#প্রেম_তুমি (দ্বিতীয় খণ্ড)
ফাবিহা নওশীন
পর্ব-৩
খালা মনির মুখে বিয়ের কথা শুনতেই ক্ষেপে গেল অর্ষা। ড্রয়িংরুমে সোফায় বসে ল্যাপটপে ওর পছন্দ করা কোম্পানিগুলোর কার্যকলাপ, বার্ষিক আয়, ব্যবসায়িক অবস্থান, কাজের পরিবেশ, তৃতীয় পক্ষের মতামত দেখছিল। এরই মধ্যে খালা মনি কফি নিয়ে ওর পাশে বসে ইনিয়েবিনিয়ে বিয়ের কথা বলল। পড়াশোনা শেষ এখন বিয়ে করা উচিত ব্লা ব্লা। এখনও নিজের ছেলের বউ করার প্রসঙ্গ তুলেনি।
খালা মনির কথা শুনে ল্যাপটপ বন্ধ করে বলল,
“আমি কি এত কষ্ট করে পড়াশোনা করেছি বিয়ে করে বসে থাকার জন্য? না, খালা মনি আমি পড়াশোনা করেছি নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য। জীবনে কিছু করতে চাই। যতদিন পর্যন্ত না জীবন নিয়ে সেটিস্ফাই হচ্ছি ততদিন বিয়ে-টিয়ে নিয়ে ভাবার সময় নেই। আমাকে আর কখনো বিয়ের কথা বলিও না৷”
“কিন্তু মা, বিয়ে তো করতে হবে। আমি ছাড়া তোর আর কে আছে? আমি বেঁচে থাকতে থাকতে তোর একটা গতি করে যেতে চাই।”
“গতি? হোয়াট ডু ইউ মিন বাই গতি? বিয়ে ছাড়া আমার গতি হচ্ছে না? তুমি সেকেলে কথাবার্তা কোথায় শিখলে? তোমার মাইন্ড তো এমন ছিল না। বিয়ে ছাড়াও আমার গতি হবে। প্লিজ এ-সব ইমোশনাল কথাবার্তা বলো না। বেশি বিয়ে বিয়ে করলে আমার বাসায় সিফট হয়ে যাব।”
অর্ষা ল্যাপটপ তুলে বিরক্ত মুখে রুমে চলে গেল। বিয়ে ছাড়া জীবনে কিছু নেই না-কি? বিয়ে শব্দটা শুনলেই মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। কি করবে বিয়ে করে? যাকে বিয়ে করবে তাকে ভালোবাসতে পারবে? আর সে-ই কি ভালোবাসবে? ভালোবাসা বলে কিছু আছে? যা আছে তা হলো ভালো থাকা। সবাই নিজের মতো ভালো থাকতে চায়।
অর্ষা সকাল সকাল রেডি হয়ে গেছে। একদম ফর্মাল লুক। কালো জিন্স, সাদা শর্ট টপ, মুখে হালকা মেক আপ, হাই হিল আর সিল্কি চুলগুলো উঁচু করে ঝুঁটি করা। হাতে প্রয়োজনীয় ফাইলপত্র। ডান হাতের কব্জির কিছুটা উপরে পার্স। অর্ষা শেষ বারের মতো নিজেকে আয়নায় দেখে নিল কোন কমতি আছে কি-না। কোনো কমতি চোখে পড়ল না। কাউকে কল করতে করতে রুম থেকে বের হয়ে গেল। ডাইনিং টেবিলে খালা মনি, খালু, খালাতো ভাই, খালাতো বোন নাস্তা করছিল। অর্ষাকে দেখে আয়াশ জিজ্ঞেস করল,
“কই যাস?”
“ইন্টারভিউ আছে।”
“ঠিক আছে নাস্তা করে নে। আমি অফিসে যাওয়ার সময় তোকে ড্রপ করে যাব।”
আয়াশের কথা শুনে খালা মনি খুশি হলো। আয়েশার দিকে কিছু একটা ইঙ্গিত করল।
“দরকার নেই। আমার সাথে আমার এক ফ্রেন্ড যাবে। ওকে কল করেছি।”
“আচ্ছা, তাহলে ভালো হলো। বেস্ট অফ লাক।”
ওদের কথা শুনে চুপসে গেল দুজন।
অর্ষা নাস্তা না করেই চলে যাচ্ছে। তাই খালা বলল,
“কিরে নাস্তা না করে কই যাস?”
অর্ষা ভার মুখে বলল,
“আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
খালা মনি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“আমার উপর রাগ করেছিস? ঠিক আছে তোকে আর কখনো বিয়ের কথা বলব না। তোর যখন ইচ্ছে হবে তখন করিস।”
আয়াশ সেটা শুনে বলল,
“বিয়ে? ওর বিয়ের বয়স হয়েছে? আমি এতবড় একটা ছেলে চোখের সামনে বউ ছাড়া ঘুরছি সেটা চোখে পড়ছে না আর ওর বিয়ে দিতে পাগল হয়েছো। একটু তো আমার জন্য পাগল হও।”
আয়াশের খেয়াল হলো বাবা ওদের সাথে বসে খাচ্ছেন। তখনই হঠাৎ পিলে চমকে উঠে। বাবার দিকে আড়চোখে চেয়ে তোতলাতে তোতলাতে বলল,
“আমি মজা করছিলাম।”
দাঁত কেলিয়ে বলল।
অর্ষা সবার কথা শুনে স্থির হলো। তারপর বলল,
“আমি রাগ করিনি খালা মনি। তুমি আমার জন্য ভাববে স্বাভাবিক। কিন্তু আগে আমি কিছু করি। তুমি না বলো প্রতিটি মেয়ের পায়ের নিচ শক্ত করা উচিত? আমি তাই করছি।”
অর্ষার খালু বলল,
“একদম ঠিক কাজ করছো অর্ষা। আয়েশাকে দেখো, লাইফে কিছু করার আগেই বিয়ে হয়ে গেল। এখন স্বামী, সংসার আর বাচ্চাদের সামলাচ্ছে। কিছু করার আর সময় পায়নি। তোমার যা ইচ্ছে হয় তাই করো। অন্যকে খুশি করার জন্য মনের বিরুদ্ধে একদম যাবে না। তাহলে আজীবন আফসোস করতে হবে।”
“জি ধন্যবাদ আংকেল। আমি তাহলে আসি। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমার জন্য দোয়া করবেন।”
“অবশ্যই। বেস্ট অফ লাক।”
…..
অর্ষা আর প্রিয়া অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। প্রিয়া অফিস দেখে বলল,
“অফিসটা তো সেই সুন্দর রে অর্ষা। দেখিস এখানেই তোর জব হয়ে যাবে।”
অর্ষা মৃদু হেসে বলল,
“তোর কথায় যেন সত্যি হয়।”
“অবশ্যই হবে। তুই সিভি জমা দিলেই তোর জব হয়ে যাবে। কোন কোশ্চেন করবে না দেখিস?”
অর্ষা ভ্রু কুঁচকে ওর দিকে তাকাল। তারপর বলল,
“অমন জব আমার চাই না। আমি নিজেকে দেখিয়ে কিংবা সিভি দেখিয়ে আর্কষিত করে জব চাই না। আমি যোগ্যতার ভিত্তিতে জব চাই। সারারাত পড়াশোনা কেন করলাম যদি কোনো কোশ্চেন না করে?”
“ওকে, ওকে। এখন ভেতরে যাওয়া যাক।”
ওরা দু’জন ভেতরে গেল কিন্তু কোথায় ইন্টারভিউ নিচ্ছে সেটা জানা নেই। এত বড় অফিসে অর্ষা জিজ্ঞেস করার মতো কাউকে পাচ্ছে না। প্রিয়া একটা ছেলেকে দেখে অর্ষাকেফিসফিস করে বলল,
“একে জিজ্ঞেস কর।”
অর্ষা প্রিয়াকে বলল,
“তুই একটু জিজ্ঞেস কর না।”
প্রিয়া ছেলেটার দিকে বারবার তাকাচ্ছে কিন্তু জিজ্ঞেস করার সাহস পাচ্ছে না। ছেলেটা ওদের দেখে ভাব নিয়ে মোবাইলে মনোযোগ দিল। প্রিয়া ইতস্তত করছে জিজ্ঞেস করতে। ছেলেটা আড়চোখে ওদের দেখছে। মনে মনে ভাবছে হয়তো ওর সাথে লাইন মারতে আসবে। মনে মনে হাসছে। প্রিয়া ওর সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
“এক্সকিউজ মি….
ছেলেটা ব্যস্ততা দেখিয়ে মোবাইল থেকে চোখ সরিয়ে ভাব নিয়ে বলল,
” জি…!”
প্রিয়া অর্ষার দিকে একবার চেয়ে ছেলেটার দিকে চেয়ে বলল,
“কিছু মনে না করলে আপনার পরিচয়টা পেতে পারি? আসলে আপনা…
প্রিয়ার কথা শেষ হতে না হতেই ছেলেটা বলল,
” এখনকার মেয়েরা ছেলে দেখলেই হলো! উফফ!”
অর্ষা ওর কথা শুনে ভীষণ ক্ষেপে গেল। পায়ের জুতা খুলে ছেলেটার মুখের সামনে নিয়ে বলল,
“এখনকার মেয়েরা কী? কী এখনকার মেয়েরা?”
ছেলেটা ভরকে গেল। ভরকে গিয়ে অর্ষার দিকে বড়বড় চোখ করে চেয়ে রইল। অর্ষা রেগে গিয়ে ওর কলার ধরে বলল,
“কথা বলিস না কেন? নিজের চেহারা দেখেছিস? জোকার একটা। যেই ভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছিস যেন কোম্পানির সিএ। মেয়েদের সস্তা মনে করিস? জুতা পেটা করে তোর ভাব ছুটিয়ে দেব। অশিক্ষিত বেয়াদব।”
ছেলেটা কথা বলতে ভুলে গেল।
অর্ষা ওর কলার ছেড়ে দিল। তারপর হনহন করে বের হয়ে গেল। প্রিয়া ওর পেছনে পেছনে দৌড়ে গেল।
“এই অর্ষা চলে এলি কেন? ইন্টারভিউ এটেন্ট করবি না?”
অর্ষার স্পষ্ট উত্তর,
“না।”
“না মানে? এত বড় একটা কোম্পানিতে জব করার সুযোগ ছেড়ে দিবি?”
“হ্যা দিলাম। এখানে আমার জবের প্রয়োজন নেই। করব না আমি জব এখানে।”
প্রিয়া প্রতিউত্তরে কিছু বলল না। অর্ষাকে দেখে সেই পুরনো দিনের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। অর্ষা উপরে উপরে যত ম্যাচিউর ভাব নিয়েই থাকুক না কেন ও সেই আগের মতোই রয়ে গেছে। ও ম্যাচিউর হলে এমন একটা কাজ করত না। ছোট একটা কারণে রাগ করে ইন্টারভিউ না দিয়ে চলে আসত না।
অর্ষা বাড়িতে ফিরে ইন্টারভিউ না দেওয়ার কথা কিছুই জানায়নি। বিকেল বেলায় গেল নিজেদের ফ্ল্যাটে। অনেক দিন ধরে ফ্ল্যাটটা বন্ধ পড়ে আছে।
চাবি দিয়ে দরজা খুলে পেছনে পা রাখতেই শরীর ছমছম করে উঠল। বাড়িটায় অনেক দিন কেউ না থাকায় হন্টেট মনে হচ্ছে। চারদিকে ধুলোবালি, মাকড়সার জাল দিয়ে বুনা। জিনিসপত্রের উপরে ধুলোর স্তুপ জমে আছে। অর্ষার ভেতরে যেতে ভয় লাগছে। এক পা-ও আগাতে পারছে না। এমন মুহূর্তে মনে হচ্ছে কাউকে না এনে চরম ভুল করেছে। নিজের প্রতি রাগ হচ্ছে। সাহস করে পা বাড়াল সামনের দিকে। চোখের সামনে ভেসে উঠছে কত স্মৃতি। ছোট থেকে বড় হয়েছে এই বাড়িতে। বাবাই একমাত্র সঙ্গী ছিল ওর। চোখ ঝাপসা হয়ে এল পুরনো স্মৃতি দৃষ্টিগোচর হতে। অর্ষা চোখের পানি মুছে নিজের ঘরে গেল। দরজা খুলে ভেতরে গেল। এত যত্নের বিছানায় ধুলো জমেছে কয়েক স্তুপ। পড়ার টেবিল, বইয়ের র্যাক, ড্রেসিং টেবিল, আলমারি সবকিছু চোখ বুলিয়ে নিল। বইয়ের র্যাক থেকে ডায়েরিটা বের করল। ডায়েরি হাতে নিতেই বুক ভারি হয়ে গেল। শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা। অর্ষার চোখের পানি ধুলো-ময়লাযুক্ত ডায়েরির উপরে পড়ে এক বিন্দু কাদার সৃষ্টি হলো। অর্ষার হাত কাঁপছে। হাতে রাখতে পারছে না ডায়েরিটা। র্যাকে আবারও রেখে দিল। দূর্বল হতে চায় না আর। ডায়েরি রেখে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। ফ্ল্যাটের আর কোন কিছু দেখার প্রয়োজন নেই। এখুনি চলে যাবে ও। ফ্ল্যাটের দরজা লক করে বের হয়ে গেল চুপিসারে। ফ্ল্যাটটা পরিস্কার করা দরকার।
ছ’মাস পর!
দর্শন দেশে ফিরেছে। ওর পরিবার আর বন্ধুরা ওকে এয়ারপোর্টে থেকে পিক করতে গিয়েছিল। দর্শন আর ওর বন্ধুরা এক গাড়িতে। দর্শন কেমন গম্ভীর আর চুপচাপ বসে আছে। কারো সাথে কথা বলছে না। চোখের ওই কালো সানগ্লাসটা ওকে আড়াল করে রেখেছে। দর্শন যখন দেশ ছাড়ে তখন ওকে তিক্ত অভিজ্ঞতার স্বীকার আর ভাঙা হৃদয় নিয়ে যেতে হয়েছিল। আজ এতবছর পর দেশে ফিরে ঠিক সেই জায়গায় ফিরে যাচ্ছে। মনে পড়ে যাচ্ছে সবকিছু। কেমন দমবন্ধ লাগছে। ভালো লাগছে না কিছু। রুশান ওকে চুপচাপ দেখে বলল,
“কিরে তুই এত চুপচাপ কেন? এতদিন পরে দেখা হলো।”
দর্শন গম্ভীরমুখে উত্তর দিল,
“ভালো লাগছে না কিছু। কেমন অস্থির লাগছে। যে ক্ষত নিয়ে দেশ ছেড়েছিলাম সেটা একটুও শুকায়নি। এখনো দগদগে। কেমন বিশ্রী যন্ত্রণা করছে।”
রুশান আর কথা বাড়ালো না। একটা মিউজিক অন করতে বলল ড্রাইভারকে।
“আমার কল্পনা জুড়ে যে গল্পেরা ছিল
আড়ালে সব লুকনো।
সেই গল্পেরা সব রঙিন হলো পলকে
তোমাকে হঠাৎ পেয়ে যেন।
প্রেম তুমি আসবে এভাবে
আবার হারিয়ে যাবে ভাবিনি।
আজও আছে সেই পথ শুধু নেই তুমি
বলো কোথায় আছো অভিমানী?”
দর্শনের গাড়ি চলছে কলেজের রাস্তা ধরে। এয়ারপোর্টে থেকে বাড়িতে যেতে হলে এই রাস্তা ধরেই যেতে হয়। দর্শন অপলক সেই রাস্তা দেখছে। যত এগুচ্ছে বুক ভারি হয়ে আসছে।
“সব থেকেও কি যেন নেই
তোমাকে তাই খুঁজে যাই প্রতিক্ষণে…..
…….
দর্শন বিভোর হয়ে গেছে রাস্তার ধারে। হঠাৎ হুশ ফিরল এই লাইনে…..
” চেয়ে থাকা দূর-বহুদূর
যে পথে আজো রয়ে গেছো স্মৃতির পাতায়
এসোনা আর একটি বার
স্বপ্ন যত সাজাতে আবার শুনছো কি আমায়?”
দর্শনের মনে হচ্ছে এই গানটা ওর জন্য। ওর প্রতি উপহাস করছে গানের প্রতিটি লাইন। এমন দমবন্ধ করা পরিস্থিতিতে এত বছরে কখনো পড়েনি। একটা মেয়েকে ভালোবেসেছিল, সেই মেয়ে ওকে ছেড়ে চলে গেছে এই সাড়ে সাত বছরে এর কিছু ভুলেনি। তবে কাউকে বুঝতে দেয়নি। কারো সাথে এ নিয়ে এক লাইন আলোচনা পর্যন্ত করেনি।
দর্শন চেঁচিয়ে বলল,
“স্টপ দ্যা সং।”
সবাই ওর চিৎকারে হকচকিয়ে গেল।
চলবে……