#ভালোবাসার_রংমহল পর্বঃ৪
#জাহানারা_রিমা
কুহু কেকের উপর ছুরিটা বসাতে যাবে এমন সময় কোথা থেকে রাহি এসে মুখচ্ছটা মলিন করে বলল, “এই তুই কেমন বান্ধবীরে? একমাত্র বান্ধবীকে ফেলেই কেক কাটতে বসে গেলি।”
রাহিকে দেখেই কুহু প্রশস্ত হাসলো। সানি দেরি দেখে বিরক্তবোধ করলো। বলল, “কুহুপাখি তাড়াতাড়ি কেক কাটো। আমি খাবো।” সানির কথাশুনে সবাই অল্পবিস্তর হাসলো। তারপর আর কালবিলম্ব না করে সানির হাত ধরেই কুহু কেকটা কাটলো। কেক খাওয়ার পর্ব শেষ হতেই রাফসান সাহেব এনগেজমেন্টের ঘোষণা দিলেন। কুহু আর প্রিয়মকে একসাথে স্টেজে ডাকতেই কুহু চমকে উঠে প্রিয়মের দিকে তাকায়। এত বড় একটা সারপ্রাইজের জন্য ও মোটেও প্রস্তুত ছিলোনা। সুষ্ঠুভাবেই ওদের দুজনের এনগেজমেন্ট সম্পন্ন হলো। পুরোটা সময় যেন কুহু একটা ঘোরের মধ্যে ছিলো। অশ্রুসিক্ত আঁখিযুগল নিয়ে একবার দীপ্তি আর রাফসান সাহেবের দিকে তাকালো। মানুষদুজন ওকে আরো বেশি ঋণী করে দিলো। যা ওর নিজের জীবন দিয়েও শোধ করা সম্ভব নয়। তবে একবারের জন্যেও কুহু প্রিয়মের দিকে চোখ তুলে তাকায়নি। চুপচাপ শুধু আংটিটা পরিয়ে দিয়েছে। প্রিয়ম অনেকক্ষণ উশখুশ করছিলো কুহুকে কিছু বলার জন্য তবে কুহু সেসবে পাত্তা দেয়নি। ফটোশুট আর খাওয়াদাওয়ার পর্ব সম্পন্ন হতেই সবাই ধীরেধীরে বিদায় নিতে থাকে। অতিথিরা সবাই বিদায় নিয়ে চলে যেতে ওরাও সবাই গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। প্রিয়ম ভেবেছিলো কুহু ওর গাড়িতে করেই যাবে তখন নাহয় দুজন কথা বলে সব মিটিয়ে নেবে। কিন্তু ওকে অবাক করে দিয়ে কুহু প্রিয়মের বাবা মায়ের গাড়িতে উঠে বসলো। প্রিয়ম হতাশার শ্বাস ফেলে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলো।
__________________
গতকালকের দিনটা যেন কুহুর কাছে স্বপ্নের মতো ছিলো। সেই ঘোর এখনো কাটেনি। স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বা হাতের অনামিকায় ঝকঝক করা আংটিটার দিকে। তবে প্রিয়মকে ও এখনো ক্ষমা করেনি। বোবা অভিমান জন্মেছে ওর উপর। প্রিয়ম নিশ্চয় আগে থেকেই সবটা জানতো তাহলে এতদিন ওকে প্রত্যাখ্যান করে এত কষ্ট কেন দিলো?
যদিও কাল থেকেই প্রিয়ম অনেকবার চেষ্টা করেছে ওর সাথে কথা বলার। তবে কুহুও কম যায়না, প্রিয়মকে কোনো সুযোগই ও দেয়নি। প্রতিবারই পাশ কাটিয়ে চলে এসেছে।
প্রিয়ম রুমের মাঝে পায়চারি করছে। আজ অফিসেও যায়নি। এত চেষ্টা করেও কুহুর সাথে কয়েক সেকেন্ডের জন্যেও কথা বলার সুযোগ হয়নি বলা ভালো কুহুই সেই সুযোগ দেয়নি। বাঘিনী যে ভালোভাবেই চটেছে সেটা ও বেশ ভালোই বুঝতে পারছে। কুহুর সঙ্গে কিভাবে একটু কথা বলা যায় সেই ব্যাপারেই ভাবছিলো। ভাবতে ভাবতে কখন হাতের নখ কামড়াতে শুরু করেছে নিজেরই খেয়াল নেই। সানি বলল, “মামা কুহুপাখির মতো আঙ্গুল কামড়ায়।”
সানির কথা শুনে প্রিয়ম চমকে উঠে নিজের হাতের দিকে তাকালো। নিজের কাজে নিজেই অবাক হয়ে গেলো। এভাবে নখ কামড়ানো কুহুর স্বভাব। আবারো ভাবনায় ডুব দিতেই সানিকে দেখে চট করে একটা বুদ্ধি খেলে গেলো মাথায়। সানিকে কোলে নিয়ে কানের কাছে ফিসফিসিয়ে কিছু কথা বললো। সানিও চটজলদি প্রিয়মের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে কুহুর কাছে ছুটলো।
কুহু এখনো একইভাবে বসে আছে। হুট করে সানি এসে ওর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ায় কিছুটা হকচকিয়ে গেলো। সানিকে দেখেই কুহুর ঠোঁটের কোণে দেখা দিলো প্রশান্তির উষ্ণ হাসি। সানি কুহুর হাত ধরে টানাটানি করছে। কুহু ওর সামনে হাটুমুড়ে বসে বলল, “কোথায় যেতে হবে বলো। এভাবে টানাহ্যাঁচড়া করছো কেন?”
“ছাদে চলো।”
কুহুর ভ্রুজোড়া খানিক কুঞ্চিত হলো। বলল, “এসময় ছাদে কেন?”
“আমার ডলটা ফেলে এসেছি। আনতে যাবো। চলো, চলো।” বলেই আবারো টানতে লাগলো কুহুকে। অগত্যা কুহুকে চলতে হলো সানির সাথে।
ছাদে আসতেই পেছন ফিরে সানিকে না দেখে অবাক হলো কুহু। পুরো ছাদ ঘুরেও সানির ডলটা কোথাও দেখতে পেলোনা। পেছন থেকে দরজা বন্ধের আওয়াজ পেয়ে চমকে উঠলো। প্রিয়মকে দেখেই বোবা অভিমানরা ঝেঁকে ধরলো আবারো। নেমে যেতে উদ্যত হতেই প্রিয়ম হাত ধরে ওকে আটকে দেয়। অনেক চেষ্টা করেও কুহু নিজ হাতটা ছাড়াতে সমর্থ হলোনা। প্রিয়ম এবার পেছন থেকে ওকে জড়িয়ে ধরতেই ওর ছটফটানি আগের চেয়ে কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেলো। তবে ওর শক্তপোক্ত হাতের বাধন থেকে নিজেকে ছাড়াতে সক্ষম হলোনা। কুহুর হম্ভিতম্বি দেখে প্রিয়ম একপ্রস্ত হেসে দিলো। প্রিয়মের হাসি দেখে কুহুর গায়ে জ্বালা করে উঠলো। নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতেই বলল, “এখন প্রেম দেখাতে আসতে কে বলেছে?”
“আমার বউ, আমার যখন ইচ্ছে আমি তার সাথে প্রেম দেখাবো তাতে কার কি?” প্রিয়মের সোজাসাপ্টা জবাব।
“কে বউ? কার বউ? আংটি বদল হলেই কেউ কারো বউ হয়ে যায়না।” প্রিয়মের মুখে বউ শব্দটা শুনে কুহুর শিরদাঁড়া বেয়ে শীতলতার এক অদ্ভুত শিহরণ বয়ে গেলো। তবে প্রিয়মকে সেটা বুঝতে দিলোনা। তাই কিছুটা রুক্ষস্বরেই কথাটা বলল। কিন্তু প্রিয়ম ওর কথায় কান না দিয়ে নিমিষহারা চোখে কুহুর মুখপানে চেয়ে রইলো। লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠা ওর লজ্জাবতীকে এখন আরো মায়াবী লাগছে।
প্রিয়ম বলল, “কিন্তু তোর মুখতো অন্যকথা বলছে। লজ্জায় কেমন লাল টমেটোর মতো হয়ে আছে।”
ধরা পড়ে যাওয়ায় কুহু মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিলো। কুহুকে অন্যদুকে মুখ ফেরাতে দেখে প্রিয়ম ওর দিকে তাকিয়ে তার দামাল হাসিটা হাসছে যে হাসিতে কুহু বারংবার মজেছে। বেহায়া চোখদুটোকে হাজার চেয়েও অন্য কোনদিকে স্থির রাখতে পারছেনা। কুহুর অবস্থাটা বুঝতে পেরে এবার মিটমিটিয়ে হাসতে লাগলো প্রিয়ম। রাগ হলো কুহুর। প্রিয়মের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে ছাদের একপাশে গিয়ে দাঁড়ালো। এবার আর বেশি কসরত করতে হলোনা।
প্রিয়ম নিঃশব্দে কুহুর পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। কিছু মুহূর্ত কেটে গেলো নিস্তব্ধতায়। নিশ্চুপতা ভাঙলো কারোর ফুঁপানো কান্নার শব্দে। প্রিয়ম আঁৎকে উঠলো। কুহুকে কাছে টেনে নিয়ে আলতো হাতে ওর চোখের জল মুছে দিলো। কুহুর মাথাটা বুকের মাঝে চেপে ধরে মাথায় হাত বুলাতে লাগলো।
“হুশ। আর একদম কান্না করবিনা। আমার কথাগুলো আগে শোন। তারপর যদি তোর আমাকে দোষী বলে মনে হয়। তাহলে যে শাস্তিই দিবি আমি সেটা মাথা পেতে নেবো।”
কুহু কোন কথা না বলে চুপ হয়ে রইলো। এখন চুপ থেকে সবটা শুনে নেওয়া উচিৎ বলে মনে হলো।
প্রিয়ম কুহুকে ছেড়ে দিয়ে ওকে নিয়ে দোলনাটায় বসালো। আর নিজে কুহুর সামনে হাটুমুড়ে বসে ওর একটা হাত নিজের দুহাতের মুঠোয় নিয়ে বলতে শুরু করলো।
“কুহু তুই তো জানিস বাবা মা তোকে ঠিক কতোটা ভালোবাসে। বাবা, মা আগে থেকেই কিছুটা ধারণা করেছিলেন আমরা হয়তো দুজন দুজনকে পছন্দ করি। তাই বাবা একদিন আমাকে ডেকে কথাটা জানতে চান। আমি সত্যিটাই বলেছিলাম। তারা চায়নি কেউ কখনো তোর দিকে কোনো বিষয়ে আঙ্গুল তুলুক। আসলে আমাদের সমাজটাই এমন এখানে যাই হোক সব ব্যাপারে মেয়েদেরই দোষারোপ করা হয়। একটা মেয়ে যদি ধর্ষিতও হয় তাহলেও কিন্তু তখন সেই মেয়েটাকেই সমাজের চোখে, সবার চোখে ছোট হয়ে থাকতে হয়। যদিও এতে মেয়েটার কোনো দোষ থাকেনা। তাও শাস্তি ওই মেয়েটাকেই পেতে হয়। তুই হয়তো ভাবছিস এসব কথা কেন তুলছি। আসলে আমাদের সমাজে কিছু মানুষ থাকে তিলকে তাল করা যাদের স্বভাব।তোর আর আমার মাঝে যদি কোনো সম্পর্ক থাকতো আর সেটা বাইরের কারোর চোখে পড়তো। তাহলে কিন্তু আঙ্গুলটা সবার আগে তোর দিকেই তুলতো। এককান দুকান হতে হতে পুরো পাড়াতেই কথাটা ছড়িয়ে পড়তো। কেউ হয়তো এমন কথাও বলতে পারতো, তুই আমাকে ফাঁসিয়ে নিজের একটা শক্ত খুটি গড়ার জন্যই আমার সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছিস। এগুলো সবই সম্ভাবনা। হতে পারতোনা এমনটা কিন্তু নয়। বাবা, মা কেউই চায়নি আমার আর তোর জীবনে এমন কিছু ঘটুক। তারা চেয়েছিলেন আমাদের সম্পর্কটা বৈধভাবে শুরু হোক। কেই যাতে আমাদের দিকে আঙ্গুল তুলতে না পারে। তাই আমি তাদের ইচ্ছেকে শ্রদ্ধা জানিয়েই এতদিন তোকে নিজের মনের কথা খুলে বলিনি।”
প্রিয়মের কথা শেষ হতেই কুহু কাঁদতে কাঁদতে বলল, “সেদিন বড়বাবা না আসলে তো আমার বিয়েও ঠিক হয়ে যেতো তখন কি করতে?”
“আরে বাবা সেইজন্যেই তো ঐদিন ফোন করে বাবাকে ডেকে এনেছিলাম। তবে আমার বাবা কিন্তু একজন জিনিয়াস! কেমন এক্টিং করলো সেদিন দেখলিনা। যেন কিছুই জানতেন না।”
“দেখতে হবেনা বড়বাবা টা কার!”
কুহুর কথাশুনে হেসে দিলো প্রিয়ম।
কুহুকে নিজের সাথে জড়িয়ে নিয়ে বললো, আমার ভালোবাসার রংমহলের সবটা জোরে শুধুই তোর বিচরণ। সেখানে আর কারোর কোনো অস্তিত্ব নেই।
চলবে,,,