#চন্দ্রপ্রভায়_তুষার_বর্ষণে।।০৭ পর্ব।।
#তাসনিম_তামান্না
বাংলাদেশ থেকে নরওয়ে ১৭ ঘন্টা ৫৩ মিনিট (প্রায় ১৮ ঘন্টা) বসে কাটানোর জন্য হানিয়ার ব্যাক পেইন হচ্ছে। নরওয়ের রাজধানী অসলো এয়ারপোর্টে থেকে হেলতে দুলতে বের হওয়ার সময় হটাৎ বা হাত টান লাগল। পিছনে ফিরে চমকে গেলো। হানিয়ার বা হাতের ব্রেসলেটের চেইন একজনের হাতের ঘড়ির সাথে পেঁচিয়ে গেছে। হানিয়া হতভম্ব হয়ে গেলো এইটুকু সময়ের মধ্যে কীভাবে আটকালো বুঝতে পারছে না। লোকটার দিকে তাকালো আগন্তুকের মুখ দেখা যাচ্ছে না মুখে মাক্স, চোখে সানগ্লাস লোকটার ফোন কানে কুঞ্চিত ভ্রুদ্বয় ওর হতভম্ব মুখ দেখে শিথিল হলো। হানিয়া অপরাধীর ন্যায় বলল
–“আ’ম সো সরি। আমি বুঝতে পারছি না কীভাবে যেনো আটকে গেলো।”
হানিয়া নিজের মাথায় নিজে গুঁতা দিয়ে বলল “ওহ। এটা বাংলাদেশ না। নো বাংলা। ইংরেজিও গুলিয়ে যাচ্ছে হাই হাই কী যেনো বলে?… উফফ… দূর।”
হানিয়া চটপট চেইনটা ছাড়িয়ে নিয়ে বলল “সরি!”
–“ইট’স ওকে!”
হানিয়া মাথা চুলকে লাগেজ টেনে আবারও হাঁটতে লাগল। এয়ারপোর্টটা পুরাটাই কাচ দ্বারা পরিচালিত। এতো লোকজনের মাঝে ওর নিজেকে কেমন এলিয়েন লাগছে দেখল সুভানা ওর নেইম-প্লেট নিয়ে দাঁড়িয়ে এদিকে ওদিকে তাকিয়ে ওকেই খুঁজচ্ছে। হানিয়া হাত নাড়ালো। সুভানা হানিয়াকে দেখতে পেয়ে বাউন্ডারি ক্রস করে লাফিয়ে দৌড়ে এলো। হানিয়াও দৌড়ে দু’জন দু’জনকে জড়িয়ে ধরল। সুভানা উৎসাচ্ছিত কণ্ঠে বলল
–“ওহ বেবস কতদিন পর! লাস্ট বাংলাদেশ কুরবানি ইদের পরে দেখা হয়েছিল।”
–“ইয়াহ, বেবস আই মিস ইউ সো সো মার্চ!”
–“মি ঠু! লেটস গো। খুব টায়ার্ড দেখাচ্ছে তোকে!”
–“ইয়ার আলমোস্ট ১৮ ঘন্টা বসেছিলাম তারও ডুবাইয়ের ফ্লাইট চেজ্ঞ করতে গিয়ে ৩০ মিনিট হাটছিলাম। মনে হচ্ছে এখানেই শুয়ে পড়ি”
সুভানা এক হাতে লাগেজ আর অন্য হাত হানিয়ার বাহু জড়িয়ে ধরে বলল
–“আমারও জার্নি করলে এমনই হয় রে। জানিস আমার ভেবেই খুশি লাগছে ফাইনালি আবার এক হলাম, মন খুলে কারোর সাথে কথা বলতে পারবো। এখানকার ফ্রেন্ডগুলো এতো ফর্মালিটি মেইনটেইন করে কথা বলে না দিস ইজ টু মার্চ ইয়ার”
–“বাঙালি স্টুডেন্ট নাই?”
–“আরে কয়েকটা আছে তারাও ফর্মালিটি মেইনটেইন করে। দূর ওগুলো কোনো ফ্রেন্ডশিপ হলো? ফ্রেন্ডশিপ মানেই হলো মন খুলে উড়াধুরা গালি পাস করব। সে রাগ না করে শুনবে। যেমন তুই!”
হানিয়া চোখ ছোট ছোট করে বলল
–“আমি গালি পারি না বলে চুপ থাকি তারই সুযোগ নিচ্ছিস তুই? দাঁড়া আমি গালি ক্লাসে ভর্তি হয়ে গালি শিখে তোকে উড়িয়ে দিব।”
–“আরে ব্যাপার না, আমি আছি না। আমি তোকে শিখিয়ে দিব।”
ওরা হাবিজাবি বিষয়ে কথা বলতে বলতে প্রস্থান করল। ওদের ফ্রেন্ডশিপটা ক্লাস এইট থেকে। ওরা যে স্কুলে ছিল সেটা ইন্টার পর্যন্ত পড়া যায়। ইমন এইচএসসির পর স্কুল থেকে চলে গেলে হানিয়া একা হয়ে যায়। স্কুলে অবশ্য ওর ডান পিঠামির জন্য পছন্দ করত না দূরে দূরেই থাকত। হামজা-হায়াত তখন কেবল ফোরে ভর্তি হয়েছে ওরা ছোট ওদের সাথে হানিয়া মন খুলে কথা বলতে পারত না আর বললেও ওরা বুঝত না। বেশিরভাগ সময় ওরা ক্লাসমেটদের সাথে খেলায় মেতে থাকত। স্কুল তখন সুভানা নতুন হানিয়াকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখত মাঝে মাঝে ক্লাসমেটদের সাথে ও ঝগড়া করত ও-ই আগ বারিয়ে হানিয়ার সাথে কথা বলত পাশে বসত। হানিয়া প্রথম প্রথম এড়িয়ে যেত। একবার সিনিয়ররা সুভানাকে টিজ করে ছিল। সুভানাকে কাঁদতে দেখে কারণ জেনে হানিয়া ছেলেগুলোকে পিটিয়েছিলো। সুভানা অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল যে মেয়েটাকে শান্ত শিষ্ট মেয়ে ভেবে এসেছে এতোদিন তার এমন রূপ দেখে। ক্লাস টিচাররা এসব জানলে চাইলে ছেলেগুলো মিথ্যা বলে ও নিজের ওপরে দোষ নিয়ে বলেছিল “ছেলেগুলো আমাকে টিজ করেছে পিটিয়েছি। আমি মিথ্যা বলছি কী সত্য বলছি পুলিশ ঠিক করবে আমার গার্জিয়ানকে ফোন করুন ওদের জেলে ঢুকিয়ে দি।”
ছেলেগুলো হানিয়ার এতো কনফিডেন্সের সাথে কথা বলতে দেখে ভয় পেয়ে মাফ চেয়ে বলে আর এমন হবে না। টিচার্সরাও জানত হানিয়া অকারণে কিছু করে না। এই স্কুলে ক্লাস থ্রির এডমিশনে চাস পাওয়ার পর থেকে নিজের একটা জায়গা করে নিয়েছিল। পড়াশোনা, দুষ্টুমি সব দিক দিয়েই এগিয়েছিল। ওদের ফ্রেন্ডশিপ হয়ে যায় তারপর থেকে এইট থেকে টেন সময়টা কেটে ছিল ওদের একসাথে তার পরই সুভানা চলে আসতে হয় দেশ ছেড়ে বিদেশের মাটিতে।
•••
সেজাদ আর সায়েম ব্যবসার কাজে সুইজারল্যান্ডে যাচ্ছে কয়েকদিনের জন্য। সায়েম ব্যবসার কাজ নিয়ে সিরিয়াস কথা বলছিল হঠাৎ পাশে খেয়াল করল সেজাদ নেই। সামনে দেখল নেই। পিছনে ফিরে ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে এগিয়ে এসে বলল
–“ব্রো! হোয়াট হ্যাপেন? এখানে স্ট্যাচু হয়ে কী ভাবছ?”
–“নাথিং!”
–“এতোক্ষণ ধরে আমি ইম্পর্ট্যান্ট কথা বললাম আর তুই কিছু শুনলি না ব্রো? আমি কী বলেছি ভুলে গেছি।”
–“লেট হচ্ছে চল”
•••
হানিয়া আর সুভানা তিলোত্তমা প্রেমকুঞ্জে আসল তখন নরওয়েতে আটটা বাজে। বাংলাদেশ আর নরওয়ের সময়ের ব্যবধান ৪ ঘন্টার। নতুন পরিবেশে এসে হানিয়া একটু ইতস্তত করছিল। এর আগে কখনো সুভানার পরিবারের কারোর সাথে দেখা হয় নি ওরা কেউ কারোর বাসায়ও যায় নি। ওরা বাসায় এসেছে তখন শাবনূর বেগম, সোনিয়া তার তার তিন বছরের ছোট ছেলে সোহান ড্রাইংরুমে বসে টিভি দেখছে। ওদের সাথে কুশলাদি বিনিময় করে সুভানা হানিয়াকে ওর জন্য রেডি করা রুমে নিয়ে গেলো। হানিয়া আর সুভানা চলে যেতেই শাবনূর বেগম চোখ-মুখ কুঁচকে বলল
–“সোনিয়া মেয়ে মানুষকে একা একা তার পরিবার ছেড়ে দিল? কেমন পরিবার তারা?”
–“কী সব বলছ দাদুমণি?”
–“মাইয়াডার চেহারা সুরাত ভালোই চরিত্র কথা তো বলা যাচ্ছে না। বাড়িতে দুইডা জোয়ান পোলা আছে সে খেয়াল আছে?”
–“দাদুমণি আস্তে শুনতে পাবে।”
–“শুনলে শুনবে।”
–“আজব তুমি হঠাৎ খেপেছ কেনো?”
–“মাইয়াডা বেশিই সুন্দর। আমার নাতিদের নিয়ে টেনশন হচ্ছে। বড়টাকে নিয়ে বেশি টেনশন নেই কিন্তু ছোটোডা তো বান্দর। না না এই মেয়ে কতদিন এখানে থাকবে?”
–“দাদুমণি থামো প্লিজ। মাত্রই এসেছে এতো জার্নি করে এখন বের করে দিবা মেয়েটাকে? সুন্দর হলেও দোষ?”
–“তুই বেশি বুঝিস না। আমার নাতি দুইটা বাড়ি ফেরার আগেই বিদায় কর এই মাইয়ারে।”
সোনিয়া শব্দ করে হেসে ফেলে বলল “তোমার নাতিরা আর ছোট নেই। বিয়ে দিবা না? ছোটটা বিয়ে করার জন্য হাত-পা তুলে বসে আছে। শুধু বড়টাই ঘাড় ত্যাড়া ওর জন্য বেচারা ছোটটা কষ্ট পাচ্ছে।”
–“তুই মজা করতেছস? সুভানারে ডাক শুন তো কয়দিন থাকবে মাইয়াডা।”
সোনিয়া হতাশ নিঃশ্বাস ছেড়ে সুভানাকে ডাক দিল। সুভানা হানিয়াকে ফ্রেশ হতে বলে নিচে আসল। বলল “কী হয়েছে?”
–“এই মেয়ে ক’দিন থাকবে এই বাড়িতে?”
–“কেনো দাদুমণি হঠাৎ এই প্রশ্ন?”
–“মাইয়াডারে সুবিধার লাগতাছে না।”
–“অসুবিধার কী দেখলে?”
–“বাড়িতে দুইটা জোয়ান পোলা আছে। এই মাইয়াডারে কী মনে করে আনলি? এইটা আমাকে আগে বল।”
–“দাদুমণি তুমি যেমন ভাবছ ও এমন নয়। ওকে আমি অলমোস্ট সাত বছর ধরে চিনি সেই এইট থেকে।”
শাবনূর বেগম মুখ ঝামটা দিয়ে বলল
–“বাতাসে আমার চুল পাকেনি। মানুষ দেখলেই চিনতে পারি। তুই এই টুকু মেয়ে মানুষের কীভাবে চিনবি।”
–“তুমি আমাকে যা বলছ বলছ হানিয়ার সামনে কিছু বলবে না প্লিজ এটা আমার রিকুয়েষ্ট। ওকে দায়িত্ব নিয়ে এখানে এনেছি। ও আসতে চাইছিল না আমার আর ওর মামার জোরে এসেছে। তুমি যা বলার আমাকে বলো।”
চলবে ইনশাআল্লাহ