#চন্দ্রপ্রভায়_তুষার_বর্ষণে।।১৯ পর্ব।।
#তাসনিম_তামান্না
সারাদিন ঝাপিয়ে বৃষ্টি পড়ছে। ঠান্ডা ঠান্ডায় কী অফিস, স্কুল, কলেজ করতে ভালো লাগে? এই বৃষ্টির দিনে বাসায় বসে খিচুড়ি, ইলিশ মাছ ভাজা খেয়ে লেপের ভেতর শুয়ে ফোন টিপতে ভালো লাগে।আর এখন ইমন লান্স টাইমে ক্যান্টিনে এসে স্যান্ডুইস, জুস, আইসক্রিম অর্ডার দিয়ে বিরশ মুখে ফোন স্ক্রোল করতে লাগল। ইমন ক্ষণে ক্ষণে দীর্ঘ শ্বাস ছাড়ছে বিরবির করে বলল ‘ছাতার মাথার জীবন’।
ইমন অল্প সময়ে নিজের দক্ষ কাজ দ্বারা অফিসের ম্যানেজার পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এতে অফিসের সিনিয়রদের রাগ, দুঃখের শেষ নেই। সকলে সামনাসামনি হাসি মুখে কথা বললেও পিছনে বদনাম করে। ইমনও বুঝে যে বা যারা ওকে অপছন্দ করে তাদের থেকে দূরে থাকে কাজ ব্যতিত কারোর সাথে তেমন কথা ও বলে না।
ইমনের ফোন স্ক্রোল করার মাঝে নরম রিনরিনে মেয়েলি সুরে ‘স্যার’ বলে ডেকে উঠল। ইমন চোখ তুলে তাকালো। রুহি! মেয়েটা সারাক্ষণ মেকাপের ওপরে থাকে। মেকাপ ছাড়া কখনো অফিসে এসেছে কিনা বা দেখেছে কিনা ইমনের মনে পড়ে না। এই মেয়ের জন্য সেদিন ইরাবতী বেগম উল্টোপাল্টা প্রশ্ন করছিল। তবে মেয়েটা সুন্দরী। আসলেই কী? নাকি মেকাপের ওপরেই সুন্দর নিচে অসুন্দর। ইমন বলল “কিছু বলবেন মিস রুহি?”
রুহি ইতস্তত করে বলল
–“আপনি যদি কিছু মনে না করেন তাহলে আমি আপনার সাথে লান্সে বসতে পারি?”
ইমন না বলতে গিয়েও সামলে নিল। মুখের ওপরে না বলাটা অসভ্যতা, অপমানিত বোধ করতে পারো ভেবে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। রুহি হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো খুশি হলো। তারপর দুজনেই চুপচাপ বসে রইল। ইমন ফোন দেখছে আর রুহি দেখছে ইমনকে। ইমন হঠাৎ চোখ তুলে তাকাতেই রুহি থতমত খেয়ে গেলো। ইমন ভ্রু কুঁচকে বলল “আপনার অর্ডার দিন। খাবেন না।”
–“জি বলেই এসেছি।”
ইমন আর রুহির খাবার একসাথে আসলো। ইমন চুপচাপ খাচ্ছে। রুহি খাবার ফাঁকে চোরা চোখে ইমনকে দেখছে। ইমন এতো খেয়াল করল না। খাওয়া শেষে আবারও যে যার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
ইমন সারাদিনের ক্লান্তির পর নিজের বাসগৃহে এসে বিছানায় গা এলিয়ে শুয়ে পড়ল। ফোনে আবারও সেই অদ্ভুত ম্যাসেজ। আজ কয়েকদিন ধরে অচেনা নম্বর থেকে প্রেমময় বার্তা আসছে। ঠিক রাত বারোটার ফোন আসে ওপাশ থেকে কেউ কথা বলে না চুপ থাকে। কথা বলতে না দেখে ইমন কয়েকটা কথা শুনিয়ে ব্লক দিয়ে দেয় আর যতবারই ব্লক করে ততবারই নতুন নম্বর থেকে কল, ম্যাসেজ আসে। হানিয়ার সাথে বিষয়টা শেয়ার করলে ও ইমনকে নতুন মামী বলে খেপাই। আদেও কী সে মেয়ে কিনা ইমনের জানা নেই তাই ইমন রাগ ঝাড়ে ওর ওপরে কিন্তু ও ওসব পাত্তা না দিয়ে বেশি বেশি খেপায়। ইমনের মনে সুপ্ত অনুভূতি উঁকিঝুঁকি দেয়। কিন্তু ইমন চাই না প্রেমে পড়তে। একবার প্রেমে পড়ে ধোঁকা খেয়েছে তারপর আর সাহস হয় না। সাহসীরা প্রেমে পড়ে বার বার ও তো সাহসী না।
ইমন হাবিজাবি বিষয়কে মন-মস্তিষ্কে কলহের মধ্যে ডাক পড়লো খাবারের জন্য। ইমন ‘আসছি’ বলে তা-ও শুয়ে রইলো। এখন সাড়ে দশটার বেশি বাজে আর একঘন্টা পর কলটা আসবে।
হামজা-হায়াত যার যার ঘরে পড়তে বসেছে। হামজা পড়াশোনায় মন দিয়েছে। প্রি-টেস্টে ফিজিক্সে ফেল করছিল তারজন্য ক্লাসমেটরা, ইমন মামা, ইফাজ, নিশাদ ভাই, চাচী কত খেপিয়ে, হাসাহাসি করেছে। হামজার তখন মনটা খারাপ করে বোনকে জড়িয়ে ধরে নিঃশব্দে কেঁদে ছিল। হানিয়া হাসে নি চুপ থেকে হামজাকে সাপোর্ট দিয়েছিল। কিন্তু বোনের নিঃশব্দতাই ও বুঝে নিয়েছিল কতটা কষ্ট পেয়েছে। বোনকে কথা দিয়ে বলেছিল ‘ভালো করে পড়বে। আর এমন হবে না।’ সেপ্টেম্বরে টেস্ট এক্সাম সে অনুযায়ী পড়ার চেষ্টা করছে। খাওয়ার ডাক আসতেই পেটের খুদা টের পেলো। উঠে গেলো পড়া ছেড়ে হায়াতের রুমে উঁকি মারলো। বই খোলা তার ওপরে মাথা রেখে কী যেন ভাবছে। হামজা হায়াতকে ডাকল সাড়া পেলো না।
হায়াতের পড়াশোনায় মন নেই কিশোরী বয়সের আবেগ প্রজাপতিরা উড়াউড়ির করছে। মস্তিষ্ক জুড়ে নিশাদ নামক মানুষের বিচরণ চলছে। তার কথা ভাবতে খুব ভালো লাগছে। সেদিন নিশাদকে প্রথম ভয় লাগছিল কিন্তু পরমুহূর্তে নিশাদের কথা শুনে ভয়টা কর্পূরের মতো উড়ে গিয়ে ভালোলাগার প্রজাপতি এসে আঁকিবুঁকি করছিল। এখনো ওর চোখের সামনে ভাসে…
নিশাদ হায়াতের বাহু টেনে পাশের একটা ফাঁকা রুমে নিয়ে গিয়ে দরজা চাপিয়ে দিলো। হায়াতের মুখ দিয়ে ভয়ে কোনো কথায় বের হলো না। দরজা দিতে দেখে হামজা, ইফাজ চমকে গিয়ে দরজা ধাক্কা দিয়ে বলল “কী করছো দরজা খুলো”
–“ওর সাথে জাস্ট কথা বলব। ঘ্যানঘ্যান করিস না এখান থেকে যা।”
ওরা গেলো না কী কথা বলছে শোনার চেষ্টা চালালো। কিন্তু কিছু শুনতে পেলো না।
নিশাদ শক্ত করে ধরে রাখা বাহুটাতে হাত শিথিল করল। হায়াত ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে আছে। নিশাদ ওর দৃষ্টি বুঝে আহত হলো ওর ছোট্ট মুখটা দুহাতে ধরে বলল “কি লাগছে আমাকে? আমি তো তোর ঐ দুচোখে ভয় না। ভালোবাসা দেখতে চেয়েছি। প্লিজ ভয় পাস না।”
হায়াত নিশাদের চোখে ভালোবাসার সমুদ্র দেখলো। আমতাআমতা করে বলল “আমি ভয় পাই না।”
নিশাদ হাসলো বলল
–“আমি জানি আমার দোষ, ভুল, অন্যায়ের জন্য তোকে অনেক মেন্টাল ট্রমার মধ্যে কাটেছে। অনেক বাজে কথা শুনেছিস। আমি খুব সরি জান।”
কথাগুলো বলতে বলতে কণ্ঠ বুজে আসলো। চোখ দিয়ে টপ করে পানি পড়লো। হায়াত চমকালো ‘জান’ শব্দটা আর নিশাদকে কাঁদতে দেখে। হায়াতের মায়া হলো। ইতস্তত করে ওর কোমল হাত দিয়ে চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল “আর এমন করবে না। মাথা ঠান্ডা রাখবে।”
নিশাদ হাসলো। হেসে হায়াতের কপালে ওর ঠোঁট ছোঁয়ালো। হায়াত লজ্জায় গুটিয়ে গেলো। সে লজ্জা দেখে বলল “হায়াতরাণী! ভালো থাকিস নিজের খেয়াল রাখিস। মন দিয়ে পড় অন্য কিছু ভাবার দরকার নেই। তুই আমার হবি। তোকে আমার হতেই হবে।”
নিশাদ দরজা খুলে চলে গেলো। হায়াত তারপরে লজ্জা থেকে বের হতে সময় নিলো। হামজা, ইফাজ অবশ্য সন্দেহ নজরে তাকিয়ে নানান রকমের প্রশ্ন করছিল ও কিছুর উত্তর দিতে না পেরে মিথ্যা রাগ দেখিয়ে চলে গিয়েছিল।
–“এই তোরে ভুতে ধরছে এমন একা একা বসে হাসিস কেন? সাতচুন্নি।”
হামজার চিৎকারে ভয়ে থতমত খেয়ে গেলো। আমতা আমতা করে বলল “আজেবাজে কী বলছিস।”
–“তুই হাসতেছিস কেনো? এটা বল।”
আবারও ডাক পড়ল। হায়াত এসব প্রশ্ন থেকে বাঁচতে। ‘ডাকছে যায়’ বলে চলে গেলো। হামজা সন্দিহান চোখে তাকিয়ে রইল।
চলবে ইনশাআল্লাহ