ধূসর_রঙের_জলছবি #অস্মিতা_রায় (সাত)

0
192

#ধারাবাহিক
#ধূসর_রঙের_জলছবি
#অস্মিতা_রায়
(সাত)
ডক্টর মুখার্জির মেয়ের জন্মদিনে যে বাড়তি টাকাটা পেয়েছিল তা দিয়ে নিজের একটা হারমোনিয়াম কিনেই নিল অবশেষে মালবিকা। গানের স্কুলটায় সপ্তাহে দুদিন সন্ধ্যাবেলা গিয়ে রবীন্দ্রসংগীত শেখায় ও। নিজেরও চৰ্চা প্রয়োজন। গানের স্কুলটা বেশ বড়ো। একই ছাদের তলায় ক্লাসিকাল, আধুনিক আর রবীন্দ্রসংগীত শেখানো হয় সপ্তাহে দুদিন করে। একেকজন টিচার একেকটা শেখান। গানের স্কুলটা বাড়ির মালিক নিখিলবাবুর। একসময় উনি গান শেখাতেন প্রচুর ছাত্রছাত্রীদের। ওনার বয়স হয়ে যাওয়াতে আর নিজে সেভাবে শেখাতে পারেন না। তবে গানের স্কুলের ধারাটা অব্যাহত রেখেছেন। তিনমাস পরে সেই স্কুলের অ্যানুয়াল ফাংশান। তার রিহার্সাল হচ্ছে জোর কদমে। দুইবাড়ি রান্না করে, গানের স্কুল করে, নিজে গান প্রাকটিস করে মালবিকার আজকাল পড়াশোনার সময়টা অনেক কমে গেছে। সেদিন একটু বইখাতা নিয়ে বসেছিল। এমন সময়ে কৌস্তভ এলো। কৌস্তভের ছুটির দিনগুলোয় ওরা একটু এদিক ওদিক ঘুরে আসে, রেস্টুরেন্টে খেয়ে আসে।
কৌস্তভ এসে বলল,”আগামী সপ্তাহে আমার পরপর তিনদিন ছুটি পড়ছে। কোথাও বেড়াতে যাবি?” মালবিকা বলল, “কোথায়?”
-“ভাবছি দীঘা। তোর তো সমুদ্র খুব পছন্দের। বেশ কেমন সমুদ্রের ধারে বসে আমরা চাঁদ দেখবো। তুই গান গাইবি, আমি শুনবো। তুই আমার কাঁধে মাথা রাখবি, আমি তোর কাঁধ ধরে তোকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরবো… হাউ রোমান্টিক!”
-“ওয়েট ওয়েট! সিনেমার দৃশ্যটা কল্পনা করে বেশ ভালোই লাগছে, তবে নায়িকার জায়গায় আমি নই, অন্য কাউকে বসিয়ে নে।”
-“মানে?”
-“মানে এটাই যে তুই এবার একটা প্রেম কর। সেই প্রেমিকাকে নিয়ে যেখানে খুশি ঘোর, যা খুশি কর।”
-“মানেটা কী? তুই থাকতে আবার অন্য প্রেমিকা কেন? তুইই তো আমার প্রেমিকা!”
-“কবে হলাম? আমি একজনের বিবাহিত স্ত্রী।”
-“সো হোয়াট! তুই চাইলেই ডিভোর্স দিয়ে মুক্ত হয়ে যেতে পারিস। পুলিশে গিয়ে কমপ্লেন কর যে তোর গায়ে হাত তুলতো তোর বর , তুই ডিভোর্স চাস, তোকে ডিভোর্স দিতে বাধ্য শুভেন্দু দাশগুপ্ত।“
-“ডিভোর্স দিয়ে কী হবে?”
-‘তুই আবার নতুন জীবন শুরু করতে পারবি।”
-“কার সাথে?”
-“কেন আমার সাথে?আমরা বিয়ে করে সংসার করবো। আমাদের সম্পর্কটায় অফিসিয়াল শিলমোহর পড়বে।”
-“প্রথম কথা, আমি আর কারোর সাথেই বিয়ে সংসারের ফাঁদে পড়তে চাই না। আর তোর সঙ্গে আমার সম্পর্কটাকে আমি এখনও শুধুমাত্র বন্ধুত্ব বলেই দেখি।“
-“ধুত্তেরী! খালি এক কথা! বন্ধুত্ব বন্ধুত্ব! বেশ, না হয় মানলাম। তা তোর জীবনসঙ্গীকে তো সবার আগে তোর ভালো বন্ধুই হতে হবে! শুভেন্দুর মধ্যে কি পেয়েছিলি সেই বন্ধুকে!”
-“সংসারের চাল ডাল তেল নুনের হিসেবে আর বন্ধুত্ব কিভাবে গড়ে উঠতে পারে!”
-“ইকুয়েশনটা সবার সাথে একরকম নাও হতে পারে।“
-“তা হয় তো ঠিক। তবে তোর সঙ্গে প্রেম, বিয়ে এসবের ইকুয়েশন আমি ভাবতে পারি না।“
-“কেন? এখনও কী আমার ফ্যামিলি, তোর ফ্যামিলি এসব নিয়ে প্রবলেম! ধন্যি জেদ বটে তোর! সব খুইয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছিস, এখনও এসব চিন্তা!আমি ছাড়া তোর আছে কে রে!”
-“আমাকে ব্যঙ্গ করছিস তুই! রাস্তায় দাঁড়ানোর খোঁটা দিচ্ছিস! ফ্যামিলি ট্যামিলি নিয়ে ভাবি না। তবে তোকে আমি বন্ধু ছাড়া আর কিছু ভাবি না।হ্যাঁ,তুই আমার অনেক উপকার করেছিস, আমি চাই তোর জীবন সুখের হোক একটা ভালো মেয়েকে বিয়ে করে।“
-“ মালবিকা, তোর বর আর বাবা আমাদের ওভাবে দেখে যাওয়ার পর আমার বাবা মা আমাকে অনেক প্রশ্ন করেছে। মালদা শহর, আমাদের বন্ধুবান্ধব সবাই জানে তুই আর আমি প্রেম করে পালিয়ে এসেছি। গত কয়েকমাস আমি বাড়ি যাই নি এগুলোর জন্য। বদনাম শুধু মেয়েদের নয়, ছেলেদেরও হয়। এখন তুই বলছিস আমাকে অন্য মেয়েকে বিয়ে করতে! এরকম স্ক্যান্ডাল শুনে কোন মেয়ে আমাকে বিয়ে করবে!”
-“টেক ইওর টাইম। ফেস দ্যা ট্রুথ। সবাইকে বোঝানোর দায় তোর নেই। তবে তোর বাবা মা আর যে মেয়ে তোর জীবনসঙ্গী হবে তাদেরকে সত্যিটা তোকে বুঝিয়ে বলতে হবে। আমিও বলবো। আমাদের মধ্যে কোনো প্রেমের সম্পর্ক ছিল না। তুই শুধুমাত্র আমার বিপদে একজন সত্যিকারের বন্ধুর মতো হেল্প করেছিস। আর বাকিরা সময়ের সাথে সাথে বুঝে যাবে।”
-“তুই তাহলে দীঘা যাবি না?”
-“বিয়ে করে বৌ আন।সেই মেয়ের সাথেও আমার বন্ধুত্ব হোক।তারপর কোনো ট্যুর নাহয় একসাথে করা যাবে।”
আচমকা মালবিকার কোমর ধরে নিজের কাছে টেনে নিল কৌস্তভ। বলল, “কেন বুঝিস না তুই, তোকে ছাড়া আমি আর কাউকে ভালোবাসতে পারবো না! একবার তোকে চোখের সামনে দিয়ে আমি অন্যের হয়ে যেতে দেখেছি।জানিস, নিজেকে কতটা অসহায় লাগছিল সেই সময় আমার! দিনের পর দিন বাড়িতে অভাব, অনিশ্চয়তা, বেকারত্ব এসবের মধ্যে তুইই ছিলি আমার শক্তি । পুরো পৃথিবী আমার উপর ভরসা না করলেও তুই আমাকে ভরসা দিতি কত! ভেবেছিলাম তোকে নিয়েই সংসার গড়ব আমি। সেটা তখন হল না। দাঁতে দাঁত চেপে মাটি কামড়ে একলা লড়ে গেছি।অবশেষে চাকরিও পেলাম।তোর সাথে যোগাযোগ ছিল না মাঝে। হঠাৎ একদিন তুই ফোন করে বললি,তুই সংসার ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাস। আমি তোকে সাহায্য করার জন্য ছুটে গেলাম। এই ক’মাস তোকে এত কাছ থেকে আমি যেভাবে পেয়েছি, এর আগে কখনও পাই নি। আমি তোকে পুরোটা পেতে চাই রে! তোর মন,তোর শরীর সব। আমার খুব ইচ্ছে করে তোর সঙ্গে লেপ্টে থাকি।প্লিজ আমাকে আর ফিরিয়ে দিস না!” নিজের মুখটা মালবিকার ঠোঁটের কাছে নামিয়ে এনেছে কৌস্তভ, নিশ্বাস প্রশ্বাস দ্রুত হচ্ছে ওর।
কৌস্তভকে ধাক্কা মেরে জোর করে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল মালবিকা।জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল, “এ হয় না।” ফুঁসে উঠল কৌস্তভ, “কী চাস কী তুই? যা খুশি তাই ভাবে এলোমেলো জীবন কাটাবি? তোর কী কারোর জন্য কোনো ফিলিংস নেই! নিজের স্বার্থ ছাড়া আর কিছু ভাবিস তুই!” মালবিকা কোনো জবাব না দিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো।
********************************
থার্মোডিনামিকসের উপর নিউনেরিকালসগুলো চেক করছিল অরণ্য। দিয়া বাথরুমে যাচ্ছে বলে খাতাটা দিয়ে চলে গেল। পনেরোটা অঙ্ক দেখা শেষ হওয়ার পর,লাস্ট পাতায় এসে যা দেখলো অরণ্য সেটা ঠিক আশা করে নি ও। খাতার পাতায় দিয়ার গোটা গোটা হাতের লেখায় লেখা রয়েছে, “অরণ্যদা,তোমাকে ছাড়া জাস্ট কিছু ভাবতে পারি না!” লেখাটা দেখে হাসবে নাকি কাঁদবে ভেবে পেলো না অরণ্য।
চোখ না তুলেও অরণ্য বুঝলো, দিয়া ফিরে এসেছে। নিশ্বাস প্রশ্বাস খুব দ্রুত হচ্ছে দিয়ার। সোজাসুজি তাকালো দিয়ার দিকে অরণ্য। মুখ লাল হয়ে গেছে দিয়ার। চোখ নিচের দিকে। অরণ্য বলল, “বস।” দিয়া পুতুলের মতো চেয়ার টেনে বসে পড়লো। যেন কিছুই হয় নি এমন ভাব করে অরণ্য দিয়াকে পড়াতে লাগল। দিয়ার হাঁটু ঠকঠক করে কাঁপছে। বুকের মধ্যে যেন লক্ষ হাতুড়ির ঘা। অরণ্য বুঝতে পারছিল দিয়ার অস্থিরতা। ওর কি কিছু বলা উচিত? দিয়ার ওর প্রতি দুর্বলতা আছে বুঝলেও সে যে ওকে সরাসরি কখনও এমন কিছু লিখবে এটা আশা করে নি অরণ্য। পরে অরণ্য নিজেই না ফেঁসে যায়। নাহ, ব্যাপারটা কোনোভাবেই প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। দিয়াকে বলল অরণ্য, “আজ তোর মন নেই পড়াশুনায়। আজ বরং থাক। আমি আজ গেলাম।” বোবা হয়ে বসে রইলো দিয়া। অরণ্য বেরিয়ে গেল।
রাস্তায় বেরিয়ে এলোমেলোভাবে হাঁটছিল অরণ্য। প্রেম, সম্পর্ক এসবে ভয় পায় ও।ওর জীবনে এসবের অভিজ্ঞতা ভালো নয়।এমন সময় ওর ফোনটা বেজে উঠল। দিয়া ফোন করছে। ফোন কানে চাপলো অরণ্য, “হ্যালো।”
-“রাগ করলে?” দিয়ার গলার স্বর ভেজা ভেজা। অরণ্য বলল, “নাহ।”কিছুক্ষন চুপ থেকে দিয়া বলল, “আমাকে পড়ানো বন্ধ করে দেবে না তো!” অরণ্য একটু হেসে ব্যাপারটা লঘু করে দিতে চাইল,বলল, “না না।”

(ক্রমশ)

© Asmita Roy

————————————————–

পরবর্তী পর্বের আপডেট পাওয়ার সুবিধার জন্য এই পেজটি ফলো করে রাখুন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here