#চন্দ্রপ্রভায়_তুষার_বর্ষণে।।১০ পর্ব।।
#তাসনিম_তামান্না
নরওয়েতে আসার পর থেকে হানিয়ার ঘুম উধাও হয়ে গেছে। এখানে আসার পর থেকে সকাল সকাল ঘুম ভেঙে যায় যতোই রাত করে ঘুমাক না কেনো। আর একবার ঘুম ভাঙলে আর ওর ঘুম আসে না। অথচ বাংলাদেশে ওকে উঠাতে ওর বড় মামী আর নানুমণিকে চিৎকার চেঁচামেচি করতে হতো। আজ এবাড়িতে পঞ্চমমত সকাল রোজকার আর চার দিনের মতো ঘুম ভাঙতেই বেলকনিতে এসে দাঁড়াল। এখানে দাঁড়ালেই ওর শান্তি শান্তি লাগে চোখ জুড়িয়ে যায় চারপাশের সৌন্দর্যে। বাংলাদেশের সৌন্দর্যেরও একটা ব্যাপার আছে সেটা গ্রামে। ঢাকা শহরে জ্যাম নোংরা দিয়ে ভরপুর হয়ে আছে ঢাকার সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে দিনকে দিন। আজই এখানের শেষ দিন এই কদিনের মতো আর সকালে উঠে সৌন্দর্য আর উপভোগ করা হবে না। ফ্রেশ হয়ে নিচে গেলো তাড়াতাড়ি উঠলেও দেরি করে নিচে নামল বাসা থেকে ফোন আসছিল সেসব শুনে সকাল সকাল মনটা খারাপ হয়ে গেছে। মনটা ভালো করতে কিচেনে গিয়ে দেখলো সুভানার মা লাইজু আর সোনিয়া মিলে সকালের ব্রেকফাস্ট বানাচ্ছে। লাইজু হানিয়াকে দেখে খুশি হয়ে গেলো ওর হানিয়াকে খুব পছন্দ হয়েছে। কথা দ্বারাই বোঝা যায় সহজসরল মহিলা। শুধু শাশুড়ির সাথে বনে না দিন-রাত ঝগড়া লেগেই থাকে। ওদের ঝগড়াগুলো সকলে মজা পাই। লাইজু একটু সাজুগুজু প্রিয় আর ভুলভাল ইংরেজি বলে এটা আবার শাবনূর বেগমের পছন্দ না। হানিয়াকে দেখে লাইজু বলল
–“এতো লেইট হলো তুমি কি চিক?”
হানিয়া লাইজুর কথা বুঝল না বলল
–“চিক? সেটা কী?”
সোনিয়া মুখ লুকিয়ে হেঁসে বললো
–“চিক না সিক বোঝাতে চেয়েছে তাই না মামণি?”
লাইজু বিরক্ত নিয়ে বলল
–“হ্যাঁ হ্যাঁ ওটাই যা বায়ান্ন তাই তিপ্পান্ন! ইংরেজিও বোঝো না দেখছি তোমরা।”
–“না না আ’ম অলরাইট আন্টি।”
–“শুনো তুমি তো বলছিলে আজ চলে যাবে থেকে যা-ও। কাল যেও”
–“না আন্টি আজ ক্লাস নেই। ওখানে গিয়ে সব ঠিকঠাক করে গুছিয়ে নেওয়ারও তো একটা ব্যাপার আছে না! তাছাড়াও কাল একটা পৌশু ক্লাস টেস্ট আছে। আমি এখানে দেরিতে এসে অনেকটা পিছিয়ে গেছি সেগুলোও কভার করতে হবে। আমি এসে আপনাদেরকে শুধু শুধু কষ্ট দিলাম। ঝামেলা করলাম।”
সোনিয়া তাকালো হানিয়ার দিকে মিষ্টি মায়াভরা মেয়েটা কি সুন্দর গুছিয়ে কথা বলছে। এই অল্পদিনে সবাইকে আপন করে নিয়েছে। মাতিয়ে রেখেছিল। যেমনটা সায়েম, সুভানা রাখে। কিন্তু সায়েম বেশির ভাগ সময়ই কাজেই ব্যস্ত থাকে ও না থাকলে বাসা শান্ত থাকে। শাবনূর বেগম ও এসে ডাইনিং টেবিলের চেয়ারে বসে তসবি পাঠ করছে। এই ক’দিনে হানিয়া বুঝতে পেরেছে শাবনূর বেগম তাকে তেমন একা পছন্দ করে না তা-ই ওনাকে জ্বালাত করে মজা পেত। সোনিয়া, সুভানা বুঝতে পারছি। কিছু বলে নি। ওদের কথা বলার মাঝে সোহান হুটোপুটি করে দৌড়ে এসে উপস্থিত হলো সম্ভবত বাইরে থেকে এসেছে। বাচ্চাটা নিজে নিজে জুতা খুলে চেয়ার বেয়ে টেবিলের ওপরে উঠে বসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে “ওয়াটার”
হানিয়া এগিয়ে এসে গ্লাসে পানি ঢেলে দিল। সেটা খেয়ে সোহান বলল “গুড মর্নিং সুইটগার্ল।”
–“ভেরি গুড মর্নিং সুইটহার্ট। হোইয়ার আর ইউ ফ্রম?”
–“জগিং থেকে। সুইটগার্ল সুইটগার্ল ইউ নো মামাই সেইড টু মি, আমাল আমাল মাসাল এন্ড সিক্স প্যাক বডি একদম মামাইয়ের মতো হয়ে গেছে। তাই না? তাই না? ইউ লুক এট মি এন্ড সেইড সেইড।”
হানিয়া কী বলবে খুঁজে পেলো না সম্মতি জানিয়ে বলল “ইয়েস ইয়েস তুমি স্পাইডার ম্যানের মতো হ্যান্সাম।”
–“ইয়ে আ’ম স্পাইডার ম্যান। দেখ আরো আরো যখন বড় হয়ে যাব মামাইয়ের মতো তখন তখন আ’ম ফ্লাই টু স্কাই ঠিক স্পাইডার ম্যানের মতো সাআআ করে।”
–“আচ্ছা। আমাকেও নিও সুইটহার্ট।”
–“ওকে। মামাই আমি সুইটগার্লকে নিয়ে স্কাইয়ে ফ্লাই করব। সুইটগার্ল বলেছে আ’ম স্পাইডার ম্যান। ইয়েএ”
সোহানের মামাই ডাক শুনে হানিয়া চমকে পাশ ফিরে তাকালো সেজাদ শান্ত দৃষ্টি তাকিয়ে আছে। এই দৃষ্টিতে হানিয়ার কেমন হয় সেটা ভালো নাকি খারাপ বুঝতে পারে না শুধু বুঝতে পারে সহ্য হয় না। শাবনূর বেগম তসবি পাঠ করলেও তার দৃষ্টি, কান এদিকেই। সেজাদ ছোট করে উত্তর দিল “হুম”
সোনিয়া এসে সেজাদকে গ্রিনটি দিল। সোহানকেও দিল ও এক সিপ নিয়েই চোখ মুখ কুঁচকে ফেললো। হানিয়া সেটা দেখে হেঁসে সোহানের নাক টিপে দিল। গ্রিনটি ওর পছন্দ না তাও খেতে হবে মামাই খাচ্ছে যে! হানিয়ার ট্রাউজারের পকেটে ফোন ভাইব্রেট করতেই হানিয়া চমকে ফোন বের করে হামজার নম্বর দেখে ভড়কে গেলো এই সময় ওদের স্কুলে থাকার কথা ফোন রিসিভ করে জায়গা থেকে প্রস্থান করতে করতে উত্তেজিত রাগে গজগজ করতে করতে বলল “এখন ফোন দিয়েছ কেনো? স্কুলে যাও নি? এ্যানি প্রবলেম? নাকি স্কুলে ফোন নিয়ে গেছো? আমি কত বার নিষেধ করছি বিয়াদপ দুইটা কয়েক ঘন্টা ফোন ছাড়া থাকলে কী জান বেড়িয়ে যাবে আমাকে শান্তিতে থাকতে দিবি না!”
সেজাদ হানিয়ার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে গ্রীনটিতে সীপ বসালো। শাবনূর বেগম সেজাদের দৃষ্টি লক্ষ্য করে হানিয়ার দিকে তাকালো তসবি পাঠ থেমে গেলো। তার নাতি তো এমন না! কোনো মেয়ের দিকে এতোক্ষণ তাকিয়ে খেয়াল করে না! এবার দুলতে দুলতে নাতিকে দেখতে দেখতে তসবি পাঠ করতে লাগল।
•••
হানিয়া সেই যে উপরে গেলো। আজ আসল ব্রেকফাস্টের সময়। এই সময়ের মধ্যে নিজের জিনিসপত্র সব গুছিয়ে নিয়েছে। এবাড়ির লোকজনকে বিরক্ত করতে চাই না। এমনিতেই শাবনূর বেগমের ব্যবহারে হানিয়া বুঝতে পারে ওনি তাকে মোটেও পছন্দ করে না। তার ওপরে সেজাদের ভয়ানক দৃষ্টি। শাবনূর বেগমও কেমন কেমন করে তাকিয়ে থাকে। হানিয়া নিজেকে আজকাল এদের দৃষ্টিতে এলিয়েন এলিয়েন ফিল হয়।
হানিয়া আর সুভানা একসাথে নিচে আসলো। এসে দেখলো সকলে খেতে বসেছে এখন সকাল সাড়ে নয়টা বাজে। সেজাদ সহ আরো একটা ছেলে হানিয়া উপস্থিত হতেই ওকে দেখে সে-ও ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। হানিয়া হাসার চেষ্টা করলো। সেজাদ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে সায়েমের দিকে আর হানিয়ার দিকে। হানিয়া একবার দেখে হেঁসে চোখ ফিরিয়ে নিলো কিন্তু সায়েম হ্যাংলার মতো তাকিয়ে থেকে হেঁসে বলল
–“হাই! মাইসেল্ফ সায়েম সিকদার। সুভানার ভাই।”
সুভানা চোখ-মুখ কুঁচকে ফলের টুকরো ছোট বাইট দিল। তার ভাই প্রেমিকা পটানোর কাজে লেগে গেছে। একটু আগে এসে শাসিয়ে গেলো তা-ও লজ্জা নেই হতড়ছাড়াটার একেবারে বেহায়া। হানিয়ার ওপরে ভরসা আছে কিন্তু আজ যে হানিয়া চটে আছে। একটু আগে রাগের কারণ জেনে ওর ও মনটা খারাপ হয়ে গেছে। মেয়েটা দূরে এসেও ভাইবোন দু’টোকে নিয়ে চিন্তায় চিন্তায় শেষ হয়ে যাচ্ছে। হানিয়া কমলালেবুর খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে বলল “হ্যালো, ভাইয়া। হানিয়া আহমেদ।”
সায়েম ফ্যাকশে মুখশ্রী করে বলল “ভাইয়া! আমি তোমার কোন জন্মের ভাই? ভাই বললে আমাকে বাবার সম্পত্তির ভাগ দিতে হবে।”
হানিয়া একপল সায়েমকে দেখে আবার নিজের কাজে মন দিয়ে বলল
–“আপনি আমার এই জন্মের ধর্মের ভাই। বোন নামক বন্ধবীর ভাই মানে আমারও ভাই।”
–“সম্পত্তির ভাগ বেশি করে দিতে হবে। যেহেতু ধর্মের ভাই আবার বোন নামক বান্ধুবীর ভাই। দুইদিকের থেকে ভাই মানে দুইটা ভাগ চাই।”
–“ওকে নো প্রবলেম।”
–“থাক সম্পত্তি দেওয়া লাগবে না ভাইকে সুন্দরী গার্লফ্রেন্ড জুটিয়ে দিও।”
–“আমি এসব ঘটকালী করি না ভাইয়া।”
–“তা তো হবে না বোন হয়ে ভাইয়ের গার্লফ্রেন্ড খুঁজে দিবে না তা কী করে হয়!”
–“ওকে”
–“আচ্ছা তোমার কী বয়ফ্রেন্ড আছে নাকি সে দায়িত্বটাও ভাইকে নিতে হবে।”
ওদের কথা চুপচাপ শুনছিল আর খাচ্ছিল এবার খাবা থামিয়ে তাকালো ওদের দিকে হানিয়া লেবুর খোসা সুচছেলা করে ছাড়াচ্ছে বলল
–“লাগবে না। সেসব লস্ট প্রজেক্টের সময় নাই আমার।”
–“প্রজেক্ট? বয়ফ্রেন্ডকে প্রজেক্ট বানিয়ে দিলা। আহারে বেচারা।”
সুভানা, সোনিয়া মিটমিট করে হাসছে হানিয়া যে পরিস্থিতি সামলে নিয়েছে শাবনূর বেগম গম্ভীর মুখে বসে আছে কিছু বলছে না সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। সে রেগে গেলে না জানি কী হতো! হানিয়ার একপাশে শাবনূর বেগম আরেকপাশে সুভানা। হানিয়ার ফোন সাইলেন্স করা সেটাতে কল আসছে বারবার ও দেখেও ধরছে না। শাবনূর বেগম হানিয়াকে বলল “তোমার ফোন বাজচ্ছে ধরো।”
চলবে ইনশাআল্লাহ