#ভালোবাসার_রংমহল পর্বঃ২
#জাহানারা_রিমা
প্রিয়ম ল্যাপটপটা কোলে নিয়ে অফিসের কিছু কাজ করছিলো। প্রিয়মকে দেখেও না দেখার ভান করে কুহু কফিটা নিয়ে সোজা বারান্দায় চলে গেলো। প্রিয়ম কিছুক্ষণ সেদিকে চোখ ছোটছোট করে তাকিয়ে আবার নিজের কাজে মনোনিবেশ করলো। বারান্দা থেকে কুহু আর রাফসান সাহেবের হাসাহাসির শব্দ ভেসে আসছে। বেশ খানিকক্ষণ পর কুহু ফিরে এসে অপর কফির কাপটা প্রিয়মের হাতে তুলে দিয়ে মুখ ভেঙছে চলে গেলো। কুহুর কান্ড দেখে প্রিয়ম আনমনেই হেসে ফেললো। কফিটা মুখে দিতেই ওর চোখমুখ কুঁচকে গেলো। ঠাণ্ডা হয়ে কফির স্বাদটাও তেতো হয়ে গেছে। পুরো ব্যাপারটা বুঝতে পেরে প্রিয়ম এবার শব্দ করে হেসে দিলো। ওর হাসার শব্দ শুনে রাফসান সাহেব বারান্দা থেকে এসে বললেন, “কিরে পাগল টাগল হয়ে গেলি নাকি! এভাবে একা একা হাসছিস কেন?”
প্রিয়ম কোনমতে হাসি থামিয়ে বলল, “তোমাদের কুহুরাণী আসলেই একটা চিজ!”
বাবাকে চোখ বড়বড় করে তাকাতে দেখে রাতুল নিজের ভুলটা বুঝতে পেরে জিভ কেটে বলল, “সরি, সরি। ভুল হয়ে গেছে।”
“আচ্ছা এবার তাহলে বল কুহু কি করেছে?”
“আমাকে শাস্তি দিতে ঠাণ্ডা কফি খাইয়েছে। প্রিয়মের কথা শুনেই উনি ঘর কাঁপিয়ে হাসলেন। তার হাসির সঙ্গে যুক্ত হলো প্রিয়মেরও হাসি।
_________________
ব্রেকফাস্ট টেবিলে মুখোমুখি প্রিয়ম আর কুহু। প্রিয়মকে দেখেই স্বভাবসুলভ ভেঙচি কাটলো কুহু। যা দেখে প্রিয়মের ঠোঁটের কোণে ভীড় করলো সূক্ষ্ম হাসির রেখা। যা কুহুর অগোচরেই রয়ে গেলো।
নাস্তা শেষে বেরিয়ে পড়লো দুজনেই। রোজকার মতো আজও কুহুকে কলেজে ড্রপ করেই অফিসে যাবে প্রিয়ম। ড্রাইভিং এর ফাঁকেফাঁকে আড়চোখে কুহুকে পর্যবেক্ষণ করছে কুহুকে। এটা ওর রোজকার কাজ। যদিও কুহুকে সেটা বুঝতে দেয়না। কুহু অনেকক্ষণ যাবৎ ফোনে গভীর মনোযোগ সহিত কিছু একটা করছে। রোজ যাওয়ার সময় পুরো রাস্তাতে কথা বলতে বলতে প্রিয়মের কান ঝালাপালা করে ফেলে। আজকে তার ব্যতিক্রম হওয়ায় প্রিয়মের কপালে সূক্ষ্ম চিন্তার রেখা ভেসে উঠলো। কিয়ৎক্ষণ পরেই গাড়িটা এসে কলেজের সামনে থামলো। কুহু ফোনটা ব্যাগে পুরে গাড়ি থেকে নামতেই একটা ছেলে এসে ওকে জড়িয়ে ধরলো। ছেলেটাকে দেখতেই কুহুর ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো। আড়চোখে একবার প্রিয়মকে দেখে নিয়ে ঠোঁটের কোণে বাকা হাসি ফুটিয়ে ছেলেটার সঙ্গে হেসেহেসে কথা বলতে বলতে সামনের দিকে হাঁটা ধরলো। রাগে প্রিয়মের কপালের রগ দপদপ করছে। গাড়িটা সাইড করে ওদের কাছে গেলো।
থমথমে মুখে প্রশ্ন করলো, “ছেলেটা কে কুহু?”
“আরে ভাইয়া তুমি এখনো যাওনি? তোমার অফিসের দেরি হয়ে যাবে তো। যাও যাও অফিসে যাও। এই রনিত চলো তো। আমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
প্রিয়ম দাঁতে দাঁত পিষে বলল, “তোকে যেটা জিজ্ঞেস করেছি আগে সেইটার উত্তর দে। এর আগে এক পা নাড়াবি তো তোর খবর আছে। ছেলেটা কে?”
“এইতো চান্দু এতক্ষণে তুমি লাইনে এসেছো। এবার দেখো কেমন লাগে। এই কুহুকে তো এখনো চেনোনাই।” মনে মনে কথাগুলো আউড়ে মুখে বলল, “ওহ আচ্ছা। সরি সরি তোমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতেই ভুলে গেছি। ও হচ্ছে রনিত, আমার বয়ফ্রেন্ড। চিন্তা করোনা খুব শীঘ্রই বড়বাবা আর মামনির সাথেও পরিচয় করিয়ে দেবো।” কথাটা বলেই একটা চওড়া হাসি দিলো। প্রিয়মকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে রনিতের হাতটা জড়িয়ে ধরে ওকে নিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেলো কুহু। প্রিয়ম নিজের রাগটাকে কন্ট্রোল করে গাড়ি নিয়ে অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো।
________________
পরেরদিন কলেজে আসার সময় কুহু বারবার রাহির ফোনে ট্রাই করছে। ম্যাসেঞ্জার, হোয়াটসআপে বারবার নক করেও কোথাও থেকে ওর রেসপন্স পাচ্ছেনা। কুহুর এমন ছটফটানি আর অস্থিরতা দেখে প্রিয়মের ঠোঁটের কোণে শয়তানি হাসি ফুটে উঠে। কলেজে গিয়ে কালকের মতো রনিতকে ফেলোনা গেইটের সামনে। মুখ গোমড়া করে ভেতরে চলে গেলো। ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে প্রিয়মের ঠোঁটের কোণে একটা রহস্যময় হাসি ফুটে উঠে।
কুহু ক্লাসে গিয়ে দেখে রাহি মুখ কালো করে একটা কর্ণারে বসে আছে। রাহির পিঠে ব্যাগ দিয়ে বাড়ি মেরে বলল, “অই তোর ওই বয়ফ্রেন্ডের কি হইছে রে? শালা, কি বয়ফ্রেন্ড তোর? অকর্মার ঢেকি একটা। একদিন এক্টিং করেই উধাও। আর তোরেও তো কতবার ফোনে ট্রাই করলাম কোথাও তো রেসপন্স করলি না। কি হইছে তোরা দুইটার?”
রাহিকে চুপ করে থাকতে দেখে ওর পিঠে আরেকটা মারতেই রাহি রাগী চোখে কুহুর দিকে তাকিয়ে বলল, “অই তোর কথার চেয়ে হাত বেশি চলে ক্যান? আর একবার মারবি তো খবর আছে বলে দিলাম। রনিত বলে দিয়েছে ও আর এসব এক্টিং ফ্যাক্টিং করতে পারবেনা।”
“কেন? পারবেনা কেন?”
রাহি কুহুর হাতে ছোট্ট একটা চিরকুট ধরিয়ে দিলো। যেখানে লেখা আছে, “যার বয়ফ্রেন্ড আছিস তার বয়ফ্রেন্ড হয়েই থাক। অন্য কারোর বয়ফ্রেন্ড হওয়ার এক্টিং করলে পরেরবার আর হাড়গোড় আস্তো থাকবেনা। প্রথমবার বলে ছেড়ে দিলাম।”
রাহি বলল, “কালকে নাকি রনিতকে কয়েকটা ছেলে এসে থ্রেট দিয়ে গেছে আর এই চিরকুটটা। ও ভয় পেয়ে গেছে ভীষণ। তাই পারবেনা বলে দিয়েছে।”
কুহুর সেদিকে খেয়াল নেই। ওর ঠোঁটের কোণে এখন সাফল্যের হাসি। যুদ্ধে জয়ী হলে মানুষ যতোটা খুশি হয় কুহুকে এই মুহূর্তে ঠিক ততোটাই খুশি দেখাছে। কুহু রাহিকে জড়িয়ে ধরে বলল, “আর লাগবেনা বান্ধবী। আমার কাজ তো হয়েই গেছে। তুইই থাক তোর ওই ভীতুর ডিম বয়ফ্রেন্ড নিয়ে আমার আর দরকার নেই।”
_________________
দেখতে দেখতে কুহুর টেস্ট পরীক্ষা শেষ হয়ে গেলো। আর কয়েকদিন পরেই ফাইনাল। কুহু এখন পুরোদমে পড়ায় মনোযোগ দিয়েছে। তবে মাঝেমাঝে প্রিয়মকে জ্বালাতেও ছাড়েনা। রাত এগারোটা পড়তে পড়তে ঘুম এসে যাওয়ায় কফি বানাতে গেলো। কফিটা নিয়ে ফিরতেই রাফসান সাহেবের কণ্ঠে একটা কথা শুনে থমকে দাঁড়ালো।
“ভাবছি কুহুর জন্মদিনের দিনেই ওর এনগেজমেন্টটা করিয়ে রাখবো।”
চোখবেয়ে কখন কয়েকফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো কুহুর সেই উপলব্ধিটুকুও হলোনা। তবে কি বড়বাবার কাছেও শেষপর্যন্ত ও বোঝা হয়ে গেলো? আর দাঁড়ালো না সেখানে ছুটে নিজের ঘরে চলে গেলো।
কুহুকে কয়েকদিন ধরেই বেশ চুপচাপ দেখা যাচ্ছে। সবাই ব্যাপারটা নিয়ে খানিক চিন্তিত এমনকি মিসেস নীলিমাও। হ্যা কুহুকে তিনি খুব একটা পছন্দ না করলেও মেয়েটার প্রতি অল্পবিস্তর হলেও মায়া জন্মে গেছে।
সকলে ভাবলো হয়তো পরীক্ষার টেনশনের কারণে এমন চুপচাপ হয়ে আছে।
___________________
দমকা বাতাস এসে কুহুর চুলগুলো এলোমেলো করে দিচ্ছে। তবে সেগুলোকে ঠিক করে নেওয়ার কোনো ব্যস্ততা ওর মাঝে নেই। সে এখন অন্য এক ঘোরের মাঝে আছে। গোধূলিলগ্নের রক্তাভ আকাশের পানে নির্নিমেষ তাকিয়ে আছে। এ কয়দিন যাবৎ নিজেকে শুধু এটাই বুঝিয়ে এসেছে, ‘যে মানুষগুলো এতদিন ওকে ভালোবেসে আগলে রেখেছে, বাবা মায়ের অভাব কোনদিন বুঝতে দেয়নি তাদের ইচ্ছের অমর্যাদা ও কিছুতেই করবেনা।’ এসবই তো মস্তিষ্কের কথা কিন্তু মনের উপর তো আর কোন জোর চলেনা। তাই শত চেষ্টা করেও মনটাকে নিজের বসে আনতে পারছেনা। আকাশ পানে চেয়ে থাকতে থাকতেই ওর ভেতরে আটকে থাকা দীর্ঘশ্বাসটা বেরিয়ে এলো। চোখের কোলবেয়ে কয়েকফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়তেই চটজলদি সেটা মুছেও নিলো। মস্তিষ্ক আর মনের যুদ্ধে আজ বড্ড ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।
গুটিগুটি পায়ে কারোর এগিয়ে আসার শব্দ কর্ণকুহরে এসে পৌঁছাতেই পেছন ঘুরে সানিকে দেখলো। হাটু মুড়ে বসতেই সানি দৌঁড়ে এসে ঝাপটে ধরলো কুহুর গলা। কুহু পড়ে যেতে নিয়েও নিজেকে সামলে নিলো। এতক্ষণের হাহাকার ভরা বুকটাতে যেন এতটা সময় পর এসে ভারি বর্ষণ নামলো। সানির মুখটা হাতের আঁজলায় ভরে বলল, “আমাল বাবাইতা কেমন আছে?”
“কুহুপাখিল বাবাইতা খুব ভালো আছে। তাইতো কুহুপাখিকে দেখতে চলে এসেছে।”
“ওলে আমাল বাবাইতা।” বলেই সানির গোলুমলু গালদুটো টেনে দিলো।
সানি রাগ দেখিয়ে বলল, “আমাল গাল তানবে না। আমি ব্যতা পাই। আমাল গাল তানলে আমিও তোমাল গাল তেনে দেবো।”
কুহু দুষ্টুমি করে আবার গাল টানতে নিলেই সানি উল্টে তেড়ে এসে কুহুর গালদুটো টেনে দিতে চায়। কুহু নিজেকে বাঁচাতে সানিকে কাতুকুতু দিতে থাকে আর সানি গড়িয়ে গড়িয়ে হাসতে থাকে। সানির হাসির সাথে যুক্ত হয় কুহুর খিলখিল করা হাসি।
কুহুকে হাসতে দেখে এতক্ষণে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে প্রিয়ম। এতক্ষণ যেন মনের মাঝে একটা কয়েক টন ওজনের পাথর চেপে ছিলো। কুহুর মুখে হাসি দেখে মুহূর্তের মাঝেই সব ভার নেমে গেলো।
স্বগতোক্তি করে বলল, “জানিনা কি এমন কারণ যার জন্যে এতোটা গুমড়ে গুমড়ে থাকছো। তোমাকে এভাবে দেখতে আমাদের কারোরই ভালো লাগছেনা। তবে কথা দিচ্ছি খুব শীঘ্রই তোমার সব কষ্ট লাঘব করে দেবো। তোমার মুখে লেগে থাকা হাসিটা কখনো বিলীন হতে দেবোনা। কথা দিলাম কুহুপাখি।”
চলবে,,,