অতিরিক্ত চাওয়া { ২ }
৪৬|
সাধারণত চৌধুরী বাড়ির বড় নেতা হচ্ছেন আমিদের মা। আনোয়ারা। এই মহিলাকে তার মৃত স্বামীও ভয় পেতেন। আনোয়ারা থেকে পরামর্শ নিয়ে তিনি সকল কাজ করে থাকতেন। তেমনি আনোয়ারার ছেলেরাও তাকে সম্মান এবং ভয়, দুটোই করেন। কিন্তু তার বড় ছেলে ব্যতিক্রম। ব্যতিক্রম বলতে সে আআনোয়ারা কে তেমন ভয় পাননা। কিন্তু সম্মান করেন। মুখের উপর কথা খুব কম বলেন। তো আজ আনোয়ারা এসেছেন নাতবউ দেখতে। তার কঠিন চাহনি আপাতত বেলীর উপর। যে তার সামনে মাথা নিচু করে বসে। এই মেয়ের জন্য তার নাতি পাগল, তা শুনে আসছেন বহু বছর আগে থেকে। যখন সে তৃষ্ণার জন্য নিজের সখির মেয়েকে পছন্দ করেছিলেন। তার ঘাড়ত্যাড়া নাতি নিজে এসে বলেগেছেন,
–” বয়স অনুযায়ী এক নাবালিকা মেয়েকে পছন্দ করি। সে বড় হতে বহু বছর। আমি অপেক্ষা করবো। ”
আনোয়ারাকে বাড়তি কথা বলার সুযোগই দেননি। ব্যস তারপর সে লোক লাগালেন এই মেয়ের ব্যাপারে। ব্যাকগ্রাউন্ড ভালো। মাস্টারের মেয়ে। এভাবে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে দমে গেলো। ব্যস। আনোয়ারার আর পছন্দ হলো না। তার মতে বিয়ে দুই পরিবারের স্ট্যাটাস দেখে হওয়া প্রয়োজন। স্ট্যাটাস উঁচু নিচু পরিবারের মধ্যে সম্পর্ক না হওয়াই উত্তম। এভাবে তৃষ্ণা ত্যাড়া হলেও তার প্রিয় নাতি। তার নাতি তার চেহারা দেখেই বুঝে ফেলেন হয়েছেকি। এবং তার বেশিরভাগ সমস্যা তার এই নাতিই দেখেশুনে দেন। তো তিনি তার এই প্রিয় নাতির জন্য, নিচু পরিবারের মেয়ের প্রত্যাশা একদমই রাখেন না। কিন্তু সে কিছু করতেও পারবে না এখন আর। তার নাতি যে কি পাগল এই মেয়ের জন্য, তা সে হাড়েহাড়ে জানে। সে একা না, তার মনে হচ্ছে পুরো গ্রাম জানে এই ছেলের পাগলামির কথা। বরং সে এই মেয়েকে একটু টাইট দেওয়ার প্রত্যাশা মনে গুঁজলেন। এবং কঠিন স্বরে বেলীকে অস্বাভাবিক প্রশ্ন করতে লাগলেন।
ড্রয়িংরুমের পরিবেশ বেশ রমরমা। উপস্থিত সবাই প্লেইন ফেইস নিয়ে দাঁড়িয়ে। এইদিকে বেলীর ভীতু চেহারা দেখে সকলেরই মায়া হচ্ছে। এই সিন যদি তৃষ্ণার সামনে পড়তো। তাহলে মনে হচ্ছে এই বাড়ি আর অবশিষ্ট থাকতো না। ভীতু বেলী রীতিমতো কাঁপছে। আনোয়ারার কঠিন কন্ঠ তাকে বেশ ভয় পাইয়ে দিয়েছে। এবার আমিদ কথা বলেই ফেলল,
–” মা, আপনার কঠিন কন্ঠ শোনার মনমানসিকতা ওর নেই। আর এভাবেও তৃষ্ণা বাড়িতে। ”
আনোয়ারা চোখ গরম করে তাকালেন,
–” তোর ছেলের ভয় দেখাচ্ছিস? আর মনমানসিকতা নেই মানে? এখন ও এই বাড়ির বউ। অবশ্যই মনমানুসিকতা তৈরি করতে
হবে। ”
দেখাগেলো তার মা’কে আমিদ থামাতে অক্ষম। তার মা আবারও বেলীকে অস্বাভাবিক প্রশ্নের সামনে দাঁড়া করালেন। বেলীর মুখে স্পষ্ট ফুটে সে কেঁদে ফেললেও ফেলতে পারে।
একদম নীরব এই ড্রয়িংরুমে শুধু আনোয়ারা’র অনুভূতিহীন কন্ঠ শোনা যাচ্ছে। বাড়ির সকলে শুধু মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে দেখে যাচ্ছে। বিমান দাঁতে দাঁত চেপে দাঁড়িয়ে। তাকে তো এভাবে হেনস্তা করেনি। শুধু এসে দেখে চলে গিয়েছিলেন৷ অথচ বেলীর বেলা পুরো উল্টো। এই অস্বাভাবিক পরিস্থিতি দেখে, অঞ্জলি তৃষা’কে পাঠিয়ে দিল তৃষ্ণাকে ডাকতে। এই একজন পারবে এই মহিলার মুখ বন্ধ করতে। সাধারণত তৃষ্ণার উপস্থিতি এই মহিলার মুখ বন্ধ করতে সক্ষম। হলোও সেটা, তৃষা যাওয়ার কিছু সময়ের মাঝে তৃষ্ণা উপস্থিত। তার ছায়া ড্রয়িংরুমে পরতেই আনোয়ারার ভাষন বন্ধ হয়েছে। সে এবার পুরো চুপ মেরে গেলো। তৃষ্ণা হাজির হয়েছে স্পোর্টস প্যান্ট আর টি-শার্ট পরে । সে আসতেই ড্রয়িংরুমের দমে থাকা পরিবেশ রমরমা হয়ে উঠলো। আমিদের হাসিটা একদম আনভিজিবল রয়েছে। আনোয়ারা বাদে বাকি সবাই নীরবে হাসছে। আসলে বাড়িতে এই একজন যে কাউকে ভয় পায়না। বরং তাকে অনেকে ভয় পায়। তৃষ্ণা এসে তার দাদির পাশে বসলেন। এবং বেলীর ভীতু চেহারা লক্ষ্য করলো। তারপর ঘুমঘুম চোখ নিয়ে সে আমিদের দিক তাকিয়ে বলল,
–” আমার পেছনে আমার বউকে বুল্লি করা হচ্ছে নাকি? ”
আমিদের হেসে জবাব,
–” কার সাহস? ”
আবির ও ফুর্তিবাজ আওয়াজে তাল মিলালো ,
–” একদম। কার সাহস হবে। ”
তৃষ্ণা কিছুক্ষণ বেলীকে পর্যবেক্ষণ করে বলল,
–” যা! একটা কফি করে নিয়ে আয়। ”
বেলী আঁড়চোখে আনোয়ারার দিক তাকালো। তৃষ্ণা আবারও বলল,
–” যা। ”
বেলী দ্রুত মাথা নাড়িয়ে উঠলো। অঞ্জলি এগিয়ে এসে বেলীকে ধরলো। আনোয়ারার কন্ঠ শোনা গেলো,
–” কথা বলছিলাম। ”
তৃষ্ণার জবাব,
–” আমি শুনছি। বলো কি বলবে। ”
দেখা গেলো আনোয়ারা আর কথা বাড়ালো না। বরং সে চলে যাচ্ছে। আমিদ আর আবিরের চোখাচোখি হতেই দুজনে হালকা হাসলো। তৃষ্ণা অভির দিক চোখ ইশারা করতেই, অভি তার দাদির পিছু ছুটলো। জয়া এগিয়ে আসলো তৃষ্ণার দিক,
–” আব্বা, হাত-মুখ ধুইছোস ? একসাথে ব্রেকফাস্ট করবি। কফি পরে খা?”
–” উঁহু। কফি লাগবে। ”
এর মাঝে কলিং বেল বাজছে। আবিদ খুলে দিতেই, আশেপাশের মহিলারা হাজির। তারা বলতে বলতে ঢুকছে,
–” কীগো ভাবী৷ তৃষ্ণার বউ উঠাইছো আর আমাদের তো জানাইলাও না। ”
জয়া হাসিমুখে তাদের ভেতরে বসালো।
–” আসলে সময় পাইনি। ”
মহিলা গুলো এসেই যথাভাবে তৃষ্ণাকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করতে লাগলো। তৃষ্ণাও বেশ উত্তর দিচ্ছে।
আয়েশা নাস্তা নিয়ে এসেছে। পেছনে বেলী ট্রে নিয়ে সাথে কফি। কফি তৃষ্ণাকে দিতেই, মহিলা গুলো বেলীকে পাশে বসালেন।
–” মাইয়া দেহি পরীর লাহান। বাজানের পছন্দ আছে দেহি। ”
তৃষ্ণা তখনও কফি হাতে বেলীর দিক তাকিয়ে।
কয়েকজন ছেলেপেলে এসেছে। আমিদ নিজেই হ্যান্ডেল করবে ভেবেছিলেন। কিন্তু আওয়াজ পেয়ে তৃষ্ণা দরজার দিক চলে আসে।
–” কি হয়েছে? ”
–” ভাই ওই শালারা আবারও গ্যাঞ্জাম করতেছে। শফিক, অরিক ওদের গায়ে হাতও তুলছে। ”
আমিদ বলল,
–” দাঁড়া, আমি আবিদ আয়ুশকে পাঠাই। ”
তৃষ্ণার জাবাব এলো,
–” আমি যাচ্ছি। ”
আমিদে আটকানোর চেষ্টা করলো,
–” আজ বেরোনোর প্রয়োজন নেই। ”
তৃষ্ণা ছেলেপেলের দিক তাকিয়ে বলল,
–” চেঞ্জ করে আসছি। ”
রুমে যাবার পথে তৃষ্ণা বেলীকে রুমে আসতে বলল। বেলী তাও রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে। ড্রয়িংরুম থেকে জয়া চেঁচালো,
–” বেলী? তৃষ ডাকছে। ”
অগ্যত বেলী ধীরে ধীরে পৌঁছালো। তৃষ্ণা তখন মাত্র প্যান্ট পরেছে। আর উপরের টি’শার্ট খুলেছে। বেলী স্পষ্ট তৃষ্ণার শরীরে নেইলস এর দাগ দেখতে পেলো। স্পষ্ট তার ফরসা শরীরে ভিজিবল। বেলীর মুখ আবারও লালচে হতে লাগলো। তৃষ্ণা এসে বেলীর গালে চুমু খেলো। তারপর সে আদুরে ভাবে, বেলীর মুখ দু’হাতে আলতো করে, নিজ বরাবর তুলে ধরলো। মুখের সামনের চুল সরাতে সরাতে জিজ্ঞেস করলো,
–” সমস্যা হচ্ছে কোনো? ব্যাথা বা আনকাম্ফোরটেবল ফিলিং
হচ্ছে? ”
বেলী ধীরে মাথা দুলালো। তৃষ্ণা বেলীর কপালে চুমু খেলো,
–” কোনো সমস্যা হলে আমায় বলবি। হু? ”
–” হু। ”
–” আমি যাচ্ছি। দ্রুত চলে আসবো। কিছু প্রয়োজন হলে কল
দিস। ”
বেলী আবারও মাথা দুলালো। তৃষ্ণা লম্বা করে বেলীর গাল টেনে চলে যাচ্ছে। রুম থেকে বেরিয়ে বেলী দেখতে পেলো তৃষ্ণার সাথে আবিদ, আয়ুশও যাচ্ছে৷
লাঞ্চের সময় হয়েছে। জয়া কল দিয়েছিলেন, কিন্তু আবিদ জানালো আসতে বিকেল হবে। তারা গ্রাম ছেড়ে বেরিয়েছে একটু। বেলী জানতে পেরে সে তৃষ্ণা এলে খাবে। আর আপাতত তার খিদেও নেই। সকলে যখন টেবিলে খেতে বসেছে। তখন বেলীকেও খেতে হয়েছে। জয়া অঞ্জলি আয়েশা তাকে একপ্রকার খেতে বাধ্য করেছে। এভাবে আমিদ বেশ তার বউদের সাথে খেতে খেতে গল্প করছে। অঞ্জলিও জবাব দিচ্ছে,
–” আব্বু চলো এবার ট্যুর এ যাই। সকলে মিলে যাব। ”
আমিদ বলল,
–” যাওয়া যায়। আমি যেতে পারছিনা মা। তোরা তোরা যাবি। ”
অঞ্জলি ফুস করে উঠলো,
–” উঁহু সবাই মিলে। না চলবেনা। ”
বেলী মুগ্ধ হয়ে দেখতে লাগলো। কে বলবে এটা শ্বশুর এবং তার ছেলের বউয়ের কথপোকথন ছিলো? মনে হচ্ছিলো নিজের বাবা আর তার মেয়ের কথপোকথন। বেলীর মনটা নিমিষেই ভালো হতে লাগলো । তেমনি তার পরিবারের কথা মনে পরে যাচ্ছে। জয়া বেলীর দিক তরকারি এগিয়ে দিচ্ছে। অথচ বেলী লজ্জা খেতে পারছেনা। তাকে এক প্রকার সবাই মিলে খাইয়েছে।
পুরো দুপুর মেয়েরা মেয়েরা বেলীদের রুমে আড্ডা দিলো। পরপর জয়া চেঁচালো,
–” অঞ্জলি? ”
–” জ্বি মা। ”
–” রুমে সারাদিন বসে আছিস যে। বেলীকে নিয়ে ছাঁদে যা। ভালো লাগবে। ”
আইডিয়া মন্দ না। অঞ্জলি সবাইকে নিয়ে ছাঁদে রওনা হলো। সোনালী পরন্ত বিকেলে ছাঁদ দেখতে অপরিসীম সুন্দর। গ্রামের আভাসটা কিছুটা ফুটে আছে। ছাঁদ থেকে বড়বড় গাছগুলো উঁচু হয়ে আছে। ছাঁদের আশপাশে নানান ফুলের তোড়া। বেশ সৌখিন ভাবে সাজানো। তৃষা বেলীকে নিয়ে দোলনায় চড়লো। কি সুন্দর দুলছে। বেলী খিলখিলিয়ে হেসে ফেলল। এর পরপর অঞ্জলিও বসলো। তখন বেলী আর তৃষা ধাক্কাতে লাগলো। এবং সেগুলো ভিডিও করছে আয়েশা।
তৃষার সাথে বেলী ছাঁদের বাউন্ডারি ঘেঁষে দাঁড়ালো। এবং নিচে চোখ বুলালো। বাড়ির পেছনের দিক বেশ কিছু টং। উপর থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। তারপর হঠাৎ তৃষা চেঁচালো,
–” ওইযে ভাইয়া দাঁড়িয়ে। ”
অঞ্জলি আয়েশা ” কই কই ” বলতে এগিয়ে আসলো। ঠিকই তৃষ্ণা, আবিদ, আয়ুশ, আমিদ, আবির, অভি সকলেই দাঁড়িয়ে আরও কিছু লোকদের সাথে। কথা বলছে। তৃষ্ণার হাতে সিগারেট। সে খাচ্ছে আর কথা বলছে। বেলী এক নজরে দেখতে লাগলো। কি সুন্দর দেখাচ্ছে। হঠাৎ তৃষা চেঁচালো,
–” আব্বুউউউউউ, ভাইয়া। ”
বেলী দ্রুত সরতে নিলে তৃষা ধরে রাখলো। তৃষ্ণা, আমিদ বাকিরা সবাই তাকিয়েছে। বেলী আঁড়চোখে তাকালো তৃষ্ণা তার দিক তাকিয়ে। পর্যবেক্ষণ করছে যেমন।
তৃষা পিচ্ছি চিল্লাচ্ছে আবারও,
–” ভাইয়া…! ভাবীরা, মামী বলছে ফুচকা খাবে। ”
অঞ্জলি কিছু বলার আগেই, তৃষ্ণা দূরবর্তী স্থানে দাঁড়িয়ে থাকা ফুচকার ভ্যানগাড়ি’কে ইশারা করলো। ওমনি গাড়ি হাজির। আবিদ দৌঁড়ে যাচ্ছে ফুচকা ডেলিভার করতে।
চলবে
নাবিলা ইষ্ক