বিদায়_বরণ পর্ব- ১৮

#বিদায়_বরণ
পর্ব- ১৮
লেখা- মেহরুন্নেছা সুরভী
.
সোমবার, ৭টার সময়,
সকাল বেলা,
কিংশুক এসেছে একদিন কেটে গিয়েছে। বাসার পরিস্থিতি এখনো স্বাভাবিকই বলা চলে। কিংশুকের মত বিভাবরী বেগম সময় নিচ্ছেন। সবাই সময় নিচ্ছে। যা সিদ্ধান্ত হোক, সবটা ভেবে চিন্তেই হোক। শিখিনীর সেরকমই ভাবনা, সে তার মাকে সময় দিচ্ছে। বিভাবরী বেগমের যেটা সিদ্ধান্ত, সেটাতেই তারা সন্তুষ্ট।
সেটাই যামিনীকে বারবার বুঝাচ্ছে শিখিনী। কিন্তু যামিনীর চোখের জল যেন কমছেই না! সকাল, দুপুর, সন্ধ্যে শুধু এক কথা, “দেখো শিখিপু, তোমরা যদি ঐ বাসায় ফিরে না যাও, তবে আমিও আর কখনো গ্রামে ফিরে যাবো না। তোমাদের সাথে এখানেই থেকে যাবো। একচুলও নড়াতে পারবে না আমায় এই বাসা থেকে!

সাখাওয়াতকে তাদের অতীত সম্পর্কে শিখিনী সব বলেছে। বিভাবরী বেগমের বাড়ি ছাড়া থেকে শুরু করে এক একটা দিনের গল্প। বাবার বাড়ি না ফেরা, সেখান থেকে কোনো খোঁজ খবর না আসা। এতগুলো বছর বাদে ভাগ্যবশত তাদের সাথে যামিনীর আলাপ, কিংশুকের আসা। সবটা সাখাওয়াত বোনের থেকে শুনে নিয়েছে।
আর বোনের মত তারও একই মতামত। তাদের মা বিভাবরী বেগম যা সিদ্ধান্ত নিবেন, সেটাই তারা মেনে নিবে।

এতগুলো বছর তো নানাবাড়ি, দাদাবাড়ী সম্পর্কে কিছুই জনত, কেউ আছে কিনা সেটা পর্যন্ত না। তাই এই বিষয়ে সাখাওয়াতের অতটা আগ্রহ প্রকাশ পেলো না। প্রতিদিনের মতই স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে লাগল।

পরিবারের মাঝে অসস্তিতে পরে রইল শুধু কিংশুক আর যামিনী। দুজনের মনের অবস্থা শোচনীয়।
কিংশুক চায় তার ফুফি আম্মা তাদের গ্রামের পিত্রালয়ে ফিরে চলুক, তাদের পরিবার জোড়া লাগুক। সবার মত সুখি পরবার গড়ে উঠুক। যামিনীর সেরকমই আশা। সেও চায় বিভাবরী বেগম তাদের বাসায় বেড়াতে যাবে, সাথে শিখিনী, সাখাওয়াত যাবে। এতদিন একসাথে থেকে ভীষণ মায়ায় পরে গিয়েছে যামিনী। আর এখন জানতে পারল, এরাই তাদের পরম আত্মীয়, রক্তের সম্পর্ক। তখন সম্পর্কের ভিত্তি আরো মজবুত হবে, সেটাই চাওয়া যামিনীর।

কিন্তু বিভাবরী বেগমের সিদ্ধান্তের উপর সবকিছু নির্ভর করছে। কিংশুক এসেছে একদিন হয়ে গেল। এর মাঝে তিনি বেশ চুপচাপ হয়ে গিয়েছে। প্রয়োজনে দু’একটা কথা বলে শিখিনীর সাথে। সাখাওয়াতের মাধ্যমে কিংশুকের যামিনীর খোঁজ খবর নেয়।

সাখাওয়াতের অবশ্য কিংশুকের সাথে ভালো ভাব জমেছে। দুজনে দু’রাত কাটালো একসাথে, গতদিন শহর ঘুরে দেখাল কিংশুককে। কতশত গল্প হলো দুজনের মাঝে। সেই সাথে কিংশুকের থেকে গ্রামের পরিবেশ, বাসস্থান, তাদের সম্পর্কে বেশ গল্প শুনে নিলো। একটু একটু আগ্রহ হলো বেড়াতে যাওয়ার।
মন্দ হবে না বেড়াতে গেলে।

সাখাওয়াতের নানাবাড়ি আছে, আর সেখান থেকে সাখাওয়াতের মামাতো ভাই এসেছে তাদের নিয়ে যেতে, সেটা সারা বিল্ডিং, আর এই পারায় খবরটা ছড়িয়ে গেল। কেউ কেউ দু’একটা কথা বলতে এলো, কিন্তু বিভাবরী বেগমের আচার আচরণ দেখে বেশি কিছু প্রকাশ করতে পারলেন না। চলে গেলেন মুখের কথা মুখে রেখেই।
মৌ আর তার মা এসেছিল, একপ্রকার সান্ত্বনা দিতে, কিন্তু বিভাবরী বেগম একদম সচল আছেন। সবাই হয়ত ভেবে নিয়েছিল, তিনি বোধহয় দুঃখে কাঁদতে কাঁদতে বিছানায় সজ্জাসায়ী!

এই সময়ের মধ্যে যামিনী একচুলও নড়েনি শিখিনীর থেকে। সারাক্ষণ ঘেঁষে ঘেঁষে থেকেছে, আর হাজারো কথা বকবক করেছে। কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি তুলেছে, আর সাথে শিখিনীর বকুনিও খেয়েছে। কিন্তু যামিনী একটু বেশি ছেলেমানুষী করছে। যদিও বিভাবরী বেগম সামনে এলেই চুপসে দাঁড়িয়ে থেকেছে।

ভোর হয়েছে শহরে। নিয়ম মত সাখাওয়াত বাহিরে বেড়িয়ে গেছে কিংশুককে নিয়ে। যামিনী বারান্দায় বসে আছে। শিখিনী দুটো কফির মগ নিয়ে যামিনীর পাশে গিয়ে বসল। এই দু’দিন যামিনী আর কিংশুকের ঠিকমত খাওয়াদাওয়া হয়নি। ওরা নিজেরা এতটা ডেস্পারেট ছিলো যে, শিখিনী অনেক বলেও ভালো মত খাওয়াতে পারেনি। তবে, শিখিনীদের জীবন আগের মতই চলছে। পরিবর্তন হওয়ার মত তেমন কিছুই হয়নি।

এত বছর বাদে কারো সম্পর্কে জানতে পারলে সেভাবে আগ্রহ আসে না। অন্তত, শিখিনীর আসছে না। সেই কত ছোট বয়সে নানাবাড়ি থেকে চলে এসেছিলো। সম্পর্কের ক্ষেত্রে আছে শুধু সামান্য স্মৃতি। সেটাও আবছায়ার আবডালে লুকিয়ে বসে আছে!

– যামিনী, কফিটা খেয়ে নেও।
-না, আমি খাবো না শিখিপু। ভালো লাগছে না।

শিখিনী দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে যামিনীর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, ” যামিনী, বাচ্চামো করে না লক্ষ্মী বোন আমার।
-” আপু, তুমি বুঝতে পারছ না, আমি তোমাদের ছাড়া গ্রামে যেতে পারব না। আমি পারছি না এসব মেনে নিতে।
– দেখো, আমি আমার মাকে চিনি। তিনি যা সঠিক মনে করবে, সেটাই সে করবে। আমরা তো তাকে সময় দিয়েছি। সময়ের উপর চলছে, চলুক, আশা করি সব ঠিক হবে।

– কী ঠিক হবে? তুমিই বলো? হ্যাঁ, আমি অবুঝ নই, ফুফি আম্মার পরিস্থিতি বুঝতে পেরেছি। কিন্তু এতগুলো বছর কেটে গিয়েছে। মা নেই আমার, দাদা-দাদুও নেই, বাবাও অসুস্থ। সময় বদলেছে। আমরাও বড় হয়েছি। আমরা সবাই চাই ফুফি আম্মা দেশের বাসায় চলুক, সুন্দর একটা পরিবারের মিলন হোক। তুমি কী সেটা চাও না বলো?
-” আমার কোনো চাওয়া, বা ইচ্ছে নেই যামিনী। সবটাই আমার মায়ের উপর। আমাদের মা এতদিন আমাদের মানুষ করেছেন, তার জীবনটা সে একলা লড়ে এসেছেন। তাই এখানে সম্পূর্ণ অধিকার তার নিজের। নিজে যা সিদ্ধান্ত নিবেন সেটাই আমরা মাথা নত করে গ্রহণ করব। আর আমি জানি, মা যা সিদ্ধান্ত নিবেন, সেটা ভেবে চিন্তেই নিবেন।

যামিনী তবুও অনেক কথা বলে। নিজের আবেক প্রকাশ করছে, কিন্তু শিখিনীর এসব কথায় ভাবান্তর নেই। এসব হাজারো কথা সে মনে মনে ভেবে সময় পার করে এসেছে। যামিনীর কথা যুক্তিসঙ্গত হলেও, সম্পূর্ণ ইচ্ছেটা এখানে বিভাবরী বেগমের।
আমরা যারা ক্ষত বিক্ষত হই, তারাই সেই ক্ষতের মর্ম বুঝতে পারি। হয়ত বিভাবরী বেগমের ক্ষতটা অনেক পুরোনো হয়েছে, তবে ক্ষতটা তো সেই এক সময় পেয়েছে। তাই সেই ক্ষতের দাগে আবার ঘা লাগলে কতটা কষ্ট পেতে হয়, সেটা একমাত্র বিভাবরী বেগমই বুঝতে পারবেন।

তাই শিখিনী তার মাকে সময় দিচ্ছে। তার যদি ইচ্ছে হয়, সে তার দেশের বাসায় যাবে। পুরোনো সব ভুলে নতুন করে সম্পর্কের নাম দিবে, তবে সেটা শিখিনীও মেনে নিবে। সেটা হয়ত যামিনী বা সাখাওয়াত আবেক দিয়ে বুঝতে চেষ্টা করছে, কিন্তু সময়ে অসময়ে আবেকের সাথে বিবেকও থাকতে হবে। বলা তো যায় না, যদি এতগুলো বছর বাদে সেই বাবার বাড়ি গিয়ে কোনোভাবে অপমানিত হতে হয়? তাহলে বিভাবরী বেগমের কতটা কষ্ট হবে, সেটা কী সবাই দেখতে পাবে? না ভাগীদার হতে পারবে?

যামিনী আর শিখিনী সকালের নাস্তা বানিয়ে নেয়। টেবিলে খাবার রেখে সবাই একসাথে খাওয়া শেষ করে। কিংশুকের যাওয়ার সময় হয়ে এসেছে। ওদিকে দেশের বাসায় সব পরে আছে, ইয়ামিনিও একলা। কিংশুকের উপরেই তো সকল দায়িত্ব!

এখন শুধু বিভাবরী বেগমের সিদ্ধান্তের উপর কিংশুকের আগামী সময়ের হাসি-খুশি নির্ভর করছে। সে এই বাসা থেকে গ্রামের উদ্দেশ্য কী মুখ নিয়ে ফিরবে?
আর ফিরলেও আদৌও আর কোনোদিন এই বাসায় পা রাখার দুঃসাহস করতে পারবে কিনা!

চলবে…

দ্রঃ আমি আন্তরিক ভাবে দুঃখিত, এতগুলো দিন বাদে লিখতে পারছি। ভুলত্রুটি মার্জনীয় দৃষ্টিতে দেখবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here