#চন্দ্রপ্রভায়_তুষার_বর্ষণে।।৩৯ পর্ব।।
#তাসনিম_তামান্না
হানিয়া দু’দিন পর এবাড়িতে এসেছে। ও বাড়িতে গেলে এখন আর ফিরতে কেমন পিছুটান লাগে মিছরির জন্য! বাচ্চা দুম করে পৃথিবীতে এসে যেনো সব পাল্টে দিলো। মায়ায় জড়িয়ে ধরল। হায়াত হামজার আর ফেব্রুয়ারী মাসের পনেরো তারিখ থেকে পরিক্ষা তারা আলসামি ছেড়ে পড়াশোনায় মন দিয়েছে। তারা বোনের পিছু পিছু ওবাড়িতে বইখাতা নিয়ে চলে গেছিল। কিন্তু তাদের পড়াশোনা বাদ দিয়ে মিছরিকে নিয়ে পড়ে থাকে। পড়ার মাঝে কোলে নিয়ে বসে থাকে তাই হানিয়া বিরক্ত হয়ে এবাড়িতে নিয়ে আসলো দুটোকে। এবাড়িতে সালেহার হাতে দু’চারটা মার খেয়ে তাও পড়বে কিন্তু ওখানে কেউ শাসন করার নেই। হানিয়া মনযোগ সহকারে ফোন দেখছিল। এই ক’দিনের রিলস, ছবি সেগুলো পোস্ট করছিল।
ইমনকে ওর পাশে বসতে দেখেও প্রতিক্রিয়া জানালো না। সেদিন রৌদ্দুরের সাথে কথা বলার পর ইমন একটু সহজ হয়েছে। নতুন করে চাকরি জোগাড় করতে লেগে পড়েছে। পাশাপাশি নিজে বিজনেস আইডিয়া বের করেছে। কোনটা নিয়ে আগাবে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে। ব্যবসা মানে লস ধরে রাখতে হবে। প্রথম থেকে লাভের আশায় থেকে লস হলে ব্যবসার প্রতি বিতৃষ্ণা আসবে। ইমন গলা ঝেড়ে বলল “কি করছিস?”
–“কেনো চোখের মাথা খেয়েেছ? দেখতে পাচ্ছো না?”
–“আচ্ছা শোন তোকে যেটা বলতে এসেছি। আমার এতো ভনিতা ভালো লাগে না। এই যে সেদিন যে ছেলেটা এলো সাজিদ না সেজান কী নাম?”
–“সেজাদ এহসান।”
–“ঐ হ্যাঁ ও ছেলেটা কেমন? চরিত্র টরিত্র ভালো? তোকে কীভাবে ট্রিট করে?”
ইমন সেজাদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতে হানিয়ার সেদিনের কথা মনে পড়ল। সেদিন কোমড় টেনে ক্রমাগত তার দিকে এগিয়ে আসা তারপর ও জোড়ে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেওয়া। তারপর থেকে দু’জন কেউই সহজ হতে পারে নি। হানিয়া তার থেকে দূরত্ব রেখে চলেছে। সেজাদও বোধহয় বুঝতে পেরে নিজেও দূরত্ব রাখে। হানিয়াকে কিছু বলতে না দেখে ইমন বলল “কী হলো? ছেলেটাকে এ-ই ক’মাস ধরে কেমন দেখলি?”
হানিয়া সেসব কথা কিছু বলল না বলল “ভালোই দেখলাম। একটু বেশি-ই চুপচাপ। বাই দ্যা ওয়ে ঐ লোকের সম্পর্কে জেনে তোমার কী লাভ?”
–“তোর বিয়ের পাত্র হিসাবে সেজাদকে ঠিক করা হলে তোর মতামত কী হবে?”
কথাটার মানে বুঝতে হানিয়ার কয়েক সেকেন্ড লাগলো। বুঝতে পেরে ধপ করে মাথায় আগুন জ্বলে গেলো “মানে? কীসের বিয়ে? কে কাকে বিয়ে করবে? আর আমার বিয়ের কথায়ই বা কেনো উঠছে? আমি তোমাদেরকে নিঃশেষ করছি না। আমি সেজাদ কেনো কোনো ছেলেকেই বিয়ে করব না।”
–“বিয়ে না করার কারণ?”
–“তুই কেনো বিয়ে করছিস না মামা? রুহি মামি তোর অপেক্ষায় আছে। সেখানে তোরা আমার বিয়ের কথা কেনো ভাবছিস?”
–“আমার বিষয়টা আলাদা নিজেকে না গুছিয়ে ওকে আমার জীবনের সাথে জড়াবো না। কিন্তু তোর না করার কারণ কী? কাউকে পছন্দ?”
–“নাহ! আমি বিয়ে করতে চাই না। আমার লাইফের সাথে কাউকে জড়াতে চাই না। আমি আমার ভাইবোন দু’টোকে নিয়ে থাকতে চাই। আমি ওদের বাবা-মা ওদের ভালোখারাপের সবদিক খেয়াল রাখতে হবে। ওরা আমার দায়িত্ব, ভালোবাসা ওদের কিছু হলে ওরা আমার জন্য কষ্ট পেলে আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারবো না।”
–“বিয়ের পর কী তুই ওদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবি?”
–“বিয়ে মানে বড়সড় একটা দায়িত্ব। একটা মানুষের সাথে শুধু জীবন জড়িয়ে যাওয়া নয় তার সাথে জড়িয়ে থাকা মানুষ গুলোর সাথেও জড়িয়ে যাওয়া। বিয়ের পরে আরো দায়িত্ব বাড়বে। সবার সাথে মানিয়ে নেওয়া সবার পছন্দ অপছন্দের খেয়াল রাখা এতো এতো কিছু মধ্যে আমি আমার ভাইবোনকে কোনো ভাবে অবহেলা করে ফেলি। না না আমি বিয়ে করব না। ওদের নিয়ে আমার জীবন পার হয়ে যাবে।”
–“বুঝলাম বাট ধর তুই ওদের জন্য বিয়ে করলি না। আমি জানি হায়াতের বিয়ে দিবি নিশাদের সাথে। হামজাও বড় হলে বিয়ে করবে সংসার হবে তুই তখন একা হয়ে যাবি। তখন তোর মনে হবে তোর কাউকে দরকার”
–“আমার কাউকে দরকার না। আমি আমার জন্য এনাফ।”
———————–
সাইফুল এহসান চিন্তিত মুখে ড্রয়িংরুমে বসে আছে। সোনিয়া তার শশুড়বাড়িতে গেছে। লাইজু এখনো ছেলেমেয়ে, স্বামী নিয়ে বাপের বাড়ি, বোনের বাড়ি ঘুরছে। বাড়িতে শুধু তিনজন। সেজাদ বাইরে থেকে এসে তাকে দেখে কিছুটা বুঝতে পেরে বলল “এনিথিং রং বাবা? আপসেট? শেয়ার করতে পারো হালকা লাগবে।”
সাইফুল এহসান হেসে বলল “তুমি বাইরে থেকে এসেছ ফ্রেশ হও ততক্ষণে আমি কফি বানাই। কফি খেতে খেতে কথা হবে।”
সেজাদ সম্মতিসূচক মাথা নাড়িয়ে চলে গেলো। শাবনূর বেগম ঠ্যাস মে’রে বলল “আমি জানতাম ও যেমন ওর পছন্দও ওমনই হইব।”
–“আহ মা থামো তো! সেজাদকে আমিই সব বলব তুমি কথার মাঝে বা হাত ঢুকাবা না। কফি খাবে? বানাচ্ছি”
–“আমি কথার মাঝে বা হাত ঢুকাই? এমন কথা বলতে পারি? আমাকে এতোটাই খারাপ ভাবিস তুই?”
সাইফুল এহসান কিছু বলল না কিচেনে দিকে গেলো। এই মহিলার মাথায় সবসময় ভুংভাং চলে। দুমদাম কী বলে কী করে নিজেও জানে না।
সেজাদ আসলো। সাইফুল এহসান ও কফি নিয়ে আসলো। বসলো সকলে রয়েসয়ে বলল “তোমাকে একটা নম্বর দিয়েছিলাম। সেটাই ফোন দিয়েছিলে?”
কফিতে চুমুক দিয়ে বলল “না সময় পাই নি। এমনিতে মনেও ছিল না। সেজন্য কী তুমি রাগ করছ? মন খারাপ?”
সাইফুল এহসান স্বতি পেলো হাসি মুখে বলল “না। ভালো করেছ ফোন দাও নি। মেয়েটা জেনি তোমার জন্য পছন্দ করা মেয়েটা একটা ছেলে ইমন নাম তাকে ফাঁসিছে। তার জন্য সে ছয়মাসের জেল।”
সেজাদ তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল “কোনো এ্যাওয়ার্ড শোতে জঘন্য মায়ের এ্যায়ার্ড দেওয়া হতো তাহলে সে এ্যাওয়ার্ডটা তোমার প্রক্তন স্ত্রী পেত বাবা। আই নোউ সে জঘন্য তার পছন্দও তার কোয়ালিটির হবে। শুধু তোমার মনরক্ষার্থে দেখা করব বলে ছিলাম।”
শাবনূর বেগম অবাক হয়ে বলল “পৃথিবী গোল তাই বলে এতোটা গোল হইতে হইবে? আমার সইয়ের ছেলেকে ফাঁসিয়েছে এই মেয়ে কী সাংঘাতিক বাবা”
——————-
দোলা আগের চেয়ে একটু সুস্থ। সন্ধ্যা থেকে মেয়েটা কান্না করছে রৌদ্দুর বিকালে বেড়িয়েছে এখনো ফেরে নি। মেয়েকে চেয়েও ঠান্ডা করতে না পেরে ভয় পেয়ে গেলো। কী হলো মেয়ের? একসময় সে-ও মেয়ের সাথে কান্না জুড়ে দিলো। রাবেয়া বাড়ি ফিরে বাচ্চার কান্নার শব্দ পেয়েছে। ফ্রেশ হয়ে এসে দেখলো বাচ্চার মা-ও কান্না করছে। আর্শ্চয হয়ে গেলো বলল “একি তুমি কাঁদছ কেনো?”
–“ও কাঁদছে আমার ভিষণ কষ্ট হচ্ছে। ওর কি হয়েছে দেখুন না কিছুতেই কান্না থামছে না।”
–“চুপ করো অপদার্থ। আরেক অপদার্থ কই?”
–“জানি না বিকালে বের হয়েছে এখনো ফেরে নি।”
–“খাইয়েছিলে?”
–“হ্যাঁ। তাও কাঁদছে।”
–“অপদার্থ কী সাধে বলি। ডায়পার পড়ানো নেই। ভিজার ওপরে শুয়ে আছে অসহ্য লাগছে ওর তাই কাঁদছে।”
দোলা কান্না বন্ধ হয়ে গেলো পরপরই ফিক করে হেসে ফেললো তার নিজের বোকামির জন্য। রাবেয়া ও ওর হাসি দেখে হেসে ফেললো। রৌদ্দুর এসে বাচ্চার কান্না শুনে দৌড়ে এসে মা-বউকে একসাথে বসে হাসতে দেখে কেন জানি শান্তি শান্তি অনুভব হলো।
তারপর মেয়ের দিকে খেয়াল হতে মায়ের কাছ থেকে নিয়ে বলল “কী হয়েছে ওর? কাদছে কেনো মা?”
–“ভিজা কাথার উপরে শুয়ে ছিল ঠান্ডা লাগছিল তাই।”
রৌদ্দুর শান্ত দৃষ্টি দোলার দিকে তাকালো। দোলা মনে মনে ভয় পেয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে রইল। রাবেয়া বুঝতে পেরে বলল “মেয়ের সাথে মেয়ের মাও কাঁদছিল। অপদার্থ গুলো এই বাড়িতে সব।”
দোলা না চাইতেও নিজের বোকামির জন্য হেসে ফেললো। রৌদ্দুর আর কিছু বলল না মেয়েকে বুকে জড়িয়ে থামানোর চেষ্টা করতে লাগলো। সফলও হলো। বাবার কোলে আরাম পেয়ে ও ঘুমিয়ে পড়ল নিশ্চিন্তে।
চলবে ইনশাআল্লাহ