#টিপ_টিপ_বৃষ্টিতে
#পর্ব_২৯(শেষ পর্ব)
লেখিকা #Sabihatul_Sabha
ঐশী বাসায় এসে দেখে বাবু ঘুমিয়ে আছে।
শান্তির একটা শ্বাস ফেলে শাশুড়ীর কাছে গেলো।
শুভ আর ঐশীর মেয়ে শুভ্রতা। এক বছর চলছে শুভ্রতার।
ঐশী গিয়ে শাশুড়ীর সাথে কাজে হাত লাগালো। পূর্ণা বাবুর কাছে বসে আছে।
আজ সন্ধ্যায় বাসায় ছোটো খাটো একটা পার্টির আয়োজন করা হয়েছে।
ঐশী ওর শাশুড়ী কে রুমে পাঠিয়ে নিজে এক হাতে সব কিছু করা শুরু করলো।
কাজ করতে করতে রান্না ঘরের দরজার দিকে তাকালো। শুভ দরজায় হেলান দিয়ে ঐশীর দিকে তাকিয়ে আছে।
ঐশী গরমে ঘেমে নেয়ে একা কার।
শুভ ঐশীর কাছে গিয়ে, ঐশীর শাড়ির আঁচল দিয়ে ওর মুখ মুছে দিলো৷
ঐশীঃ বাসায় কখন আসলেন আপনি…?
শুভঃ কিছু সময় আগে। বলেই শুভ ঐশী কে রান্নায় হেল্প করা শুরু করলো । দুই জন মিলে রান্নার কাজ শেষ করলো।
সন্ধ্যায় দীপ্ত আর মৌ, দীপ্তি, শান্ত, চলে আসলো।
মৌ এর পাঁচ মাস চলছে প্রেগন্যান্সির।
একটু পর সোনিয়া, আদিত্য, সুরভি আসলো।
সুরভি এখন মুরতাসিম অফিসে জব করে। মুরতাসিম এর পিএ।
সবাই মিলে আড্ডায় মেতে উঠলো তখনি আবার প্রবেশ করলো আরেক জোরা কাঁপল।
সুরভি বললো,’ ভাবি তোমাদের আসতে এতো দেরি কেনো..?
অথৈ রেগে সৌরভ এর দিকে তাকালো।
সৌরভ অথৈর তাকানো দেখে ভয়ে আদিত্যের কাছে গিয়ে কথা বলা শুরু করলো।
সুরভিঃ কিছু কি হয়েছে ভাবি..?
অথৈ মুখে হাসি ঝুলিয়ে বললো,’ না না সুরভি কিছু হয়নি।’
আসলে ওই দিন অথৈর জন্য যেই ছেলে পক্ষ আসার কথা ছিলো সেটা সৌরভ এর পরিবার ছিলো। কিন্তু সৌরভ অথৈ কে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য বলেনি।
অনেক দিন পর সব বন্ধু এক সাথে হওয়ায় কথার ঝুড়ি নিয়ে বসলো।
শান্ত সোনিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো,’ বেয়াইন কেমন আছেন..? ‘
সোনিয়া রেগে তাকালো শান্তর দিকে। এই বেয়াদব ছেলে আজ তিন বছর ধরে ওর পিছু ঘুরছে।
শান্ত দাঁত কেলিয়া আবার বললো,’ বেয়াইন আপনাকে রাগলে না অনেক হট লাগে। ‘
সোনিয়া রেগে হাতের বোতল ছুড়ে মারলো শান্তর দিকে।
সবার আড্ডার মাঝে দরজা কয়েক বার কলিং বেল বাজলো।
ঐশী গিয়ে দরজা খুলে দিলো। সামনের মানুষটাকে দেখে স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো। সে কি স্বপ্ন দেখছে। নিজের হাতে নিজে চিমটি কাটলো। “আহ্ ” না তো এ তো স্বপ্ন নয়। সয়ং বিথী ওর ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে সাথে পিচ্চি একটা ছেলে।
তীব্রর ফোনে অসংখ্য বার এই বাচ্চা কে দেখেছে ঐশী।
এ যে আমাদের মুনতাসীর।
বিথীর ছেলের নাম মুনতাসীর।
ঐশীকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে বিথী হেঁসে বলে উঠলো,’ বাসায় ডুকতে দিবি না।
ঐশীর যেনো হুঁশ ফিরলো।
ঐশী সরে দাঁড়িয়ে বিতীকে আসতে বললো।
বিথী বাসায় ডুকতেই মুনতাসীর ঐশীর সামনে এসে বললো,’ আনতি…
ঐশীর চোখ জলে ভরে উঠলো।
বাসার সবাই বিথীকে দেখে অবাক হলো।
দীপ্ত নিজের অজান্তেই বলে উঠলো,’ ভাবি!!!..
সবাই এবার বিথীর থেকে চোখ সরিয়ে দীপ্তর দিকে তাকালো।
দীপ্ত একটা বোকা হাসি দিয়ে বললো,’ এভাবে তাকিয়ে আছো কেনো..? কেমন আছেন বিথী আপু..?
বিথীঃ আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তুমি কেমন আছো..?
এক এক করে সবার সাথে কথা হলো। ঐশী চুপচাপ তাকিয়ে আছে মুনতাসীর এর দিকে।
পূর্ণা শুভ্রতা কে নিয়ে ঐশীর সামনে এসে বললো,’ ভাবি বাবু কান্না করছে ধরো তো। ‘
ঐশী কোলে নেওয়ার আগেই বিথী বাবুকে কোলে নিয়ে জড়িয়ে ধরলো। চোখ থেকে গড়িয়ে পরছে পানি। আজ ছোটো একটা অভিমানে কেটে গেলো তিনটা বছর।
ঐশী মুনতাসীর এর সামনে হাঁটু গেড়ে বসলো। মুনতাসীরকে জড়িয়ে ধরে সারা মুখে চুমুয়ে বড়িয়ে দিলো ঐশী। মুনতাসীর ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে ঐশীর দিকে।
সব শেষে বিথী ঐশীর সামনে গিয়ে জড়িয়ে ধরতে চাইলো কিন্তু ঐশী সাথে সাথে দূরে সরে গেলো।
বিথী টলমল চোখে তাকালো ঐশীর দিকে।
শুভ এসে ঐশীর দিকে তাকিয়ে বললো,’ ঐশী এতোটা রাগ করা ঠিক নয়। রাগ করে কি পেয়েছো..? জীবন থেকে তিনটা বছর শেষ। প্লিজ…
ঐশী গুটিগুটি পায়ে গিয়ে দাড়ালো বিথীর সামনে। জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিলো। বিথীও ঐশীকে জড়িয়ে ধরে কান্না করছে। সবার চোখে পানি জমে গেলো।
মুনতাসীর গিয়ে দাঁড়ালো শুভ্রাতার কাছে।
শুভ্রতা হাত পা নেড়ে খেলা করছে।
মুনতাসীর ভ্রু কুঁচকে শুভ্রতার গালে আঙ্গুল দিয়ে ধরলো।
শুভ্রতা ড্যাব ড্যাব করে বড় বড় চোখ গুলো দিয়ে মুনতাসীর এর দিকে তাকালো।
মুনতাসীর এর কাছে ব্যাপার টা খুব সুন্দর লাগলো। সে খুশিতে শুভ্রতার গালে আবার আঙ্গুল দিয়ে টুকা দিলো৷
শুভ্রতা খিলখিল করে হেঁসে উঠলো। মুনতাসীর শুভ্রতার সাথে খেলতে শুরু করলো।
খাওয়া দাওয়া শেষ করে সবাই নিজেদের বাসায় চলে গেলো৷
বিথী যেতে পারেনি৷ মুনতাসীর শুভ্রতা কে ছাড়া যাবে না । সে সাথে করে শুভ্রতা কেও নিয়ে যাবে কান্নাকাটি শুরু করলো।
বিথী অসহায় চোখে তাকিয়ে আছে ঐশীর দিকে। ঐশী খুশিতে বলে উঠলো।
আপু থাক না মুনতাসীর আজকে তুইও থাক। তোর সাথে অনেক দিন হলো মন খোলে কথা বলা হয় না। আজ সারা রাত দুই বোন কথা বলবো।
কথায় কথায় বিথী আকাশের সম্পর্কেও জানতে পারলো৷ এতো বছর পর আবার বুকটা চিনচিন ব্যাথা করে উঠলো। চোখের সামনে ভেসে উঠলো প্রেমিক পুরুষটির মুখ।
🍁🍁
কেটে গেছে আরও কয়েক দিন।
বিথী এখানে আবার আরেকটা জব খোঁজে নিয়েছে। সব মিলিয়ে খুব ভালোই কাটছে ওর জীবন।
ঐশী বাবুকে খাবার খাওয়াতে গিয়ে বিরক্ত হয়ে শুভর দিকে তাকালো।
ঐশী রেগে বললো,’ বাবার মতো হয়েছে…
শুভ আরচোখে ঐশীর দিকে তাকিয়ে মেয়েকে কোলে তোলে নিলো৷
শুভঃ বাবার মেয়ে তো বাবার মতোই হবে।
ঐশীঃ তাহলে আপনি সামলান না আপনার মেয়েকে৷ আমি আর পারবো না। আজ থেকে আপনি ওর দেখাশোনা করবেন।
শুভঃ আচ্ছা করলাম।
ঐশী আরও রেগে গেলো। রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই শুভ আরেক হাতে ঐশীকে জড়িয়ে ধরলো।
ঐশীঃ ছাড়ুন বলছি।
শুভঃ বউ টা কথায় কথায় কেনো এতো রাগ করে..
ঐশীঃ আপনি রাগের কাজ করেন তো আমি কি করবো!!
শুভঃ এখন আমি কি করলাম..?
ঐশীঃ আমি যখন আপনার সাথে ঝগড়া করতে চাই। সুন্দর করে ঝগড়া করবেন। সব কিছু এভাবে মেনে নেন কেনো..?
শুভঃ ঐশী আমি চাই না আমার কোনো কথায় আমার লক্ষি বউটা কষ্ট পাক তাই সব মেনে নেই। খুব বেশি ভালোবাসি আমার মিষ্টি বউটা কে।
ঐশী লজ্জায় মুখ ডাকলো শুভর বুকে।
বাহিরে আকাশ কালো করে টিপ টিপ বৃষ্টি পরছে, এই যেনো ভালোবাসা নিয়ে আসা বৃষ্টি।
🍁🍁🍁
আজ অফিস থেকে তারাতাড়ি বেড়িয়ে পরলো বিথী।
অফিস থেকে কিছুটা দূরে আসতেই আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে গেছে।
বিথী আশেপাশে গাড়ি, রিক্সা খুঁজলো। কিছুই না পেয়ে হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিলো।
গায়ে বাসন্তী রঙের শাড়ি।
কিছুটা দূর আসতেই বৃষ্টি শুরু হলো। বিথী রাস্তার পাশে এক ছাউনির নিচে গিয়ে দাঁড়িয়ে পরলো।
কিছু সময় পর বৃষ্টিতে ভিজে একটা ছেলে এসে দাঁড়ালো বিথীর পাশে।
বিথীর মনে পড়ে গেলো আজ থেকে পাঁচ বছর আগে ঠিক এমন ভাবেই এসে দাঁড়িয়ে ছিলো সে। আবারও আজ সেই দিনটির কথা মনে পড়ে গেলো।
হঠাৎ পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটা বলে উঠলো,’ শাড়িটা ঠিক করে দাঁড়ান। ‘
বিথী চমকে তাকালো ছেলেটির দিকে। মুখে ফুটে উঠলো এক চিলতি হাসি। নিজের শাড়ির আঁচল ঠিক করে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বললো,’ মুরতাসিম আপনি…? ‘
মুরতাসিমঃ যাক মনে রেখেছেন তাহলে…
বিথীঃ ভুলে যাওয়ার ও তো কথা নয়।
মুরতাসিমঃ কবে আসলেন এখানে..?
বিথীঃ আমার থেকে ভালো তো আপনি জানেন।
মুরতাসিম আমতা আমতা করে বললো,’ আমি জানবো কিভাবে..?
বিথী মুচকি হেসে বললো,’ বাদ দেন সে সব কথা। আপনি এখানে। এই সময়। কোনো কাজে এসেছেন..?
মুরতাসিমঃ হুম।
বিথীঃ কি কাজ..?
মুরতাসিমঃ কোনো এক নারীকে আজ থেকে কিছু বছর আগের রূপে দেখতে এসেছি।
বিথীঃ দেখা হয়ে গেছে কি..?
মুরতাসিম বিথীর দিকে তাকিয়ে বললো,’ হয়তো হয়ে গেছে। ‘
বিথী কিছু না বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে আর বৃষ্টি দেখছে।
মুরতাসিম নিরবতা ভেঙে বললো,’ ছেলের নাম মুনতাসীর রাখার কারন..?
বিথীঃ কোনো একদিন এমন এক নামের পুরুষ আমার জীবন এলোমেলো করে দিলো। এমনি এক দিনে আমার সামনে এসে ছিলো। আমি হাজার খোজে ও তাকে আর পাইনি। তাকে খুজতে খুঁজতে অচেনা রাস্তা বেছে নিলাম, আপন করে নিলাম। আবার ঠকেও গেলাম। তাই সেই পুরুষের নামের সাথে মিলিয়ে ছেলের নাম রেখে দিলাম।
মুরতাসিম বুঝে গেলো বিথী ওকে অনেক আগেই চিনে ফেলেছে।
মুরতাসিমঃ কিভাবে সেই পুরুষকে চিনলেন..?
বিথীঃ সত্য একদিন সামনে আসেই। আমরা লুকিয়ে থাকতে চাইলেও এমন কিছু ঘটনা ঘটে যা আমাদের সবার সামনে নিয়ে আশে।
[ ঐশীর বিয়ের দিন বিথী মুরতাসিম কে চিনতে পারে । মাক্স পড়া অবস্থায় যখন বিথীকে ধরে ছিলো। তখনি বিথী চিনে ফেলে মুরতাসিম কে। ]
মুরতাসিম বিথীর সামনে গিয়ে বললো,’ কারও জন্য জীবন থমকে যায় না। সব ভুলে কি সেই প্রথম যুবকটিকে আপনি মেনে নিবেন বিথী।’
বিথী কিছু বলে না।
মুরতাসিমঃ আমি আপনাকে কখনো কষ্ট পেতে দিবো না বিথী। একবার শুধু একবার বিশ্বাস করে হাতটা শক্ত করে ধরেন।মৃত্যুর আগে আর ছাড়বো না। আমার মৃত্যুর পরেও আপনাকে চাই বিথী।
বিথী কিছু না বলে রহস্যময় হাসি দিয়ে বাহিরে তাকালো টিপ টিপ বৃষ্টি পরছে। এই বৃষ্টির মধ্যেই বেরিয়ে পরলো বিথী।
মুরতাসিম চিৎকার করে বলে উঠলো,’ আপনি মুখে কিছু বলতে হবে না শুধু একবার পিছন ফিরে তাকাবেন। যদি না তাকান তাহলে আজকের পর আমি আর কখনো আপনার সামনে আসবো না বিথী।
বিথী চলে যাচ্ছে।
মুরতাসিম চাতক পাখির মতো তাকিয়ে আছে বিথীর দিকে। মনে মনে আল্লাহ কে ডাকছে। একবার তাকান প্লিজ। শুধু একবার তাকান।
দেখতে দেখতে বিথী চোখের আড়াল হয়ে গেলো।
মুরতাসিম আজ-ও হেরে গেলো। সে আর আসবে না এই কঠিন মানুষটির কাছে। চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা পানি পরলো। ছাউনির নিচে হাঁটু গেড়ে মুখে হাত দিয়ে বসে পরলো মুরতাসিম।
কিছু সময় যেতেই মনে হলো সামনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। চোখ তুলে উপরে তাকাতেই বিথীকে দেখে অবাক হয়ে গেলো। কিছু না বলেই বিথীকে জড়িয়ে ধরলো।
বৃষ্টি থেমে গেছে কিন্তু মুরতাসিম এখনো বিথীকে জড়িয়ে ধরে আছে। ছেড়ে দিলেই যেনো বিথী হারিয়ে যাবে।
কিছু সময় যেতেই মুরতাসিম বিথীকে ছেড়ে দূরে সরে গেলো।
মুরতাসিমঃ সরি বিথী।
বিথীঃ সরি কেনো..?
মুরতাসিমঃ না বলে জড়িয়ে ধরার জন্য।
বিথীঃ ওকে। রাত দশ টায় কল দিয়েন।
মুরতাসিমঃ নাম্বার…
বিথী মুরতাসিম এর দিকে তাকিয়ে বললো,’প্রতি রাতে যেই নাম্বার দিয়ে কল দেন ওটা দিয়ে দিলেই হবে।
মুরতাসিম বুঝলো এবার ও ধরা পড়ে গেছে৷
বিথী মুরতাসিম এর দিকে মুচকি হাসি দিয়ে তাকিয়ে বৃষ্টির মধ্যেই বেরিয়ে গেলো।
মুরতাসিম তাকিয়ে আছে বিথীর যাওয়ার দিকে খুশিতে আজ হয়তো তার ঘুম, খাওয়া দাওয়া কিছুই হবে না। প্রথমে না পাক শেষে তো পেলো।
সমাপ্ত
ভুলত্রুটি মার্জনীয়।