ভালোবাসার_রঙ ‘৫’ #Jerin_akter_nipa

0
210

#ভালোবাসার_রঙ ‘৫’
#Jerin_akter_nipa

সন্ধ্যার আগে আগে মা রায়াকে বললেন,
-বসে বসে গান শুনছিস, ছাঁদ থেকে কাপড় গুলো কি তোর বাপ আনবে? ‘
-আনলে মন্দ হয় না। চাইলে মা’ও আনতে পারে। আমি কিছু মনে করব না।’
মাথা দোলাতে দোলাতে মায়ের দিকে তাকাল রায়া। মা’কে চোখ পাকাতে দেখে উঠে গেল।
-উফ! যাচ্ছি বাবা। কথায় কথায় এতো রাগ দেখাও কেন? ঘরের সব কাজ তো আমাকে দিয়েই করাও। নিজেও তো একটু কাজ করতে পারো। এই বাচ্চা মেয়েটাকে আর কত খাটাবে?’
ততক্ষণে ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে রায়া।
-কি বললি তুই? ঘরের সব কাজ তোকে দিয়ে করাই আমি! পানির গ্লাসটাও তো তুলে খাস না। আবার বলিস তোকে দিয়ে আমি সব কাজ করাই।’
সন্ধ্যা হয়ে আসছে। আশেপাশে একটু একটু অন্ধকার হয়ে গেছে। রায়া ছাদে গিয়ে নিজে নিজে কথা বলতে বলতেই দড়ি থেকে কাপড় তুলে নিচ্ছে।
-আর ভাল্লাগে না। সারাক্ষণ শুধু, রায়া এটা কর। রায়া ওটা কর। রায় এই কাজ কে করবে? রায়া ওই কাজটা এখনও করলি না কেন? কাজের মেয়ে পেয়েছে যেন আমাকে। হুহ্! একবার বিয়ে হোক না। তখন বাপের বাড়িতে এসে পায়ের উপর পা তুলে বসে বসে খাব। এখন যত পারো খাটিয়ে নাও।’
দলা পাকিয়ে কাপড় গুলো নিয়ে দুই সিঁড়ি নামতেই সামনে তাকিয়ে ইহফাজকে দেখতে পেল। দুই মিনিটের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল রায়া। ব্যাটা তাকে ধরে মার শুরু করার আগেই এখান থেকে কেটে পড়তে হবে। ইহফাজ সরে দাঁড়িয়ে রায়াকে যাওয়ার জন্য জায়গা করে দিল।
-আল্লাহ বাঁচাও। আল্লাহ বাঁচাও।’ অস্পষ্ট স্বরে বলতে বলতে রায়া চোখ কান বন্ধ করে এক দৌড় দিল। রায়াকে দৌড়াতে দেখে হাসছে ইহফাজ।
-যাও, যাও। আসল মজা তো আজ রাতে হবে।’
দোয়া দরুদ পড়ে বুকে ফুঁ দিতে দিতে ঘরে এসে ঢুকলো রায়া।
-বেঁচে গেছি আল্লাহ। বড় বাঁচা বেঁচে গেছি।’
রায়াকে হাঁপাতে দেখে মা বললেন,
-হাঁপাচ্ছিস কেন তুই? ‘
-কুত্তার দৌড়ান খেয়েছি মা।’
কপাল কুঁচকে মা বললেন,
-কিহ! কুত্তা কোথায় পেলি তুই? তুই তো কাপড় আনতে ছাঁদে গিয়েছিলি।’
-মানুষ কুত্তা, মা। ও তুমি বুঝবে না।’
-তোর পাগলামি ছাগলামি কোনো কথাই আমি বুঝি না। দু’পা শান্তিতে হাঁটতে পারিস না। দৌঁড়ের উপর থাকতে হয় তোকে।’
মায়ের বকবক চলতেই থাকবে। থামার নাম নিবে না। হাতের কাপড় গুলোর দিকে ইশারা করে বলল,
-কোথায় রাখবো? ‘
-আমার মাথায় রাখ। ঘরে যখন জায়গা নেই তখন আমার মাথায় এনে রাখ।’
মুখ মুচড় দিল রায়া। মহিলার মেজাজ দিনদিন এমন খিটখিটে হয়ে যাচ্ছে কেন? পাগল টাগল হয়ে যাচ্ছে নাকি? না। সময় থাকতে ডাক্তার দেখাতে হবে।
-এতো রাগো ক্যান?’
-বিছানার উপর না রেখে আমাকে জিজ্ঞেস করছিস ‘কোথায় রাখব’। রাগবো না তো তোকে চুমো খাব?’
-চুমো খেতে বলেছে কে? নাও রাখলাম। এবার খুশি তো?’
-রাখলাম কী? মাগরিবের নামাজ পড়ে এগুলো ভাঁজ করে আলমারিতে তুলে রাখবি। আমি তোর চাকর না। নিজের কাজগুলো অন্তত করে খা। পরের বাড়িতে গেলে ওখানে তোমাকে কেউ বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াবে না।’
-অহ মা! তুমি ঘুরেফিরে পরের বাড়িতে গিয়ে উঠো কেন? নিজের বাড়ি নেই তোমার? দেখবে আমার শাশুড়ি এতো ভালো হবে যে,সব কাজ উনি নিজেই করবেন। আমাকে কিচ্ছু করতে দিবেন না। ধরতে, ছুঁতেও না।’
-এমন হলে তো বলতে হবে কপাল ভালো তোর। নইলে তোর দাদীর মত একজন শাশুড়ি পেলে…
-তুমি সুযোগ পেলেই আমার দাদীর বদনাম বলতে শুরু করো। দাদী ততটাও খারাপ না।’
-না, তুমি আর তোমার দাদী তুলসীপাতা। এখনও তোমার দাদী আমার সব কাজে ভুল ধরে।’
-তুমি কাজ পারো না তাই ধরে। তোমার কাজ দাদীর পছন্দ হয় না।’
-আমি কাজ পারি না। আর তুই তো অনেক কাজ পারিস। দেখব, নিজের শাশুড়ির বদনাম আমার কাছে বলতে আসিস শুধু।’
রেগেমেগে মা চলে গেলেন। মায়ের সাথে মিছেমিছি ঝগড়া করতে মজাই লাগে রায়ার। যেকোনো কথাতে মা’কে রাগিয়ে দেয়া যায়। আর মা একবার রেগে গেলে ঝগড়ায় বাবাকে, দাদীকে পর্যন্ত নিয়ে আসে। মজার কথা, মা কোনদিনও ঝগড়ায় রায়ার সাথে জিততে পারে না।

নামাজ পড়ে এসে কাপড় গুলো ভাঁজ করছিল রায়া। ওড়নাটা হাতে নিয়ে চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইল। চোখ মুখ খিঁচিয়ে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে আকাশ ফাটিয়ে চিৎকার করল রায়া।
-মা….মা আ আ আ আ….. মাআআআআ…
কোনরকম মেয়ের চিৎকার শুনে ছুটে এলেন মা। রায়ার কাছে এসে ওর পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বললেন,
-কি হয়েছে মা? কি হয়েছে তোর? এই রায়া…
ওড়নাটা মায়ের দিকে ধরে কাঁদো কাঁদো গলায় রায়া বলল,
-আমার ওড়না…
মেয়ের পাগলামি দেখে দম নিলেন মা। তেমন কিছু হয়নি।
-সামান্য একটা ওড়নার জন্য এভাবে চিল্লিয়েছিস!’
রেগে গিয়ে রায়া বলল,
-সামান্য! তুমি জানো এই ওড়না কে দিয়েছিল?’
-জানব না কেন? ওটা তোর রাসেল ভাইয়া দিয়েছিল। গতবছর তোর জন্মদিনে।’
-আমার ওড়না কে যেন কেটে দিয়েছে মা। দেখো তুমি গোল গোল করে কেটেছে। কেউ শয়তানি করে আমার সাথে এমনটা করেছে।’
-কাঁদিস না তো। আমি রাসেলকে বলব তোকে যেন এমন আরেকটা ওড়না কিনে দেয়। এতটুকু ব্যাপারে চিৎকার করে বাড়ি মাথায় তুলে নিয়েছিস। ভয় পেয়ে গেছিলাম আমি। ভেবেছিলাম বিছানা থেকে পড়ে গিয়ে হয়তো হাত পা ভেঙে ফেলেছিস।’
মা চলে গেলেন। রায়া সত্যিই কাঁদতে বসে গেল। তার কত পছন্দের ওড়না এটা। ভাইয়া কত ভালোবেসে দিয়েছিল। কে এমন করেছে? তার সাথে কার এত শত্রুতা। রায়ার সাথে না পেরে ওর ওড়নাটা নষ্ট করে দিল। বাঁ হাতে চোখ মুছে নিল রায়া।
-এটা ওই বদের কাজ। অসভ্য জানোয়ার বদ লোকটাকে ছাড়া আর কেউ এমন করবে না। ছাড়বো না আমি ওকে। তাই তো বলি, সিঁড়ির কাছে আমাকে পেয়েও কিছু বললো না কেন? বলবে কেন? সে তো আগেই শয়তানি সেরে রেখেছে। বান্দর ছেলে, তোর বাঁদরামি যদি আমি বন্ধ করতে না পারি তাহলে আমার নামও রায়া না।’

প্রতিশোধ নিতে পেরে ইহফাজ ঠান্ডা হয়ে গেছে। রায়া অনেক চেষ্টা করেও ইহফাজকে কীভাবে শাস্তি দিবে ভেবে পাচ্ছে না। গাছগুলোই লোকটার দুর্বলতা। কিন্তু তাই বলে এক কাজ বারবার করবে নাকি? আজ ইহফাজের আপু এসেছে। টিয়াকে নিয়ে ইহফাজ বসার ঘরের সোফায় বসে আছে। আপু মা’র সাথে রান্নাঘরে। সেখান থেকে আবার গলা উঁচিয়ে ইহফাজের সাথে কথা বলছে।
-হ্যাঁরে ইফু! তোর চাকরি বাকরির কী খবর? দেশের বাইরে তো যাবি না। দেশে কোন চাকরিটা করবি শুনি? ‘
-ভাবছি তোর জামাইয়ের সাথে তোদের কাপড়ের দোকানে বসে যাব। দুলাভাই একা হাতে কয়টা শাড়িই বা দেখাতে পারে? আমি সাথে থাকলে ওর একটু সুবিধা হবে।’
আপুকে খেপানোর জন্য এই কথাটুকুই যথেষ্ট। ইহফাজ ভাবছে আপু আবার গরম খুন্তি এনে গালে না ছুঁইয়ে দেয়। দৌঁড়ে বেরিয়ে এসেছে আপু। ইহফাজকে মারতে মারতে বলল,
-শয়তান। কাপড়ের দোকান আমার শ্বশুরের। তোর দুলাভাই শাড়ি বেঁচে! ও ইঞ্জিনিয়ার। তুই জানিস না?’
হাসতে হাসতে ইহফাজ বলল,
-ওই একই। বাপের কাজ ছেলেকেই তো দেখতে হবে। তোর শ্বশুরের পরে তোর জামাই-ই তো শাড়ি বেচবে।’
ইহফাজকে হাসতে দেখে আপু রেগে মায়ের কাছে বিচার দেওয়ার জন্য রান্নাঘরে চলে গেল।
-দেখলে মা, তোমার ছেলে কী বলে? তুমি ওকে কিছু বলবে?’
-তুই ওর কথা কানে নিস কেন? ও তো ওসব মজা করে বলে।’
-মজা করে বললেও আমার ভালো লাগে না। লোকে শুনলে ভাববে সত্যিই আমার বর শাড়ি বিক্রি করে। কাপড়ের দোকান ওর।’
ইহফাজ জোরে বলল,
-আপু শোন, তোর যখন এতই চিন্তা তাহলে তোর জামাইয়ের কপালে ইঞ্জিনিয়ার লিখে ট্যাটু করিয়ে নে। লোকে দেখেই বুঝে ফেলবে, ব্যাটা ইঞ্জিনিয়ার।’
হাসতে হাসতে ইহফাজ নিচু গলায় টিয়ার সাথে কথা বলছে,
-দেখলে মামা, তোমার আম্মু কিচ্ছু বুঝে না। মজাও বুঝে না। বোকা আম্মু।’
নুডলসের বাটি হাতে নিয়ে আপু এসে ইহফাজের পাশে বসল।
-চাকরি বাকরি খোঁজ তাড়াতাড়ি। তাহলে তোর জন্যও মেয়ে দেখা শুরু করব। দেখিস, আমি যদি তোর বড় বোন হয়ে থাকি। তাহলে পান বিক্রি করে এমন শ্বশুর খুঁজে বের করব তোর জন্য। তখন জামাই শ্বশুরেতে মিলে পান বিক্রি করবি।’
আপুর হাত থেকে বাটি নিয়ে ইহফাজ নিজে খেতে খেতে বলল,
-তোর স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে। আমার শ্বশুর হেব্বি বড়লোক হবে। নইলে আমি বিয়েই করব না।’
চোখ বড় বড় করে আপু বলল,
-কী লোভীরে তুই! ‘
হাসছে ইহফাজ।
-টিয়াকে খাওয়াবো একটু?’
-এই না,না। ঝাল লাগবে ওর।’
-আমাদের নিউজ বাবা কই? আসার পর থেকে ওকে দেখলাম না।’
-সারাদিন তো এখানেই থাকে। মা’র আশেপাশে ঘুরঘুর করে। আসলে দেখিস, খেতে খেতে ভুঁড়িটা যা বানিয়েছে। ওর মা খেতে না দিলে আমার মা’র কাছে চলে আসে। আন্টি, আন্টি বলে যেটা ইচ্ছা সেটা রান্না করিয়ে নেয়।’
-ইশ! ছেলেটা খেতে পছন্দ করে। ওর মা এমন করে কেন? আমি ওর মায়ের সাথে কথা বলব।’
-বলিস। তুই তো আবার জনদরদি মহিলা।’
-ওহ আরেকটা কথা ভুলেই গেছি। রায়ার খবর কী রে? আমাদের ওখানে আসে? ‘
যেন চিনতেই পারেনি এমন ভাবে কপাল কোঁচকাল ইহফাজ। নামটাও যেন আগে শুনে নি এমন ভাবে বলল,
-কে রায়া?’
-সেকি রে! রায়াকে চিনিস না তুই? আরে আমাদের দোতলায় ভাড়া এসেছে যে। আরে, ওই দিন যে মার্কেটে তোকে চোর বলেছিল।’
যা! চিনলেই হয়তো ভালো হতো। আপু তাহলে এই খোঁচাটা দিতে পারত না। হঠাৎ যেন মনে পড়েছে এমনি করে বলল ইহফাজ।
-অহহ ওই মেয়েটা। হ্যাঁ মনে পড়েছে।’
-আসে না আমাদের ফ্ল্যাটে?’
বিরক্ত হয়ে ইহফাজ বলল,
-আমি কী জানি? কে এলো,কে গেল এসব নিয়ে বসে থাকি নাকি আমি? ফালতু জিনিস দেখা ছাড়াও আমার হাতে আরও অনেক কাজ আছে।’
-রেগে যাচ্ছিস কেন তুই? আচ্ছা চল, ওদের ওখান থেকে ঘুরে আসি। অনেকদিন ওর বাবা মা’র সাথেও দেখা হয়নি। ভদ্র মহিলা…
উঠে দাঁড়িয়ে গেল ইহফাজ।
-তোর ইচ্ছা থাকলে তুই যা। আমাকে যেতে বলিস কেন? যতসব কাম কাজ নাই।’
রায়ার কথা উঠলেই ইহফাজের রাগ উঠে যায়। মেয়েটা চরম লেভেলের বেয়াদব। তবুও আপু আর মা ওর গুণ গাইতে গাইতে জীবন দেয়। ইহফাজ নিজের ঘরে চলে গেলে আপু হতবুদ্ধি হয়ে বলল,
-এর আবার কী হলো? হঠাৎ করে এতো রেগে গেল কেন?’
আপু মা’কে বলে রায়া ওর বাবা মা’কে সহ নিউজদের পুরো পরিবারকে রাতে খাওয়ার জন্য দাওয়াত করে এলো।

ইহফাজদের ওখানে যেতে হবে শুনেই রায়া বেঁকে বসেছে।
-না। আমি যাব না।’
-যাবি না কেন? ইহফাজের বোন নিজে এসে বলে গেছে। ওর সাথে তো তোর ভালো খাতির আছে। তাহলে যাবি না কেন?’
-এমনি। আমার ভাল্লাগে না। তুমি আর বাবা যাও।’
-তুই না গেলে মেয়েটা কী মনে করবে? কষ্ট পাবে ও।’
ভাবছে রায়া। ওখানে গেলে ওই বদের সাথে দেখা হবেই। রায়া বদের হাড্ডিটাকে দু’চোখে দেখতে পারে না। তবুও আপুর কথা ভেবে রাজি হয়ে গেল।
রায়া, নিউজরা একসাথেই বেরিয়েছে। নিউজ ডোরবেলে চাপ দিয়ে ধরে আছে। রায়া তার মাথায় গাট্টা মেরে বলল,
-বেদ্দপ পোলাপান। তোর ওই গুণ্ডা ভাই হাত ভেঙে দিবে তোর।’
সাথে সাথেই ইহফাজের গলা শোনা গেল।
-নিউজ, হাত ভেঙে দিব তোর। আসছি আমি। দাঁড়া।’
বলতে বলতে দরজা খুলে দিল। রায়া হাসছিল। ইহফাজকে দেখে মুখ থেকে হাসি উড়ে গেল। ইহফাজও ওর দিকে তাকাল না। ইহফাজকে পাশ কাটিয়ে মায়ের পেছন পেছন ভেতরে চলে গেল সে। ইহফাজ দরজা বন্ধ করে নিজের ঘরে চলে গেল।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here