চন্দ্রপ্রভায়_তুষার_বর্ষণে।।২০ পর্ব।। #তাসনিম_তামান্না

0
377

#চন্দ্রপ্রভায়_তুষার_বর্ষণে।।২০ পর্ব।।
#তাসনিম_তামান্না

অক্টোবর মাসের হুটহাট বৃষ্টির আগমন ঘটছে। এই আকাশে সূর্য মামার দেখা আবার দেখো মেঘের আনাগোনা। হানিয়ার মাঝে মাঝে মনে হয় আকাশ আর সূর্য বোধহয় প্রেমিক-প্রেমিকা। আকাশটা বোধহয় প্রেমিকা! তাই তো সে ইমোশনালফুল হয়ে দুঃখ করে মন খারাপ গুলো বৃষ্টি হয়ে ঝড়িয়ে দেয়। তারপর… তারপর… আবারও ওদের মিল হয়। আবারও প্রেম জমে! দূরত্ব ওদের সয় না। ওদের ঝগড়া হলে বোধহয় বৃষ্টি নামে। এসব আজগুবি চিন্তাভাবনা করতে করতে হানিয়া হেসে ফেললো একা একা।

আজ কয়েকদিন দিন পরে বাইরে বের হলো এই ক’দিন শুধু পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত ছিল। আজ কিছু বই কালেক্টর করতে বের হয়েছে একা। সুভানার আসার কথা থাকলেও সে ঘুমে বিভোর। হানিয়া ভেবে পাই না এই মেয়ে এতো ঘুমাতে পারে কীভাবে। যেখানে সেখানে, বাস, ট্রেন, ক্লাস কিছু মানে না ঘুম মানে ঘুম।

stockfleths Coffee shop, (Gamlebyen, oslo) এই কফিশপে রাত্রি ওয়েটারের জব করে। সে হানিয়ার রুমমেট। বাঙালি বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণে এই ক’দিনে ভালো সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছে। হয়েছে যদি ও রাত্রি হানিয়ার এক সেমিস্টার সিনিয়র কিন্তু সেটা ও বুঝতে দেয় না। হানিয়া আগে কখনো এই কফিশপে আসে নি বাইরে থেকে মনে হলো ভিতরটা ঘুটঘুটে অন্ধকারে বুদ হয়ে আছে। ভিতরে ভুতুড়ে কারবার বাইরেও তেমন একটা মানুষ জন নেই। কফিশপের পাশ দিয়ে মেট্রোরেল লাইন সেখান থেকে একটা স্কাই ব্লু রংয়ের মেট্রোরেল গেলো স্টেশনে অবশ্য থামলো কয়েকজন যাত্রী উঠলো। হানিয়া ভারী ভারী বই হাতে ধরে রেখে হাত ব্যথা করে উঠলো। কফি-শপে ডুকলো। মানুষ জন আছে ভিতরটা সাজানো গোছানো। নিচে কাউন্টারে গিয়ে রাত্রির কথা জিজ্ঞেসা করতে জানালো সে উপরের ফ্লোরে। হানিয়া সিঁড়ি দিয়ে উঠে প্রথমে চোখ গেলো নাক উঁচু, অহংকারী, রোবট লোটার দিকে সামনের সম্ভবত ক্লাইন্টের সাথে হাত নেড়ে কথা বলছে। ওপরের ফ্লোরটা ফাঁকা, শুধু তিনজন লোকজন আর ওয়েটাররা। হানিয়া ভেংচি কেটে চোখ সরিয়ে নিজের কাজে মন দিলো রাত্রির দেখা মিললো। ওকে দেখে রাত্রি অবাক হয়ে ফিসফিস করে বলল “তুমি এখানে? ডেটে এসেছ না-কি?”

হানিয়া মিটমিট করে হেসে বলল “তুমি রাজি থাকলে ডেট হবে। বলো রাজী?”

রাত্রি হেসে ফেলো বলল “কাজ আছে। অন্যদিন।”

–“শুধু কাজ আর কাজ লাইফটাকে এনজয় করো। সুন্দর সুন্দর মোমেন্ট ক্রিয়েট করো। এতো টাকা জমিয়ে কী করবে বলো তো! বুইড়া বয়সে না টাকা, ইচ্ছে থাকলেও হাঁটুতে সেই জোড় থাকবে না। তখন কী করবে? কী ভেবে আনন্দিত বোধ করবে?”

রাত্রি হানিয়ার কথা শুনে মন দিয়ে এবারও শুনলো বলল “মিষ্টি মেয়ের, মিষ্টি মিষ্টি কথা। কিন্তু আজ না অন্যদিন।”

হানিয়া দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বলল “ওকে। বইগুলো রাখো। দু’ঘন্টা পর তোমার ছুটি তখন একসাথে হোস্টেলে ফিরবো। এবার বলো এখানে কফি ছাড়া আর কী পাওয়া যায়?”

–“তোমার ফেবারিট চকলেট মিল্ক শেক দিবো?”

–“হ্যাঁ দাও।”

–“আজ আমি ট্রিড দি।”

–“নো যেদিন তুমি এনজয় করতে বের হবে আমার সাথে সেদিন ট্রিড নিব।”

হানিয়া অন-টাইম মিল্ক শেক পটটা নিয়ে বের হয়ে এলো কফিশপ থেকে।

সেজাদ মিটিংয়ের মাঝে হানিয়াকে একটা মেয়ের সাথে কথা বলতে দেখে থেমে গেলো। মেয়েটার হেসে কথা বলছে। কী বলছে শোনা যাচ্ছে না। ক্লাইন সেজাদের অন্য অন্যমনস্ক দেখে ডেকে নরওয়েজিয়াম ভাষায় বলল “মিস্টার এসএ! আর ইউ ওকে?”
–“ওহ ইয়াহ।”

–“আমরা ডিলটাতে রাজি। নিউ প্রজেক্টটা অন্য প্রজেক্টগুলোর মতো বেস্ট হবে আশা করছি।”

–“আই ইউল ট্রাই মাই বেস্ট।”

ক্লাইন থেকে চোখ সরাতেই দেখলো হানিয়া নিচে যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি কাজটা শেষ করে উঠে গেলো।

স্ট্র মুখে নিয়ে এদিকে ওদিকে তাকিয়ে ভাবলো কোন দিকে যাবে? Gamle রোড দিয়ে ইউনিভার্সিটির উল্টো দিকে হাঁটতে লাগলো। নরওয়ে দেশটা যেনো সবটা সাজানো রূপকথার মতো লাইন দিয়ে কিছু বিল্ডিং রংবেরঙের দেখতে বেশ লাগে। গাছের পাতার রং হলুদ নিচেও পাতা পড়ে আছে নিচু হয়ে কয়েকটা পাতা তুলে নিলো। পিছন থেকে পুরুষালী কণ্ঠে বলে উঠলো “আপনি এখানে একা কী করছেন মিস হানিয়া! আপনার ইউনিভার্সিটি, হোস্টেল তো উল্টো দিকে।”

হানিয়া পিছনে ফিরে সেজাদকে দেখে অবাক হলো। মুখ থেকে স্ট্র সরে ঠোঁট জোড়া ফাঁক হয়ে গেলো। হানিয়াকে এভাবে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে গলা ঝেড়ে বলল “মিস হানিয়! এনি প্রবলেম?”

হানিয়া চিন্তিত হয়ে বলল “আপনি কী অসুস্থ?”

–“হোয়াট? কেনো বলুন তো!”

–“না আসলে, সজ্ঞানে তো আপনি আমার সাথে নিজের থেকে এসে কথা বলা লোক না। সেদিন আপনাদের বাড়িতে দরজায় দাঁড়িয়ে হাই দিলাম উত্তর দিলেন না।”

সেজাদ বিব্রতবোধ করলো কী উত্তর দিবে ও? বলবে ‘আপনাকে দেখছিলাম?’ হ্যাংলা ভাববে না? ও নিজে থেকে কেন এসে কথা বলছে এটাও ও জানে না। সেজাদ সময় নিয়ে বলল “একচুয়েলি আমি ভাবলাম আপনি রাস্তা হারিয়ে ফেলেছেন। একা তাই জিজ্ঞেসা করছিলাম।”

–“না না পথ হারাই নি। এমনিতেই বেড়াতে যাচ্ছিলাম।”

–“একা?”

–“হ্যাঁ, কেন একা বেড়ানো নিষিদ্ধ আছে না-কি!”

সেজাদ ফট করে বলল
–“না আপনি তো এখানে কিছু তেমন চিনেন না। চলুন আমি যায় আপনার সাথে”

কথাটা বলে ও নিজেই বোকা হয়ে গেলো। কী বলে ফেললো ওরই লজ্জা লাগছে। ও কী হানিয়ার সঙ্গ চাইছে? হানিয়া ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল মুখের ওপরে ‘না’ করে দেওয়াও অসভ্যনিও। হানিয়া বলল “আপনার কাজ নাই?”

–“নো আ’ম টোটালি ফ্রি নাউ।”

–“ওকে চলুন।”

দুজনে চুপচাপ হাঁটছিল দুজনের মাঝে একহাত সমান দূরত্ব। হানিয়া বলল “আমি একাই খাচ্ছি আপনি কিছু খাবেন? আমার পক্ষ থেকে ট্রিড। বলুন কী খাবেন”

সেজাদ ওর দিকে তাকিয়ে রইল। মনে মনে ভাবছে সেজাদ এহসানকে এই পুঁচকে মেয়েটা ট্রিড দিবে? কী দিবে? মনে আগ্রহ নিয়ে শান্ত দৃষ্টি তেমনই শান্ত কণ্ঠে বলল “আপনি যা খেতে চান। চকলেট, আইসক্রিম এনিথিং”

সেজাদ নিভৃতে হাসলো। ও কী বাচ্চা? যে চকলেট, আইসক্রিম খাবে। সেজাদ বলল “আপনি কী খেতে চান?”

হানিয়া ভাবুক হয়ে বলল “এখানে সবচেয়ে বেস্ট কী?”

–“আমার কাছে stockfleths এর কফি বেস্ট লাগে।”

–“ওহ তাহলে চলুন কফি খাই।”

–“নো কফি খেয়েই এসেছি।”

–“চলুন তাহলে আমরা বরং আইসক্রিম খাই।”

–“আইসক্রিম?”

–“হ্যাঁ চলুন চলুন”

–“খাই না”

হানিয়া বড়বড় চোখ করে তাকিয়ে বলল
–“আইসক্রিম খাই না এমন মানুষ আছে নাকি?”

সেজাদ কিছু বলল না। হানিয়াই বলল “খান না তো কী হয়েছে আজ খাবেন।”

–“ওকে বাট ওয়ান কন্ডিশন আমি ট্রিড।”

–“ওকে।”

রেস্টুরেন্টে গিয়ে হানিয়াকে বসতে বলে সেজাদ গিয়ে আইসক্রিম অর্ডার দিয়ে আসলো। সেজাদ এসে বসে হানিয়াকে চিন্তিত দেখে বলল “এনি প্রবলেম মিস. হানিয়া?”

–“নাথিং। আমাকে তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে। সন্ধ্যা হয়ে গেছে।”

–“ডোন্ট ওয়ারি আমি পৌঁছে দিব।”

হানিয়া গ্লাস ভেদ করে বাইরে তাকিয়ে আছে আকাশে স্বল্প সবুজ রংয়ের অরোরা দেখা যাচ্ছে। কালো মেঘে ছেয়ে যাচ্ছে সেগুলো। সেজাদ হানিয়ার দিকে তাকিয়ে রইল। কয়েক মিনিটের মধ্যে আইসক্রিম চলে আসলো। ফালুদা, বাওবিং, সোরবেট, রোলড আইসক্রিম এতো অর্ডার দেখে হানিয়ার চোখ বড়বড় হয়ে গেলো ফিসফিস করে বলল “আপনি পাগল এতো আইসক্রিম অর্ডার দিয়েছেন কেনো কে খাবে?”

–“কেনো আপনি!”

–“আমাকে রাক্ষস মনে হয়?”

–“অর্ডার তো এসে গেছে এখন কিছু করার নাই।”

–“এগুলো খেলে আমি কয়েকদিন উঠতে পারব না।”

–“কেন?”

–“কেনো মানে ঠান্ডা খেলে মানুষ অসুস্থ হয়ে যায় জানেন না? ঠান্ডা লাগবে।”

সেজাদ বুদ্ধি লোপ পেলো যেনো অর্ডার দিয়ে নিজেই বোকা হয়ে গেলো। একথা মাথায় ই ছিল না। বলল
–“বেশি খেতে হবে না অল্প করে সবগুলো টেস্ট করুন।”

আইসক্রিম যতোটা পারে হানিয়া খেলো। সেজাদও সঙ্গ দিলো এভাবে কখনো আয়োজন করে আইসক্রিম খাওয়া হয়েছে কিনা ওর মনে পড়ে না। আইসক্রিম খেয়ে বের হয়ে হানিয়া চকলেটের দোকানে ডুকে অনেক গুলো চকলেট কিনলো দুই প্যাকেট ভরে। একটা সেজাদকে দিল আরেকটা নিজের। সেজাদ অবাক হয়ে বলল

–“এতো চকলেট নিয়ে কী করব?”

–“কেনো খাবেন। আপনি আইসক্রিম ট্রিড দিলেন আমি চকলেট।”

–“তাই বলে এতোগুলো।”

–“হ্যা ওখানে কিন্তু শুধু আপনার চকলেট না সোহানের ও চকলেট আছে। ওকেও দিয়েন।”

সেজাদ তাকিয়ে রইল ওর দিকে। হানিয়া যে আইসক্রিম খেয়েছে সেটাই চকলেট দিয়ে শোধ করল সেটা বুঝতে একটুও অসুবিধা হলো না। এতো আত্মসম্মানবোধ এই মেয়ের?

হাঁটতে লাগলো। হানিয়া টুকটাক কথা বলছে দেশ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করছে। সেজদা উত্তর দিচ্ছে। এর মধ্যে টুপটাপ ফোঁটাতে বৃষ্টি পড়তে পড়তে জোরে বৃষ্টি নামলো। সেজাদ সাদা শার্ট, কোট প্যান্ট, সু ফর্মাল লুকে ছিল। আর হানিয়া সাদা টি-শার্টের ওপরে লাল স্ট্রবেরি আঁকা কালো জিন্স পরা দুজনের মুহুর্তে ভিজে টইটম্বুর হয়ে গেলো stockfleths এর সামনে এসে গেলো। হানিয়া মজা করে হাত-পা ছোড়াছুড়ি করে ভিজতে লাগলো হাসি মুখে বলল “আমি এখান থেকে যেতে পারব। আমার রুমমেটকে সাথে নিয়ে চলে যাবো আপনি চলে যান। অনেকটা দেরি হয়ে গেলো আপনার।”

সেজাদ ঘোর লাগা দৃষ্টিতে তাকিয়ে এগিয়ে এসে হানিয়ার কোমড়ে হাত রাখলো। হানিয়ার হাসি মুখ থেকে চলে গেলো। চুল দিয়ে মাথা গড়িয়ে ফোঁটায় ফোটায় পানি পড়ছে। সেজাদ তাকিয়ে রইল। মুখ এগিয়ে আনতেই হানিয়া ওর বুকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল। ওর ঘোর কাটলো। সেজাদ বিব্রত বোধ করল কী করতে যাচ্ছিল এটা? ও কিছু বলতে গেলে হানিয়া বলল “আমার দেরি হচ্ছে যেতে হবে।”

বলে দ্রুত পায়ে প্রস্থান করলো। সেজাদ তাকিয়ে রইল চেয়েও কিছু করতে পারল না বলতে পারল না।

চলবে ইনশাআল্লাহ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here