মন্দ বোঝার বয়স হয়নি। যখন হবে তখন প্রিতমকে ওর ভালো না-ও লাগতে পারে। এখুনি যখন ভালো লাগে না পরে লাগার সম্ভাবনা দেখছি না।”
“বড় হলে তখন সব ঠিক হয়ে যাবে। প্রিতম ছেলে খারাপ নয়। আপনিও জানেন। ওদের বিয়েটা ঠিক করে রাখলে….
” আমি পারব না। অর্ষা আমার একমাত্র মেয়ে। ও যা চাইবে তাই হবে। ও যদি বড় হবার পর বলে প্রিতমকে বিয়ে করবে আমি আপত্তি জানাব না। কিন্তু অর্ষার অমতে প্রিতমের সাথে কিছুতেই আমি বিয়ে ঠিক করে রাখব না। প্রয়োজনও মনে করছি না। আপনি প্লিজ এসব নিয়ে আর কথা বাড়াবেন না। প্রিতমকে বলবেন ও যেন আর আমার মেয়েকে বিরক্ত না করে। আমার মেয়েকে বিরক্ত করলে আমি স্টেপ নিতে বাধ্য হব। আমার কাছে আমার মেতের ভালো থাকাটা সবচেয়ে বেশি জরুরি। ”
অর্ষা প্রিতমের বাবার প্রস্তাব শুনে তব্ধা খেলেও বাবার কথা শুনে স্বস্তির নিঃশ্বাস নেয়।
…..
অর্ষা প্রিয়াকে সব জানানোর পর প্রিয়াও তব্ধা লেগে আছে৷ প্রিতমের বাবা সমাধান হিসেবে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছে। ওর কেন জানি হাসিও পাচ্ছে। প্রিয়া উচ্চস্বরে হাসতে লাগল। অর্ষা ওর হাসি দেখে বলল,
“হাসতে থাক৷ আঠারো হতে দে।”
“আঠারো হলে কী করবি? আংকেলকে তোর আর দর্শনের রিলেশনের কথা জানাবি?”
“আরে নাহ! সে-সব জানাবো কেন?”
“তাহলে?”
“কয়েকদিন পর আমার সতেরো হবে তারপর আঠারো। আঠারো হলেই দর্শনকে ব্ল্যাকমেইল করে বিয়ে করে ফেলব।”
প্রিয়া ওর কথা শুনে হাসতে লাগল। তারপর বলল,
“মানুষ ঠিকই বলে। প্রেমে পড়লে মানুষ বেক্কল হয়ে যায়। তুই ও তাই। তোর আঠারো হলেই কী দর্শন বিয়ে করতে পারবে?”
“কেন পারবে না? ”
“কারণ তোর আঠারো হলে দর্শনের একুশ হবে না। আর ওর একুশ না হলে বিয়ে করতে পারবে না।”
অর্ষার এতক্ষণে খেয়াল হলো। আসলেই বুদ্ধিশুদ্ধি সব খেয়ে ফেলছে। নিজের মাথায় নিজেরই বারি মারতে ইচ্ছে করছে।
“এতদিন প্রেম প্রেম করে পাগল হয়েছিস আর এখন বিয়ে বিয়ে করে পাগল হবি। দুদিন পর বাচ্চা বাচ্চা করে পাগল হবি।”
অর্ষা মনে মনে বলছে আসলেই পাগল আমি। কারণ আমি বাচ্চা নিয়েও পরিকল্পনা করে দর্শনের কাছে ফেঁসেছিলাম। অর্ষা বিরক্ত নিয়ে বলল,
“ধুর! সরকার ছেলেদের বিয়ের বয়স একুশ কেন করল? ওদের কি বিয়ে করতে ইচ্ছে করে না?”
প্রিয়ার মাথায় হাত ওর কাণ্ডকারখানা দেখে।
আগাম একটা করে বেশি পর্ব পড়তে চাইলে আমাকে এক্ষনি ফ্লো করুন ✊🖐️
চলবে……