ভালোবাসার_রঙ ‘১২’ #Jerin_akter_nipa

0
237

#ভালোবাসার_রঙ ‘১২’
#Jerin_akter_nipa

বিকেলে মা, বাবা চলে এসেছেন। ইহফাজ এতক্ষণ বাড়িতেই ছিল। বাবা মা এসেছে পরে বের হতে যাচ্ছিল। মা বললেন,
-রায়া কই? ওকে দেখছি না।’
-ঘরে ঘুমাচ্ছে।’
-ওহ। দুপুরে খেয়েছিস তোরা? ‘
-হুম।’
-তুই এবার এখন কোথায় বের হচ্ছিস?’
-কাজ আছে একটু।’
ইহফাজ বেরিয়ে গেল। তার মনে মনে ভয় হচ্ছে তার ছিড়া মেয়েটা না আবার ঘুম থেকে উঠে মা’কে সবকিছু বলে দেয়। তাহলে ইহফাজের আর বাড়ি থাকা হবে না। মা ঘাড় ধরে বাড়ি থেকে বের করে দিবে।
দশটার পর ইহফাজ বাড়িতে ফিরল। নিজের ঘরে গিয়ে রায়াকে দেখল না।
-পাগল মেয়েটা নিশ্চয়ই মা’র কানে আমার নামে বদনাম করছে।’
চেঞ্জ করে বেরিয়ে এলো ইহফাজ। মা কোথায়? রান্নাঘরে নাকি? ইহফাজ মা’কে ডাকতে লাগল।
-মা! ও মা! ‘
ঘর থেকে মা জবাব দিলেন,
-কি হয়েছে তোর? চেঁচাচ্ছিস কেন? ‘
-যাহ বাবা! মা’র আবার কি হলো?’
মায়ের ঘরে গিয়েও ইহফাজ রায়াকে দেখতে পেল না। কোথায় গেছে মেয়েটা? বিকেলে তো রুমেই দেখে গিয়েছিল। ঘুমাচ্ছিল তখন।
আমতা আমতা করে ইহফাজ বলল,
-রায়া কোথায় মা?’
-ওর বাবা মা’র কাছে।’
কিছু বুঝতে পারল না ইহফাজ। রায়া চলে গেছে! কেন?
-কেন? ‘
-কেন কি হ্যাঁ? জ্বরে অজ্ঞান হয়েছিল মেয়েটা। আর তুই বলেছিলি ও ঘুমাচ্ছে! কোনটা ঘুম আর কোনটা অজ্ঞান হয়ে থাকা সেটাও বুঝিস না তুই। বৌ ঘরে জ্বরে মরছে আর তুই বাইরে গিয়ে আড্ডা দিচ্ছিলি। এক দুপুরের জন্য রেখে গিয়েছিলাম। তাতেই এই অবস্থা। দু’তিন দিন তোর সাথে মেয়েটাকে ছাড়লে ও হয়তো মরেই যেত। এতটা দায়িত্বহীন কীভাবে হতে পারিস তুই? ওর বাবা মা কী ভাববে! ভাববে আমরা হয়তো এখানে রায়ার খেয়াল রাখি না।’
দুমিনিটের জন্য কিছু বলতে পারল না ইহফাজ। সত্যিই মেয়েটাকে ওই অবস্থায় একা রেখে যাওয়া ঠিক হয়নি। দুপুর থেকেই কপাল গরম ছিল।
-অনেক জ্বর এসেছে নাকি?’
অবাক হয়ে ছেলের দিকে তাকালেন তিনি।
-তুই আমারই ছেলে, ইফু? নিজের বোনের সামান্য গা গরম হলে না খেয়ে ওর পাশে বসে থাকতি। আর এখন নিজের বউয়ের বেলায় এতটা কেয়ারলেস তুই! সে অন্যের মেয়ে তাই এতটা অবহেলা! ভাবতেই আমার অবাক লাগছে। তোর সাথে ওই মেয়েটার বিয়ে দিয়েছি আমরা! তুই তো ওর যোগ্যই না।’
-আমি সত্যিই জানতাম না মা। ওর জ্বর এসেছে জানলে আমি ওকে ফেলে রেখে বাইরে যেতাম না। তুমি আমাকে ভুল বুঝছো।’
-আমার চোখের সামনে থেকে সর তুই। সহ্য করতে পারছি না তোকে। একা ঘরে জ্বরে কাঁপতে কাঁপতে মেয়েটা তার মা’কে ডাকছিল। কপালে হাত দিয়ে আমি রীতিমত ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। হঠাৎ করে মেয়েটা এত জ্বর বাঁধাল কি করে? দুপুরেও তো ভালো দেখে গিয়েছিলাম। রান্নাঘরে আমার পেছন পেছন ঘুরঘুর করছিল। হাসিখুশি মেয়েটা কয়েক ঘন্টার ভেতরে বিছানায় পড়ে গেল!’
কিছু বলার মুখ ইহফাজের নেই। তার জন্যই এসব হয়েছে। সে বাড়াবাড়ি না করলে আজ রায়া জ্বরে কষ্ট পেত না।
-আমি যাচ্ছি ওর কাছে। দরকার হলে রাতে ওখানেই থেকে যাব। তোর মত ছেলে পেটে ধরেছি মানুষের সামনে লজ্জা তো পেতেই হবে। মেয়েটাকে যে জোর নিজের কাছে রাখব, সে মুখও ছিলনা। ওর বাবা মা ওকে নিয়ে যেতে চাইলে আর না করতে পারিনি।’
মা চলে গেলে স্তব্ধ হয়ে কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইল ইহফাজ।

রায়া ওপাশ ফিরে শুয়ে আছে। রায়ার মা কম্বলটা ভালো করে টেনে দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে দরজার সামনে ইহফাজকে দেখল। ইহফাজের মা’ও রায়ার পাশে বসে আছে।
-আরে ইহফাজ, বাইরে দাঁড়িয়ে আছো কেন বাবা? ভেতরে এসো।’
ইহফাজ ঘরের ভেতর চলে এলো। মা তার দিকে তাকাচ্ছে না পর্যন্ত। রায়ার দিকে দেখল ইহফাজ। রায়ার মা বললেন,
-ঘুমিয়ে আছে। জ্বর একটু কমেছে। ঔষধ দেওয়ার পরই ঘুমিয়েছে।’
রায়ার মুখটা দেখার অনেক ইচ্ছে করছিল। কিন্তু রায়া তো ওপাশ ফিরে শুয়ে আছে।
-বসো তুমি। আমি ওর বাবাকে দেখে আসি। মেয়ের চিন্তায় নিজের শরীর খারাপ করে নিয়েছে।’
এবার নিজের কাছে ইহফাজকে অপরাধী মনে হচ্ছে। তার জন্য এতগুলো মানুষ কষ্ট পাচ্ছে। রায়ার মা চলে গেলে ইহফাজের মা বললেন,
-কেন এসেছিস তুই? ‘
-এখনও তুমি আমার উপর রাগ দেখাচ্ছ মা। আমি তো বলেছি, আমি জানতাম না ওর জ্বর।’
-জানলে যেন অনেক কিছু করে ফেলতি। যা তুই নিজের ঘরে গিয়ে ঘুমা। এখানে বসে ঢং করতে হবে না।’
মায়ের কথা শুনে ইহফাজের হাসি পাচ্ছে আবার কষ্টও লাগছে।
-ঢং কে করছে মা। আমি তো তোমার বউ মা’র সেবা করতে এসেছি। নিজের অপরাধ একটু কমাতে এসেছি।’
কপাল কোঁচকালেন মা।
-সত্যি বলছিস?’
-একদম। সারারাত জেগে সেবা করব। কসম। তবুও তুমি আর আমার উপর রাগ করে থেকো না। মাফ করো এবার।’
-কাল সকালে রায়াকে সুস্থ দেখলে তবেই তোকে মাফ করব।’

ইহফাজের মা ইহফাজকে রায়ার কাছে রেখে চলে গেলেন। ইহফাজ রায়ার মাথার কাছে বসে আছে। এখনও ঘুমাচ্ছে মেয়েটা। এই প্রথম রায়ার মুখের দিকে তাকিয়ে ইহফাজের মায়া লাগল।
-ঘুমিয়ে থাকলে তো কত ইনোসেন্ট লাগে। কিন্তু জেগে থাকলে যে এই মেয়ে কতটা শয়তানি করে তা কে বলবে?’
হাসলো ইহফাজ। রায়ার মা ঘরে এলেন।
-আজ রাতে আমি ওর পাশে থাকি, বাবা। জ্বর হলে রায়া একদম ঘুমাতে পারে না। অনেক জ্বালায়। তুমি বাড়ি চলে যাও।’
-না আন্টি, আপনি গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন। আমি আছি এখানে।’
-তুমি না ঘুমিয়ে ওর…
আন্টিকে কথা শেষ করতে না দিয়ে ইহফাজ বলল,
-আপনি চিন্তা করবেন না। আমার সমস্যা হবে না।’
রায়ার মা চলে গেলে ইহফাজ কতক্ষণ রায়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে চেয়ার গিয়ে বসে পড়লো। কখন যে চেয়ারে বসেই ঘুমিয়ে গেল তা মনে নেই। রাতে রায়ার গলা পেয়ে ঘুম ভাঙে। রায়া পানি চাচ্ছে।
-মা। মা, পানি। গলাটা শুকিয়ে গেছে।’
ইহফাজ ব্যস্ত হয়ে উঠে গিয়ে রায়াকে পানি দিল। পানি খাওয়ার জন্য এপাশ ফিরে ইহফাজকে দেখে ভূত দেখার মত চমকে উঠল রায়া।
-আপনি! আপনি এখানে কি করছেন? ‘
ইহফাজ রায়ার মাথা ধরে তুলে মুখের সামনে পানি ধরে বলল,
-আগে পানি খাও।’
বাধ্য মেয়ের মত পানি খেল রায়া।
-আপনি এখানে কেন?’
-শ্বশুড়বাড়িতে বেড়াতে এসেছি। আর কিছু? এবার চুপচাপ ঘুমাও।’
কিছুক্ষণ পর্যন্ত চুপ করে শুয়ে রইল রায়া। তারপর বলল,
-আপনার জন্যই কিন্তু আমার জ্বর এসেছে।’
-তাই তো রাত জেগে সেবা করছি।’
ইহফাজের সোজা উত্তরে আর কি বলবে ভেবে পেল না রায়া। লোকটা কি ঝগড়া করার মুডে নেই? এত সহজে নিজের দোষ মেনে নিচ্ছে।
-আপুর বাসা থেকে মা ফিরেছে? ‘
ইহফাজ বিছানায় উঠে গিয়ে রায়ার পাশে বালিশে হেলান দিয়ে বসল।
-বিকেলেই এসেছে। তুমি দেখ নি? মা-ই তো জানলো তুমি জ্বরে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে আছো। একটু আগেই এখান থেকে গেল।’
-ওহ।’
-আমার মা কোথায়? ‘
-তোমার বাবার কাছে। মেয়ের চিন্তায় বাবা অসুস্থ হতে চলেছেন।’
রায়া হাসলো। বলল,
-বাবা ওরকমই। আমার জন্য একটুতেই অনেকটা ঘাবড়ে যান।’
ইহফাজ বুঝলো এই মেয়ের চোখে যত ঘুম ছিল তা বিকেল থেকে ঘুমিয়ে নিয়েছে। এখন সারারাত নিজেও সজাগ থাকবে। আর কথা বলে বলে ইহফাজকেও সজাগ রাখবে। ইহফাজ ধমকের সুরে বলল,
-আর কোন কথা না। চুপ করে ঘুমাও তো এখন।’
ঠোঁট বাঁকিয়ে রায়া বলল,
-ঘুম না এলে জোর করে ঘুমাবো নাকি? আজব লোক! একটা অসুস্থ মানুষকে ধমকাচ্ছেন। দয়া মায়া কিছু নেই! ‘
-আচ্ছা সরি। আর ধমকাবো না। কথা না বলে ঘুমাবার চেষ্টা করো।’
-ঘুম আসবে না।’
-আসবে। কথা না বলে চোখ বন্ধ করে রাখলেই আসবে। তুমি চোখ বন্ধ করো। আমি তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। দেখবে দশ মিনিটে ঘুম এসে যাবে।’
রায়া মনে মনে ভাবছে, সে কি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছে? নাকি সত্যিই বদটা তার সাথে এত ভালো করে কথা বলছে। এসব তার কল্পনা নয় তো? এটা কি সত্যিই ইহফাজ? নাকি কোন ভূত টূত। ভয় পেয়ে গিয়ে রায়া বলল,
-শুনুন, আপনাকে একটা চিমটি কাটি?’
কপালে ভাঁজ ফেলে ইহফাজ রায়ার মুখের দিকে তাকাল।
-কেন? ‘
-না মানে, আপনি সত্যিই আছেন নাকি আমার কল্পনা? স্বপ্ন দেখছি নাকি ভূত দেখছি, ঠিক বুঝতে পারছি না।’
কথা শেষ করেই ইহফাজকে কিছু বুঝতে না দিয়ে ওর হাতে জোরে চিমটি কাটল রায়া।
ব্যথা পেয়ে ইহফাজ কাকিয়ে উঠেছে।
-আহ! মাথা খারাপ মেয়ে, মাংস তুলে নিয়েছ তো। নখ না অন্য কিছুরে বাবা!’
রায়া হাসতে গিয়েও ভয়ে মুখ কালো করে নিল।
-সরি। আসলে আপনি এত মিষ্টি ব্যবহার করছেন তো তাই আমার সন্দেহ হচ্ছিল। হয় আপনি ভূত আর নাহয় আমার কল্পনা।’
অন্য হাতে চিমটি কাটা জায়গা ডলতে ডলতে ইহফাজ বলল,
-এবার বিশ্বাস হয়েছে তো আমি ভূত না? নাকি আরেকবার চিমটি কেটে দেখবে।’
-না,না। আর দরকার নেই।’
ইহফাজ সহজভাবে রায়ার কপালে হাত রেখে জ্বর দেখল।
-জ্বর নেই। কিন্তু কপাল হালকা গরম। এখন বকবকানি বাদ দিয়ে ঘুমাও। নইলে রাতে আবার জ্বর আসবে।’
রায়া এখন ইহফাজের সাথে অনেকটা সহজ হয়ে উঠেছে। আগের মত আর ইহফাজকে তার কাছে খারাপ লাগছে না। রায়ার চুলে বিলি কাটতে কাটতে চোখ লেগে এসেছিল ইহফাজের। রায়া ডাকল,
-শুনুন, ঘুমিয়ে পড়েছেন? ‘
-হ্যাঁ? কি? না ঘুমাই নি।’
-একটা কথা জিজ্ঞেস করলে সত্যি সত্যি উত্তর দিবেন তো?’
-কি কথা? ‘
-আপনার গার্লফ্রেন্ড আছে? বা বিয়ের আগে কারো সাথে সম্পর্ক ছিল?’
-না।’
-না?’
-উঁহু।’
-তাহলে আপনি আমাকে দেখতে পারেন না কেন? আমি তো আরও ভেবেছিলাম, আপনার হয়তো গার্লফ্রেন্ড আছে। বাবা মা জোর করে বিয়ে করিয়েছে বলে রেগে আছেন। এখন তো দেখছি গার্লফ্রেন্ড নেই। তবুও বউয়ের প্রতি এত রাগ।’
-রায়া! আমাকে ঘুমাতে দিবে তুমি? সকালে কিন্তু আমার অফিস আছে। আজও তোমার জন্য অফিস কামাই হয়েছে। যেহেতু অফিসটা আমার বাবার বা শ্বশুরের না। তাই এভাবে অফিস মিস দিলে ওরা আমাকে ঘাড় ধরে বের করে দিবে।’
-আচ্ছা ঘুমান আপনি। আর কথা বলব না। ঘুমান।’
-তুমি কি করবে? তুমিও ঘুমাও না।’
-হুম।’
ইহফাজ চোখ বুজে শুয়ে পড়লে রায়া মাথা উঁচু করে তাকে দেখল। মনে মনে বলল,
-এতটাও বদ না।’

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here