ঝরা_বকুলের_গল্প #পর্ব_২১ (শেষ-খ) #মেহা_মেহনাজ

0
536

#ঝরা_বকুলের_গল্প
#পর্ব_২১ (শেষ-খ)
#মেহা_মেহনাজ
.
.
.
মেঘবালকের চাঁদ রাণী বেঁচে আছে। তাহলে সেই চিঠিতে লেখা কথাগুলোর সত্যতা কি? আর কেইবা লিখেছে? কেন লিখেছে?

তুষার-বকুল বসে রয়েছে পাশাপাশি। বাতাসে বকুলের চুল উড়ছে। মাথায় ঘোমটা নেই। রাতের আকাশে আলোর কারচুপি। ভোর ফুঁটি ফুঁটি করছে। গোটা একটা রাত ওরা কাটিয়ে দিলো খোলা আকাশের কোলে। তুষার আচানক বকুলের কোলের উপর নিজের মাথা দিয়ে শুয়ে পড়ল। ওর কেমন ঘুম ঘুম লাগছে। বকুল চমকে গেলেও খুশি হয়। দু’হাতে তুষারের চুলগুলো খামচে ধরল। তুষার সামান্য ব্যথা পেয়ে হালকা স্বরে বলল,

“আস্তে।”

বকুল সঙ্গে সঙ্গে হাত ছেড়ে দিলো। তুষার মুচকি হেসে ওর হাত নিয়ে নিজের চুলের ফাঁকে গুঁজে দিলো। বলল,

“নাও, যত ইচ্ছে হয় টানো। শুধু ছিঁড়ে ফেলো না।”

বকুলও হাসল মিষ্টি করে।

“আপনেরে আমি ব্যথা দিতে পারি?”

“হৃদয়টা ভেঙেচুরে একাকার করে বলছো ব্যথা দিতে পারি!”

বকুল মুখ ভোঁতা করে বলল,

“কই ব্যতা দিলাম?”

“ব্যথা দাওনি? তবে চিঠিটার মানে কি?”

বকুল সব ক’টি দাঁত বের করে হাসলো।

“ওইডা তো গতরের কাম। সবাই যহন গেলো গা, তহন গতর আইসা আব্বারে কইলো, খালি আমিই না, আপনেও আমারে ভালোবাসেন। আব্বারে আপনার লেহা চিঠিডা পইড়া শুনাইলো। আব্বা বিশ্বাসই করতে চাইলো না। আপনে কই আর আমি কই! আমিও বুঝাইয়া কইলাম। তারপর গতর ভাই কইলো, তাইলে আপনেরে গেরামে আনোনের ব্যবস্থা করতেছে। আপনে যাতে তাড়াতাড়ি আহেন আর সত্যিই আমার উপর আপনের কত টান, এইডা দেহনের লিগাই গতর ভাই ওমনে চিঠি লেইখা পাডাইছে। চিঠি লেখনের সময় আমি সামনেই আছিলাম। সত্যি কতা কই? আমার না অনেক মজা লাগছে। হাসি পাইতেছিল খালি। চিঠিডা পড়ার পর আপনের কেমুন লাগব এইটা ভাইবাই হাসি পাইতেছিল।”

“তাই না? খুব হাসি পাচ্ছিল?”

তুষার খপ করে বকুলের গাল জোড়া টিপে ধরে। বকুল গুঙিয়ে উঠল। তুষার ছাড়ল না বরং আরও শক্ত হয়ে ওঠে ওর হাতের চাপ।

“নাও, হাসো এখন, কত হাসতে পারো হাসো। আমাকে জ্বালানো! পাজি মেয়ে!”

বকুল তুষার হাত সরিয়ে দিলো। তারপর এক হাতে নিজের গাল ডলতে ডলতে বলল,

“আপনে আমারে রাইখা গেছেন কিলিগা? না গেলে এত কিছু হইতোই না।”

“আবার চলে যাবো।”

“কি কইলেন?”

“বলছি, আবার চলে যাবো।”

“চইলা যাইবেন?”

“হুম, চলে যাবো।”

“সত্যি?”

“তিন সত্যি!”

“আইচ্ছা, যান তাইলে।”

বকুল ঠেলে তুষারের মাথা সরিয়ে নিজে উঠে দাঁড়াল। আর বসবে না ও পাশে। অভিমানে আপনা আপনি গাল দুটো ফুলে গেছে। নাক হয়েছে ঈষৎ লাল। পূবের আকাশে সূর্যের লুকোচুরি। এমন চমৎকার ভোর এর আগে কোনোদিন দেখেনি ও!

বকুল বড্ড অভিমানী। একটুতেই অভিমান ঝরে পড়ে চোখ দিয়ে। ও উঠে গিয়ে বসেছে আরেক ডালের উপর। তুষার ও উঠে এলো পেছন পেছন।

“বাবারে! এত রাগ?”

বকুল সে কথার পাশ দিয়েও হাটলো না। যেন শুনতেই পায়নি এমন একটা অঙ্গভঙ্গি তার। চুপচাপ বসে পা দিয়ে মাটিতে খুঁটতে লাগল। তুষার ঈষৎ হাসে। একবার আকাশের দিকে তাকায়। ভোর দেখে। তারপর পুনরায় লেগে পড়ে প্রিয়তমার মান ভাঙাতে। এই মুহূর্তে সে আর পুরুষ নেই, পরিণত হয়েছে সদ্য কৈশোরে পা দেওয়া যুবকে…

ঠোঁট গোল গোল করে আহ্লাদী কণ্ঠস্বরে বকুলের নাম ধরে ডাকতে লাগল তুষার।

“বকুল…ও বকুল! আমার চাঁদ রাণী..”

বকুল ভীষণ গাম্ভীর্যপূর্ণ কণ্ঠে উত্তর দিলো,

“মা*রা গেছে।”

“ইশ! এভাবে বলে না। আচ্ছা বাবা, আমি হার মানছি। মজা করছিলাম বিশ্বাস করো। আমি কোথায় যাবো তোমাকে ছেড়ে?”

“যাইতেই পারেন। কত সুন্দরীরা আছে। আমি তো তাদের সামনে পান্তা ভাত।”

“আমার এই পান্তা ভাতই লাগবে। বেশি পোলাও ভাত খেলে শেষে পেট খারাপ করবে।”

“পান্তা ভাতে বেশি খাইলে বুক জ্বলাইবো।”

“সেটা কমানোর ওষুধ ও আছে। তোমার ভালোবাসা।”

বকুল মুখ ভেংচে বলল,

“আপনেরে ভালোবাসতে আমার বয়েই গেছে! আপনের মতো কুমিররে আমি ভালোবাসতাম না আর। আইজ থেইকা সব ভালোবাসা… টুট টুট!”

তুষার হেসে উঠল।

“কি বললে, কি বললে, আমি কুমির?”

“গায়ে কা*টা ওয়ালা কুমির। খালি ব্যতা দেন।”

তুষার এবার অধিকারবোধ থেকেই বকুলকে দু’হাতে আঁকড়ে ধরল, পেছন থেকে।

“আর ব্যথা দিবো না। ওয়াদা করছি।”

“ছাড়েন…”

বকুল ছ্যাৎ করে ওকে সরিয়ে দিলো।

“আলগা পিরিতি দেখাইবেন না। ছাড়েন আমারে।”

বকুল উঠে দাঁড়াল। তুষারের দিকে ঘুরল। ভোরের চমৎকার আলো ওর চেহারায় এসে পড়ছে। গাল জোড়া চিকচিক করছে। তুষার মুগ্ধ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। কোমরে হাত বেঁধে শাসানোর সুরে বকুল বলতে লাগল,

“একবার গিয়া আমারে আগুনের ভিত্রে ফালাইছেন। জ্বইলা পুইড়া শেষ হইয়া গেছি। এত্তদিন পর হেই আগুন নিভানোর একটুখানি পানি আইনা এহন আবার কইতাছেন যাইবেন গা! তাইলে যান গা। গিয়া আমারে উদ্ধার করেন যান। সকালের ট্রলারেই যান গা। আমি বাঁচি..”

“বকুল!”

“কি?”

“তোমাকে সুন্দর লাগছে!”

বকুল স্তব্ধ হয়ে গেল এক মুহূর্তের জন্য। অভিমান কমে এলো মুহূর্তেই কিন্তু ধরা দিতে ইচ্ছে করল না এত দ্রুত। তাই মেকী অভিমানী সুরে অন্যদিকে তাকিয়ে বলল ও,

“তো?”

“বউ বউ লাগছে।”

তুষারের ঠোঁটে হাসি। বকুলের অভিনয় ধরে ফেলেছে। নিজেকে অভিমানী দেখানোর সর্বাত্মক চেষ্টা করছে ও, কিন্তু পারছে না। তুষারের মুখ থেকে কাঙ্ক্ষিত শব্দটি শোনার পর বকুলের হৃদস্পন্দন বেড়ে দ্বিগুণ হলো। বুকের র*ক্ত ওঠে ছলকে। নাম না জানা এক অদ্ভুত শিহরণ পুরো শরীরে ভালো লাগার বাতাস বইয়ে দিলো। বকুল হার স্বীকার করল।

“কিসের মতো লাগতেছে?”

প্রশ্নটা করল খুব আস্তে করে যেন গলায় কোনো জোর নেই। তুষার ও নিচু কণ্ঠে প্রত্যুত্তর করে,

“বউয়ের মতো!”

“কার বউ?”

তুষার বকুলের এক হাত টেনে নিজের দিকে এগিয়ে নিতে নিতে জবাবটা ছুঁড়ে দিলো,

“আমার!”

‘আমার’ শব্দটিতে একটা জোর ছিল, অধিকারের জোর, যেন বকুল ওর সম্পদ! বকুলের পুরোটাতেই শুধুমাত্র ওর প্রতিপত্তি।

বকুলের সর্বাঙ্গে তখন উথাল-পাতাল ঢেউ। ভালোবাসার জোয়ারে ও ভেসে চলে স্রোতের অনুকূলে। দুই জোড়া চোখের দৃষ্টি এক হয়। ওরা চেয়ে থাকে অনেকক্ষণ…অনেকক্ষণ… কি যে দেখে অত মুগ্ধ দৃষ্টি দিয়ে… জানে না দু’জনের কেউ। যখন মাথার উপর রোদ ছুঁয়ে গেল গরম আবেশে, ওদের ধ্যান ভাঙল। সময় অনেক গড়িয়েছে। এবার বাড়ি যেতে হয়!

_____________

মকবুল হা-মুখ করে বসে রয়েছেন। তুষারের বলা প্রতিটি কথা উনার মাথার উপর দিয়ে শাঁই করে চলে গেল। তুষার মকবুলের কোলের উপর পড়ে থাকা হাতের উপর নিজের একটা হাত রাখল। ভরসার কণ্ঠে বলল,

“আপনি কি আমাকে বিশ্বাস করেন না?”

মকবুল দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিয়ে বললেন,

“করি বাজান তয়…আমার মাইয়া আর তুমি…”

“অনেক পার্থক্য, আমি জানি। জেনেই ভালোবেসেছি। সমানে সমানে কখনো ভালোবাসা হয় না। ওটা হয় সমঝোতা। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। আমি আপনার মেয়েকে ওর যোগ্য সম্মানে রাখব।”

“ভয়ডা তো এইনেই রে বাবা। সম্মান কি জিনিস ও কহনো পায় নাই। যেইডা মানুষ না পায়, হেইডা পাইয়া গেলে বেশিদিন ধইরা রাখতে পারে না। ওর কপালডা দুইন্নার পুড়া কপাল।”

মকবুল চোখ মোছেন। উনার চোখজোড়া ভিজে উঠেছে। তুষার জোরালো গলায় বলল,

“আপনার মেয়ে আমার ঘরের চাঁদ। যতদিন বেঁচে আছি, চাঁদ রাণীর জন্য নিঃশ্বাস নেবো। কথা দিচ্ছি আপনায় ছুঁয়ে, আপনার পর আমি হবো ওর বটবৃক্ষ। আমি থাকতে আমার চাঁদ রাণীর গায়ে একটি আঁচড় ও লাগতে দিবো না। পার্থক্য টা অনেক, আমি জানি। কিন্তু চাইলেই এই পার্থক্য কমানো যাবে। চাঁদ রাণীর পরিবেশ পালটে গেলে সবকিছু শিখে যাবে। আমার বিশ্বাস ও পারবে, আমিও পারব। শুধু আপনাদের দোয়া চাই। আমাদের জন্য দোয়া করবেন তো?”

মকবুল ঝরঝর করে কেঁদে দিলেন। একজন পিতার কাছে তার কন্যা সন্তান রাজকন্যার চেয়ে কোনো অংশেই কম হন না। তাতে পিতার সাম্রাজ্য থাকুক বা না থাকুক, তিনি তার রাজকন্যার জন্য সামর্থ্যের সবটুকু দিয়ে সাম্রাজ্য তৈরি করতে পারে। সেই রাজকন্যাকে যখন আরেক রাজকুমার নিজের রাণী করে নিতে চায়, তখন সেই পিতার চেয়ে খুশি আর কেউ হন না। মেয়েদের জীবন টা বড় হিসেবের। একটুখানি হিসেব এলোমেলো হয়ে গেলে গোটা জীবনের ছক পাল্টে যায়। পিতার বাড়ির সুখ আর কয়দিন? স্বামীর সংসারে যদি সুখ না হয়, তবে সেই রাজকন্যার রাজত্ব ব্যর্থ। অবশেষে কি তবে মকবুলের রাজকন্যা কারো রাণী হতে চলেছে? শেষমেশ বুঝি ভাগ্য সদয় হলো?

মকবুল এবং আরজু হাসিমুখেই সম্মতি দিলেন। তাঁরা দু’জনেই তুষারের সাথে বকুলের বিয়েতে রাজী। বকুলের সবকিছু স্বপ্নের ন্যায় লাগল। চারিদিকে শুধু সুখ আর সুখ। এত সুখ… বকুলের ভয় জমলো মনে। এত সুখ ওর কপালে সইবে তো?

রাতের খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষ হয়েছে বেশ কিছুক্ষণ আগে। আজ তুষারের ইচ্ছেতেই ওরা পাটি পেতে বসল উঠোনে। সাথে রাখল টিমটিমে কুপি বাতি। বেশ অনেকক্ষণ ওদের গল্প চললো। মকবুল, আরজু, আকাশ, বকুল এবং তুষার। সবুজ আড্ডার মাঝেই ঘুমিয়ে গেছে। কিছুক্ষণ পর মকবুল উঠলেন, আরজুও উঠে এলো সবুজকে কোলে নিয়ে। আকাশ ও চলে গেল ঘুমুতে। রইলো ওরা দু’জন। খোলা আকাশ মাথার উপর। আজ চাঁদ রয়েছে। সুন্দর লাগছে নির্মল অন্তরীক্ষ দেখতে। তুষার দু’হাত মাথার পেছনে রেখে নির্নিমেষ আকাশ চেয়ে দেখে। বকুল ওর পাশে বসে…মুখ গুঁজে রেখেছে হাঁটুর উপর। অনেকটা সময় ওদের নিরবতায় কেটে গেল। বকুল কি রেখে কি বলবে, কথা খুঁজে পায় না। অথচ এই এতটা দিন, তুষারের সাথে রোজ গল্প করত মনে মনে, কল্পনায়…
ভেবে রাখত, দেখা হলে এটা বলবে, ওটা বলবে। প্রতিদিনকার মন খারাপ গুলো লিস্ট করে রাখত। এখন কিচ্ছুটি মনে নেই। বকুল পাশ ফিরে তুষারের দিকে তাকাল। আস্তে করে জিজ্ঞেস করল,

“কি ভাবতাছেন?”

“উঁ?”

তুষার অন্যমনস্ক ছিল। বকুলের কথাখানা স্পষ্ট শুনতে না পেয়ে ওর দিকে ফিরে তাকাল। বলল,

“কি বললে?”

বকুল ফের বলল,

“কি ভাবতাছেন?”

“তেমন কিছু না।”

“কেমুন কিছু? হেইডাই কন।”

“ছেড়ে দাও।”

“কারে?”

“কথা…”

“কথা ছাড়ে কেমনে?”

“জানতে চেয়ো না।”

“কি জানতে চাইবো না?”

“ইয়া আল্লাহ!”

তুষার দ্রুত উঠে বসল।

“এত কথা পেচাতে পারো!”

বকুল ভ্রু কুঁচকে বলল,

“কই কতা পেচাইলাম?”

“এই যে এখনো পেচাচ্ছো।”

“এত কতা না কইয়া যেডা জিগাইছি হেইডা কইলেই তো হয়।”

“জানতেই হবে?”

“হ, হইবো, কন..”

তুষার ছোট শ্বাস ফেলে।

“এত জিদ এই মেয়েটার…”

“কন..”

তুষার হার মানলো।

“বলছি বাবা বলছি…বকুল।”

“হুঁ?”

“যদি বলি আমার সঙ্গে গাছ তলায় থাকতে হবে। পারবে?”

বকুল সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলো,

“পারব।”

“যদি বলি তিন বেলার জায়গায় এক বেলা খাওয়াতে পারব। চলবে?”

“আবার জিগায়!”

“যদি বলি, পূবের বিল পুরোটা সাতরে আমাকে ভালোবাসার প্রমাণ দিতে হবে।”

“ওইডাও পারুম। আমি যেই সাতার জানি..এডি আমার বাও হাতের কাম।”

“তোমাকে এসবের কিচ্ছুই করতে হবে না বকুল। কিন্তু এরচেয়েও কঠিন কাজ করতে হবে।”

“এর চাইতেও কঠিন?”

“হুম। তোমাকে বদলাতে হবে বকুল। আমার জন্য নিজেকে অনেক অনেক পরিবর্তন করতে হবে। চলাফেরা, কথা বলা, আচরণ…পারবে?”

বকুল এইবার সাথে সাথে জবাব প্রদান করতে পারল না। ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে শুধু চেয়ে রইলো। তুষার বলল,

“তুমি যেমন, আমি তোমাকে তেমনই ভালোবাসি। ব্যাপারটা যদি শুধু আমার হতো, আমার কোনো সমস্যাই ছিল না। কিন্তু এখানে ব্যাপারটা আমার পরিবারের সাথে জড়িয়ে। আমি আমার বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে। মা অসুস্থ। বাবা মানছে না। আমি তবুও তোমাকে ছাড়তে পারব না। আবার তাদেরকেও কষ্ট দিতে পারব না। তাই তোমাকে একটুখানি ত্যাগ স্বীকার করতে হবে, আমার জন্য চাঁদ রাণী! আমি তোমাকে সবকিছু শিখিয়ে দিবো। তোমার শুধু শেখার আগ্রহ থাকতে হবে। পারবে বকুল? বলো..”

“কইতে পারি না। জীবনে শিক্ষা কি জিনিস, জানি না। স্কুলের চাইরপাশ দিয়াও হাঁটি নাই কোনোদিন। আমাগো পরিবেশ, পরিবার তো দেখছেনই সব। কথা দিতে পারুম না। তয় আমি আমার সবটুকু চেষ্টা করুম। চেষ্টার উপরে আর তো কিছু নাই।”

তুষার বকুলকে নিজের কাছে টেনে নিলো,অনেকটা কাছে,যতটা কাছে টানলে একে অপরের নিঃশ্বাসের শব্দ স্পষ্ট পাওয়া যায়,ততটা কাছে….

“কথা দিচ্ছি আমি, তোমার পাশে আছি, পাশে থাকব। তোমাকে আমার মতো করে গড়ে তুলবো। তোমার জীবনে যা গেছে সব কিছু বাদ। এখন থেকে এক নতুন ভোর শুরু হবে। সেই নতুন ভোরের প্রতিটি মুহূর্তে আমি শিশির বিন্দুর ন্যায় তোমার সঙ্গে মিশে থাকব। আমাকে ভালোবেসো বকুল। আমার প্রতি তোমার ভালোবাসার মৃত্যু যেন না হয় কোনোদিন। এইটুকুই চাওয়া…”

বলল তুষার, বকুলের কপালে কপাল ঠেকিয়ে। বকুলের শরীরের প্রতিটি রন্ধ্র কাঁপছে, বুকে হাতুড়িপেটায় কে যেন। ঘন শ্বাসে কম্পিত কণ্ঠে ও কোনোরকমে উত্তর দিলো,

“কথা দিলাম। আমি কথা দিলাম।”

______________

প্রবাদ আছে, দুঃখ এবং বিপদ যখন আসে, তখন চারিদিক থেকেই আসে। তাহলে সুখ কেন চারিদিক থেকে আসতে পারবে না?

ভোর হওয়ার আগেই মকবুলের বাড়িতে আরও দুইজন অতিথি এলেন। তাদের বাড়ি অবধি পথ চিনিয়ে নিয়ে এসেছে গতর। মকবুল ঘুম জড়ানো চোখে চমৎকার দেখতে দুইজন মানুষ কে দেখতে পেয়ে তাজ্জব বনে গেলেন। সিনেমায় দেখা স্যুট-কোট পরা মানুষ আজ তার বাড়িতে! গতর ফিসফিস করে জানালো, এরা তুষারের বাবা-মা। তুষার পাগলের মতো বাড়ি ছেড়ে চলে আসার পর তারা তুষারের ঘর থেকে গতরের লেখা চিঠিটি উদ্ধার করতে সক্ষম হন। এরপর সেলিনা কান্নাকাটি শুরু করলে আফজাল হোসেন বকুলের ব্যাপারে সবকিছু খুলে বলতে বাধ্য হলেন। সব শুনে সেলিনা একটা কথাই বললেন,

“সংসার করবে আমার ছেলে। জীবনটা ওর। তুমি আর আমি কে সেখানে বাঁধা দেওয়ার? আমি ভেবেছিলাম ওর দোলাকে পছন্দ, তাই দোলাকে নিজের ঘরের বউয়ের মতো ভেবেছি। যদি একবার বুঝতাম অপছন্দের বিষয়টি তাহলে কক্ষনো আমার ছেলের উপর দিয়ে যেতাম না। আমার শরীরের কথা ভেবে ভেবে তোমরা অযথাই এতকিছু লুকালে। আমার ছেলের কাছে আমায় নিয়ে যাও এক্ষুনি। আজ এই মুহূর্তে যদি ওর পাশে না দাঁড়াতে পারি তবে বাবা-মা হিসেবে আমরা ব্যর্থ আফজাল..”

চিঠির পাতায় স্পষ্ট ডাকঘরের ঠিকানা লেখা ছিল। তাই মনপুরা পর্যন্ত আসতে অসুবিধে হয়নি। গতরের দোকান মনপুরা সদরের একমাত্র বড় মিষ্টির দোকান হওয়ায় তাকে খুঁজে পেতেও কষ্ট হয়নি খুব একটা। গতরের কাছে নিজেদের পরিচয় দেওয়া মাত্রই গতর সব বুঝে ফেলেছে। ঘুম ফেলে তাদের নিয়ে ছুটে এসেছে এখানে। মেয়েটার ভাগ্য বুঝি এবার সদয় হলো।

নতুন এক ভোরের মতো নতুন এক অধ্যায় শুরু হলো বকুলের জীবনে। স্বপ্ন যেমন ফটাফট করে কেটে যায়, সেরম করেই দুটো দিন বকুলের জীবন থেকে কেটে গেল। ঘনিয়ে এলো শুক্রবারের দুপুর। যোহরের নামাজ আদায় শেষে পরাপর দুই ঘর মিলিয়ে সকলে বসল। বাদ্য যন্ত্র নাই, চাকচিক্য নাই, একেবারে সাদামাটা আয়োজনে রূপসী বধু সেজে বসে থাকা বকুল চোখের জল নিয়ে পর পর উচ্চারণ করল শব্দখানি…
জাদুর শব্দ, সম্পর্ক বদলে দেওয়া সম্পর্ক, যে শব্দে মনের মিলন ঘটে, যে শব্দ অনন্তকালের…’কবুল’

গলা ধরে এলো, চোখ ভিজে টইটম্বুর।
সেলিনা নিজ হাতে পুত্রবধূর চোখ মুছিয়ে দিলেন। কানে ফিসফিস করে বললেন,

“তোর মতো আমিও গ্রামের মেয়ে মা। অনেক ভয় আর আতংক নিয়ে মানুষটাকে কবুল বলেছিলাম। মানুষটা আমার হাত ছুঁইয়ে কথা দিয়েছিল, কখনো কষ্ট পেতে দিবে না। এই দেখ..সে কথা রেখেছে। আজ এত বছর পরও আমরা এক সঙ্গে। আজও তার আমাকে নিয়ে যত চিন্তা। আমার শরীর অসুস্থ অথচ আমার চেয়ে তার অস্থিরতাটাই বেশি। তারই তো ছেলে আমার তুষার। বাপের ধর্ম পেয়েছে। তোকে ভীষণ ভালোবাসবে মা। তুই কি আমাকে বিশ্বাস করিস?”

বকুল মাথা ঝাঁকিয়ে এক নিঃশ্বাসে বলে ফেলল, ‘কবুল, কবুল, কবুল।’
ঘরে উপস্থিত জনস্রোত সমস্বরে চিৎকার করে, ‘আলহামদুলিল্লাহ।’
পাশের রুম থেকে তা শুনতে পেয়ে আরও একটি মানুষ আলগোছে চোখের জল মোছে। অবশেষে মেঘবালকের রত্ন নিজের নামে লিপিবদ্ধ হলো।

বিয়ের প্রথম রাতে ওরা বসে রয়েছে পূবের বিলের আম গাছটির নিচে। ওখানে বড় বড় বেশ কয়েকটি ডাল পড়ে রয়েছে। বকুলের গায়ে গাঢ় খয়েরী রংয়ের কাতান শাড়ি। মাথায় লম্বা করে ঘোমটা টানা। তুষারের গায়ে সাদা রংয়ের পাঞ্জাবি। ও বসে আছে বকুলের কোমরে একটা হাত রেখে, খুব পাশাপাশি, খুব কাছাকাছি।

বকুলের সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। সে মাথা তুলে আকাশের দিকে এলোমেলো ভাবে কি যেন খুঁজে চলেছে। একবার এদিক দেখছে তো একবার ওদিক। তারপর ভীষণ মন খারাপ নিয়ে মুখটা নিচু করে নিলো। অন্ধকার চারিপাশে, ঝিঁঝিঁ পোকাদের গান গানে ভেসে আসে। তবুও তুষারের বুঝতে অসুবিধে হলো না,বকুলের মনের পরিস্থিতি।

সে বলল,

“কি খুঁজছ?”

বকুল ভোঁতা মুখে উত্তর করে,

“চাঁদ।”

“হঠাৎ?”

“আপনে আমারে চাঁদ কন, আর নিজে নাকি মেঘ। ভাবলাম আইজ আমাদের প্রথম রাত। ওদেরকে নিয়েই শুরু করি। তা আর হইলো না! আইজকেই ম*রার চাঁদ ডুব দিছে।”

তুষার ঠোঁট কামড়ে হাসল। তারপর বকুলের কানের পাশে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল,

“ডুব দেয়নি, নেমে এসেছে। আজ চাঁদ আকাশ থেকে খঁসে নেমে এসেছে আমার পাশে। তুমি দেখবে না গো চাঁদ রাণী… তুমি দেখবে না।”

ওর ফিসফিসানি কণ্ঠস্বর বকুলের সমস্ত অঙ্গে জোয়ার নিয়ে আসে। হাত নিশপিশ করে। মাথা ঝিমঝিম করে। শিউরে ওঠে ও। মেঘবালক শক্ত করে ওর কোমর চেপে ধরল। পূর্বের কণ্ঠে বলল,

“আমার ঘরে আর কোনোদিন চাঁদের আলোর কমতি হবে না।”

চাঁদ রাণী দম আঁটকে জড়ানো কণ্ঠে আস্তে করে বলল,

“ক…কি কইতাছেন? ছা…ছাড়েন আ..মারে।”

তুষার আরও শক্ত হাতে ওকে কাছে টেনে নিলো। পারছে না নিজের বলিষ্ঠ হাত জোড়ায় পিষ্ট করে নিজের সঙ্গেই মিশিয়ে নেয়। ঘোর লাগা কণ্ঠে বলল,

“তোমায় ছাড়া যাবে না কভু,
কেমন মাদক গো তুমি বধূ!”

চাঁদ রাণী বোঝে প্রেমিক পুরুষের আহ্বান। ও হেসে মাথাটা মেঘবালকের কাঁধে চিরজীবনের জন্য ভরসায় লুটিয়ে দিলো।

(সমাপ্ত)
[অবশেষে! চাঁদ রাণী এবং মেঘবালকের গল্পের ইতি টানলাম। ইতিই টানলাম শুধু, তবে ওদের নিয়ে মাঝে মাঝেই লিখবো আমি! ছোট ছোট গল্প। আপনারা পড়বেন? ওদের মিল না করালে আমি নিজেই হার্ট ফেইল করে ম*রে যেতাম! হা হা হা।
মেহা মেহনাজের ফেসবুকের পাতায় লেখা প্রথম গল্প যদি আপনাদের ভালো লেগে থাকে তবে আমার সঙ্গে থাকার অনুরোধ। খুব শীঘ্রই আমি নতুন গল্প নিয়ে ফিরবো আপনাদের মাঝে। পুরো গল্পের জার্নিতে যারা যারা আমার সাথে ছিলেন, সবাইকে অনুরোধ করছি মন্তব্য করে যাওয়ার জন্য। ভালো থাকুন, চমৎকার থাকুন, আল্লাহ হাফেজ।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here