অতিরিক্ত চাওয়া { ২ }
২৭|
সুন্দর এক সন্ধ্যা। নানান আলাপ-আলোচনায় বিভর সবাই। খুশি তাড়াহুড়ায় নানান নাস্তা সামনে এনে দিচ্ছে। আবিরের গুরুত্বপূর্ণ কিছু কল আসছে। কিন্তু সে রিসিভ করছে না। কল রিসিভ করলেই চলে যেতে হবে এখনই। কিন্তু সে যেতে চাচ্ছে না। তাই ফোনটা বন্ধ করে ফেলল। তার হয়ে ম্যানেজার হ্যান্ডেল করে ফেলবে নিশ্চয়ই। উঠানে মতামত আদানপ্রদান চলছে, অভি আর বিমানের বিয়ের ব্যাপারটা নিয়ে। আনন্দ আরও সময় চাইছে। এ-ই মাসের মাঝে সে এতো টাকা কিভাবে যোগাবে? বিয়েতে প্রচুর খরচ। নিম্নে ৫-৬ লাখ তো লাগবেই। বিমানের বিয়ের জন্য মাত্র ৪ লাখ জমেছে। বাকিটা নাহয় গাছপালা আর জমিন বেচে যোগানো যাবে। কিন্তু তার জন্য মাস খানিক সময় লাগবে। এ-ই মাসের ৭ দিন চলে যাচ্ছে। হাতে যেই সময় আছে, তাতে সে সবকিছু সম্পুর্ন করতে পারবে নাকি সন্দেহের বিষয়।
হাসিবুলের শান্ত কন্ঠে আনন্দ সেদিকে মনোযোগ দিলো,
—- সমস্যা থাকলে খুলে বলতে পারেন আনন্দ ভাই।
আনন্দ কাঁচুমাচু করছিল। সে বলতে চাচ্ছে না। কিন্তু আমিদের মাথা ঝুলানো আর বন্ধুত্বপূর্ণ হাসি দেখে খুলে বলল,
—- বড় মেয়ের বিয়ে। অনেক খরচ। এ-ই মাসের মাঝে বিয়ের এতো খরচ, একটু সমস্যা হচ্ছে। আবার অভি বাবাকে কিছু দিতে হবে। মেয়ের গয়নাগাটির কেনাকাটা। তারপর,
তৃষ্ণা থামিয়ে দিলো,
—- মেয়ে বড় করে, পড়াশোনা করিয়ে দিচ্ছেন। এটাই অনেক। শুধু বিয়ের ব্যাপারটা দেখুন।
আবির সহমত হলো,
—- বেশি সমস্যা হলে বাড়িতেই নিজেরা মিলে বিয়েটা করাতে পারি। পরে নাহয় বড় করে রিসিপশন রাখা যাবে।
আনন্দ অমত করলো,
—- না, না। মেয়ের বিয়ের খরচ উঠানোর সামর্থ্য আছে ইনশাআল্লাহ।
হাসিবুল আনন্দের কাঁধে হাত রাখল,
—- আনন্দ ভাই। আমার টাকা-পয়সা আছে। নেই শুধু একটা মেয়ে। আপনি আমাকে মেয়ে দিচ্ছেন এটাই বড় পাওয়া। গয়নাগাটি এগুলো অভির আম্মু তার ছেলে- বউয়ের জন্য আগেই তৈরি করে রেখেছে। আপনি দেওয়া নিয়ে ভাববেন না। সাহায্য লাগলে অবশ্যই বলবেন।
আনন্দ হেসে মাথা ঝুলালো।
খুশি বেশ লজ্জা পাচ্ছে। সে নিজে চৌধুরী বাড়ি দেখে এসেছে। সেখানে সেই বড় বাড়ির লোক যখন তাদের এ-ই সাধারণ বাড়িতে এসেছে।ব্যাপারটা তাকে লজ্জায় ফেলছে। কিন্তু পরক্ষণেই জয়ার উজ্জ্বল হাসি দেখতেই লজ্জাটা ধুয়ে যাচ্ছে। খাবার পরিবেশন করতে গিয়ে, হঠাৎ জয়া প্রশ্ন করে বসলো,
—– ভাবী, আপনার আমার তৃষ্ণা-কে কেমন লাগে?
খুশি কিছুটা অপ্রস্তুত ছিলো এমন প্রশ্নের জন্য। সে হালকা হাসলো,
—– ছেলে আপনার মাশাল্লাহ।
জয়া সন্তুষ্ট হলো,
—– ওর জন্য যেকোনো মেয়ের হাত চাইলে পাওয়া যাবে তো।
খুশি ঠোঁটের হাসির রেখা আরও বড় হয়ে উঠলো,
—– অবশ্যই।
জয়া আপনমনেই বলতে লাগলো,
—– ছেলেটা আমার খুবই জেদি, অধৈর্য্যে, অসামাজিক, একঘেয়ে। যা মন চাইবে করবে। এমন ছেলেকে কে মেয়ে দিবে? এখনও আমার রাত জেগে থাকতে হয় ওকে খাওয়ানোর জন্য। বাড়ি থাকলে সারাদিন ঘ্যানঘ্যান করতে হয়। তা-ও কোনো কাজ হয়না। ওর বাবার কথার ও পাত্তা দেয়না। কি জানি কার মতো হয়েছে। ওর বাবা, ভাই, আবার এমন রাগী,জেদি, একঘেয়ে না । এটাই এমন হয়েছে।
খুশি হালকা হাসলো। সে জয়ার ‘ কেমন লাগে তৃষ্ণাকে ” প্রশ্নের ব্যাপারটা বুঝেছেন। আপাতত সে কথা ওঠাবেন না। মেয়ে এখনও ছোট। বড় হোক।
আমিদের হঠাৎ কল এলো। বড় এক গ্যাঞ্জাম লেগেছে তাদের দলের সাথে। মারামারির পর্যায়ে চলে যাচ্ছে ব্যাপারটা। এইসব মারামারির ব্যাপার তৃষ্ণাই হ্যান্ডেল করে। কিন্ত এখন তো তৃষ্ণা পুরোপুরি সুস্থ না। হাতের পাতায় এখনও ব্যান্ডেজ করা। কপালের সাইডে পট্টি। আমিদের উদাসি চিন্তা দেখে তৃষ্ণা নিজেই জিজ্ঞেস করলো,
—– হয়েছে কী?
—– পাশের গ্রাম থেকে কিছু ছেলে-পেলে এসে নাকি হামলা করেছে। মারামারি হচ্ছে। এখনই যেতে হবে।
তৃষ্ণা ফোন পকেটে ভরে, উঠে দাঁড়ালো। আবিদকে ইশারা করলো সঙ্গে চলতে।
—- আমি যাচ্ছি।
জয়া দ্রুত অন্য রুম থেকে চলে এসেছে। নির্দেশ করে দিলো,
—- কোথাও যাবেনা। আমার সাথে এখান থেকে সোজা বাড়ি যাবে।
আমিদ অমত করলো,
—– তোর যেতে হবেনা। আমি আবিদ বা অভিকে নিয়ে যাচ্ছি।
তৃষ্ণা ততক্ষণে বেরিয়ে যাচ্ছে। জয়া থামাতে সক্ষম হননি। খুশি দরজার সামনেই ছিলো। ধীর আওয়াজে সে বলল,
—- কিছু ত খেলে না বাবা। সমস্যা সমাধান করে আসবে ত?
তৃষ্ণা জবাব দিলো,
—- আমি চেষ্টা করব।
আনন্দ ও উঠে দাঁড়ালো,
—- সমস্যা সমাধান করে দ্রুত এসো।
কিছুটা গিয়ে তৃষ্ণা ফিরে আবিদকে বলল,
—- বেলীকে ডেকে আনতো।
কথাটা বলে সে বেরিয়ে গেলো। এদিকে উঠানে উপস্থিত সবাই শুনেও না শোনার মতো করে নিজেদের মতো কথা বলতে লাগলো।
বিমানকে শাড়ী পরানো হচ্ছে। অঞ্জলি, আয়েশা পরাচ্ছে। বেলী বিছানায় বসে দেখছে। এবং তাদের টুকটাক কথা শুনছে। এবং আপনমনে বিড়বিড় করছে যে, সে এ-ই রুমের বাহিরে আজ যাবেনা। মানে শপথ করে ফেলেছে যাবেনা। কিন্তু একটু পরপর খুশি তাকে ডাকছে। এটা কর, ওটা কর। বেলী তাও বিছানার সাথে আঁটকে আছে। অঞ্জলি দুষ্টু হেসে প্রশ্ন করলো,
—- বেলী তুমি কি আজ রুমের বাহিরে যাবেনা?
বেলী অসহায় চোখে তাকিয়ে অঞ্জলির দিক,
—- ম..মানে?
আয়েশা বিমানের কুঁচি গুঁছিয়ে নিচ্ছে,
—- তুমি কি ভাবছ রুম থেকে না বেরোলে, তৃষ কথা না বলে চলে যাবে?
বেলী বারবার পলক ফালাচ্ছে। আয়েশা আবার বলতে লাগলো,
—– দেখা যাবে সকলের সামনে এসে বলছে,
” বেলী এক্ষুনি সাথে চল কথা আছে। ”
কথা শেষ করে আয়েশা আওয়াজ করে হাসছে। অঞ্জলি আর বিমানও হেসে যাচ্ছে। বেলী লজ্জা পাবে নাকি ভয় বুঝতে পারছেনা। অবুঝের মতো সে তিনজনের খিলখিল হাসি দেখছে।
এ-র মাঝে আবিদ দরজায় নক করে। ততক্ষণে বিমানের শাড়ি পড়া কমপ্লিট। আবিদ প্রবেশ করেই বেলীকে তাড়া লাগালো,
—– ভাই ডেকেছে। দ্রুত চল।
বেলী না করবে তার আগেই আবিদ আবারও বলল,
—- কোনো এক কাজে যাবে। আজ আর আসবে না। এখন তুমি নটাংকি করলে নির্ঘাত তোমার কপালে শনি আসবে।
এবার বেলী নড়েচড়ে উঠলো। একটু-আধটু বাহানা খুঁজতে লাগলো। আবিদ চলে যেতে যেতে বলল,
—- দ্রুত যাও ভাই দাঁড়িয়ে।
আবিদ যেতেই শুরু হলো শীলার নানান কূটনৈতিক কথা বার্তা। বেলী বেশ দমে গেল। তাও শীলাকে আঙুল দিয়ে বোঝালো ” বোঝাপড়া বাকি আছে “! বুকে ফুঁ দিয়ে পেছন দরজা দিয়ে রউনা হলো।
বেলী পৌঁছিয়ে দেখল আবিদকে তৃষ্ণা কিছু বলছে। এবং মাথা দুলিয়ে আবিদ গাড়ি করে চলে যাচ্ছে। বেলীকে দেখতে পেয়ে তৃষ্ণা এগিয়ে গেলো,
—- হয়েছে কী তোর?
বেলী মুখ কাঁচুমাচু করে জবাব দিলো,
—- কী হবে?
—- কুয়েশ্চন আমি করেছি। উত্তর দে।
—- কিছুই হয়নি।
তৃষ্ণা ভ্রু উঁচু করলো,
—- তাহলে এমন অ্যাবনরমাল বিহেভিয়ার কেন?
বেলী ভ্রু কুঁচকে রইলো। তৃষ্ণা বেলীর গাল টেনে ধরলো,
—- কে কী বলেছে?
—- সবাই বলে।
—- কী বলে?
—- আপনি আপনার নিজেকে আর আমাকে দেখেছেন?
—- হ্যাঁ। সারাক্ষণ।
—- তাহলে অমিল গুলিও দেখেছেন নিশ্চয়ই।
—- অমিল কী?
—– আপনার টি-শার্ট এ-র প্রাইজ বলুন।
—– আমি এগুলোর দাম মনে রেখেছি?
—– কতো হতে পারে?
—– দু’আড়াই হাজার।
—– অনেক দাম। প্যান্ট আর জুতো বাদই দিলাম। আমারটার জানেন? কামিজ মাত্র ছয়শত টাকা। মজুরি একশ-পঞ্চাশ। স্যান্ডেল দুইশো বিশ টাকা।
পার্থক্য দেখতে পাচ্ছেন? আমাদের একদম মানায় না।
বেলীর দু’গাল চেপে ধরলো তৃষ্ণা,
—- এ-ই মুখটা, চুল, কাপড়ের ভিতরে যা আছে। সেগুলোর দাম তো আমার নিজের থেকে বেশি। এগুলোর প্রাইজ?
বেলী টপটপ চোখে বলল,
—- ছিঃ
—- ছিঃ কী? পার্থক্য বললাম।
—- গালে ব্যাথা পাচ্ছি।
তৃষ্ণা এবার বেলীর চুল টেনে ধরলো। নিজের দিক টেনে আনলো,
—- কতদিন ধরে দেখা হয়নি বলত?
—- জানি না।
—- পুরো তিনদিন। বল, কি করা উচিৎ তোর?
বেলী আঁড়চোখে অন্যদিকে তাকাচ্ছে। তৃষ্ণার চাহনি উপেক্ষা করে বলল,
—- কোথায় জেন যাচ্ছিলেন?
—- হুঁ।
—- তো যান।
তৃষ্ণা হঠাৎ বেলীর ঘাড়ে কামড়ে দিল। বেলী উঁহু করে সরে যেতে চাইলে তৃষ্ণা সেখানে বেশ কিছু চুমু খেয়ে নিলো। বেলীকে গভীর ভাবে জড়িয়ে ধরলো ,
—- উহ! বেলী। তোকে প্রচন্ড মিস করেছি।
তৃষ্ণার স্পর্শে আর হালকা হুসকি আওয়াজে, বেলী স্তব্ধতায় কেঁপে উঠলো।
চলবে
নাবিলা ইষ্ক