#চন্দ্রপ্রভায়_তুষার_বর্ষণে।।৩৬ পর্ব।।
#তাসনিম_তামান্না
সেজাদের কল্পনা জল্পনার অবসান ঘটিয়ে সাদাকালো চুলের আটপৌরে শাড়ি পড়া বয়স্ক মহিলা উপস্থিত হলো। সেজাদ তাকে দেখে মুহুর্তে চিনে ফেললো। শাবনূর বেগম আর ইরাবতী বেগম আবেগে আপ্লূত হয়ে জড়িয়ে ধরে আনন্দ অশ্রু ধারা বইয়ে দিলো। সালেহা এসব দেখে অবাক হয়ে গেলো এতোদিন পরেও এদের এতো ভালোবাসা দেখে। কিন্তু ওর বান্ধবীগুলো কোথায়? কতগুলো দিন, মাস, বছর দেখা হয় না। চেহারাগুলোও কেমন অস্পষ্ট হয়ে গেছে মনে করতে পারলো না। এসব দেখে ওনি আর না দাঁড়িয়ে হেঁসে রান্নাঘরে গেলেন নাস্তা পানি তৈরির জন্য।
দুইসই গলাগলি করে শান্ত হলো। তখনও সেজাদ তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। কী বলবে আসলে ও খুজে পাচ্ছে না। ইরাবতী বেগম সেটা দেখে বলল “একি তুমি দাঁড়িয়ে আছো ক্যানো? বসো বসো।”
–“আমার বড় নাতি। বাড়িতে একলা একলা ভালো লাগতেছিল না বুঝলি আমরা দুজনেই ছিলাম তাই চলে আসলাম।”
সেজাদ বসে হালকা হেসে বলল “জি কেমন আছেন?”
–“ আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?”
–“জি ভালো।”
–“তার তোর আজ কয়েকদিন ফোনে কী হইছে সই? আমি তো ভাবতেছিলাম তোরে আবার হারাই ফেলাম না তো! তোর নাতনিটারও বলি হারি দেশে ফিরল আমাগোরে একটা বার কইল না।”
–“ও ছোট তো এতো বুঝতে পারে নি রাগ করিস নে সই। আমার ফোনটা ভেঙে ফেলাছি বুঝলি। ছোট ছেলেটার সম্পর্কে এমন একটা ঘটনা ঘটে গেলো। আত্মীয় স্বজনরা এতো ফোন দিতেছিল বাজে বাজে কথা বলতেছিল যে রাগে ভেঙে ফেলছি।”
–“কী হয়েছে রে?”
ইরাবতী বেগম ইতস্তত করে বলল
–“আর বলিস না সই… ইমন ইউনিভার্সিটিতে থাকাকালীন একটা মেয়ের সাথে সম্পর্ক ছিল। মেয়েটা বিঁড়ি, মদ খেতো খারাপ যেনে প্রথমে শোধরাবার চেষ্টা করে পরে না পেরে নিজেই ধীরে ধীরে সরে আসে। পরে মধুকে নিয়ে বাজে বাজে কথা বলছে ইমনের সহ্য হয় নি। সব সম্পর্ক শেষ করে। এতোগুলো বছর পর ছেলেটা আবারও কাউকে ভালোবাসলো। মেয়েটার সহ্য হলো না। খারাপ ভিডিও বানাইছে কি এডিট করে না? এখন তো ফোনের যুগ কিসব করে ইমনের মুখ বসিয়ে বলে বেড়াচ্ছে আমার ছেলে নাকি ঐ মেয়ের সর্বনাশ করেছে। আমি ও রাগে ছেলের গায়ে হাত তুলেছি রে…”
ইরাবতীর চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়তে লাগলো। শাবনূর বেগম ওনার চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল “তারপর কী হইলো?”
–“মেয়েটা বলল ওর সাথে বিয়ে না দিলে ও কেস করবে। ইমন মেয়েকে বিয়ে করবে না। আমিও বিয়ে দিবো। নিশাদ, হামাজ ইমনকে নিয়ে কোথায় যেনো চলে গেলো। দুদিন বাড়ি ফিরলো না। তিনদিনের মাথায় সব প্রমাণসহ বাড়ি ফিরল। আমার ছেলেটা নির্দোষ প্রমাণ হলো। ওর অপমান ঘুচলো। কিন্তু আমার ছেলেটার যে কী হলো ঘর থেকে বের হয় না সারাদিন অন্ধকার ঘরে থাকে। আমার হাসিখুশি ছেলেকে এভাবে দেখতে কোন মার ভালো লাগবে বলতো!”
ওদের কথার মাঝে নাস্তা আনলো সালেহা। সেজাদ, শাবনূর বেগম মন দিয়ে সবটা শুনলো। ইরাবতী বেগম পানি মুছে বলল “নাও ভাই খাও। নে সই খা। আজ কিন্তু থাকতে হবে কোনো কথা শুনব না।”
–“সে থাকবক্ষণ….
শাবনূর বেগম আর কিছু বলার আগে সেজাদ বলল
–“দাদু থাকলে চাইলে থাকুক কোনো প্রবলেম নাই। আমাকে যেতে হবে।”
শাবনূর বেগম গম্ভীর কণ্ঠে বলল “একা একা গিয়ে কি করবি? কাল ফিরে যাবো। আমার সইয়ের সাথে কথা আছে যা শেষ হবে না। তুইও থাকবি।”
সালেহা বলল
–“আমাদের বুঝি পছন্দ হয় নি?”
–“না না আন্টি এমন কিছু নয়।”
–“তাহলে?আজ থাকো। বন্ধুবীদের কথা কখনো শেষ হয় না। বোরিং লাগছে তোমার? বাচ্চারা এখনো কোচিংয়ে একটু পর দেখবে হইচই বেঁধে গেছে কাল বছরের প্রথম দিন সাথে মধুর জন্মদিন… ”
–“ভালো কথা বউমা মধুকে ডাকো ওনারা এসেছে। মেয়েটাতো বারোটার দিকে খেয়ে ঘুমিয়েছে এখনো উঠলো না জ্বর ট্বর আসল নাকি আবার?”
–“দেখছি…” বলে উপরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা ফেলতে হানিয়া দৌড়ে নিচে নামতে দেখে সালেহা চেচিয়ে উঠে বলল “এই… এই… দৌড়াচ্ছিস ক্যানো ফাজিল পড়ে গেলে ব্যাথা পাবি।”
সেজাদ তাকালো। কালো টি-শার্ট সেটার ওপরে কার্টুন আঁকা, সাথে কালো প্লাজু পড়া এলোমেলো চুলে খোপা করা ঘুমিয়ে ছিল সেজন্য মুখটা ফোলাফোলা লাগছে কাছাকাছি আসতে মুখ পানিতে ভেজা সেটা মোছে নি। নিচে এসে শাবনূর বেগম আর সেজাদকে দেখে অবাক হয়ে থেমে গেলো। দৌঁড়ানোর কারণে হাঁপাচ্ছে বলল “আপনারা?”
শাবনূর বেগম গম্ভীর কণ্ঠে বলল “হ্যাঁ আমরা। তুমি তো আমাদেরকে তোমাদের বাসায় আনবে না বলে আগে আগে চলে আসলে। তাই আমরাই চলে আসলাম।”
–“না না আমি তেমনটা ভেবে আসি নাই। আপনি ভুল বুঝছেন। আমি…”
এক্সপ্লেন করার আগে আবারও ফোন আসলো। হানিয়া সেটা দেখে বলল “ওহ সীট! আমি একটু আসছি। মাম ইফাজকে একটু পাঠাও।” বলে চলে গেলো।
–“তোর নাতনী কি এমন উড়নচন্ডী নাকি? তোর নাতনী তো আমাকে পাত্তাই দেয় না।”
সালেহা ইফাজকে ডেকে ডেকে পেলো না। শাবনূর বেগম বলল “সেজাদ তো বসে আছে কী দরকার ও গেলে হবে না?”
–“বোধহয় পার্সেল আসছে মধু একা আনতে পারবে না ভেবে ইফাজকে ডেকে দিতে বলেছে।”
সেজাদ বলল “সমস্যা নাই আন্টি আমি যাচ্ছি।”
সেজাদ গেলো। গেটের সামনে হানিয়ার স্লিপে সাইন করছে। ওর পাশাপাশি গিয়ে দাড়ালো। ও সাইন করে তাকালো ওর দিকে বলল “আপনি? কোনো দরকার?”
–“উহুম। আপনার দরকারে এসেছি।”
বলে কিছু প্যাকেটগুলা তুলে নিলো। হানিয়ার হাতে দুইটা কেকের বক্স। কোনো পেজ থেকে পিয়ার, কেক, চকলেট পাঠানো হয়েছে। সেজাদ সামনে হাঁটতে লাগলো ও পিছনে। সামনের জন হুট করে দাঁড়িয়ে পঠতেই হানিয়া বুঝতে না পেরে দাঁড়াতে পারলো না ঠাস করে সেজাদের পিঠের সাথে সজোরে বাড়ি খেলো নাকে ব্যথা পেয়ে চোখে পানি এসে গেলো। রেগে বলল “হুট করে দাঁড়িয়ে পড়লেন কেনো? ব্যাথা পেলাম না!”
সেজাদ সেসব কথার প্রতিত্তোর করল না বলল “এডভান্স হ্যাপি বার্থডে। এন্ড এভাবে না বলে চলে এসে আপনি মোটেও ঠিক করেন নি।”
হানিয়া কিছু বলার আগে সেজাদ বাড়ির ভিতরে চলে গেলো। হানিয়া বিরবির করে বলল
–“আমি ইচ্ছে করে করি নি। তাড়াহুড়ায় হয়ে গেছে এটাতে এতো রিয়াক্ট করার কী আছে? বুঝি না বাপু!”
হানিয়া সবগুলো জিনিসপত্র টেবিলের ওপরে নিয়ে আনপ্যাক করলো দুইটা কেক একটা ভ্যানিলা আরেকটা চকলেট তার ওপরে সুন্দর করে ডেকোরেশন করে হ্যাপি বার্থডে হানিয়া লেখা। আরেকটা বক্সে অনেকগুলো চকলেট। আরেকটাতে ওরজন্য ড্রেস কসমেটিক। ইফাজ কোথা থেকে ছুটে আসলো। হানিয়া হেসে বলল “ইঁদুর এসে গেছে।”
সালেহা খেপে উঠে বলল “আসবে না খাবারের গন্ধ পেয়েছে। কাজের সময় ওনাকে খুঁজে পাওয়া যায় না।”
–“আম্মু সবসময় খ্যাকখ্যাক করবা না তো! আমি ওয়াশরুমে গেলে তোমার ডাকা লাগে।”
–“আমি ডাকলেই তোমার ওয়াশরুম পাই। তা এতোক্ষণ ওয়াশরুমে কী করো? ঘুমাও?”
সালেহার বকাবকির মাঝে হায়াত-হামজা আসলো। হামজা এসে ছোট চকলেট মুখে পুরে খেতে লাগলো আর বলল “ও ওয়াশরুমে বসে রিংকির সাথে ফোনেপ্রেম আলাপে ব্যস্ত থাকে। তোমার ফোন দিয়েই করে।”
হাঁটে হাঁড়ি ভেঙে গেলো! সালেহা ওর কথাশুনে চোখগুলো রসগোল্লার মতো করে তাকালো। ইফাজ ভো দৌড় দিয়ে চলে গেলো। সকলে সশব্দে হেসে ফেললো শাবনূর বেগম বলেন “এটাতো দেখছি পাকা ঝুনু হয়ে গেছে।”
–“একটু বেশি।”
হায়াত চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল তার হাসি পাচ্ছে না মন ভিষণ খারাপ। একটা ভুল কাজ করে ফেলেছে এটাকে কীভাবে লুকাবে? বোনের হাসিখুশি মুখটার দিকে তাকিয়ে রইল। হানিয়া সেটা খেয়াল করে হাসতে হাসতে ইশারায় জিজ্ঞেসা করলো কী হয়েছে? হায়াত হাসার চেষ্টা করে দু’দিকে নাড়িয়ে রুমে চলে গেলো। হানিয়ার হাসি চলে গেলো ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। সেজাদ শুধু তাকিয়ে হানিয়াকে দেখছে এ-ই কদিনে না দেখার তৃষ্ণা মেটাচ্ছে। আর আগে কখনো হানিয়াকে এতো স্বচ্ছ হাসি হাসতে দেখে নি।
চলবে ইনশাআল্লাহ