ভালোবাসার_রঙ ‘৯’ #Jerin_akter_nipa

0
220

#ভালোবাসার_রঙ ‘৯’
#Jerin_akter_nipa

গা থেকে শাড়ির আঁচল খসিয়ে ফেলে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করল রায়া।
-আমি বিয়ে করব না! নায়য়য়য়য়া, না….না। ওই বদ জানোয়ার বান্দরকে আমি জীবনেও বিয়ে করব না। পরিচয় হওয়ার আগেই বদ আমাকে দু’টা থাপ্পড় মেরেছে। না জানি বিয়ের পর আমার সাথে কী করে? দিনে রাতে কয়টা থাপ্পড় দেয়! না। আমি তো বিয়ে করবই না। কোনো ভাবেই না। মরে গেলেও না।’
রায়ার চিৎকার শুনে মা ছুটে এসেছে। শাড়ির আঁচল তুলে দিয়ে বলল,
-কি হয়েছে তোর? কি হয়েছে মা আমার? চিৎকার করছিস কেন তুই?’
-আমি বিয়ে করব না। তুমি বাবাকে বলে বিয়ে বাতিল করে দাও। ওই বদের হাড্ডিকে বিয়ে করে আমি মার খেয়ে মরতে পারব না। ওই ছেলে যা রাগী। তোমার মেয়েকে মেরেই ফেলবে মা।’
রাগী গলায় ধমক দিয়ে মা বললেন,
-ছেলেমানুষি কথা বলিস না রায়া। সব জায়গায় ফাজলামি পেয়েছিস নাকি? গায়ে হলুদ হয়ে গেছে। কাল বিয়ে। এখন বলছিস বিয়ে করবি না! তোর বাবার সম্মান মজা মনে হয় তোর কাছে। বিয়ের আগের রাতে বিয়ে ভেঙে দিলে লোকে ছি ছি করবে। সমাজে মুখ দেখাতে পারবে না তোর বাবা।’
-কিন্তু মা,তোমরা তো আগে বলোনি ওই ছেলের সাথে আমার বিয়ে দিচ্ছ।’
ভ্রু উঁচিয়ে মা বললেন,
-ওই ছেলেটা কে?’
-যার সাথে তোমরা আমার বিয়ে দিতে চাইছ। ওই বদ।’
-একটা থাপ্পড় মারব বেয়াদব। হবু স্বামীকে বদ বলছিস! এই শিক্ষা দিয়েছি তোকে?’
-তুমি জানো না মা, বিয়ের পর একটু ত্যাড়িং বেড়িং করলে ওই ছেলে আমাকে মারতে মারতে মেরেই ফেলব।’
-সেটাই ভালো হবে। তোর ঘাড় ত্যাড়ামি কমবে।’
-তুমি সন্তান হারা হতে চাও? একটা মাত্র মেয়ে, সেই মেয়েকে হারাতে চাও? তুমি চাও আমি ওই ছেলের হাতে জীবন দিই?’
মেয়ের এসব পাগলামি কথা শুনে মরে যেতে ইচ্ছে করছে। এই মেয়ে নতুন করে আবার কী শুরু করল! নিজেই রাজি হয়েছে। এখন এসব বলছে। অসহায় ভাবে মাথা নাড়িয়ে মা বললেন,
-মারবে কেন, মা? কোন স্বামী কি তার স্ত্রীকে মারে? তোর বাবা কখনও কি আমার গায়ে হাত তুলেছে? তাহলে ইহফাজ কেন মারবে? ইহফাজ তো অনেক ভালো ছেলে। তোর বাবার থেকেও ভালো। তুই দেখিস, ইহফাজ তোকে অনেক ভালোবাসবে। একটুও বকবে না। মারবে তো দূর উল্টো তোর সব কথা শুনবে। এখন তুই আর পাগলামি করিস না মা। তোর বাবা শুনলে রাগ করবে। আর ও বাড়ির কেউ শুনলে কী ভাববে বল তো? লক্ষ্মী মা আমার। সোনা মা আমার পাগলামি করিস না। তুই তো আমার ভালো মেয়ে। এসব শুধুই তোর ভয়। তুই ভয় পেয়ে এসব ভাবছিস। ইহফাজ তোকে মারবে না। বকবেও না।’
রাতে ইভা এসে রায়ার দুই হাত ভর্তি করে মেহেদি পরিয়ে দিয়ে গেল। শুধু কি মেহেদি পরিয়ে ক্ষান্ত হয়েছে? ডান হাতের তালুতে বড় করে ইহফাজের নাম লিখে দিয়েছে। রায়া মুখ ফোটে কিছু বলতেও পারেনি।
ইহফাজের কাছে ইভা ঘেঁষতেও পারেনি। ইহফাজ রাগ দেখিয়ে বড় বোনকে তাড়িয়ে দিয়েছে। ইভা মেহেদি দেয়ার কথা বললে ইহফাজ মুখ কুঁচকে বলেছে,
-তোদের ছাগলামির শেষ নেই। ছেলেরা হাতে মেহেদি দেয়?’
-দেয় না নাকি? বিয়ের সময় তো সবাই দেয়।’
-সবাই দিলেই তো হারাম জিনিস হালাল হয়ে যায় না। ছেলেরা মেহেদি দিতে পারবে না। ওসব লাল নীল রঙ মেয়েদের মাখার জিনিস। আমার সামনে থেকে এখন তুই দূর হ তো।’
মুখ মুচড়ে ইভা বলেছে,
-ওরে আমার হুজুর রে। শুক্রবার ছাড়া আর কোন দিন নামাজ পড়ো না। এখন আসছো হাজীগিরি দেখাতে।’
এবার চটে গিয়ে ইহফাজ বলল,
-এই তোর সমস্যা কি রে? আমি নামাজ পড়ি কি পড়ি না তা তুই মসজিদে গিয়ে দেখে আসছিস। দেখ, তুই আমার বড় বোন বলে কিছু বলছি না। মুখ বুজে তোদের অত্যাচার সহ্য করছি। বিয়ে করতে বলেছিস,বিয়ে করছি। এর থেকে বেশি আমাকে দিয়ে হবে না। বেশি চাপাচাপি করলে আমি কিন্তু বিয়ের আগের রাতে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাব। তখন তোর ওই আদরের হতে না পারা ভাবির জন্য নতুন বর খুঁজিস। কারণ আমাকে তো হাতের কাছে পাবি না। এক মাস আগে আমি আর বাড়িতেই ফিরব না।’
ইহফাজের কথা শুনে ইভা সত্যিই ভয় পেয়ে ওকে আর চাপাচাপি করলো না। মাথা খারাপ ইফুটা পালিয়ে গেলে তখন আবার নতুন ঝামেলা তৈরি হবে। ছেলেটা নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে করছে এটাই অনেক।
পরের দিন কোন প্রকার বাধাবিপত্তি ছাড়া ওদের বিয়ের আয়োজন শেষ হলো। দোতলা থেকে তেতলায় যাবে রায়া। এখানে গাড়ির প্রয়োজন নেই। কিন্তু নতুন বউকে হাঁটিয়েও নিয়ে যেতে পারে না। ইভার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। বিদায় নেওয়ার সময় রায়া বাবা মা’কে জড়িয়ে ধরে অনেক কাঁদলো। ইহফাজ এসব কান্নাকাটি দেখে মনে মনে বিরক্ত হচ্ছে। মেয়ে তো দূরে কোথাও যাচ্ছে না। চোখের সামনেই আছে। পরেও এতো কান্নার কী আছে? যাবার সময় ইভা বলল,
-ইফু,তুই রায়াকে কোলে নিয়ে উপরে যা।’
বিরক্তিতে মুখ কুঁচকে ইহফাজ বলল,
-কেন? তোদের উদ্ভট নিয়ম টিয়ম থাকলে আমি ওসব পালন করতে পারব না।’
-আরে বাবা, নিয়ম না। নতুন বউকে পায়ে হাঁটিয়ে নিব নাকি? তোর বউ, তুই কোলে নিয়ে যাবি।’
-আমি পাবর না।’
পেছন থেকে দুলাভাই হেসে বললেন,
-ঠিক আছে, ঠিক আছে। বুঝতে পারছি, শালা বাবুর কষ্ট হবে। দশটা না, পাঁচটা না। একটা মাত্র দুলাভাই, আমি আছি কেন বলো তো? শালার বউকে নাহয় আমিই কোলে তুলে নিয়ে রুমে দিয়ে আসি।’
কান্না করে এমনি রায়ার অবস্থা কাহিল। এখন আবার এরা নতুন নাটক শুরু করেছে। ভদ্রতার খাতিরে কিছু বলতেও পারছে না সে। হঠাৎ কি মনে করে ইহফাজ বলে উঠল,
-না থাক,দুলাভাই। এই ভারী শরীর নিয়ে একা একাই তো এতগুলো সিঁড়ি উঠতে পারবেন না। আরেক জনকে কোলে নিয়ে উঠতে গেলে তো কাপড় নষ্ট করে ফেলবেন।’
দুলাভাই ইভার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপে হাসল।
-দেখলে কীভাবে লাইনে আসে! নিজের বউকে এত সহজে অন্য কারো হাতে ছাড়বে নাকি? এটা আমার শালা বলে কথা!’
ইহফাজ রায়াকে কোলে তুলে নিল। রায়া মনে মনে ভয় পাচ্ছে। না জানি বদটা ওর উপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য ওকে কোল থেকে ফেলে দেয়। ইহফাজের মুখের দিকে তাকাল রায়া। কিছুই বুঝতে পারল না। কী চলছে এর মনে? হঠাৎ তার উপর এতো দরদ দেখিয়ে নিজে কোলে নিয়ে এতগুলো সিঁড়ি উঠছে কেন? এর পেছনে অন্য কোন মতলব নেই তো? ভয় পেয়ে দু’হাতে শক্ত করে ইহফাজের গলা চেপে ধরল রায়া। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল,
-এবার ফেলে দেখা, দেখি। আমাকে ফেলে দিতে চাইলে সাথে তুইও পড়বি। আমার একা কোমর ভাঙবে না। মরতে হলে তোকে সাথে নিয়ে মরব, ব্যাটা বদ।’
রায়ার ভয় বুঝতে পেরে মনে মনে হাসল ইহফাজ। এর মাথায় এর থেকে ভালো চিন্তা আসবে না। নিজে যেমন পাগল ছাগল অন্যকেও তেমন ভাবে। নিজেদের ফ্ল্যাটের সামনে এসে রায়াকে দাঁড় করিয়ে দিল। মা বরণ ডালা নিয়ে এসে রায়াকে বরণ করে ঘরে তুললেন। ইভা রায়াকে ইহফাজের ঘরে নিয়ে এসেছে।
-জানোই তো এটা তোমার রুম। আগে ইফুর ছিল। এখন দু’জনের। তুমি একটু রেস্ট নাও। সারাদিন অনেক ধকল গেছে। টায়ার্ড লাগছে হয়তো। আমি একটু পরে এসে তোমার কাপড় দিয়ে যাব। শাড়ি চেঞ্জ করে নিয়ো।’
মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ জানাল রায়া। আপু চলে গেলে মাথা থেকে ঘোমটা ফেলে বিছানায় চিত হয়ে শুনে পড়ল। চোখ বন্ধ করে বড় বড় দম নিয়ে বলল,
-আহ আল্লাহ! বিয়ে তো না, পুরাই জীবন তেজপাতা। ঘুমে আমি মরে যাচ্ছি। চোখ খোলা রাখতে কষ্ট হচ্ছে। সুখে থাকতে ভূতে কিলায় তাই মানুষ বিয়ে করে।’
ক্লান্তিতে বিছানায় শোয়ার পর কখন যে রায়া ঘুমিয়ে গেল তা সে নিজেও টের পায়নি। প্রায় এক ঘন্টা পর ইহফাজ রুমে এসেছে। দরজা ধাক্কা দিয়ে ভেতরে এসে চোখ চড়কগাছ। মেয়েটা হাত পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে মরার মত পড়ে ঘুমাচ্ছে। একে দেখে কেউ বলবে আজ এর বিয়ে। শ্বশুরবাড়িতে আজই প্রথম রাত। বাসর ঘরে এসেই কোন মেয়ে ঘুম দেয়? রায়ার নেতিয়ে যাওয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে মায়াই হলো ইহফাজের। যতই দুষ্টু হোক। মেয়েটা একটা মানুষ তো! সারাদিন বাঁদরামি করে বেড়ালে ক্লান্ত হবে না? ইহফাজ রুমে কোন প্রকাশ শব্দ করল না। চুপচাপ বিনা আওয়াজে শেরওয়ানি চেঞ্জ করে একটা টিশার্ট গায়ে দিয়ে দরজা ভিড়িয়ে দিয়ে চলে গেল। বাদরের সর্দারও ঘুমাক একটু। জাগলেই তো পাগলামি ছাগলামি শুরু করে দিবে। আচ্ছা, এর বাবা, মা, আত্মীয়রা একে কীভাবে সামলেছে? এক কথা শোনার মেয়ে তো ও না।
ঘুমের ঘোরে মিটিমিটি হাসছে রায়া। মনে হচ্ছে সুন্দর কোন স্বপ্ন দেখছে। পরমুহূর্তেই ওর মুখ কালো হয়ে গেল। হয়তো স্বপ্নেও ইহফাজ চলে এসেছে।
-এই মেয়ে! এই মেয়ে এই। কথা কানে যাচ্ছে না? ডাকছি যে শুনতে পাচ্ছ না? এই মেয়ে ওঠো বলছি। ঘুম থেকে জাগো। কত বড় সাহস! আমার বেডে শুয়ে আছে। আমার বেডে ঘুমানোর অধিকার কে দিয়েছে তোমায়? নামো বলছি।
রায়া জাগছে না। ইহফাজ ঘরের চারপাশে তাকাল।
-দাঁড়াও। তোমাকে কীভাবে জাগাতে হয় তা আমার জানা আছে।’
পানির জগ নিয়ে রায়ার উপর ঢেলে দিল ইহফাজ। চিৎকার দিয়ে হুড়মুড়িয়ে ঘুম থেকে জেগে উঠল রায়া। নিজেকে দেখছে সে।
-কই ভিজিনি তো? ও আল্লাহ! স্বপ্ন দেখছিলাম তাহলে! বদটা এখন স্বপ্নে এসেও আমাকে জ্বালানো শুরু করেছে!’
সত্যিই ঘরে পানির জগ আছে কিনা খুঁজছে রায়া। আছে। টেবিলের উপর পানি ভর্তি জগ।
-হু হু হু(নাকি কান্না করছে রায়া) বদের হাড্ডিটা যদি আমার স্বপ্ন সত্যি করে দেয়? না, বাবা। এর সাথে আজ বেশি কথা বলা যাবে না। রেগে গেলে দেখা যাবে সত্যি সত্যিই পানি ঢেলে দিবে। চাঁদু, আমাকে বিয়ে করার শোধ তো আমি তুলবই। রাতটা শুরু পার হোক না৷ কাল সকাল থেকেই তোমার জীবন ত্যানাত্যানা বানিয়ে ফেলব।’
হঠাৎ ইহফাজ এসে ঘরে ঢুকলে ভয় পেয়ে গেল রায়া। মনে মনে বলল,
-সামান্য ভদ্রতাও শেখেনি। ঘরে আসার আগে যে নক করবে বা গলা খাঁকারি দেবে তা যেন বলে দিতে হবে।’
পুরো বেড দখল করে, বেডের ঠিক মাঝখান টায় বসে আছে রায়া। ইহফাজ আড়চোখে একবার ওকে দেখল। রায়া ভাবছে, এই বুঝি স্বপ্নের মত বদটা তাকে বেড থেকে নেমে যেতে বলবে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here