ধূসর_রঙের_জলছবি #অস্মিতা_রায় (পাঁচ )

0
194

#ধারাবাহিক
#ধূসর_রঙের_জলছবি
#অস্মিতা_রায়
(পাঁচ )
-“বলিস কী রে! ওই মেয়ের তলে তলে এত! হ্যাঁ রে,তা বলি টুবলু আদৌ তোরই ছেলে তো?”
-“আঃ মা! টুবলুর মুখ চোখ দেখে বোঝো না! ও তো আমার মতোই দেখতে হয়েছে!”
-“হ্যাঁ তাও ঠিক, যেমন গায়ের রঙ তেমন চোখমুখ সবই হয়েছে আমার শুভর মতো। ঠিক যেন রাজপুত্তুর! তা অমন চরিত্রহীন মেয়েকে তুই এমনি এমনি ছেড়ে দিলি! আবার বলছিস ডিভোর্স দিবি না! আমি বলি তুই ওই মেয়েকে ডিভোর্স দিয়ে আরেকটা বিয়ে করে এবার একটা লক্ষী প্রতিমার মতো বৌকে ঘরে তোল। ওই মেয়ের তো না ছিল রূপ না ছিল গুন। আর কী চ্যাটাং চ্যাটাং কথা মুখে মুখে!”
-“আমি আর বিয়ে করবো না। তাই আমার ডিভোর্সও দরকার নেই।“
-“ওমা! ওকি কথা! তোর এতখানি জীবন পড়ে আছে, তুই কী একা একা কাটিয়ে দিবি সেটা! আর টুবলুর কী হবে! না, মানে আমরা যতদিন সুস্থভাবে বেঁচে আছি ততদিন কোনো চিন্তা নেই। আমরাই ওকে দেখে রাখবো। কিন্তু তারপর? টুবলুর তো একজন মাও দরকার হবে।
-“সৎ মা এসে টুবলুর উপর অত্যাচার করলে! তাছাড়া মা, আমি খুব ক্লান্ত। তুমি এখন যাও, আমাকে একা থাকতে দাও।”
মা চলে যাওয়ার পর শুভেন্দু ঘরটার দিকে তাকিয়ে দেখলো। এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে মালবিকার জিনিসপত্র। পুরো ঘর জুড়েই যেন মালবিকার ছোঁয়া লেগে রয়েছে।এক সঙ্গে থাকলে যে কোনো কিছুর উপর মায়া পড়ে যায়। সেভাবে মালবিকার জন্যও ওর মন খারাপ হচ্ছে বই কী! এই সন্ধ্যেবেলা মনটা খুব মালবিকার হাতের চা পেতে চাইছে। প্রতিদিনের অভ্যেস হয়ে গেছিল শুভেন্দুর। মা মালবিকার কোনো ভালো গুন দেখতেই পায় না। এত সুন্দর চা বানায় মালবিকা, রান্নাটাও ভালো করে অথচ মা ওর কোনোদিন কোনো প্রশংসাই করল না। মালবিকাকে দেখতে গিয়ে ওর গলায় রবীন্দ্রসংগীত শুনেই ওকে পছন্দ করেছিল শুভেন্দু। বিয়ের পরে প্রথম জন্মদিনে মালবিকাকে একটা হারমোনিয়াম উপহার দিয়েছিল ও । খুব খুশি হয়েছিল মালবিকা। রোজ সকালে উঠে রেওয়াজে বসতো ও। কিছুদিন পরে সেই নিয়ে বাড়িতে অশান্তি শুরু হল। শুভেন্দুর বাবা মা দুজনেই বলে বসল, সকাল সকাল মালবিকার অ্যা অ্যা আওয়াজে নাকি ওদের ঘুম ভেঙে যায়। তাই সকালে ওসব গানটান নিয়ে বসা যাবে না। মালবিকাও কঠিন মুখে বলেছিল, “ওটা অ্যা অ্যা আওয়াজ নয়। ওটাকে রেওয়াজ বলে। আর বেশি বেলা করে কারোর ঘুমোনোর দরকারটাই বা কী! ভোরবেলা ওঠা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো।” শুভেন্দুর মা মুখ বেঁকিয়ে বলেছিল, “তোমার তো সারাদিন কোনো কাজ নাই ঘরে বসে থাকা ছাড়া!দুপুরে আরামে ঘুমোতে পারবা ।আমার ছেলেটাকে তো অফিসে বেরোতে হয়। ও সকালবেলা একটু বেশিক্ষন না ঘুমালে চলবে কীভাবে!” মালবিকা বলেছিল, “বেশ, ঘুমোবো না আমিও দুপুরে। আর আমি মোটেই সারাদিন শুধুই ঘরে বসে থাকি না!ও যেমন অফিসে কাজ করে, আমাকেও তেমন ঘরে সবার খিদমত খাটতে হয়।” থামানো যায় নি মালবিকাকে। নিজের জেদ বজায় রেখে রোজ সকাল সন্ধ্যে গান করতে বসতো ও । শুভেন্দুর বাবা বলতো, “এত গান গেয়ে কী লতা মঙ্গেশকর হবা?” জবাব দিতো না মালবিকা।
মালবিকার হারমোনিয়ামের বাক্সটার উপর হাত রাখলো শুভেন্দু। মালবিকাকে শুভেন্দুর বাবা মা অনেক কথা শুনিয়েছে। শুভেন্দুও ঝগড়া করে ওকে অনেক কিছু বলেছে। এমনকি মাঝে মাঝে গায়ে হাতও তুলেছে। মালবিকা কী সত্যি এই জন্য চলে গেল! প্রতিটা বাড়িতেই বউরা অনেক কিছু সহ্য করে মাটি কামড়ে পরে থাকে। মালবিকা কেন পারলো না! শুভেন্দু তো গেছিল কৌস্তভের ঠিকানা জোগাড় করে মালবিকার খোঁজ নিতে । ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিল ওকে। তবে শুভেন্দু ভাবে নি, কৌস্তভের ঘরে পা দিয়েই অমন দৃশ্য দেখবে ও। উঃ! কেমন ঘনিষ্ঠভাবে আলিঙ্গন করেছিল দুজনে!
হামাগুড়ি দিয়ে পায়ে পায়ে শুভেন্দুর কাছে এসে দাঁড়ালো টুবলু। চারখানা দুধের দাঁত বের করে বলে উঠল, “বাব্বা!” ছেলেকে কোলে তুলে নিল শুভেন্দু। ছেলেটা বড্ডো ন্যাওটা ওর। মালবিকা মনে হয় এই জন্য হিংসে করতো শুভেন্দুকে। তাই হয় তো টুবলুকে ভালোবাসতে পারে নি। নাহলে এমন পাষানি মা কেউ হয়! নিজের সন্তানকে ফেলে রেখে চলে যায়!
হঠাৎ শুভেন্দুর মনে হল, ও ঘুরে ফিরে মালবিকাকে নিয়েই ভেবে চলেছে। নাহ! আজ থেকে ওই নাম ওর মন থেকে মুছে ফেলবে ও। টুবলুকে আদর করতে করতে শুভেন্দু বলল, “আজ থেকে আমিই তোর বাবা, আমিই তোর মা।” টুবলু কথাটার মানে কিছুই বুঝলো না ঠিকই, তবে হঠাৎই বলে উঠল, “মা!”

**********************************

মুখচোরা আর ভীতু মেয়েটার সাহস দেখে হতবাক হয়ে গেল অরণ্য। কলকাতার কলেজে পড়ার জন্য কলেজের কাছে এই অ্যাপার্টমেন্টটার একটা ওয়ান বেডরুমের ফ্ল্যাট ভাড়া করে ওকে রেখেছে ওর বাবা। নিজের পকেটমানির জন্য আগের বছর থেকে দুটো ছেলেকে জয়েন্টের জন্য ফিজিক্স পড়াচ্ছিলো ও। একদিন উপরতলার প্রতাপকাকু প্রস্তাব দিলেন ওর ক্লাস টেনের মেয়েকে সায়েন্সগ্রুপ পড়িয়ে দিতে। নিজেরই অ্যাপার্টমেন্ট বলে না করে নি অরণ্য। একটু রাতের দিকে গিয়ে পড়িয়ে আসে ও দিয়াকে। মেয়েটা অত্যন্ত শান্ত আর বাধ্য। অরণ্য যবে থেকে ওকে পড়াতে শুরু করেছে তবে থেকে দিয়ার রেজাল্ট ভালো হতে শুরু করেছে। তাই জন্য দিয়ার চোখে ও হিরো হয়ে উঠেছে। দিয়ার যে ওর প্রতি খানিকটা দুর্বলতা জন্মেছে, সেটা বোঝে অরণ্য। তবে কোনোদিন ব্যাপারটাকে পাত্তা দেয় নি।পনেরো বছরের মেয়ের এই প্রেমকে ছেলেমানুষি ভেবেই উড়িয়ে দেয় বছর উনিশের অরণ্য। তবে আজ হঠাৎ ফাঁকা ঘরে মেয়েটা একলা কি জন্য এসেছে!এই ভরদুপুরবেলা কোনো সেলসম্যান এসেছে ভেবেই দরজা খুলেছিল অরণ্য।ভেবেছিলো একটা দুটো কথা বলেই বিদায় দেবে।ভাবতে পারে নি তার জায়গায় দিয়াকে দেখবে।
দিয়া অরণ্যর বেডরুমের দিকে এগোলো। সর্বনাশ!বেডরুমে তো….তাড়াতাড়ি দিয়ার হাত শক্ত করে চেপে ধরল অরণ্য।“ওদিকে কেন যাচ্ছিস?” দিয়া বলল, “আমার যাওয়া উচিত মনে হচ্ছে তাই।“ দিয়ার স্পর্ধা দেখে অরণ্য তাজ্জব হয়ে গেল। বলল, “কারোর পারমিশন ছাড়া তার ঘরে যাওয়াকে অসভ্যতা বলে তা কি জানিস? বেশি পাকামো না করে নিজের ঘরে যা… “ বলতে বলতে অরণ্যর মাথাটা হঠাৎই চক্কর দিয়ে উঠল। সকাল থেকে পেটে এক কাপ চা আর দুটো বিস্কুট ছাড়া আর কিছু খাবার পড়ে নি। খালি পেটেই কতখানি মদ যে খেয়েছে আজ, তা অরণ্যর নিজেরও খেয়াল নেই। নিজেকে সামলাতে না পেরে পড়ে যাচ্ছিল অরণ্য। তাড়াতাড়ি দিয়া নিজের সর্বশক্তি দিয়ে অরণ্যকে ধরে নিল। দিয়ার কাঁধের উপর ভর দিয়ে অরণ্য নিজেকে সামাল দিল।
সাবধানে অরণ্যকে ঘরে নিয়ে গিয়ে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে দিয়া। ঘরের চারপাশটা একবার ভালো করে চোখ বুলিয়ে দিয়া বলল, “একী অরণ্যদা! তোমার ঘরে মদের বোতল, এতগুলো সিগারেটের প্যাকেট! তুমি এভাবে টলছো, তোমার গা-ও তো গরম! কী হয়েছে তোমার!”অস্বস্তি আর কাকে বলে! মেয়েটা এসব কথা আর কাউকে বললে সবাই অরণ্যকে ভুল বুঝবে তো! অরণ্য নিজের মাথাটা ধরে বলে উঠল, “ আমি একটা মেয়েকে খুব ভালোবাসি। সে আমাকে আজ খুব কষ্ট দিয়েছে। তাই জন্য… দিয়া তুই প্লিজ কাউকে কিছু বলিস না। আজ আমি একটু পাগলামি করে ফেলেছি।” দিয়ার মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। ও জিজ্ঞেস করল, “কাকে ভালোবাসো তুমি? “ অরণ্য বলল, “স্নেহা। আমার স্কুলের বন্ধু।“ দিয়া বলল, “সে তোমায় কীভাবে কষ্ট দিয়েছে?”
-“ইলেভেন থেকে প্রেম আমাদের। বেশ অনেকদিন ধরে আমাকে অ্যাভয়েড করে চলেছিল। আজ ডেকে বলল, দেখা করতে চায়। কিছু বলার আছে। আমি গেলাম। বলল, এই সম্পর্কটা ও কোনোভাবেই আর রাখতে চায় না। কারণ এর কোনো ফিউচার নেই। আমি নাকি ম্যারেজ মেটেরিয়াল নই।”
-“কেন? “
-“আমার ফ্যামিলির জন্য ওর প্রবলেম।”
-“মানে? কী হয়েছে তোমার ফ্যামিলিতে?”
অরণ্যর খেয়াল হল আবেগের বশে ও দিয়াকে অনেক বেশি কথা বলে দিচ্ছে। অরণ্য বলে উঠল, “তোকে বলবো কেন? সব কিছু জানার তুই কে?” দিয়ার মুখটা অন্ধকার হয়ে গেল। তবে এ ব্যাপারে আর কিছু বলল না। জিজ্ঞেস করল, “কিছু খাবার খেয়েছো?” অরণ্য চুপ করে রইলো। দিয়া অরণ্যর রান্নাঘরে গেল। স্টকে কিছু চাল, ডাল, আলু রয়েছে। প্রেসার কুকারে বসিয়ে দিল দিয়া। অরণ্যকে বেড়ে দিল ডাল আলু সেদ্ধ আর ভাত । অরণ্য আর কিছু না বলে চুপচাপ খেয়ে নিল। পেট আর মাথায় অসহ্য যন্ত্রনা। খাবার পেটে পড়ার পরে অরণ্যর ঘুম পেতে শুরু করল। দিয়াকে ও বলল, “থ্যাংক ইউ! অনেক করলি তুই। এবার ঘরে যা। লোক জানাজানি হলে উল্টোপাল্টা কথা হবে।”দিয়া বলল, “কেউ জানবে না। সবাই এখন ঘুমোচ্ছে। আমি সুযোগ বুঝে ঠিক চলে যাবো। তুমি ঘুমোও।” অরণ্যর চুলে হাত ডুবিয়ে দিল দিয়া। মাথায়, ঘাড়ে আঙুলের নানা কারুকার্য করে ম্যাসাজ করে দিতে লাগল অরণ্যকে। অরণ্য আপত্তি করতে চেয়েও পারলো না। আরামে ঘুমে চোখ বুজে আসছে ওর।অরণ্য ঘুমিয়ে পড়ার পর দিয়া ওর মদের বোতল আর সিগারেটের প্যাকেটগুলো সরিয়ে রাখল।
রাতে খেতে বসে দিয়া একটু ইতস্ততভাবে বলল, “বাবা, অরণ্যদার না খুব শরীর খারাপ।এখন কেমন আছে একবার খোঁজ নেবে?ও তো একা থাকে।” প্রতাপ বলল, “কী হয়েছে?” দিয়া বলল, “দুপুরে দেখলাম জ্বর এসেছিল।” কাকলি বলল, “তাই নাকি!তাহলে একবার খোঁজ নিতে হয় তো! রাতে কিছু খেয়েছে ছেলেটা? আজ না হয় আমাদের সাথেই খেয়ে নিক।”

(ক্রমশ)

© Asmita Roy

——————————————————–

পরবর্তী পর্ব আসতে চলেছে খুব তাড়াতাড়ি। আপডেট পাওয়ার সুবিধার জন্য এই পেজটি ফলো করে যুক্ত থাকুন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here