ঝরা_বকুলের_গল্প #পর্ব_২ #মেহা_মেহনাজ

0
338

#ঝরা_বকুলের_গল্প
#পর্ব_২
#মেহা_মেহনাজ
.
.
নিজের স্বামীকে সতীনের সঙ্গে সুখ শীৎকারে হারিয়ে যাওয়ার মতো নিদারুণ বুক চেঁড়া দৃশ্য যেন আর কারো দেখবার ভাগ্য না হয়! বাড়ির পেছনে জোড় পুকুর, একটা বড় কল পাড়, খানিকটা জায়গা জুড়ে বড় হাঁস-মুরগির খোঁয়াড় রয়েছে। জোড় পুকুর ঘুরে গেলে গরু-ছাগলের আঁতাল ঘরটা চোখে পড়ে। বকুল এলোমেলো পদক্ষেপে হাঁটতে হাঁটতে জোড় পুকুর ঘুরে সেই আঁতালের সামনে গিয়েই দাঁড়াল। সব ঘুমিয়ে। কোনো সাড়াশব্দ নেই। নিকষ কালো অন্ধকার,কোথায় কি- বোঝার সাধ্যি কার! কিন্তু বকুল সব চেনে, সব অনুভব করে চোখের দর্পণে দেখতে পায়। ছোট বেলা থেকে একাকীত্বই যার সঙ্গী, তার আঁধারে ভয় কীসের? আঁতাল ঘরের দরজার গোড়ায় বকুল মাটিতে হাত-পা ছড়িয়েই বসে পড়ল। কেমন অবশ লাগছে শরীরটা। কপালে হাত দিয়ে বুঝলো, ভীষণ জ্বর উঠেছে। তবে সেটা শারীরিক ব্যথায় নাকি মানসিক, কে জানে?

বকুল চোখ বন্ধ করে নিজেই নিজের সাথে কথা বলার চেষ্টা করল।

বাস্তবের বকুল হৃদয় বাড়ি হাতড়ে এক কোণে মৃ’তের মতো পড়ে থাকা আরেক বকুলকে খুঁজে পায়। তাকে জিজ্ঞেস করে উঠল,

“তোর কষ্ট হইতাছে?”

প্রতিচ্ছবি বকুল মাথা তোলে না। হাঁটুতে মুখ গোঁজ করে রেখেই জবাব দেয় ছোট করে,

“হুঁ।”

“হেয় তোরে মা*রতো, কা*টতো, তোর শরীরডারে শরীর মনে করত না। জোর কইরা হইলেও হের চাই। কত রাইত তুই দুই চোখের পানি ছাইড়া দিয়া আল্লাহর কাছে অভিযোগ করছোস, রাগ দেখাইছোস, ভুইলা গেছোস সব?”

“ভুলি নাই। হেয় আরেক বিয়া কইরা আনছে, হেইতে আমার কষ্ট না। কষ্ট হইতাছে অন্যখানে..”

“কোন খানে?”

মনের বকুল মুখ তুলে তাকাল। বাস্তব বকুল এবং অবাস্তব বকুল যেন মুখোমুখি, একে অপরের দিকে তাকিয়ে।

“এত্তকিছু সহ্য কইরাও তারে ছাইড়া যাওনের কথা চিন্তা করি নাই। হেয় মা*রতো, অথচ আমি রাইতের বেলা হেয় না আইলে মুখে ভাত তুলতে পারতাম না। হের লগে সারাদিন কাইজ্জা হইতো, তাও হের চেহারাটা দেখলে চিন্তা থাকত না। হেই যেমনই আছিলো, আমি সব মাইনা নিয়া থাকতেছিলাম। আর হেয়, আমার লিগা একটুখানি কিছুই মানতে পারল না। ফট কইরা একজন রে নিজের বানাইয়া নিয়া আইলো! যেই বিছানায় আমারে নিয়া শুইছে, হেই একই বিছানায় হেরে নিয়া শুইতাছে! একটুখানি দয়ামায়া ও লাগে না? একটুখানি না? কেমন পাত্থরের লাহান দিল নিয়া জন্মাইছে হেয়? আমি কি হের কিচ্ছু আছিলাম না? কিচ্ছুই না?”

বকুল কাঁদে, আকুল হয়ে কাঁদে। তার কান্নার আওয়াজ অদ্ভুত ঝংকার তুলে বাতাসে মিশে যায়। কেমন অশরীরী শোনায় সে শব্দ! বকুল নিজেই নিজের কান্নার নিনাদে চমকিত হয়ে চুপসে গেল। পেটের ভেতরটা হুট করেই পাঁক দিয়ে উঠে। কেমন যেন লাগছে। মনে হচ্ছে, ভেতর থেকে সব বেরিয়ে যাবে। বকুল হা করতেই মুখ ভর্তি বমি করে দেয়। একবার, দুইবার, তারপর আরও একবার।
জ্বরে পুরো শরীর টা ঠকঠক করে কাঁপছে। উত্তুরে হাওয়া গায়ে কাঁপন ধরায়। শীতের মাস। গায়ে গরম কাপড় নেই। অস্বাভাবিক ভয় এবং মাথার ভেতর এক রাশ চিন্তা…. শরীর নিতে পারে না। আঁতাল ঘরের সামনেই ঠান্ডা ধুলোবালির উপর বকুল নিজেকে ছেড়ে দিলো। অন্তরীক্ষে চাঁদ নেই। সবকিছু স্থির, নিশ্চল, শুধুমাত্র প্রলয়ঙ্কারী ঝড় উঠেছে ওর হৃদয়ে… বকুলের জ্ঞান হারাতে হারাতে ওর দুই চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে।

___________

“চুতমা*রানি আমারে এতদিন জ্বালাইয়াও পরাণে শান্তি পায় নাই। এখন অন্য ভাবে জ্বালানো শুরু করছে আবার। ওরে কও ও যেন ভালা হইয়া যায়। নাইলে এই বাড়িত থেইকা ঘাড় ধাক্কা মা*ইরা বাইর কইরা দিমু। তখন টের পাইবো, কত ধানে কত চাইল।”

“আহহা আপনে একটু থামেন। শরীরডা খারাপ বানাইয়েন না উত্তেজিত হইয়া।”

শাহজাদির দরদ উপচে পড়ে কণ্ঠস্বর বেয়ে। মোরশেদের গায়ে ধরা আগুন টা যেন একটু কমলো। তিনি ঘন ঘন কিছু নিঃশ্বাস ছেড়ে বিছানার উপর মৃ*তের ন্যায় পড়ে থাকা বকুলের দিকে তাকালেন। পুনরায় মাথার ভেতর রাগ দপ করে উঠে।

“অত রাইতে কোন ভা*তারের লগে দেখা করবার গেছিল ও, জিগাও ওরে! সকাল সকাল এলাকার সবাইরে একটা তামাশা দেখাইলো। আমার কারণে ওয় ম*ইরা যাইবার লাগছে, না? তাইলে নটিরে ম*রতে দাও। ফালাইয়া আও বাইরে। ওরে ঘরে আনছো ক্যান?”

মোরশেদ তেজ নিয়ে দুই পা এগোয়। উদ্দেশ্য বকুলকে পুনরায় শারীরিক ভাবে প্রহার করা। রুনু বেগমের কলিজা ধ্বক করে উঠে। মেয়েটা অসুস্থ। তার উপর ওর শরীর দেখে উনার অন্য কিছু আন্দাজ হচ্ছে। এই অবস্থায় এতটা ধকল নেওয়া ওর জন্য মোটেও ভালো কথা নয়!

রুনু বেগম ঝট করে দাঁড়িয়ে পড়লেন। জোর গলায় বললেন,

“এহন থাম।”

তারপর শাহজাদির দিকে এক নজর তাকিয়ে গলার স্বর নিচু করে বললেন,

“তুই একটু বাইরে আয়। আমার কতা আছে।”

মোরশেদের মেজাজ খারাপ। সে ছ্যাৎ করে উঠে,

“কি কতা? এইনে কও!”

“আয় না..”

রুনু বেগম দ্রুত পদে বেরিয়ে গেলে মোরশেদকেও অগত্যা বেরিয়ে যেতে হলো। তাদের গমন পথের দিকে চেয়ে মুখে ভেংচি কাটে শাহজাদি। তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে বকুল। এমন ভয়াবহ কর্ম করার কথা ঘূনাক্ষরেও ভাবতে পারে না সে!

ঘরের দাওয়ায় টেনে আনেন রুনু বেগম। মোরশেদ যারপরনাই বিরক্ত। রুনু বেগম কণ্ঠস্বর যথেষ্ট নিচুতে নামিয়ে বললেন,

“তুই একবার দাক্তার ডাকবি?”

মোরশেদ ভ্রু কুঁচকালেন,

“কেডায় ম*রছে?”

“ওর লিগা।”

মোরশেদ বুঝলেন, এখানে বকুলের কথা বলা হচ্ছে।

“ওরে দেইখ্যা আমার অন্যরকম লাগতাছে। মন কইতাছে, ওয় পোয়াতি।”

“বলো কি আম্মা!”

মোরশেদের দুই চোখ ছানাবড়া। এতগুলো বছরের এতগুলো দিন একসাথে থাকার পরও বকুল গর্ভবতী হয়নি যখন, তখন মোরশেদ অন্যদিকে নজর দিয়েছে। ভেবেই নিয়েছে এই মেয়ে মা হওয়ার ক্ষমতাটুকুও রাখে না! কিন্তু এখন…
একটা আলাদা চিন্তা ঢুকে গেল মনের ভেতর।

রুনু বেগম বললেন,

“আমি দা-ঈ ডাক দেই? আইয়া একবার দেইখ্যা যাক। ওর মাসিক বন্ধ হইছে কিনা হেইডাও জানা লাগবো।”

মোরশেদ চিন্তিত গলায় সম্মতি জানালেন,

“যা করার করো। আমারে জ্বালাইয়ো না।”

তারপর হনহন করে নেমে এলো উঠোনে। রুনু বেগম পরপর কয়েকবার ডাকলেও তিনি শুনলেন না। হেঁটে চললেন অজানার উদ্দেশ্যে।

__________

“তুমি আমার মেলা ছোডো হইবা।”

শাহজাদির এহেন কথায় বকুল ভ্রুক্ষেপহীন চেয়ে রয়। তারপর এক সময় চোখ ফিরিয়ে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে জানালার ওপারে। গত রাতে অজ্ঞান হওয়ার ঘটনাটা তার স্পষ্ট মনে আছে। এরপর কি হয়েছিল, কিচ্ছু জানা নেই! অজ্ঞান হয়েছিল নাকি গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছিল এরপর, কে জানে! চোখ মেলতে নিজেকে ঘরে আবিষ্কার করল। এই বিছানায়। সকাল কত হলো? দুপুরের রান্নাটা বসাতে হবে!

বকুলের মনে পড়ে গেল অনেক গুলো কাজ তার হাত ধরে সমাপ্ত হওয়ার অপেক্ষায়। আর শুয়ে থাকলে চলবে না। শরীরটা দুর্বল লাগছে। পেটে কয়টা ভাত দেওয়া প্রয়োজন।

বকুলকে উঠে বসতে দেখে শাহজাদি কেন যেন এগিয়ে এলো। বকুল ভাবলো, ওকে উঠে বসায় সাহায্য করবে বলে শাহজাদি এগিয়েছে। তাই সে নিজ থেকে বলে উঠে,

“আমি পারমু। ধরা লাগবো না।”

সঙ্গে সঙ্গে ভ্রু কুঁচকে শাহজাদি মুখ বাঁকালো।

“তোমারে ধরার লিগা আমার বইয়া যায় নাই। শোনো, এখন কেউ নাই, এই লিগা দুইডা কতা কই। আমার লগে এক আসমানের তলে থাকবার চাইয়া নিজের দুঃখ বাড়াইয়ো না। এমনেই তো কপালে দুঃখ ডাইকা আনছো নিজেরডা নিজেই। বাপের বাড়ি যাও গা। আরেক বিয়া পাতো। আমার সংসারে আমি কুনুদিন তোমারে আপন কইরা নিবার পারুম না।”

বকুল ব্যঙ্গ করে অল্প একটু হাসি টানে ঠোঁটে। তার সংসার! সংসার তো বকুলের ছিল। সে এসে জুড়ে বসেছে। অথচ এখন গলায় কত জোর নিয়ে বলছে ‘তার সংসার!’ তবে কি সংসার মানে শুধু স্বামী? স্বামীকে নিজের শাড়ির আঁচলে রাখতে পারলেই সে সংসার জীবনে পাশ? আর বাদ বাকি চেষ্টা, শ্রম, কষ্ট, ত্যাগ- সেসব? সেসব কিচ্ছু না।

বকুলের মনে কতশত কথার স্রোত বয়ে চলে। কিন্তু মুখ ফুঁটে বের হয় না একটি আওয়াজও! নিজের মতো করে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই শাহজাদি ডেকে উঠে ফের। বকুল পেছন ঘুরে তাকাল। শাহজাদি কেমন করে হাসে।

“আমি পোয়াতি। আমার গর্ভে হের সন্তান। তোমার এইনে কুনু ভাত নাই গো। তুমি চইলা যাও।”

এরপরও বকুল রাঁ কা*টে না মুখে। ওর মনে হয়, পৃথিবীর সবচেয়ে বিশ্রী হাসিটা শাহজাদির অধরে। বকুল চুপচাপ নিজের অসুস্থ শরীরটাকে টেনে টেনে এগিয়ে চলে সামনের দিকে।

(চলবে)
[ছোট বলে অভিযোগ করবেন না। ছোট হলেও প্রতিদিন দিতে চাই! প্রতিদিন সন্ধ্যে ৭ টায় দেওয়া হবে। যেদিন না দিবো, সেটাও জানিয়ে দেওয়া হবে।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here