রূপবানের_শ্যামবতী -২২তম_পর্ব

#রূপবানের_শ্যামবতী
#২২তম_পর্ব
#এম_এ_নিশী

বিকেল বেলা বাগানে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে ড্রয়িংরুমে এসে বসলেন গুলবাহার। হাঁক ছেড়ে ডাকলেন আমেনাকে। আমেনা ছুটে এসে বলে,

–জে বড় ম্যাডাম।

–আমার শরবত নিয়ে আয়।

–আইচ্ছা।

যেভাবে ছুটে এসেছিলো সেভাবেই ছুটে চলে গেলো আমেনা। আফজাল সাহেব এবং আফতাব সাহেব আজ দুপুরেই ফিরেছেন। তবে সন্ধ্যার দিকে আবার বেরোবেন। গুলবাহারের কাছে একটা অনুমতি নেয়ার উদ্দেশ্যে তারা দুজনেই এসে বসেন মায়ের মুখোমুখি। আফতাব সাহেবই আগে কথা বলেন,

–আম্মাজান, আপনার শরীরের কি অবস্থা?

গুলবাহার গম্ভীরভাবে জবাব দেন,

–হুম, ভালো।

এবার আফজাল সাহেব বলেন,

–ওষুধগুলো ঠিকমতো খাচ্ছেন তো আম্মাজান? নইলে কিন্তু আরো বেশি অসুস্থ হয়ে পড়বেন।

–খাইরে বাপজান। সব ঠিকঠাক খাই।

আফজাল সাহেবের সাথে কথাবার্তায় ভিষণ নম্র গুলবাহার।

আফজাল সাহেব পুনরায় বলে ওঠেন,

–একটা বিষয়ে কথা বলতে এসেছিলাম, আম্মাজান।

–হুম, বল।

–আমার একটা প্রস্তাব আছে।

গুলবাহার কপাল কুঁচকে প্রশ্ন করেন,

–কি প্রস্তাব?

আফজাল সাহেব বলেন,

–আহরারের বিয়েটা যেভাবে হলো তাতে পরিবারের কেউই তো উপস্থিত থাকতে পারেনি আফতাব ছাড়া। তাই আমি ভাবছি একটা বড় করে অনুষ্ঠান করবো। আত্মীয়-স্বজন থেকে শুরু করে, বন্ধু বান্ধব, অফিসের কর্মচারী সকলেই নিমন্ত্রিত থাকবে। আপনি কি বলেন আম্মাজান?

গুলবাহার জবাব দেননা। তিনি ভাবছেন, তিনি তো সকলের সামনেই আহরারের সাথে ফারহার বিয়ের ঘোষনা দিয়েছিলেন। এখন যদি সকলে জানতে পারে আহরারের বিয়ে ফারহার সাথে না হয়ে অন্য একটি মেয়ের সাথে হয়েছে তাও আবার হুট করে কাওকে না জানিয়ে তাহলে তার সম্মানে বড়সড় আঘাত আসবে। সবসময় বড় বড় কথা বলা, সকলকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে আসা গুলবাহার এবার কোথায় মুখ লুকাবেন?

গুলবাহারকে নিশ্চুপ দেখে আফজাল সাহেব ডেকে ওঠে,

–আম্মাজান।

আফজালের ডাকে ভাবনা ছেড়ে বেরিয়ে আসেন গুলবাহার। তারপর জবাব দেন,

–অনুষ্ঠান করাটা কি জরুরি?

–অবশ্যই। এই বাড়ির বউকে সকলের সাথে পরিচিত করতে হবেনা? খান বাড়ির বউ বলে কথা। বিয়েটা যেভাবেই হোক অনুষ্ঠান হওয়াটা বাধ্যতামূলক।

গুলবাহার ভাবছেন বাধা দেওয়ার উপায় নেই। তবে যেই পরিস্থিতিগুলোর সৃষ্টি হবে সেসব কিভাবে সামলাবেন তা ভেবেই অস্থিরতা অনুভব করছেন তিনি। কোনরকম ভাবে বলে উঠেন,

–বেশ, তবে তাই করো।

বলেই তিনি উঠে দাঁড়ালেন। নিজের ঘরে চলে গেলেন। আফজাল সাহেব ও আফতাব সাহেব নিজেদের মধ্যে আলোচনায় মশগুল হলেন।

ঘরে ঢুকেই অস্থিরভাবে পায়চারি করছেন গুলবাহার। তিনি চুপচাপ আছেন। তার কারণ ঝোঁকের বশে কোনো কাঁচা কাজ করতে চান না তিনি। সুযোগের অপেক্ষায় আছেন। শুধু একটা মোক্ষম সুযোগ। ওই কালো মেয়েকে কুপোকাত করে বাড়ি ছাড়া করবেন তিনি। যেভাবেই হোক। একজনকে হজম করেছেন তাও পারছেন না এখনো পর্যন্ত মেনে নিতে। আবার আরো একজন। না.. না.. না। এ কিছুতেই সম্ভব না। এদিকে আবার অনুষ্ঠান। সবাই জেনে যাবে। বাঁকা চোখে দেখবে গুলবাহারকে। কটাক্ষ করবে। প্রতিশোধ নিবে। উফফ! আর ভাবতে পারছেন না গুলবাহার। ধপ করে বসে পড়েন বিছানায়। চোখ বুজে জোরে জোরে শ্বাস নিতে থাকেন। এভাবে উত্তেজিত হয়ে কোনো সমাধান মিলবেনা। ঠান্ডা মাথায় ভাবতে হবে।

দরজায় ঠকঠক আওয়াজে বিরক্ত হন গুলবাহার। বাজখাঁই গলায় চেঁচিয়ে বলেন,

–কে রে? সমস্যা কি?

বাইরে আমেনা ছিলো। সে গুলবাহারের জন্য শরবত নিয়ে এসেছে। কিন্তু চিৎকার শুনে ভয়ে গলার স্বর আটকে গেছে তার। তবুও একটু চেষ্টা করে বলে ওঠে,

–বড় ম্যাডাম, আফনের শরবত।

ঘরের ভেতর থেকে আরো একধাপ গলা চড়িয়ে জবাব দেন গুলবাহার,

–তুই খা তোর শরবত।

আমেনা বুকে থু থু দেয়। তাড়াতাড়ি সেখান থেকে চলে যেতে যেতে বলে,

–মাগো, বুড়ি ক্ষেপছে।

~~~~~~~~~~~~~

কোচিং এ ভর্তি প্রক্রিয়া শেষ করে রাস্তার ফুটপাত ধরে হেঁটে যাচ্ছে আহরার ও অরুনিকা। দুজনেই নিশ্চুপ। বেশ অনেকটা সময় ধরে কারো মুখে কোনো শব্দ নেই। আহরার নিজেই নিজের আচরণে হতবাক। কি হয়েছে তার? সর্বক্ষণ এমন অস্থিরতায় থাকছে কেন সে? হয়তো অরুনিকা পুরোপুরি সহজ – স্বাভাবিক হয়নি তাই। অরুনিকাও কেমন লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে আছে। দুজনেই যদি অস্বস্তি নিয়ে দুদিকে সরে থাকে তবে সম্পর্ক এগোবে কি করে? নাহ। আহরারকেই আগে ধাপ ফেলতে হবে।
চিন্তিত ভঙ্গিতে হাঁটতে হাঁটতে বন্ধুদের দেওয়া পরবর্তী পরামর্শের কথা ভাবতে থাকে আহরার। চট করে মাথায় আসে ফুচকা ও আইসক্রিম খাওয়ানোর কথা। আশেপাশে নজর বুলিয়ে ফুচকাওয়ালা খুঁজতে থাকে সে। কিছুদূর যেতেই পেয়ে যায় একজনকে, রাস্তার ধারে। তবে রাস্তা পেরিয়ে যেতে হবে। আহরার অরুনিকার উদ্দেশ্যে বলে ওঠে,

–অরু, পার হতে হবে।

এই বলে সে অরুনিকার একহাত শক্ত করে ধরে নিয়ে যেতে থাকে রাস্তার ওপারে। গাড়ি চলাচল যেদিকে সেদিকে নিজেকে রেখে অপর পাশে নিরাপদ জায়গায় অরুনিকাকে রেখেছে। অরু যন্ত্রমানবের মতো আহরারের সাথে তাল মিলিয়ে চলছে আর মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় দেখছে আহরারকে।
রাস্তা পেরিয়ে আসতেই আহরার গদগদ ভাব নিয়ে বলে ওঠে,

–চলো, ফুচকা খাই। তোমরা মেয়েরা তো ফুচকা বেশি পছন্দ করো।

অরুনিকার ইচ্ছে হলো বলতে যে সে ফুচকা পছন্দ করে না। কিন্তু আহরারের অতি উৎসাহ দেখে দমে যায় সে। কিছু বলে না। এই মানুষটার খুশির জন্য একটাদিন অপছন্দের খাবার খাওয়াই যায়। সে মাথা হেলিয়ে জবাব দেয়,

–চলুন।

আহরার ফুচকাওয়ালাকে বলে দুই প্লেট ফুচকা দিতে। তারপর অরুর দিকে তাকিয়ে বলে,

–পানির বোতলটা দাও তো।

অরুনিকা ব্যাগ থেকে বোতল বের করে আহরারের হাতে দিতেই আহরার সেটা হাতে নিয়ে একপাশে সরে যায়। তারপর একটানে নিজের মুখ থেকে মাস্ক খুলে ফেলে সে। বোতলের ঢাকনা খুলে হাতে পানি ঢেলে তা চোখে মুখে ছিটায়। প্রতিবার পানির ঝাপটা পরায় চোখমুখের সংকোচন – প্রসারণ ঘটছে। পানির স্পর্শ পেয়ে হলদে ফর্সা মুখটা আরো বেশি হলুদাভ লাগছে। হালকা লাল ঠোঁট রক্তবর্ণ লালে পরিণত হয়েছে। সবমিলিয়ে আহরারের রূপ যেন ছিটকে বেরিয়ে আসতে চাইছে। অরুনিকা একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে। তার ভেতরে সে হুট করেই অস্বাভাবিক কম্পন অনুভব করছে।
ফুচকাওয়ালার দোকানে কিছু কলেজ পড়ুয়া মেয়েরা দাঁড়িয়ে ছিলো। তারাও ফুচকা খেতে এসেছে। তাদের মধ্যে রুম্পা নামের একটি মেয়ে বান্ধবীদের উদ্দেশ্যে বলে ওঠে,

–এই দেখ দেখ, ছেলেটাকে দেখ। মানুষ নাকি অন্য কিছু? এত্তো সুন্দওওওররর।

রুম্পার দৃষ্টি অনুসরণ করে বাকিরাও সেদিকে তাকিয়েছে। একেকজনের মুখের অবস্থা এমন হয়েছে যেন পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য দেখে ফেলেছে। নাদিয়া নামের একটি মেয়ে বলে,

–ভাবতেই পারছিনা, একটা ছেলে এতো সুন্দর কিভাবে হয়?

পাশ থেকে রুমঝুম নামের মেয়েটি বলে ওঠে,

–ভাইইই! ক্রাশ, ক্রাশ। মারাত্মক লেভেলের ক্রাশ খাইছি ভাই। এর নাম্বার, ফেসবুক আইডি যা পারিস জোগাড় করে দে যেভাবেই হোক।

রূম্পা মুখ হা করে সেদিকে চেয়ে থাকতে থাকতে বলে,

–চুপ থাক। পেলে সেসব শুধুই আমার কাছে থাকবে, আর কেউ পাবিনা।

মেয়েগুলোর সমস্ত কথোপকথন কর্ণগোচর হয় অরুনিকার। কারণ সে কাছাকাছিই দাঁড়িয়ে ছিলো। একবার আড়চোখে আহরারকে দেখে আবারো মেয়েগুলোর দিকে তাকায় অরু। তারপর হালকা কেশে দৃষ্টি আকর্ষণ করে মিষ্টি করে হেসে বলে ওঠে,

–কিছু মনে করোনা আপুরা, যেই উদ্দেশ্যে উনার (আহরারের দিকে আঙুল ইশারা করে) নাম্বার নেওয়ার আশা করছো, তা সফল হওয়ার নয়। কারণ উনি বিবাহিত।

মেয়েগুলো প্রথমে একটু অস্বস্তিতে পড়লেও অরুনিকার শেষ কথাটা শুনে বিস্ফোরিত নয়নে চেয়ে রইলো। তা দেখে অরুনিকা হালকা হেসে আবারো বললো,

–আর আমি হলাম উনার স্ত্রী। একমাত্র স্ত্রী।

মেয়েগুলো সত্যি সত্যি লজ্জায় পড়ে গেলো ভিষণ। তারা ভাবতে পারেনি একজন বিবাহিত ছেলেকে নিয়ে তারা এতোক্ষণ এসব কথা বলছিলো আবার তারই বউ এর সামনে। লজ্জা, সংকোচে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলোনা তারা। ফুচকা না খেয়েই তাড়াহুড়ো করে চলে গেলো।

মুখ ধোয়া শেষে আহরার অরুনিকার দিকে বোতলটা এগিয়ে দিলো। অরুনিকা বোতলটা নিয়ে নিতেই আহরার নিজের চুলে লেগে থাকা পানি হাত দিয়ে ঝাড়তে থাকলো। আড়চোখে এই দৃশ্যটাও মন ভরে দেখলো অরুনিকা।
ফুচকাওয়ালার ডাকে সম্বিত ফিরে পেয়ে তড়িৎ গতিতে সামনে ফিরে অরুনিকা। দুটো প্লেট সামনে এগিয়ে দিয়েছে। আহরার প্লেট দুটো নিয়ে একটা প্লেট অরুনিকার দিকে বাড়িয়ে দিলো। অরুনিকা প্লেটটি হাতে নিতে নিতে চমৎকার করে হাসলো। বিনিময়ে আহরারও একটা মুচকি হাসি ফিরিয়ে দিলো।
ফুচকার প্লেটের দিকে তাকিয়ে আহরার মনে মনে ভাবতে থাকে, “কখনো এভাবে এসব জিনিস খাইনি, কেমন হবে? কি হবে না হবে?”
একবার অরুনিকার দিকে তাকাতেই অরুনিকা ইশারায় খেতে বলে। আহরার মাথা নাড়িয়ে একটা ফুচকা মুখে পুরে। সাথেসাথে মাথা ভনভন করে ওঠে তার। অস্বাভাবিক ঝাল। এদিকে আহরারকে মুখে নিতে দেখে অরুনিকাও খেতে শুরু করে। বুঝতে পারে ঝালের মাত্রাটা একটু বেশি। হয়তো বেশি নয়। কিন্তু আহরার অরুনিকা কেউই বেশি ঝাল খেতে পারেনা। অরুনিকা তাও সহ্য করে নিচ্ছে। কষ্টটা একটু কম করার চেষ্টায় খুব দ্রুত মুখে পুরছে সে। এদিকে দ্বিতীয় বারের মতো ফুচকা মুখে নিতেই আহরারের মনে হলো এবার তার কান দিয়ে ধোঁয়া ছুটতে শুরু করেছে বোধহয়। তবে বিন্দু পরিমাণও নিজের অবস্থা প্রকাশ করছেনা সে। ভাবছে অরুনিকা কি ভাববে? এদিকে অরুনিকাও ঝাল সহ্য করতে পারছেনা তারপরও খেয়ে যাচ্ছে কারণ সেও ভাবছে আহরার কি ভাববে?
একবার আহরারের দিকে তাকাতেই অরুনিকা খেয়াল করে আহরারের চোখ মুখ লাল হয়ে আছে। চোখে পানি জমেছে। ঠোঁটজোড়া কাঁপছে। মুখ হা করে করে যেন ঝাল সহ্য করার চেষ্টা করছে। অরুনিকা ঝটপট বোতলটা এগিয়ে দিয়ে বললো,

–নিন, পানি খান।

অরুনিকা বলতেই আহরার ছোঁ মেরে বোতলটা নিয়ে ঢকঢক করে সবটুকু পানি সাবাড় করে দিলো। তাও তার ঝাল মিটছে না। চোখের কোণ বেয়ে টুপ করে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো তার। বারবার নাক টানছে। ঠোঁটজোড়া ফাঁক করে মুখ হা করে রাখছে বারবার। অরুনিকার বড্ড মায়া লাগছে। এই মানুষটার ঝাল সহ্য করার ক্ষমতা তার চেয়েও কম। অরুনিকা ফুচকাওয়ালার কাছে পানি চাইতেই তিনি এক গ্লাস পানি দিলেন। আহরার সেটাও এক নিঃশ্বাসে শেষ করলো।
এভাবে পরপর পাঁচ গ্লাস পানি শেষ করে কিছুটা ধাতস্থ হলো সে। অরুনিকাও ধীরেসুস্থে দু গ্লাস পানি গেলো। অল্পসময়ের মধ্যেই তার ঝালটা সয়ে এসেছিলো। ফুচকাওয়ালাকে টাকা দিয়ে অরুনিকাকে নিয়ে আবার হাঁটতে শুরু করলো আহরার। তার চোখ-মুখ কিছুটা স্বাভাবিক হলেও ঠোঁট এখনও টকটকে লাল হয়ে আছে। মনে হচ্ছে কেউ আলকাতরা লাগিয়ে দিয়েছে। আহরার লজ্জায় অরুনিকার দিকে তাকাতে পারছেনা। কে জানে, অরুনিকা কি ভাবলো? কি যে বিব্রতকর অবস্থা। অরু আড়চোখে বারবার আহরারকে দেখছে। তার একদিকে মায়া লাগছে আবার হাসিও পাচ্ছে। কিছুসময় পর সে নিজেই বলে উঠলো,

–আমিও কিন্তু ঝাল খেতে পারিনা একদমই।

চলা থেমে যায় আহরারের। ঝট করে ফিরে তাকায় অরুনিকার দিকে। কৌতুহলী স্বরে বলে ওঠে,

–তোমারও ঝাল লেগেছিলো।

অরুনিকা ওপর নিচ মাথা নাড়ায়।

–তো আগে বলোনি কেন? চুপচাপ খেয়ে যাচ্ছিলে।

–যে কারণে আপনিও কিছু না বলে খেয়ে যাচ্ছিলেন।

সহসা কোনো জবাব দিতে পারেনা আহরার। দৃষ্টি সরিয়ে এদিক সেদিক এলোমেলোভাবে দেখতে থাকে। তারপর হুট করেই একটু দূরে চোখ পড়তেই আহরারের চোখ দুটো চকচক করে ওঠে। সে খুশি মন নিয়ে বলে ওঠে,

–অরু, ওই দেখো সামনে যে পার্কটা দেখা যাচ্ছে, খুব সুন্দর। চলো যাই।

আহরার অরুনিকা হাঁটতে হাঁটতে চলে আসে পার্কটাতে। ভেতরে ঢুকতেই দেখতে পায় বেশ কয়েকজোড়া কপোত-কপোতী ঘুরে বেড়াচ্ছে। সকলেই যেন ভালোবাসায় মোড়ানো প্রেমকাব্য রচতে ব্যস্ত। প্রেমিকের মুখ নিঃসৃত প্রেমময় বাক্য আর তা শুনে প্রেমিকাদের লজ্জায় রাঙা হওয়া মুখ, কেউ কেউ পরম যত্নে হাত আগলে নির্নিমেষ চোখে চেয়ে দেখছে প্রেমিকার মায়াভরা মুখ। সকলের মুখমন্ডলে লেপ্টে রয়েছে সুখানুভূতি। অরুনিকার মনটা অন্যরকম হয়ে গেলো। কি অদ্ভুত এক ভালো লাগা কাজ করছে তার। জানেনা। হাঁটতে হাঁটতে কিছুটা ভেতরে আসতেই এবার এক আইসক্রিমওয়ালাকে দেখতে পায় আহরার। তখনই অরুনিকার উদ্দেশ্য বলে ওঠে,

–অরু, তুমি দাঁড়াও আমি আইসক্রিম নিয়ে আসছি।

অরু খানিকটা কঠোরস্বরে বাধা দিলো,

–দাঁড়ান।

আহরার অরুনিকার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে। অরুনিকা একই স্বরে বলে ওঠে,

–আপনি কি আমার ভালোলাগা ভেবেই এসব ফুচকা, আইসক্রিম খাওয়ানোর জন্য এমন অস্থির হচ্ছেন?

ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাকিয়ে থাকে আহরার। কি বলবে সে? আমতাআমতা করে বললো,

–অস..অস্থির হলাম ক..কই?

–এইতো অস্থির হচ্ছেন? ব্যাপারটা কি বলুন তো।

আহরার জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নেয়। মেয়েটা এভাবে ধরে ফেলছে কেন? অরুনিকার চোখের দিকে তাকাতে পারছেনা আর। আশেপাশে তাকাচ্ছে। মাঝে মাঝে মাথা চুলকিয়ে ভাবছে কি বলবে। তার অবস্থা দেখে অরুনিকা ফিক করে হেসে দেয়। কিন্তু আহরার তা দেখে না। অরুনিকা নিজেকে সামলে কন্ঠে কিছুটা গাম্ভীর্যতা আনার চেষ্টা করে বললো,

–আপনি হয়তো ভেবেছেন মেয়েরা এসব পছন্দ করে। কিন্তু সত্য হলো এটাই যে, মেয়ে হয়েও আমি এসবের কিছুই পছন্দ করিনা।

আহরার হতভম্ব হয়ে চেয়ে রয়। অরু এসব পছন্দ করেনা? আর সে ও অরুর পছন্দ অপছন্দ না জেনেই বেকার বেকার কিসব করে বেড়ালো। আহরারের মুখে আঁধার নেমে আসে। মুখটা দেখার মতো হয়েছে। অরুনিকা ঠোঁট চেপে হাসে। বহু কষ্টে সে হাসি আটকে রাখার চেষ্টা করছে। হালকা কেশে অরু আবারো বলে উঠলো,

–তবে, পার্কটা ভালো লেগেছে। এখানে হাঁটতে মন্দ লাগবেনা।

আহরারের মুখের আঁধার সরে গিয়ে তাতে দেখা যায় খুশির ঝিলিক। উৎফুল্ল হয়ে বলে ওঠে,

–তাহলে চলো হাঁটি।

অরুনিকা হেসে ফেলে। তারপর হাঁটা শুরু করে। নরম ঘাসের ওপরে হাঁটতে বেশ লাগছে অরুর। তার চেয়েও বেশি ভালো লাগছে পাশে থাকা এই মানুষটাকে। আড়চোখে তাকিয়ে পরখ করে নিলো মানুষটার মুখাবয়ব। মানুষটার ঠোঁটের কোণে তৃপ্তির হাসি। নির্মল হাসির রেশ ছড়িয়ে আছে পুরো মুখমন্ডলে। অরুনিকা সামনে তাকায়। আলগোছে আহরারের আঙুলে স্পর্শ লাগতেই হাত মুঠো করে নেয় সে। পরক্ষণেই কি ভেবে ঠোঁটে সূক্ষ্ম হাসি ফুটিয়ে নিজেই নিজের আঙুল দিয়ে আঁকড়ে ধরে আহরারের আঙুল। আহরার মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়ায়। তার হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে কেউ তাকে ধমকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। অরুনিকা আহাম্মক হয়ে যাচ্ছে বারবার। এই সেই আহরার যে তার পেছনে কত পাগলের মতো ছুটেছে তার মন পাওয়ার জন্য। যদিও সে সাড়া দেয়নি বা দিতে পারেনি। কারণ সে ভরসা করতে পারেনি। কিন্তু মানুষটা এখন তার স্বামী। পূর্ণ অধিকার প্রাপ্ত। তার যত জল্পনা কল্পনা, আহ্লাদ, ভালোলাগা, ভালোবাসা সব তো এই মানুষটার জন্যই হওয়া উচিত। তাই সে একটু একটু করে নিজের সমস্ত জড়তা, সংকোচ, ভীতি কাটিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে মানুষটার দিকে। তাকে নিজের সাথে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে নেয়ার আশায়। অরুনিকা হাঁটতে শুরু করে। আহরারও চুপচাপ হাঁটছে। কারণ তার আঙুল অরুনিকা শক্ত করে পেঁচিয়ে রেখেছে নিজের আঙুলের সাথে। বিস্ময়কর অনুভূতি নিয়ে সে হেঁটে যাচ্ছে অরুনিকার সাথে। অরুনিকার চোখেমুখে নেই কোনো লজ্জা, নেই কোনো সংকোচ ভাব। ঠোঁটজুড়ে মায়াময় হাসি। সেই হাসি আহরারে ভেতর নাড়িয়ে দিচ্ছে। একটাসময় আহরারও তাল মেলায় সেই হাসির সাথে।
সন্ধ্যা নেমেছে। আকাশে রক্তিম আভা। হাওয়া বইছে, ঠান্ডা হাওয়া। সেই হাওয়ার তালে মৃদুছন্দ মিলিয়ে দুলছে গাছের ডালপালা। কোথা হতে ভেসে আসছে মিষ্টি এক ঘ্রাণ। মোহনীয় গোধূলি সাজে সজ্জিত প্রকৃতির মাঝে হেঁটে চলেছে রূপবান আর তার শ্যামবতী।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here