অতিরিক্ত চাওয়া { ২ } ৩৯|

অতিরিক্ত চাওয়া { ২ }
৩৯|

ঘড়ির কাঁটায় এগারোটা পঁয়তাল্লিশ বাজছে। বেলী তৃষ্ণাদের ছাদে কখনও আসেনি। এসেছিলো নাকি মনেও নেই। কিন্তু, আজকে প্রথম এসে ঝলমলে সাজানো ছাদ দেখতে পাচ্ছে। খুব সুন্দর ভাবে লাইটিং করা। উপরে কালারিং ড্রিম-লাইট গুলো জ্বলছে। মারাত্মক সুন্দর দেখাচ্ছে। তারাময় আকাশটাও চমৎকার ফুটে উঠছে। মিডেলে কেক বসিয়েছে। ক্যান্ডেল সাজিয়েছে। অঞ্জলি বেলীকে ইঙ্গিত করে বলছে ,
— শোনো বেলী, এইযে এতো কষ্ট করেযে, তোমার জামাই-র জন্মদিনের আয়োজন করছি আমরা। অথচ, দেখবে তার কোনো খুশিতে বিমোহিত হওয়ার ঝলক নেই। একদম প্লেইন।
আবিদ বলল,
— বিমোহিত হবার ঝলক? আয়োজন তো প্রত্যেক জন্মদিনেই হয়। নরমাল হয়ে গেছে ম্যাটার।

সঠিক বারোটা বাজতে একমিনিট আগে, তৃষ্ণাকে উপরে আনে আবির। বারোটা বাজতেই সকলে চেঁচাচ্ছে ‘ হ্যাপি বার্থডে ‘ বলে। তৃষ্ণা হাফ ছাড়লো,
— এগুলো পালন করার বয়স আমার? তোমাদের এই বাচ্চামি কবে যাবে?
বলতে বলতে সে কেক কেঁটে সবাইকে খাওয়াচ্ছে। কিন্তু বেলীকে খাওয়ালো না। আয়েশা এটা নিয়ে কিছু বলতে নিচ্ছিলো কিন্তু আবির বলতে দিল না৷ এদিকে বেলীর চোখ প্রায় লালচে হয়ে আসছে। তৃষ্ণার এমন বিহেভিয়ার একদম নিতে পারছে না। কিছুক্ষণ আগেতো কেমন লাগালাগি করলো। অথচ এখন আবার রাগ দেখাচ্ছে? নাকি ইচ্ছে করে এমন করছে। এতো কষ্ট করেও বেলী চোখের পানি থামাতে পারলো না। চোখ দিয়ে এক ফোঁটা পানি গাল গড়িয়ে পড়লো। সাথেসাথে মুছে ফেলল। এদিকে তৃষ্ণা কিছুটা হাসলো। আমিদ এসে সবাইকে ছাদ থেকে নামাচ্ছে,
— হয়েছে, হয়েছে। এখন যার‍যার রুমে গিয়ে ঘুম।
অগ্যত সবাই চলে যাচ্ছে তৃষ্ণা নামেনি। এবং সে বেলীকেও হাত টেনে ধরে রেখেছে। সবাই ইচ্ছে করেই নেমে যাচ্ছে। বার্থডে-র দিন তার লেইট নাইট পর্যন্ত এঞ্জয় করে। কিন্তু, আজকে তারা তৃষ্ণাকে বেলীর সাথে সময় কাঁটার সুযোগ করে দিল।

বেলী হাত ছুটাতে চাইছে। এখন ‘ ছাড়ুন ‘ বলতে গিয়েও নির্ঘাত কেঁদে ফেলবে। তাই সে মুখ চেপে, কিছু বলছেও না। তৃষ্ণা হাসতে হাসতে বেলীর ঘাড়ে মুখ ছোঁয়াল,
— এতো অভিমান? এতটুকুতেই? তোকে নিয়ে হবে কি আমার।
বেলীকে একপ্রকার জোর করে নিজের দিক ঘোরালো। পাশের টেবিলে থাকা কেক থেকে কিছুটা নিজের মুখে পুড়ে ফেলল। তারপর জোর করে বেলীর গাল চেপে ধরলো। বেলী আন্দাজ করতে পেয়ে চোখ বড়সড় করে, আরও সরার জন্য ঠেলছে। তৃষ্ণা ছাড়ছে না দেখে এবার মুখ খুলল,
— ছাড়ু…
তৃষ্ণার ঠোঁট বেলীর ঠোঁটে চেপে ধরলো। বেলী কিছুক্ষণ ছছটফট করতে থাকলেও, পরে থেমে যায়। কিন্তু, তার কাঁপা-কাঁপি থামছে না, তৃষ্ণার শীতল হাতের খেলায়।

সাগরের স্রোতের মতো তৃষ্ণা-বেলীর বিয়ের খবরে গ্রাম রীতিমতো কাঁপছে। হেডলাইন চলছে,
— এবারও ভেগে বিয়ে। চৌধুরী কি তার ছেলেদের সঠিক শিক্ষা দেয়নি?
এই হেডলাইন যদি চৌধুরীর কানে যেতো, তাহলের জবাবটা এমন হতো,
— অবশ্যই! আমার ছেলেরা আমার শিক্ষার পথেই চলছে।

এতো কানাকানি-তে সেই রাতেই, হাওলাদার বাড়িতে খবর পৌঁছিয়ে গেল। আশেপাশের চেনাজানা অনেকে, আনন্দের সামনেই চলে গেলেন খবর নিয়ে। আনন্দ চুপসে যাওয়া গলায় তাদের জবাব দিয়েছিলেন,
— আমরা জানি। বিয়েটা নির্ধারণ করা ছিলো।
আনন্দের জবাবেও গ্রামবাসী থেমে নেই। নানান আলোচনা,
— মেয়ে ভেগে বিয়ে করেছে তাও, তার থেকে বড় বয়সী এক লোককে, আবার সে বড়লোক।
এতো এতো যুক্তহীন আলোচনায় আনন্দ রেগে গেলেন। সে তো মেনে নিয়েছিলেন। তাহলে? আর কি কিছু বছর অপেক্ষা করা যেতো না? সেই রাত্রে যেতে না পারায়, আনন্দ সকাল-সকাল পৌঁছায় চৌধুরী বাড়ি। বাড়িতে প্রবেশ করে, দরজায় পা আঁটকে তার। সে বাড়িতে ঢুকে একটা রমরমা চিন্তাসমৃদ্ধ চিত্র দেখার আশা রেখেছিলেন। অথচ সে দেখছে, ডাইনিং এ সিরিয়ালে সবাই বসে। সবগুলো চৌধুরী হাজির। তাদের বঁধুরা পাশে বসে। এবং সে তার নিজের দুই মেয়েকেও দেখলেন। বেলী আমিদ আর আবিরের মাঝে। বিমান অভির পাশে। শুধু সেখানে সবসময়ের মতো ছোট চৌধুরী মানে তৃষ্ণা রাজ চৌধুরীকে পেলেন না। এই একটাকে কখনও নরমাল মানুষের মতো বিহেভিয়ার করতে দেখলো না আনন্দ। সে সদা দেখে যাচ্ছে সকলের সামনে এন্ট্রি নিচ্ছে। আনন্দ যখন তৃষ্ণাকে পড়াতে আসতেন চৌধুরী বাড়ি, তখনও তাকে ঘন্টাখানেক বসেই থাকতে হতো এই ছেলের জন্য। কোথার থেকে ধরে নিয়ে আসতেন আমিদ৷ তাও এনে ছেলেকে মারধর করতেন না। বরং বলতেন,
— এখন থেকে টানা দশদিন পড়াশোনা করলে, যা চেয়েছিলে পাবে।
তারপর সেই ছেলে পড়তে বসত। কী সাংঘাতিক এই ছেলে তার হাড়েহাড়ে জানা। অথচ, তাও তার কিছু করার নেই।
যখন মিয়া-বীবী রাজি তো কেয়া কারেগা কাজী?
চৌধুরীবাড়ির এমন আবহাওয়া দেখে আনন্দের রাগ না চাইতেও কমে আসছে। সে আজকে উঁচু গলায় কিছু কথা শোনাতে চাচ্ছিলেন। হঠাৎ,জয়ার দরজায় চোখ পড়তেই সে শুরু করলো,
— আনন্দ ভাই, আনন্দ ভাই। বসেন, বসেন!
বাবাকে দেখেই বেলী সেখানেই দ্রুত দাঁড়িয়ে গেলো। বিমান তার বাবাকে দৌঁড়ে গিয়ে জড়িয়ে আছে। অথচ, বেলী ভয়ে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে। আমিদ আনন্দর জন্য নিজের পাশের চেয়ার খালি করে দিলেন। এবং নিজে হাতে চেয়ার টেনে বসালেন,
— সমস্যা হয়নি তো আনন্দ ভাই?
আনন্দ না চাইতেও হালকা হাসলো,
— না৷
জয়া দ্রুত আনন্দকে খাবার পরিবেশ করছেন। কিন্তু আনন্দ বললো,
— আমি খেয়ে এসেছি।
আবিরের জবাব,
— ধুর! এটা বিশ্বাস করার মতো কথা? মেয়ে নেই বাড়ি আর আপনি খেয়ে আসবেন? আমার তো মনে হচ্ছে, আপনি রাত থেকেই বসে ছিলেন, সকালের অপেক্ষায়।
আনন্দ কিছুটা নড়ে বসলো। কথাটা সত্য। তার ঘুম হয়নি। বরং, বলতে গেলে খুশির ও হয়নি ঘুম। মেয়ের চিন্তায় দু’জন একদম মিইয়ে ছিলেন। খুশি নিজেও আসতে চেয়েছিলেন সাথে। বেলীর মাথায় চোট লেগেছে জেনে বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েছে। আনন্দ সাথে আনেনি। কারণ সে তার মেয়েকে আজ নিয়েই যাবেন। বিয়ে হয়েছে তো হয়েছে। বেলী প্রাপ্তবয়স্ক না হওয়া পর্যন্ত উঠিয়ে দিবেন না।
আনন্দ খাবেন না জানালেন। তাও আমিদ শুনলেন না। বাধ্য হয়ে খাবারে হাত দিতে হলো।
বেলী সেইযে দাঁড়িয়েছে তো দাঁড়িয়েছেই। তাকে টেনে আর কেউ বসাতে পারলো না। আনন্দের দিক টুকটুক চোখে তাকিয়ে। আনন্দ খেয়াল করেও মেয়ের দিক তাকায়নি। মাথায় ব্যান্ডেজ, এমন অবস্থায় মেয়েকে বেশি দেখলে কড়াকড়ি কিছু কথা শোনাতে পারবে না। ছোট্ট মেয়েটা তার অবুঝ একদম কিছুই বুঝত না। সেই মেয়েটাকে তার কী করে ফেলল। আহা! ভাবতেই আনন্দের মাথা ধরে যায়।

সকলের খাওয়া যখন শেষ পর্যায়ে তখন দেখা গেলো তৃষ্ণাকে। তার চোখ লালচে। সে এসেই সোফায় গা এলিয়ে বলল,
— মা, কফি হবে।
জয়া ছেলেকে এক প্রকার টেনে টেবিলে বসালেন। জোরপূর্বক ব্রেকফাস্ট করতে বাধ্য করলেন। আজ সারাদিন মর্নিং থেকে রাত পর্যন্ত তৃষ্ণার পছন্দের সবকিছু রান্না হবে। তাই অবশ্যই তাকে খেতে হবে। খেতে গিয়ে বেলীকে বেশকিছুক্ষন যাবত দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, এবার মুখ খুলল,
— দাঁড়িয়ে কেন?
বেলী আমতাআমতা করছে। এভাবেই তার বাবা আজকে তাকে নির্ঘাত দাফন দেবে। তার উপর এই লোক তাকে শান্তি দেবেনা। তৃষ্ণার চোখ রাঙানোতে বেলী পাথরের মতো বসে পড়লো। এভাবেই তৃষ্ণা তার উপর রেগে। কাল রাত্রে সে একসাথে ঘুমাতে চেয়েছে। কিন্তু ভাগ্যক্রমে জয়া দেয়নি। সে বেলীকে তার সাথে নিয়ে পাশে শুইয়েছে। যতদিন পর্যন্ত পুরোপুরি বেলীকে এই বাড়িতে না উঠিয়ে দিচ্ছে, সেই পর্যন্ত তাদের একসাথে থাকা যাবেনা, এটা জয়া ঘোষণা দিয়েছেন। অগ্যত তৃষ্ণা আবিদ এবং বাকিদের নিয়ে সারারাত ছাদে ওয়েডিং নাঈট পালন করেছে ড্রিংকস করে।
তাইতো এমন চোখমুখ লাল। ঘুম কাটেনি, অথচ উঠেছে।
সোফায় বসে আনন্দ ডিরেক্টলি বলে ফেললেন,
— আমি মেনে নিয়েছিলাম। তাও আপনার ছেলের হচ্ছিলো না। যাইহোক বিয়েটা হয়েগেছে। এখানে করার কিছু নেই। কিন্তু বেলী এখনও প্রাপ্তবয়স্ক হয়নি সংসার করার জন্য। এসএসসি শেষে লাগলে উঠিয়ে দেওয়া যাবে। আপাতত যেতে হবে। ওর মা খুবই চিন্তিত।

আমিদ বোঝাতে চাচ্ছিলেন। কিন্তু আনন্দের ‘ শুনবো না ‘ ভাবসাবে আর বোঝাতে পারলেন না। দেখা গেলো তৃষ্ণাও আটকায়নি। বরং আবিদকে পাঠিয়ে দিল তাদের পৌঁছিয়ে দেওয়ার জন্য। তৃষ্ণার কোনো ইঙ্গিত না পেয়ে বেলী কেমন চুপসে গেলো। তার মাথায় নানান ভাবনা চলে এলো।
বেলীরা যেতেই তৃষ্ণা নিজের রুমের এ সি বাড়িয়ে আবার ঘুম দিতে যাচ্ছে। সে জানে বেলীকে আটকাতে পারবেনা। আজ আনন্দ একদম মাথায় গামছা বেঁধে এসেছে। মেয়ে নিয়ে যাবে তো যাবে। তৃষ্ণা তাই চেপে গেলো। বিয়ে হয়েছে এখন এক ঘটনা ঘটিয়ে বউকে একদম নিয়ে আসবে। ব্যস!

বাড়িতে ফিরতেই, খুশি মেয়েকে ধরে কেঁদে শেষ। বেলীও কেঁদে ফেলল মায়ের কান্নাকাটিতে। খুশি চেঁচাচ্ছে,
— দুটো মেয়েই পর হয়ে গেলো। না, না বেলীকে এতদ্রুত উঠিয়ে দেওয়া হবেনা। ও থাকবে। এক মেয়ে গিয়ে ঘর শুন্য। ও গেলে কেমনে বাঁচব।
বাবলু বেশ রমরমা গলায় বলল,
— দুলাভাই আসেনি?
খুশি রেগে ছেলেকে এক থাপ্পড় দিয়ে ফেললেন। অবশ্য থাপ্পড়টা লাগার মতো ছিলো না।
কিছুক্ষণের মাঝে শীলা হাজির। সে এসেই বেলীকে জড়িয়ে ধরলো,
— ইশ, মিসেস হা?
বেলী লজ্জায় আঁড়চোখে তাকাচ্ছে। তার এখনও এগুলো শোনার অভ্যাস হচ্ছেনা। কেমন মাথা শরীর কেঁপে উঠছে । শীলার সাথে কথা বলতে গিয়ে, মনে পড়লো তার গিফটির কথা। কতো কষ্ট করতে হয়েছে এটার জন্য। সেটাই হারিয়ে ফেলল?
বেলীকে দেখতে আত্নীয় আসলেন কিছু। তারা নানান কথা বলছেন। অবশ্য কেউ বেলীকে দোশ দিচ্ছেন না। তাদের চৌধুরীর ছেলেকে হাড়েহাড়ে চেনা। সেইদিন বেলী বেশ ভালবাসা পেয়েছে বাড়িতে। আনন্দও তাকে কিছু বলেনি। বরং মেয়েকে এটাসেটা এনে দিয়েছেন। সেদিন মাছ ও ধরা হয়েছে বেলীর পছন্দের।

বিয়ের পর আনন্দ কড়া হয়ে উঠলো। অযথা বেলীকে বেরোতে দিচ্ছেনা। আজ প্রায় কিছুদিন হয়ে যাচ্ছে তার বিয়ে হয়েছে। এই পর্যন্ত সে একবারও বেরোতে পারেনি। যা লাগছে আনন্দ বাবলু এনে দিচ্ছে। টাম্মিকে নিয়ে আশেপাশেও যেতে পারছেনা। বেলী নিজেও বুঝতে পারছে। এখন আর সে একা-একা বেরোতে পারবে না। মানুষ খারাপ বলবে। অগ্যত বেলী বাড়িতেই থাকছে। এইকয়দিনের মাঝে তৃষ্ণার সাথে বেলীর কথা হয়নি। বেলী কল করেছিলো ধরেছিল আবিদ। নানান অহেতুক কথা বলে কেঁটে দিল। তারপর বেলী আজরাত্রে জানল, বিমান- অভি আসছে কাল, সাথে তার দুই ভাই। এবং খুশি তৃষ্ণাকেও আলাদা ভাবে কল করে বলেছে আসতে। তারা বেড়াবে কিছুদিন। ব্যস, বেলীর স্বাশ যায়যায় অবস্থা,

চলবে,
নাবিলা ইষ্ক

[ ভুল গুলো বুঝে নিবেন কাইন্ডলী। আমি একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছি। লিখতে পারছি না। সময় দিন লিখে ফেলব আগামী। মনমতো সাজাতেও পারছিনা। ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here