প্রেম_তুমি পর্ব ২৮ শেষ

#প্রেম_তুমি
ফাবিহা নওশীন
পর্ব-২৮ শেষ

_____________

জানুয়ারি মাস। এলোমেলো ভাবে কেটে গেছে অনেকগুলো দিন। যতই মাসটা বহমান ততই শীতের প্রকোপ বাড়তে লাগল। কুয়াশায় আচ্ছন্ন থাকে পুরো শহর। মাঝেমধ্যে রোদের উঁকিঝুঁকি। ভোরবেলা দর্শন বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। গায়ে পাতলা টি-শার্ট। শীতের প্রকোপ যেন ওর গায়ে লাগছেই না। লোকজন রাস্তায় জড়োসড়ো হয়ে হাঁটছে। শিক্ষার্থী আর অফিসগামী মানুষের আনাগোনা ছাড়া আর মানুষ দেখা যাচ্ছে না। আকাশ থেকে টিপটিপ করে বৃষ্টির ন্যায় পানি পড়ছে। দর্শনের খুব ইচ্ছে অর্ষার সাথে এমন একটা সকালে কাঁপতে কাঁপতে কোন এক টং দোকানে গিয়ে চা খাবে আর গল্প করবে। চোখের সামনে ভেসে উঠছে সে দৃশ্য। জানুয়ারির উনিশ তারিখে অর্ষার জন্মদিন। সেদিন একটা সারপ্রাইজ রাখবে অর্ষার জন্য। সমস্ত মান-অভিমান, গ্লানি মিটিয়ে নিবে সেদিন। তারপর আবারও এক সাথে পথ চলা। সুখে-দুঃখে একে অপরের সাথে ছায়া হয়ে থাকবে। অর্ষাকে আর কখনো কষ্ট দেবে না। চোখের তারায় রাখবে ওকে। এসব ভাবতেই দর্শনের মুখে হাসি ফুটল। পরক্ষণেই বুক ভারি হয়ে গেল। হঠাৎ করেই অন্তর-আত্মা কেঁপে উঠল। আজ টেস্ট পরীক্ষার রেজাল্ট দিবে। কি হবে জানা নেই। তবে রেজাল্ট খুব একটা ভালো হবে না সে কথা জানা আছে। বাবা রেজাল্ট দেখে হয়তো খুব বকবে। মা সামলে নিবে। আবারও ঘুরে দাঁড়াবে দর্শন। পুরো দমে পড়াশোনা করবে। সারাদিন পড়বে। দিন-রাত এক করে নিজের বুকের ভেতর লালিত স্বপ্নটাকে সত্যি করবে। চমকে দিবে সবাইকে।

….

কলেজে এসেছে আজ সবাই। দীর্ঘদিন পর বন্ধুদের সাথে দেখা। দীর্ঘদিন বলতে এক সপ্তাহ। টেস্ট পরীক্ষার পর সবাই পড়াশোনা নিয়ে এত ব্যস্ত যে কোথাও মিট করার সময় পায়নি। আজ রেজাল্টের উছিলায় দেখা হবে সবার। অর্ষার সাথেও দেখা হবে। দুদিন আগেও ওর বাসায় গিয়েছিল কিন্তু অর্ষা দেখা দেয়নি। দরজাই খোলেনি কেউ। কিন্তু কলেজে গিয়ে দর্শন হতাশ অর্ষা না-কি লাস্ট দুইদিন ধরে কলেজে আসছে না। কেন আসছে না জানা নেই। দ্বিতীয় বার হতাশায় নিমজ্জিত হলো যখন নিজের রেজাল্ট জানতে পারল। রেজাল্ট খারাপ হবে কিন্তু এত খারাপ হবে সেটা কল্পনার বাইরে। স্যার মেম, বন্ধুবান্ধব সবাই ওর রেজাল্ট দেখে হতবাক। পাঁচ সাবজেক্টে ৫০ এর ঘরে মার্ক পেয়েছে। বাকিগুলো ৭০-৮০-৯০ এর ঘরে। স্যার ওকে ডেকে পাঠিয়ে এহেন রেজাল্টের কারণ জানতে চাইল কিন্তু দর্শন কোন উত্তর দিতে পারেনি। তারা ওর এইচএসসি রেজাল্ট নিয়ে বেশ সন্দিহান। যাকে নিয়ে এত আশাভরসা ছিল সে তীরে এসে তরী ডুবিয়ে সমস্ত আশা ভঙ্গ করে দিল।

___________

দর্শন মাথা নিচু করে বসে আছে। নিজেই বেশ বিস্মিত ও অখুশি। সেখানে বাবা-মা, বন্ধুবান্ধবকে দোষ দিয়ে কী হবে। তামিম তো রেজাল্ট দেখে বলেই ফেলল বলেছিলাম আমার কথা শুনিসনি। সবাই তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে উড়িয়ে দিয়েছিলি। এখন যা আরো চারটা প্রেম করে যেটুকু বাকি আছে সেটুকুও শেষ করে দে। দর্শনের বাবাকে ডেকে পাঠিয়েছিল কলেজ থেকে। এত ব্রাইট একজন স্টুডেন্ট যে সব সময় টপ করে এসেছে তার এহেন রেজাল্ট দেখে সবাই চিন্তিত। এমন রেজাল্ট করার কারণ খুঁজে পাচ্ছে না। ক্লাসে মনোযোগী ছিল, পড়াশোনাও ভালো চলছিল কিন্তু রেজাল্ট! ওকে যেন গার্ড দেয়, ওর সমস্যা অনুসন্ধান করে ওকে পড়াশোনার প্রতি মনোযোগী করে তোলার জন্য দর্শনের বাবাকে ডেকে পাঠিয়েছে।

দর্শনের বাবা চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করেছে। খারাপ রেজাল্ট করে ছেলের মনে যে ঝড় বইছে সেটা বোঝার চেষ্টা করছে না। তিনি শুরু তার জবাব চাইছেন। ছেলের মানসিক অবস্থা না বুঝেই বারবার জিজ্ঞেস করছে,
“কী সমস্যা তোর? এমন বোবার মতো বসে আছিস কেন? কথা বলতে পারিস না? কলেজ থেকে বলে দিয়েছে তোর সমস্যা কী জানতে। কিন্তু তোমার ছেলে যেমন মৌনব্রত করেছে তাতে কিছু জানা সম্ভব না।(দর্শনের মাকে উদ্দেশ্য করে শেষ লাইন)

দর্শনের মাও বেশ বিরক্ত। প্রথমত এমন রেজাল্ট করেছে তার উপর চুপ করে আছে। এত প্রশ্ন করছে একটা উত্তরও দিচ্ছে না।
” এটাকে কি বলে জানো? বেয়াদবি। এতগুলো প্রশ্ন করছে তুমি একটা উত্তরও দিচ্ছো না। কেন?”

দর্শন এইবার এক কথায় উত্তর দিল,
“কারণ আমার কিছু বলার নেই।”

“কিছু বলার নেই? কেন বলার নেই? খারাপ রেজাল্ট করে আমাদের নাক-কান কেটে চুপ করে আছো। তুমি কখনো এমন রেজাল্ট করোনি, আমরা কল্পনাও করেনি তুমি এত বাজে রেজাল্ট করবে। তুমি নিজের পড়া নিজেই দায়িত্ব নিয়ে, আগ্রহ নিয়ে পড় তাই আমরা কখনো গার্ড করিনি। তোমার রুমে কখনো উঁকিও দেইনি। তোমার উপর ভরসা করে ছিলাম। তুমি কী এখন ঠিকমতো পড়ছো না? এত খারাপ রেজাল্টের কারণ কী? অন্য কোন কিছুতে জড়িয়ে যাওনি তো?”

দর্শন কোন উত্তর দেওয়ার আগেই ওর বাবা বসা থেকে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলছে,
“দেখো গিয়ে কী করে বেড়াচ্ছে তোমার ছেলে। হয়তো আমরা কিছুই জানি না। বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে মিশে কোন পথে চলে গেছে আল্লাহই জানে। এই তুমি নেশাদ্রব্য নিচ্ছো না তো? কোন অপরাধে জড়িয়ে পড়োনি তো? প্রেম-ট্রেম করে নিজেকে ভাসিয়ে দিয়েছো না-কি ?”

দর্শন চোখ তুলে বাবার দিকে তাকাল। সারাজীবন ভালো রেজাল্ট করেছে তখন একবারের জন্য কোন প্রশ্ন তুলেনি। বাহবা দিয়েছে। আর আজ জীবনে প্রথম বার খারাপ রেজাল্ট করেছে তাতে এত প্রশ্ন, এত সন্দেহ, এত অপবাদ, এত অবিশ্বাস? একবার তো পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে বলতে পারতো কি হয়েছে তোর? মন খারাপ? লাইফে কোন সমস্যা চলছে? আমাদের বল, আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করব। মন খারাপ করিস না, এই পরীক্ষা খারাপ হয়েছে তো কী হয়েছে সামনে ভালো হবে। এখন একটু মনোযোগ দিয়ে পড়। তুই তো সেরা ছাত্র। অন্তত ওর মা বলতে পারত কিন্তু না। মা তো মমতাময়ী। কোথায় গেল সে মমতা?
ওর বোন দিশা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। দিশা বেশিরভাগ সময় বাসায় থাকার কারণে জানে ভাইয়া কারো সাথে সারাক্ষণ ফোনে ফুসুরফাসুর করে। ওর সন্দেহ ভাই প্রেম করছে। কিন্তু এই মুহুর্তে এটা বলা অনুচিত। বাবা-মা এমনিতেই ক্ষেপে গেছে।

ওকে চুপ থাকতে দেখে ওর বাবা আবারও বলে উঠল,
“এই ছেলেকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না। ওর আশা ছেড়ে দেও। ওকে নিয়ে যে বড় বড় স্বপ্ন দেখেছো সেটা ভুলে যাও।”

দর্শন এইবার বসা থেকে ধপ করে দাঁড়িয়ে গেল। বাবার দিকে তাকাল। চোখে চোখ রেখে চোয়াল শক্ত করে বলল,
“হ্যা, ভুলে যাও। সারাজীবন তোমার ছেলে যে ভালো রেজাল্ট করে তোমাদের গর্বিত করেছিল সেই দিনগুলোও ভুলে যাও। আমাকে দিয়ে আর কিছু সম্ভব না। যা ভেবেছিলে, যে স্বপ্ন দেখেছিলে সব ভুলে যাও।”

দর্শনের বাবা দ্বিগুণ ক্ষেপে গিয়ে বলল,
“সব যখন ভুলেই যাব তোমাকে খাইয়ে পড়িয়ে মানুষ করছি কেন? তোমার সব আবদার পূরণ করছি কেন?”

“সেটা সব বাবা-মাই করে। যারা পরীক্ষায় ফেইল করে তারাও বাবামায়েরটা খেয়েই বেঁচে থাকে।”

“মুখে মুখে তর্ক করছো, বেয়াদব ছেলে। এই শিক্ষা দিয়েছি? এভাবে কথা বলার জন্য বড় করেছি?”

দর্শন হনহন করে নিজের ঘরের দিকে চলে গেল। এখানে যত থাকবে ততই কথা বাড়বে। ঝামেলা হবে। দরকার কী?

ওকে এভাবে চলে যেতে দেখে ওর বাবা আরো চিৎকার চেঁচামেচি করছে।
“দেখেছো তোমার ছেলে কত শিয়ান হয়েছে? কোথায় যাচ্ছিস তুই? এই তুই আমার বাড়ি থেকে বের হয়ে যা।”

দর্শনের মা পেছনে থেকে বারবার ডাকছে।
“দর্শন, দাঁড়াও বলছি। এমন বেয়াদবি কার কাছে শিখেছো? দাঁড়াও।”

দর্শন কারো কথা না শুনে ঠাস করে ঘরের দরজা বন্ধ করে দিল। ঘরের ভেতরে গিয়ে বাচ্চাদের মতো কাঁদতে লাগল। এত কান্না জীবনে কখনো কাঁদেনি। বুক ফেটে যাচ্ছে। কেউ আপন না সবাইকে পর মনে হচ্ছে। সবাই শুধু স্বার্থের জন্য ভালোবাসে, পাশে থাকে। কেউ ওর মনের অবস্থা বোঝার চেষ্টা করছে না। কেউ বুঝতে চাইছে না ওর মনে কী ঝড় বইছে। ও নিজেই এই রেজাল্ট দেখে ভেঙে পড়েছে। দর্শন টেবিলের উপর থেকে বইগুলো ছুড়ে ফেলে দিচ্ছে।
“কিচ্ছু হবে না আমাকে দিয়ে। আমি কোন কিছুরই যোগ্য নই। কিছুই পাব না আমি।”

পুরো দিন পাড় হয়ে রাত হয়ে গেছে কিন্তু কেউ ওকে খাওয়ার জন্যও ডাকেনি। শুধু দিশা এসে একবার ডেকে গেছে। দর্শন দরজা খোলেনি। তারপর আর দিশাও ডাকেনি। দর্শনের খুব কষ্ট হচ্ছে, একা লাগছে খুব। এই মুহুর্তে কাউকে প্রয়োজন। অর্ষাকে ভীষণ প্রয়োজন। দর্শন অর্ষার
নাম্বারে কল দিল। আশ্চর্যজনক ভাবে চারদিন পর ওর নাম্বারে কল ঢুকল। দর্শনের মনে আশার আলো জ্বলে উঠল। কিন্তু কল রিসিভ হচ্ছে না। কয়েকবার কল করার পরেও রিসিভ করেনি। দর্শন ঘড়িতে সময় দেখল। সবেমাত্র দশটা বাজে। ঘুমানোর কথাও না। হয়তো ইচ্ছে করে ধরছে না। তাই অনুরোধ করে মোবাইলে একটা বার্তা পাঠাল। অর্ষা প্লিজ কলটা ধর। তোমাকে আমার খুব প্রয়োজন। বারবার অনুরোধ করে কল, টেক্স করার পরেও কোন রেসপন্স পায়নি। দর্শন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“আমার কাউকে প্রয়োজন হলেও এই পৃথিবীতে আপাতত কারো আমার প্রয়োজন নেই।”

___________

“অর্ষা, উঠ। আমরা চলে এসেছি।”
অর্ষা নড়ে-চড়ে উঠে চোখ মেলল। পাশে ওর বাবা। অর্ষা কয়েক পলক ফেলে বাবাকে ভালো করে দেখল।
“মা, উঠে পড়। আমরা চলে এসেছি, ট্রেন থেমে গেছে।”

অর্ষা ট্রেনের কেবিনে ঘুমিয়ে ছিল। বাবা ওকে ডেকে তুলছে। অর্ষা হাই তুলতে তুলতে উঠে বসল। জানালা খুলে দিয়েছে বাবা। বাইরে রোদ চিকচিক করছে। তার মানে অনেক বেলা হয়ে গেছে। রাত সাড়ে ন’টায় ট্রেনে উঠে ক্লান্ত শরীরে ঘুমিয়ে পড়েছিল। আর এখন ঘুম ভাঙল। অর্ষার ব্যাগপত্র গুছানোই ছিল। রাতে শুধু চাদর আর পানির বোতল বের করেছিল। অর্ষা কেবিন থেকে নেমে বাবাকে জিজ্ঞেস করল,
“ক’টা বাজে?”

ওর বাবা লাগেজ তুলতে তুলতে বলল,
“সাতটার উপরে।”

অর্ষা চাদর ভাজ করে কাঁধের ব্যাগে রেখে দু কাঁধে বেল্ট লাগিয়ে পানির বোতল হাতে নিল। তারপর দুজন বের হতে লাগল ট্রেন থেকে। অর্ষা ওর বাবার সাথে গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিল। দাদার মিলাদ ছিল। চাচারা দেশের বাইরে তাই অর্ষার বাবাকেই এই দায়িত্ব নিতে হয়েছে। ওখানে ওরা চারদিন ছিল। অর্ষার মাইন্ড ফ্রেশেরও একটা ব্যাপার ছিল। তাই একটু বাড়িয়েই থেকেছে। ট্রেন থেকে নেমে পানি দিয়ে মুখ ধুয়ে নিল। ওদের গাড়ি স্টেশনের বাইরে অপেক্ষা করছে।
বাড়িতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে আটটার বেশি বেজে গেছে। অর্ষার বাবা ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করে অফিসের জন্য বের হয়ে গেছে। অর্ষা নাস্তা করে মোবাইল নিয়ে বসল। অনেকদিন ধরে অনলাইনে যাওয়া হয়না। গ্রামে গিয়ে নেটই পায়নি। শুধু গেমস খেলে আর ডাউনলোড করা মুভি দেখে সময় কাটিয়েছে। ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করতেই দর্শনের নাম্বার থেকে অনেকগুলো কল আর মেসেজ স্কিনে ভাসতে দেখল। অর্ষার চোখের কোনে পানি জমেছে। যতই বলুক ওর সাথে সম্পর্ক রাখবে না কিন্তু পারছে না। কখনো হয়তো পারবে না। এই চারদিন ওকে অনেক মিস করেছে। দর্শন যেমন হোক, যাই করুক ও তো ভালোবাসে ওকে৷ সেই ভালোবাসার কারণে ভুলা সম্ভব না। যত ভুলই করুক ক্ষনিকের জন্য অভিমান হবে কিন্তু ওকে ছেড়ে থাকা একদমই অসম্ভব সেটা হারে হারে টের পেয়েছে। ও যাবে আজ দর্শনের কাছে। চোখের তৃষ্ণা, মনের তৃষ্ণা সব মিটিয়ে নিবে। ওর লাস্ট মেসেজ এইরকম ছিল যে,
“আমার রেজাল্ট খুবই জঘন্য হয়েছে। আমি শেষ। একদম শেষ। ভেতরটা ভেঙেচুরে যাচ্ছে। আফসোস, এই মুহুর্তে আমি কাউকে পাশে পেলাম না। আসলে কেউ আমার নয়, আমি কারো নই।”
অর্ষা মোবাইল রেখে জামা চেঞ্জ করতে গেল।

দর্শন মোবাইল চেক করে মলিন হাসল। সেই হাসি ঠোঁটে লেগে আছে। বিছানায় মোবাইল রাখল। দরজার দিকে তাকাল। বাবা-মা এত স্বার্থপর? প্রেমিকাও স্বার্থপর। কেউ বুঝল না ওকে। কিছু একটা মাথা চারা দিয়ে উঠছে। ঘরের চারদিকে চোখ বুলালো। সব এলোমেলো, অগোছালো একদম ওরই মতো। দর্শন দু’হাতে নিজের চুল চেপে ধরে চোখ বন্ধ করে জোরে নিশ্বাস নিল। চোখ খুলে ফুলদানি হাতে নিয়ে ড্রেসিং টেবিলে বারি মারল। বিদঘুটে শব্দ করে কাচগুলো কয়েক টুকরো হয়ে মেঝেতে পড়ে আরো ছোট ছোট ভাগে বিভক্ত হলো। দর্শন এক টুকরো কাচ তুলে হাতের কব্জি বরাবর টান মারল। র*ক্তে ভেসে যাচ্ছে মেঝে। মাথা ঝিমঝিম করছে, চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। লুটিয়ে পড়ল দর্শন।

অর্ষা রেডি হয়ে মোবাইল হাতে নিয়ে বের হলো। প্রিয়ার কল আসায় একটু দেরি হয়ে গেল। অনেকদিন পরে ওর সাথে কথা হলো। ওর লাইফে ঘটে যাওয়া এতদিনের ঘটনা প্রিয়াকে জানাতে গিয়ে ৪০ মিনিট পার হয়ে গেছে। দরজা খুলে বাইরে বের হতেই মোবাইল বেজে উঠল। অর্পার কল। কল রিসিভ করে যা শুনল তাতে ওর পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেল। হাত-পা অবশ হয়ে আসছে। ছুটতে লাগল অর্ষা। বাসার নিচে দাঁড়িয়ে রিকশা, অটো কিছুই দেখতে পাচ্ছে না।
অর্ষার শরীর কাঁপছে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে আর অনবরত চোখের পানি মুছে যাচ্ছে। অর্ষা সামনের দিকে এগিয়ে গেল। কিন্তু রাস্তা পুরো ফাঁকা। নিজের চুল টেনে ধরে চিৎকার করল। শব্দ করে কাঁদতে কাঁদতে দৌড়াতে লাগল। ইচ্ছে করছে উড়ে দর্শনের কাছে চলে যেতে। দর্শন কি করে এমন একটা কাজ করল? ওর মতো স্ট্রং পার্সোনালিটির ছেলে এমন কিছু করবে তা কল্পনাতীত। অর্ষা দিকবিদিকশুন্য হয়ে এলোমেলো ভাবে দৌড়াচ্ছে। মাঝেমধ্যে ডান হাতের কব্জি দিয়ে গাল মুছছে। মনের ভেতর ঝড় বয়ে যাচ্ছে। আফসোস হচ্ছে। যদি সকাল বেলায় কথা বলে নিত। কিংবা রাতটা জেগে থাকত তাহলে ওর কল দেখতে পেত। তাহলে এমন হত না। আশেপাশের মানুষ অনেকেই অর্ষাকে বিভিন্নভাবে দেখছে। কিন্তু অর্ষা তেমন পাত্তাই দিচ্ছে না এসবে। ও একবার থামছে আবার সামনে দৌড়াচ্ছে। মেইনরোডে চলে এসেছে ও। এখন নিশ্চয়ই সিএনজি বা টেক্সি পেয়ে যাবে। হঠাৎ পেছনে থেকে বিকট শব্দ পেল। পেছনে ঘুরে দেখল একটা প্রাইভেট কার হর্ন বাজাচ্ছে। অর্ষার খেয়াল হলো ও ফুটপাত ছেড়ে রাস্তায় নেমে এসেছে। ওর পেছনে একটা প্রাইভেট কার হর্ন দিচ্ছে যাতে সরে যায়। অর্ষা পেছনের দিকে এতটাই মজে ছিল যে সামনের দিকটা খেয়াল করেনি। সামনের দিক থেকে একটা সিএনজি আসছে। অর্ষা সরার জন্য সামনের দিকে ঘুরতেই সিএনজি দেখে থমকে গেল। পা জমে গেছে সরতে পারছে না। চোখ বড়বড় করে চেয়ে আছে। আতংকে মুখ হা করে আছে। চোখ বন্ধ করে চিৎকার করল। সিএনজিও কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলেছে। ভেবেছে ও সরে যাবে। কিন্তু অর্ষা সরতে পারেনি। সিএনজির সাথে ধাক্কা খেয়ে পেছনের প্রাইভেট কারের সাথে পালটা ধাক্কা খেয়ে পিচঢালা রাস্তার উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল। নিঃশব্দে ওর রক্তমাখা শরীর লুটিয়ে পড়ল। মুখ দিয়ে হালকা গোঙানির শব্দ হলো। তারপর দুচোখ বন্ধ হয়ে গেল।

_____________

সাতদিন পর। দর্শন শারিরীক ভাবে পরিপূর্ণ সুস্থ হলেও মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। কারো সাথে কথা বলে না, ঠিকমতো খায় না, ঘুমায় না। ওর পরিবার, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন সবাই আপ্রাণ চেষ্টা করছে ওকে সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনার। ওর বাবা-মা নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে। এর জন্য ছেলের কাছে ক্ষমা চেয়েছে। তারা শুধু তাদের ছেলেকে সুস্থ দেখতে চান। শুধু রুশানকে একটা কথা জিজ্ঞেস করেছিল,
“অর্ষার কোন খবর জানিস? ও এসেছিল আমাকে দেখতে?”

রুশান হতাশ হয়ে উত্তর দিয়েছিল,
“ওকে সেদিন সকালেই অর্পা কল করে জানিয়েছিল তুই হাসপাতালে আছিস। এটা জানানোর পর ওর থেকে কোন উত্তর আসেনি। ঘন্টাখানিক পর থেকে ওর মোবাইল বন্ধ আসছিল। আমি আর অর্পা ওর বাসায় গিয়েছিলাম কিন্তু ওরা বাসায় ছিল না। বাড়িতে তালা ছিল। কলেজেও আসেনি আর। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও আর দেখা যায়নি ওকে। প্রিয়া রাঙামাটি থেকে ফিরেছে। ওকে জিজ্ঞেস করেও কিছু জানতে পারিনি। ওর সাথে নাকি শেষ ওইদিন সকালে কথা হয়েছে। এরপর আর যোগাযোগ করেনি অর্ষা।”
সেদিন শুধু দর্শন চোখের পানি ফেলেছিল নিঃশব্দে। রুশান ওকে অনেক বুঝিয়েছে সব ভুলে নিজের লাইফে,পড়াশোনায় ফোকাস করতে।
দর্শন তবুও হাল ছাড়েনি প্রিয়ার সাথে কথা বলতে কলেজে এসেছে। আত্মহত্যার খবর সব জায়গায় ছড়াতে ও বাসা থেকে বের হয় না। কিন্তু অর্ষার কোন খবর না পেয়ে ও বাধ্য হয়ে প্রিয়ার সাথে দেখা করতে কলেজে এসেছে।
প্রিয়া কাঁদোকাঁদো হয়ে বলল,
“আমি সত্যিই জানি না। আমি নিজেও অনেক চিন্তায় আছি। আমি ওর বাসায় গিয়েছিলাম কিন্তু কেউ বলতে পারে না ওরা কোথায় গেছে।”

“কোথায় যেতে পারে এনি আইডিয়া?”

“না, ওর দাদা-দাদি মারা গেছেন, চাচারা বাহিরে থাকেন। আর নানাবাড়ির সাথে কোন সম্পর্ক নেই। তারা চাইলেও অর্ষা তাদের কাছে যাবে না। আর ওর বাবা ভালো পোস্টে চাকরি করেন। অনেক মানুষের সাথে জানাশোনা আছে। তাই কোথাও হঠাৎ শিফট হওয়া ব্যাপার না। উনি ওকে এত ভালোবাসে যে ওর সব চাওয়া পূরণ করবে। কোথায় শিফট হয়ে গেছে বুঝতে পারছি না। আবার ভয় লাগছে যদি কোন দূর্ঘটনা ঘটে থাকে।”
দর্শন আর কোন কথা বলেনি। অর্ষা ওর উপর এত অভিমান করেছে? অভিমানের পাল্লা এত ভারি যে সব ছেড়ে ছুড়ে চলে গেল। একবারের জন্য ওর মুখটা ভেসে উঠেনি?

অন্ধকার বারান্দায় গিটার বাজাচ্ছে দর্শন। গিটারে টুন বাজছে অন্ধকার ঘরে কাগজের টুকরো ছিড়ে কেটে যায় আমার দিন…..
আর ওর চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। রুশান এসে লাইট অন করল। রুশান আপ্রাণ চেষ্টা করছে ওকে সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনার।
রুশানকে দেখে দর্শন ওকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কেঁদে দিল।
“দোস্ত, আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। কেন বেঁচে এলাম আমি? মৃত মানুষের মতো বাঁচার চেয়ে মরে যাওয়া ভালো ছিল না? আমি কি এতটাই অন্যায় করেছিলাম যে আমাকে এতবড় শাস্তি পেতে, হলো? আমি তো ওকে ভালোবেসেছিলাম আর ও…. ও তো আমাকে কত ভালোবাসত। আমাকে শেষ বার বলেছিল যদি আমি আর ওকে ডিস্টার্ব করি তবে এই শহর ছেড়ে দিবে। আমি ওকে অনেকবার কল আর মেসেজ দিয়েছিলাম। ও নিজের কথা রেখেছে। চলে গেছে দূরে। এতটা দূরে যে আমি ওকে আর কখনো দেখতে পাব না, ছুতে পাব না, বলতে পারব না ভালোবাসি। আমি মরে যাচ্ছি রুশান।”
দর্শন আবারও কাঁদতে লাগল। রুশান ওর পিঠে হাত বুলিয়ে বলল,
“যে চলে গেছে তাতে ভেবে এত কষ্ট পাচ্ছিস আর আমরা যারা তোর কাছে আছি, সব সময় থেকেছি তাদের কেন কষ্ট দিচ্ছিস? আমরা সবাই ভীষণ কষ্টে আছি। তোকে এভাবে দেখলে আমাদের বুক ফেটে যায়। এতদিনের ভালোবাসার চেয়ে মাত্র কয়েকদিনের ভালোবাসা বড় হয়ে গেল? বন্ধুর শুদ্ধ ভালোবাসার চেয়ে প্রেমিকার ভালোবাসা বেশি প্রশান্তিদায়ক?”

দর্শন চুপ করে আছে।
“আমাদের যদি ভালো বাসিস, যদি আমাদের কোন মূল্য তোর কাছে থাকে তবে আজ থেকে গ্রুপ স্টাডিতে জয়েন হবি।”
রুশান চলে গেল। ঘন্টাখানেক পর দর্শন জয়েন হলো ওদের সাথে। বদলে যেতে লাগল সময়। আগের মতো পড়াশোনায় এক্টিভ হয়ে উঠল। দিনরাত এক করে পড়ে যাচ্ছে। লক্ষ্য স্থির করে এগিয়ে যাচ্ছে। এভাবে এইচএসসি পরীক্ষা ভালো ভাবে শেষ করে। প্রতিটা পরীক্ষা দুর্দান্ত হয়েছে। সবাই মিলে এডমিশন পরীক্ষার জন্য বিভিন্ন কোচিং-এ ভর্তি হয়। ওরা কয়েকজন বিভিন্ন দেশের ইউনিভার্সিটিতে পড়ার জন্য এপ্লাই করে। কিন্তু দর্শন কোথাও স্কলারশিপ চায় না। ও চায় না এই দেশ ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে। এখানেই থাকবে। হয়তো একদিন অর্ষা ফিরে আসবে। কিন্তু ওর বন্ধুরা জোর করে ওকে দিয়ে এপ্লাই করায়। ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল তাই চান্স হয়ে যায় ইউএসএ তে। কিন্তু দর্শন যাবে না।
পরিবার থেকে ওকে জোর করে নি কেউ। কিন্তু বন্ধুরা বেশ জোর করছে ওকে। কারণ ওরা ভাবছে ও এখান থেকে দূরে থাকলে ভালো থাকবে। অর্ষাকে ভুলতে পারবে। তাই ওর ইউএসএ যাওয়া জরুরি।

সবার জোরাজুরিতে দর্শন রাজি হলো। কিন্তু মনটা সায় দিচ্ছিল না। কিন্তু সবার ভাষ্যমতে অর্ষা ফেরার হলে আগেই ফিরত। দর্শনও কম চেষ্টা করেনি ওকে খোঁজার। তাই সমস্ত পিছুটান ছেড়ে পাড়ি জমাল সূদুর ইউএসএ।

~~~~~সমাপ্তি।

(প্রথম খন্ডের সমাপ্তি। হয়তো দ্বিতীয় খন্ড হতেও পারে। তাই দ্বিতীয় খন্ডের জন্য অপেক্ষা করুন ❤️❤️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here